PravatiPatrika

Sunday, July 19, 2020

রবিবারের স্পেশাল সংখ্যা




           যে ছড়া খুঁজছি আমি
             উৎপলকুমার ধারা

ছড়াটি কোথায় গেল,  ও-ছড়া খুঁজছি তোকে
ঘুম চোখে হাতড়ে বেড়াই তোকে আজ স্বপ্নলোকে
খুঁজছি আকাশ-পাতাল ধরতে পারছিটা কই
খুঁজে ঠিক আনবো তোকে ঘাঁটছি অজস্র বই !

খুঁজছি সেই ছড়া যে সকালের স্বপ্ন এঁকে
আতরের গন্ধ ছোটায় না-ফোটা কুঁড়ির থেকে
সুর তাল ছন্দ বুনে শিশুদের মাতন আনে
হাটখুলে পাখনা ম‍্যালে ছোটদের ছড়ার গানে !

যে ছড়া পাখির ঠোঁটে সুরেলা ছন্দ ফোটায়
রাতে বাঁশগাছের মাথায় জ‍্যোৎস্নার চাঁদকে ওঠায়
শিশু ও কিশোর মনে বাঁধভাঙা তুফান তোলে
যার সুরে ঘুমিয়ে পড়ে দুষ্টুরা মায়ের কোলে !

আমি সেই ছড়ার পাগল জেনে গেছে আজ অনেকেই
ছড়াতে ছন্দ পেলেই নাচি আমি ধেই ধেই ধেই
যে ছড়া খুঁজছি আমি পেলে তাকে সন্নিকটে
রাখবো যত্ন করে আমারই মনের পটে !!




           আলো ও ছায়ার সমীকরণ
              বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়


 নিস্তব্ধ মাঝরাতে আমি একদিন হঠাৎ কান্নার শব্দ শুনতে পেলাম। কেউ কাঁদছে।কোথায় কতদূরে তাও জানি না। শুধু শব্দ শুনতে পাচ্ছি। অনেকদিন আগেও আমার একবার এরকম হয়েছিল। ফলে ভয় না পেয়ে আমি জানলা দিয়ে তাকালাম। যতদূর চোখ যায় দেখতে লাগলাম। খুঁজতে লাগলাম শব্দের উৎসমুখ। শুনশান হয়ে গেছে চারদিক।জোনাকিরাও তাদের বাতি নিভিয়ে ঘরে ফিরে গেছে । স্তব্ধ জানালায় চোখ রেখে আমি তন্ন তন্ন করে দেখতে লাগলাম অন্ধকার। অন্ধকারের ভেতর লুকিয়ে থাকা কান্না ।কম্পিউটারে অসমাপ্ত গল্পের অক্ষরগুলো ঘুমিয়ে পড়লে এমনিতেই  নিজেকে একা লাগছিল । মনে হয়েছিল  সমগ্র পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এক নির্জন দ্বীপে নির্বাসিত আমি । তারপর এরকম এক রাত। যখন সমস্ত নিস্তব্ধতাকে চিরে কেউ কাঁদছিল ।প্রথমে আমি বুঝতে পারছিলাম না  এতই মৃদু ছি ল তার উচ্চারণ।তারপর আওয়াজটা ধীরে ধীরে বাড়তে লাগল। কেউ জেগে ছিল না সেদিন  সারা বাড়িতে। মা, বাবা, ছেলে মেয়ে ।শুভমিতা এক একদিন আমার সাথে পাল্লা দিয়ে অনেক রাত অবধি জেগে থাকে।সেও তখন স্বপ্নের দেশে।নানা রঙে ও মুদ্রায় অলীক এক পৃথিবী গড়ে তুলছিল সে।স্থির ও নীরব  তার ভাষা।গভীর জিজ্ঞাসায় তার স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছিলাম  আমি- মিতা তুমি কোন কান্না শুনতে পাচ্ছো?
তছনছ হয়ে যাওয়া ঘুম থেকে নিদ্রালু চোখ কচলাতে কচলাতে শুভমিতা বলেছিল -  না তো। কই কিছুই তো শুনতে পাচ্ছি না আমি।
অথচ কান্নার সেই ঢেউ আমাকে ভিজিয়ে দিচ্ছিল  তখনও। জানলা পেরিয়ে দূরে ধানখেতের পাশ দিয়ে একটা তরঙ্গ হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে এসে লাগছিল আমার কানে।
তুমি পাচ্ছো না? সত্যিই পাচ্ছো না? এক অবিশ্বাস থেকে গলার স্বর যেন তীব্র হয়ে উঠছিল।
শুভমিতা কান পেতেছিল  মৃদু ও মর্মভেদী কান্নার শব্দ শুনবে বলে। কিন্তু সে পায় নি । এক মোচড় দেওয়া কষ্ট নিয়ে বিলাপের ধ্বনি ভেসে আসছিল  অথচ কেউ শুনতে পাচ্ছিল  না শুধু আমি ছাড়া । এরকম হওয়ার কথা নয়  অথচ এরকমই হয়েছিল সেদিন । চুপচাপ জানলা বন্ধ করে আমি শুয়ে পড়েছিলাম ।এতেও শব্দ প্রতিহত হয়নি  বরং তা আরও গুমরে উঠেছিল।
অবিন্যস্ত চিন্তার ভেতর ধাক্কা মারছিল  হাহাকার। কেউ যেন আমার নাম ধরে ডাকছিল – মাধুর্য,মাধুর্য। তারপর এক আর্ত চীৎকার যে চিৎকৃত  শব্দের ভেতর কোন নির্দিষ্ট উচ্চারণ ছিল না ।পরিষ্কার কোন কথা ছিল না। শুধু কেউ  যেন নিজের সমস্ত হাহাকার নিংড়ে বাতাসে ঢেলে দিচ্ছিল  ক্রমাগত।তীব্র আকাশ ফাটানো সেই চীৎকার অন্যেরা শুনতে পাচ্ছিল না। তাহলে সবাই কি বধির হয়ে গেছে? আমি ভাবছিলাম।এত প্রাণপণ গোঙানি যে দরজা জানালা তছনছ হয়ে যাচ্ছিল। মনে হয়েছিল শুভমিতাকে বলি তোমার কানগুলো বোধহয় আর খুব বেশি  সক্রিয় নেই। বলা হয়নি সেকথা।  এসব ভাবতে ভাবতে কখন ঘুম এসেছিল আমি নিজেই জানি না। সূর্যের আলো  সকালবেলাকে আগের মতোই রাঙিয়ে দিয়েছিল আবার। শুভমিতা বলেছিল- তোমার পাগলামি দিন দিন বাড়ছে,আজ থেকে আর রাত জেগো না।পারলে একবার ডাক্তার দেখিয়ে নিও।শরীর দুর্বল থাকলে এরকম হয়।
পাগল! একই সত্যিই পাগলামি।  নিজের খুবই খারাপ লাগছিল। সবাই বিভ্রম মনে করলেও আমি তো স্পষ্ট শুনেছি সেই ডাক, সেই কাতরানি । যাইহোক সেসব যত তাড়াতাড়ি মন থেকে মুছে ফেলা যায় ততই মঙ্গল। ভুলেই গিয়েছিলাম।নিজের কাজের ভেতর মন জড়িয়ে পড়েছিল আনন্দে।এরকম ঘটনা তো রোজ রোজ ঘটার নয়। তাই কখন স্মৃতি থেকে মুছে গিয়েছিল  টেরই পাইনি।

হঠাৎ সেদিন সৌমিত ফোন করে বলল-  মাধুর্য,তুই খবরটা শুনেছিস?

কোন খবর? জিজ্ঞাসায় তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছিল  আমার স্নায়ু।

শুনিস নি?অর্পণ আর আমাদের মধ্যে নেই।

অর্পণ নেই। শব্দদুটো শোনার সাথে সাথে  মনটা কেমন হু হু করে উঠল। বুকের ভেতরটা শূন্য মনে হল এ হতেই পারে না। আমাদের স্কুল কলেজের সবচেয়ে উজ্জ্বল প্রাণবন্ত ছেলে ছিল সে।সজীব ও চঞ্চল। সবসময় কিছু না কিছু কাজ করার উন্মাদনা তাকে তাড়া করত। অত্যন্ত মেধাবী। যেকোন বিষয় নিয়ে অসীম তার পড়াশোনা।অথচ কী আশ্চর্য সে কোন চাকরি করল না।কোন চাকরির পরীক্ষায় বসল না অবধি।

আমি প্রশ্ন করেছিলাম – কী পাগলামি করছিস? জীবন কি এভাবেই চলবে?

হেসেছিল অর্পণ – আমার পিপাসা যে অনেক।

তাহলে বড় বড়  চাকরির পরীক্ষায় বোস।

এবার আরও এক উন্মাদ হাসিতে আমাকে তছনছ করে দিয়েছিল অর্পণ- মাধুর্য, আমার তৃষ্ণা এক জীবনে মিটবার নয়।যদি কোটি কোটি টাকা সঞ্চয় আমার স্বপ্ন হত। তাহলে হয়তো পূরণ করতে পারতাম চেষ্টা করলেই। কিন্তু সারা পৃথিবীতে যত মূল্যবান বই আছে সব পড়বার পিপাসা কি এক জীবনে শেষ হবে? জানি শেষ হবে না। তবু এই স্বপ্নটাই আমি দেখি।অসফল হবে জেনেও একটা বড় স্বপ্ন দেখতেই আমার ভালো লাগে।

সৌমিত চুপ করে ছিল মোবাইলের অন্যপ্রান্তে। আমার মনে পড়ে যাচ্ছিল  অনেক কথা। স্মৃতির ভেতর দিয়ে যেতে যেতেই সৌমিতকে প্রশ্ন করলাম- কী হয়েছিল? এত তাড়াতাড়ি তো ওর চলে যাওয়ার কথা নয়।

-      ক্যানসার। রক্তের ভেতর বাসা বেঁধেছিল মারণ রোগ। কাউকে বলেনি। আমি যখন জেনেছিলাম তখন প্রায় শেষ অবস্থা।

সময় কত নিষ্ঠুর । এভাবে বললে সময়ের উপর সব ভার চাপিয়ে নিজেকে মুক্ত করা যায়।কিন্তু আসলে আমরা প্রত্যেকেই উদাসীন।এত কাছের বন্ধু। হরিহর আত্মা বলতে যা বোঝায় তাই। অথচ পরবর্তীক্ষেত্রে তার ন্যুনতম খবরটুকু রাখার দরকারও আমি মনে করিনি।আমি বা আমার মতো অনেকেই।

সৌমিতের গলার স্বরে বেদনা  - ওর কষ্ট সহ্য করা যাচ্ছিল না। শেষবার যখন  ওকে দেখতে যাই তখন শরীরটা মিশে গিয়েছিল বিছানায়।মর্মভেদী চীৎকার ছাড়া আর কিছুই ছিল না। আকাশ কাঁপানো শব্দে কান্নার ধ্বনি মিশে এক হাহাকারের রূপ নিচ্ছিল।সে যে কী ভয়ানক তোকে বোঝাতে পারব না মাধুর্য।কান্নার ভেতর বারবার করে বলছিল  তোর কথা।তোকে দেখতে চেয়েছিল অন্তত একবার।

নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছিল আমার।এক ভয়ংকর অপরাধী।এর যেন কোন ক্ষমা নেই।  সৌমিত ফোন ছেড়ে দেওয়ার আমার কেবলই মনে হচ্ছিল এই কান্নার ধ্বনিই তো আমি শুনতে পাচ্ছিলাম সেদিন রাতে।কতদূর থেকে অর্পণ আমাকে ডাকছিল।হাজার কিলোমিটার দূর থেকে।একসময় যার সাথে সব যন্ত্রণা ভাগ করে নিতাম। জীবনের আলো অন্ধকার, প্রতিটি মনখারাপ।সেই অর্পণ তার জীবনের চুড়ান্ত বেদনা কি আমার।





                পাখির ডানার উড়ান
                   প্রশান্ত ভৌমিক 

                            ছয়

আজকে ধর্ম পরীক্ষা বিকেলবেলা। সকাল থেকে খুব টেনশন হচ্ছে। গতকালের ইংরেজি পরীক্ষা খুব ভাল হয়েছে। কিন্তু অন্য বিষয়ের চাপে সারা বছর ধর্ম খুব ভাল করে পড়া হয়নি। অথচ অন্য ছাত্ররা কেউ ধর্ম নিয়ে টেনশন করছে না। আমি গত ১৫ দিন ধরে শুধু পড়া নিয়েই ছিলাম। খুব মন দিয়ে পড়েছিলাম। তাও মদন স্যারের ক্রোধ থেকে বাঁচতে পারিনি। নানা রকম পদ্ধতি আবিষ্কার করে তিনি আমায় শাস্তি দিয়েছেন, অপমান করেছেন। আমি গায়ে মাখিনি। ওনার মত উনি চলেছেন, আর আমার মত আমি চলেছি।
তবে আমার সত্যিই খারাপ লেগেছিল যেদিন তিনি প্রথম আমায় কান ধরে উঠতে বসতে বলেন। আমি এর আগে কল্পনাও করতে পারিনি ২০০২ সালে এসেও এরকম ধরনের কোন শাস্তির মুখোমুখি হতে পারি। আচ্ছা, ব্যাপারটা খুলেই বলি। একদিন মদন স্যার একটি অংক করতে দিয়েছিলেন। আমি করতে পারিনি। পারার কথাও নয়। কারণ, লগারিদমের এই অংকগুলো স্যার আগে আমাকে করান নি। কিন্তু না পারার শাস্তি স্বরূপ স্যার আমাকে বললেন ২৫ বার কান ধরে উঠবস করতে। আমি ভেবেছিলাম স্যার বোধহয় আমার সাথে দুষ্টামি করছেন। তাই আমি গুরুত্ব দেইনি কথাটাকে। আমি কান ধরছি না দেখে স্যার শুধু জিজ্ঞেস করলেন- তুই কান ধরবি কি ধরবি না?
আমি না বলাতে স্যার আর কিছু বললেন না। স্বাভাবিকভাবে পড়ালেন। পড়ানো শেষ করে চলেও গেলেন। কিন্তু এরপর আর অনেক দিন পড়াতে এলেন না। এক সপ্তাহ, দুই সপ্তাহ করে এক মাস পার হয়ে গেল, কিন্তু স্যার আর আসেন না। বাবা আমাকে একদিন জিজ্ঞেস করলেন স্যার আসছেনা কেন?
আমি বললাম- জানি না।
বাবা জানালেন অর্ণবকে তো নিয়মিতই পড়াতে যাচ্ছেন। স্যার আমাকে সপ্তাহে দুই দিন অংক করালেও অর্ণবকে ছয় দিন পড়াতে আসতেন। ওকে ইংরেজি ছাড়া বাকি বিষয়গুলো তিনিই পড়াতেন। আর ইংরেজি পড়ানোর জন্য মদন স্যারের বন্ধু নেপাল স্যারকে রাখা হয়েছিল।
বাবা আর কিছু বললেন না। পরের দিন বাবা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন মদন স্যারের কোন কথা আমি শুনিনি?
আমি হঠাৎ করে ভেবে পেলাম না বাবা এমন কথা বলছেন কেন? বাবাই খুলে বললেন ঘটনাটি। মদন স্যারকে আজ বাবা জিজ্ঞেস করেছিলেন না আসার কারণ। স্যার বলেছেন, আমি স্যারের কোন কথা মেনে চলি না, তাই তিনি আমাকে পড়াবেন না।
আমি একটু ভাবতেই মনে পড়ল স্যার আমাকে কান ধরে উঠ-বস করতে বলেছেন, আমি করি নি। তখন বাবাকে পুরো ঘটনা খুলে বললাম। সাথে আগের সব কথা। মানে মদন স্যারের করা অপমানের কথা, অন্যায় অত্যাচারের কথা। বাবা চুপচাপ সব শুনলেন। কিন্তু গুরুত্ব দিলেন বলে মনে হল না। শুধু বললেন- আমি কথা বলব।
পরদিন বাবা কথা বললেন। রাতে এসে আমাকে জানালেন স্যারের সঙ্গে কথা বলেছেন। সাথে বললেন, এখন থেকে যেন স্যারের সব কথা মেনে চলি। পাশাপাশি যেন মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করি।
আমি দিশেহারা বোধ করলাম। এতদিন ভরসা ছিল মদন স্যারের অত্যাচারের হাত থেকে নিশ্চয়ই বাবা আমাকে মুক্ত করবেন। কিন্তু সে আর হল কই? এখন দেখছি সে গুড়ে বালি। আমি বাবাকে আবারো সব কথা বোঝাবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু বাবা আমাকে থামিয়ে দিলেন। বললেন, স্যার নাকি অর্ণবদের বাসায় সবার সামনেই বলেছেন আমি কোন পড়াশুনোই করি না। আর যাই হোক, আমাকে দিয়ে কোন ফলাফল আশা করা যায় না। তাই বাবাকে বুদ্ধি দিয়েছেন যত দ্রুত সম্ভব আমাকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে কোন দোকানের কাজে কিংবা রিক্সা চালানোতে লাগিয়ে দিতে। শুনে বাবা খুব দুঃখ পেয়েছেন। তাই তিনি চান, আমি যেন ভাল ফল করি পরীক্ষায়। কারণ, যখন মদন স্যার অর্ণবদের বাসায় বসে এসব কথা বলছিলেন তখন অর্ণবের মা-ও ভেতর থেকে হাসাহাসি করছিলেন। বাবা খুব অপমান বোধ করেছেন। তাই স্যারকে বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজি করিয়েছেন আবার পড়াতে আসার জন্য। সাথে কথা দিয়ে এসেছেন, আমি এরপর থেকে সব কথা মেনে চলব।
বাবা কথা দিয়ে এসেছেন। আমিও মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম, বাবার দেয়া কথা রাখব। দু’দিন পরে মদন স্যার পড়াতেও এলেন। বাকিটা ইতিহাস!
নবপর্যায়ে প্রথম দিন এসেই স্যার স্বমূর্তি ধারণ করলেন। ঘরে ঢুকে প্রথম ডায়লগই হল- সেদিন ২৫ বার কান ধরতে বলেছিলাম। যেহেতু সেদিন ধরিসনি, তাই আজ সেটা ২৫০ বার করতে হবে। আমি বিনা বাক্য ব্যয়ে শুরু করলাম। জেদের বসে ২৫০ বার কান ধরে উঠ-বস করতে শুরু করা আর ২৫০ বার কান ধরে উঠ-বস করা- সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার। ৬০-৭০ বারের পর থেকে আমার খুব কষ্ট হতে লাগল। কিন্তু আমি দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে চালিয়ে যেতে লাগলাম। ১৫০ বারের পর আর কোনমতেই করতে পারছিলাম না বলে স্যারকে বললাম, বাকি ১০০ বার একটু পরে করব। স্যার বিদ্রুপ মেশানো হাসি দিয়ে বললেন- তাহলে আমি চলে যাচ্ছি। বাকি কথা তোর বাবার সঙ্গে বলে নেব।
আমি স্যারকে আর কিছু না বলে আবার উঠ-বস করতে শুরু করলাম। যখন ২৫০ বার শেষ হল, লক্ষ্য করলাম ততক্ষণে পার হয়ে গেছে ৩৫ মিনিট সময়। তার মানে স্যার আর ২৫ মিনিট পড়াবেন। আমি মোড়ায় বসার চেষ্টা করতে গিয়ে দেখলাম আমি সোজা হয়ে দাঁড়াতেই পারছি না।
ফ্লোরে বসে বসেই পড়তে লাগলাম। পা দু’টো যেন আমার নয়। নাড়াতেই পারছিলাম না। স্যারের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হল, খুব খুশি হয়েছেন আমার দুর্দশা দেখে। মুচকি মুচকি হাসছেন। আমি অপেক্ষা করছি ১ ঘণ্টা পার হয়ে যাওয়ার। কিন্তু আমার ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে স্যার সেদিন ২ ঘণ্টারও অধিক সময় পড়ালেন।
স্যার চলে যাওয়ার পর আমি মেঝেতেই শুয়ে পড়লাম এবং শুয়ে রইলাম বেশ কিছুক্ষণ। এরপর কোনমতে উঠে দেয়াল ধরে ধরে বাথরুমে গেলাম। বাথরুম থেকে বেরিয়ে শুয়ে পড়লাম বিছানায়। রাতে যে উঠে ভাত খাব, সেই শক্তিটুকুও অবশিষ্ট নেই। মা ভেবেছিলেন আমার বোধহয় জ্বর কিংবা পেটের গোলমাল। তাই ঠিকঠাক না চলার জন্য কিছুক্ষণ বকাবকি করলেন। তারপর ভাত খাইয়ে দিলেন। আমি চেতন-অচেতনের মাঝামাঝি থেকে ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরদিন ভোরবেলা উঠে দেখি, আমি আর কোন পা নাড়াতে পারি না। মা প্রথমে ভাবলেন আমি খেলতে গিয়ে পায়ের এই অবস্থা করেছি। পরে মনে করে দেখলেন, আমি গত দুই মাসেও কোথাও খেলতে যাই নি। জানতে চাইলেন, ব্যাপার কী? আমি সব খুলে বললাম। মা সব কথা বাবাকে জানালেন। কিন্তু কোন ভাবান্তর নেই কারোরই। তিন-চারদিন ভুগে স্বাভাবিক হলাম। আমার জীবনযাত্রাও স্বাভাবিক হয়ে পড়ল। অস্বাভাবিকতার মধ্যে শুধু কানে ধরে উঠ-বস করাটা আমার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে পড়ল।
আজ এতদিন পরে কথাগুলো মনে পড়তে প্রথমে শিউরে উঠলাম। পরে আর তেমন কোন অনুভূতি হল না। আমি এসব শাস্তি পেতে পেতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। একদিনে সর্বোচ্চ ২৯০০ বার কান ধরেও স্বাভাবিকই ছিলাম।
ধর্ম পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে নিতে বিভিন্ন কাহিনি পড়ে অবাক হলাম। সত্যিই কি এমন হয়? দেবতাদের সত্যিই এত ক্ষমতা? তাহলে তাঁরা কেন আমাকে এই অত্যাচারী শিক্ষকের হাত থেকে বাঁচাবেন না? নাকি শিক্ষকই ঠিক? আমি ভুল করছি বারবার।
সিদ্ধান্ত নিলাম, পরীক্ষাটা শেষ হয়ে যাক, এখন থেকে পুজো-আর্চায় মন দেব পুরোপুরি। তাহলে যদি কপাল ভাল হয়! দ্বিগুণ মনোযোগে পড়া শুরু করলাম। গীতার শ্লোকটি প্রায় শেখা হয়ে এসেছে। আবার পড়া শুরু করলাম-
অনেক বাহুদরবক্রনেত্রং...



এসো, তুমি এসো
                            অমিত দত্ত

আজ যে স্থান শূন্য
কাল হবে পরিপূর্ণ

আজ যে রিক্ত
আগামীতে সে সিক্ত

আজ তুমি পিপাসার্ত
কাল পূর্ণ হবে তব পাত্র

আজ ধূসর চোখে রুক্ষ্মতা খেলা করে
আগামী বর্ষায় সজল আহবাণ সবারে

আজ সাদা কালো ভেদাভেদ প্রতি কোণে
প্রেমবারি আগামীতে থাকবে প্রতি মনে

মেঘমল্লার রাগে নীর তুমি নামো ঝরোঝরো
রক্তসিক্ত ভূমি তুমি পূণ্যতীর্থ করো

আজ কঠোর কঠিন মন কোমল পরশ চায়
উঁচিয়ে থাকা ব্যারেলও তোমাতে মাতৃগন্ধ পায়

বরষা তুমি নেমে এস শুধু নামার কারণে নয়
তুমি এলে পরে আজও ক্যাকটাসে ফুল হয়




            স্বত্তা
    বিশ্বজিত মুখার্জ্জী

জীবনবোধে জেগে কালো স্বার্থের পুঁজি,
অসাড় অস্তিত্বে বাঁচার মানে খুঁজি।
হাত আছে তাই হাতাহাতিতেই ব্যস্ত,
ঘুমন্ত হৃদয় হৃদয়হীন হতে অভ্যস্ত।
জীবন রঙ্গিন পাপড়িগুলোকে করতে উন্মুক্ত,
অসহায় মানুষগুলোকে জড়িয়ে ধরতে বিরক্ত।
অস্তিত্ব প্রমাণে স্থবির থেকে অনড়,
মানব খুঁজে ফেরে চারিত্রিক বিবর।
পোড়া আগুন স্পর্শে মন বিদ্রোহী,
জীবন অস্তিত্বের আড়ালে লড়াইয়ে আগ্রহী।
সমাজের জানালায় ডুকছে তাজা বাতাস,
অসাড় আমিত্বে ঘুমিয়ে মনের ক্যানভাস।






                      বৃষ্টি ভেজা রাত
                         সুতপা মন্ডল

টুপ টাপ বৃষ্টি পরেই যাচ্ছে ঘরের ভিতর। বালতি, বাটি, গামলা, গ্লাস রেখে জল থেকে বাঁচার চেষ্টা।
  টানাটানির সংসারে, ছাদ সারানোর অতিরিক্ত খরচা কিছুতেই জোগাড় করতে পারছে না জয়ন্ত। ভেবেছিল, এপ্রিলের প্রথমে ইনক্রিমেন্টের টাকাটা পেলে ছাদটা সারিয়ে নেবে।তার আগেই বসন্তে অকাল বর্ষণ রাতের ঘুম কেড়েছে।
বৃষ্টি কমলো কিনা দেখতে, জানালা খুলতেই ফুটপাতের ছোটো ছেলেটাকে দেখতে পায় সে,  ভিজে ঠান্ডায় কাঁপছে। না, আর কপালের দোষ দেবে না, মাথার ওপর কমপক্ষে ছাদটা  আছে। দরজার বাইরে পা বাড়ায়........





       পর্যটন এবং....
     শর্মিষ্ঠা সাহা

ঝমঝম করে বৃষ্টির জল
পাহাড়ী ঢাল বেয়ে নেমে আসছিল
রৈখিক মননে,
তারপর উঁচু নীচু সিঁড়ি বেয়ে
মিলিয়ে গেল নীচে কোথাও
সমচ্চোশীল ধর্মে ।
আমি ঐ সিঁড়ি ধরে নামতে নামতে
দেখলাম, প্রত্যেক সিঁড়ির গায়ে
কাহিনী খলনায়কের,
আর নীচে জলে ভেসে যাচ্ছে
লোমহীন, চামড়াহীন দেহ,
সবই জাতক ।
দেখতে দেখতে ভ্রান্ত হলো আমার গন্তব্য
উৎস আর মোহানার গতিমুখ ,
আমি নারী পর্যটক ।।






                 শূন্য মিনা
         হীরক বন্দ্যোপাধ্যায়

শূন্য মিনারের পাশে শতছিন্ন দেহ বাতাসে উড়ছে
পৃথিবী যে বানিয়েছিল বাতাস কিংবা নদী
পাহাড় কিংবা ঝর্ণা গ্রীষ্মের হাতপাখা
চাষ করে এনেছিল যারা শস্যধারা,কারখানা থেকে লৌহ ইস্পাত শতাব্দী রাজধানী ছুটিয়েছিল দুরন্ত, সে যদি ভুখা থাকে শ্রেণীহীন রাষ্ট্রহীন গণতন্ত্র কোথায় মুখ লুকিয়ে থাকে

এখন যেদিকে তাকায় দেখি নি:শব্দে মুহুর্মুহু
হাওয়া ওঠে খুব মনে হয় সমুদ্র কাছাকাছি বোধহয়, যে দেশে মীরজাফর বিভীষণ নরেন গোসাই ভায়েদের ভাতের হাড়ির খবর পাচার করে ছত্রহীন করেছিল বিপ্লব সে দেশে
স্বর্গরাজ‍্য হবে নিশ্চিত, এ তো স্বত:সিদ্ধ
যেদেশে আ্যন্টিসেপটিক থেকে কন্ট্রাসেপটিভ
কেলেঙ্কারি কোলগেট স্ক‍্যাম চিটফান্ড আই পি এল বেটিং সারদা নারদা সেদেশের ছেলেরা যে হাজারো ধর্ষক হবে এ আর বেশি কথা কি ?
লোভ ঈর্ষাকাতরতা থেকে বন্ধুত্বের অপমান
প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে কাকড়া কালচার
শুয়ার কা বাচ্চা ,কালো কুত্তা ...পুতুপুতু প্রেমজন্ম নেবে সেবাদাস সেবাদাসী

যে ভাগ্যবান নিষ্প্রাণ বরফের মতো সাদা
ছায়াপথে মিছিলের মুখগুলি নিষ্কলুষ নীল হয়ে যায়,আর এদিকে সুন্দর শুভেচ্ছা মূর্তি
পাজামা পাঞ্জাবীতে অবিচল তুমি এখনো
কুরুক্ষেত্র আর অযোধ্যা নিয়ে কবিতা লিখে যাও রাসকেল ....





                মিষ্টি বৃষ্টি
            ডঃ রমলা মুখার্জী

 ধুৎ তেরি, অঝর ধারায় হঠাৎ এল বৃষ্টি....
কি করি এখন, কোথায় যাই, একি অনাসৃষ্টি!
অগত্যা একটু দাঁড়াই ঐ পাশের দোকানে-
কত টুকরো কথা আসছে ভেসে দু কানে।
বড় চেনা একটা আওয়াজ যেন কানে আসে......
চকিতে তাকাই আমি এ পাশ ও পাশে।
ওকে দেখেই হৃদয়-মাঝে লাগল খুশির দোল-
স্নায়ু-স্পন্দনে বয়ে গেল আনন্দের হিল্লোল।
ও বললে," বৃষ্টি থামতে হবে হয় তো দেরি -
চল আজ আমরা দুজন অকাজেতেই ঘুরি"।
বৃষ্টি তুমি বড় মিষ্টি প্রিয়কে দিলে এনে-
টিপ্ টিপ্ পড়বে যখন ভিজবো তাতে দুজনে।






               শ্রম
      মহীতোষ গায়েন

বহুদিন সূর্য দেখিনি,আকাশ দেখিনি
শুনিনি পাখির ডাক,দেখিনি মুঠোভাত,
রুটির জন্য হাড়ে কালশিটে দাগ...
হাড়ভাঙ্গা খেটে কাটে বিনিদ্র রাত।

এখন চারিদিকে নানা নিষেধ জারি...
মরণের সাথে লড়ে জীবন আসর;
এলোমেলো পড়ে থাকে ঘর সংসার
চোখের জলে ভাসে শ্রমের বাসর।






অস্থির সময়
               অপূর্ব রায়

এই ঝাঁ চকচকে  শহর
কোথায় ও মাটি নেই
শুধু পাথর, ইট ,কাঠ
স্থান নেই !
কংক্রিট বুক জড়িয়ে ধরে প্রাচীন শিকড়
আরো একটু সময় বাঁচতে চায়
উঁচু আকাশের নীচে স্বপ্ন স্বাদ নিতে চায়
                    [  ১]

  ওকে ঝাড়েমূলে কেঁটে ফেল
 না হলে  , দেওয়াল ভেঙে যাবে
অনেক যাযাবর পাখিরা আসবে ;
ঘর নোংরা হবে
সারা রাত ক্যারম্যাচর
ঘুম হবেনা
ওকে ঝাড়ে মূলে কেঁটে ফেল
           (  ২ )
সময় টা স্থির নয়
সূর্য এখন মাথার উপরে
ঠা ঠা রোদ্দুর
দৃষ্টি চলে না
মনে হল একটা প্রাচীন সবুজ আশ্রয় প্রয়োজন আছে
সে সুসময় হোক আর অসময় হোক
ঝাড়ে মূলে তাকে উচ্ছেদ করো না
                (  ৩)
সময় চক্র স্থির না
একদিন তুমিও ...
সে দিন সন্ধ্যা নামবে
বলবে ঝাড়ে মূলে বিদায় করো.





পালোয়ান
অনিক চক্রবর্তী

নাম তার
দামোদর
       বড়ো পালোয়ান
কুস্তি তে
হারিয়েছে
       হাজারো জোয়ান
সারা দিন
কাজ তার
      মুগুর ই ভাজা
তাতে নাকি
দেহ মন
      হয় তর তাজা
যা পায়
তাই খায়
       নেই কোনো মানা
এমন কোনো
পালোয়ান
      আছে কারোর জানা?

   



গাইডলাইন
--চিরঞ্জিৎ বৈরাগী

ভাঙাচোরা পেরিয়ে কংক্রিটের দেওয়াল
পিছনে নীল কিংবা ভারত মহাসাগর
ব্যারিকেডহীন শূন্যতায় অদ্বিতীয়

কয়েকটি বিকল্প
                হিম-উষ্ণ লড়াই
                মিশরীয় মমি
আর বাউন্ডারিহীন হিমালয়

আনকোরা দাড়ি
জিলেটে সাফ কীট-বসন্ত

ফেলে আসা টিসু পেপার
শুকনো রক্তেও স্রোতের উপকূল

একটা সম্বন্ধের পরেই অন্যটি
দামি আঠা কমদামী কপাল
যদিও আপেক্ষিকের পরেও অকৃত্রিম

বিজয়ী অথবা জবানী

                          চিরন্তন গাইডলাইন!







জীবন্ত ইতিহাস
( ভাষা - মানভূঁইয়া)
 উত্তম চক্রবর্ত্তী

ডুহা আস্যে বইলল
বদনা রে যা ক্যানে --
তোর হাড় জির জিরা বাপ ট
বড় বাঁধের আগালে
খকলা প্যাটে হাপর টাইনছ্যে  --
আগুইড়টা টান্যে দিহে
ছুইটত্যে ছুইটত্যে গেলহি
সব আঁড়রিকোল ইথানে বিথানে
খুঁজলি -- আঁড়রাই ডাকলি --
বাপ্ হে --- কুথায় তুই -- ?
পালহি , তবে আর হাপর টানে নাই
হামার লিকপিক্যা গতরে
বাপ ট কে কাঁধে লিহে
সটান হাসপাতাল,
ডাগতর সাব দ্যাখেই বইলল --
ক্যানে আনলি বাপ্,
অপুষ্টিতে পেরান বাইরাই গ্যাছে।

ভাবলি আঁড়রাই কাঁদি
লারলি, চখেও জল নাই
অব্বেবু হয়্যে ভাল্যে আছি
বাবু জনতার দিকে --
কেউ বলে খাত্যেই দেই নাই
তাই পইটক্যে গ্যাছে।

সি দুবছর আগের কথা
ঘরে হামি, পোয়াতি বৌ আর বাপ্,
হামার লিকপিক্যা গতর
তাই জমি জিরেতে কেউ
কাইজ দেই নাই
খাবার কুথায় পাব --- ?
ভকু খুড়া বইলল রেশনে দুটাকা কেজি চাল
আন ক্যানে -- ফুটাই খা,
ট্যাঁকে পয়সা নাই, দে ন খুড়া দু-টাকা
ইকদিন প্যাট ভইরে খাই ,শোধ দিব।
দিলহ নাই, ইঁড়ক্যে পাল্যাল।
রেশন বাবুকে বইললম্ --
কেজি চাল দিবে ব
পরে টাকা দিব ---
দূর দূর কইরে কুকুরের পারা
লেতাড়্যে দিলহ -----

হামি দিশা হারা
ছুইটত্যে ছুইটত্যে গেলম্
উপাড়ার মা ঠাকরুনের কাছে
দেখি মা ফ্যান গড়াছ্যেন,
বইললম্ ,মা গো ফ্যানটুকু দাও ক্যানে --
ঠাকরুন বইললেন --দ্যাখ বদনা
ঘরে গভীন বকনা, তবে টুকু পাবি
জামবাটি আন ----

এক জামবাটি ধুঁয়া উঠা মাড়,ভাতের গন্ধ
হামি, বৌ আর বাপ্
তিনদিকে বস্যে হাপুরছি
লিশ্বাস ফেলি নাই, পাছে কম পড়ে!

মাড়ে কি আর পুষ্টি হয় বাবু --
পোয়াতি বৌ গেল সইটক্যো
চল্যে গেলহ কন আকাশে তারা হয়্যে
ইখন আর চিনত্যে লারি --
কন টা বঠে উ --
আর ইবারে চল্যে গেলহ বাপ্ --
বাঁচ্যে কি আর আছি ---- ?

ইখন হামি জীবন্ত ইতিহাস  !






   বিশ্বায়নের ঢেউ এ ভেসে যাচ্ছে পুরনো সংস্কার
                    -ভাস্কর বাগচী



আজ  হাটবার । পুরুলিয়া জেলার সেনাবনার হাট । ইতি উতি বিকোচ্ছে মুরগি , হাঁস , জংলি কাঠ , মাছ ধরার গলুই , কমদামী শাড়ি , গামছা , লুঙ্গি , প্লাস্টিকের চটিজুতো , নানারকমের কাঁচের চুড়ি আর টিপ । আর একপাশে আলু , ঝিঙে , টাটকা ফুলকপি , বাঁধা কপি , পালং শাক আর টমাটো , স্থানীয় ভাষায় বিলাতি ।

          এই হাটেই শাক সব্জি বিক্রি করে অযোধ্যা পাহাড়ের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা গুরুবারি । গুরুবার অর্থাৎ বৃহস্পতিবারে জন্ম তাই নাম গুরুবারি । গুরুবারি জাতিতে বিরহোড় । শোনা যায় বিরহোড় জনগোষ্ঠী দ্রাবিড় শাখার উপজাতি । আর্যদের আগমনের ফলে এরা ছোটনাগপুরের জঙ্গল ঘেরা অঞ্চলে বসবাস শুরু করে । পশ্চিমবঙ্গ , ঝাড়খন্ড , বিহার , ওড়িশা ও মধ্যপ্রদেশের জঙ্গল মহলেই এরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে । অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষা গোষ্ঠীর পর্যায়ভুক্ত বিরহোড়রা দেখতে শারীরিক ভাবে মাঝারি গড়নের । স্ফুরিত ও ঈষৎ চাপা নাসার অধিকারী কালো রঙের এই জনজাতি প্রটো-অস্ট্রেলয়েড গোষ্ঠীভুক্ত । বির মানে  জঙ্গল । তা থেকেও এদের নাম বিরহোড় হতে পারে । বিরহোড় সম্প্রদায়ের কোঁকড়ানো চুল অনার্য গোষ্ঠীভুক্ত অন্যান্য  সম্প্রদায়েরই মতো ।

        বুদ্ধ পূর্ণিমার দিন অযোধ্যা পাহাড়ের শিকার পরবে গেলেই পাহাড়ের ভূমিপুত্র বিরহোড়দের দেখা যায় হেসে নেচে –গেয়ে সারা পাহাড় মাতিয়ে রাখতে । পাহাড়ি জোড়ের ধারে ওরা দিন মজুরিতে ছাগল চরায় । সময়ে বীরভুমের পাথর খাদানে কখনও ইটভাটায় পূব খাটতে যায় ।

       নিমতেল ও মহুয়ার গন্ধে এদের একটা নিজস্বতা আছে যা শহুরে মানুষদের থেকে এদের আলাদা করে রাখে । অকৃতদার এক মানুষ  সুবোধবাবু শহর থেকে এসে এদের নিয়েই বহুদিন ধরে নিঃশব্দে কাজ করে চলেছেন এ অঞ্চলে । নৃতাত্ত্বিক গবেষণা করতে সেই কবে এসেছিলেন । সোজা সাপ্টা মানুষ গুলোর মায়া আর কাটাতে পারলেন না । সেই সুবোধ বাবুই বলছিলেন – এখানে পাতুমুড়া বা সুবল শবরের অনাহারে মৃত্যু নিয়ে বিতর্ক হয় । সাংবাদিকরা শহর থেকে আসেন স্কুপ নিউজের আশায় , সমস্যার কথা সবাই বলেন । সমাধানের রাস্তায় হাঁটার চেষ্টা নেই কারও । প্রেস থেকে প্রশাসন ক’দিন হইচই হয় । আবার সব চুপচাপ । লোকগুলো যে তিমিরে সেই তিমিরেই থাকে ।

    সুবোধবাবুই হঠাত একদিন বাজারের থলি হাতে নিয়ে বাজারে গিয়ে খেয়াল করলেন – গুরুবারি চুলে যেন কলপ করেছে মনে হচ্ছে । গুরুবারির বয়স পঞ্চাশ বলে মনে হয় তার । আবার পয়ত্রিশও হতে পারে । রুখা সুখা এই অঞ্চলের প্রকৃতির রুক্ষতায় মেয়েদের প্রকৃত বয়স বোঝা যায় না । তবে এই ভূমি কন্যাদের চুল কখনও পাকতে দেখেন নি সুবোধবাবু । রিঠা দিয়ে চুল পরিষ্কার করে চপচপে করে নিমতেল মাখতেই দেখা যায় সবাইকে ।

         জিগ্যেস করাতে গুরুবারির ব্যতিক্রমী উত্তর –

“ রিঠাতে কাজ হছে নাই কাকা । সব চুল পাকে যাছে । টুকুন এই তেলট লাগাছি” ।  কথা বলে বোঝা গেল টিভির মাধ্যমে গুরুবারি ভালোই চিনেছে প্রসাধনীগুলোকে । জানা গেল প্রাইমারি স্কুলের মাস্টার মশায় বঙ্কিমবাবুর বাড়িতে সে টিভি দেখে নিয়মিত । বিস্মিত সুবোধবাবু সে সত্যিই টিভি দেখে কিনা জানার জন্য জিগ্যেস করলেন –

- পিভি সিন্ধু কে জানো ? দেখেছ টিভিতে ?

- হ বাবু ।

- বল তো কে ? কোন মন্ত্রী ?

- মন্ত্রী হবেক কেনে ? ঢ্যাঙা পারা মেইয়ে লোক ট । দমে দৌড় ঝাপ করে । খেলা ট কি তা বইলতে লাইরব । তবে চিনি উয়াকে ।

হাঁ হয়ে গেলেন সুবোধবাবু । এই প্রান্তিক জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের নিরক্ষর মহিলাটি ভারতের ক্রীড়াজগতের এখনকার পয়লা নম্বর ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডরকে ভালই চেনে ।

নৃতাত্ত্বিক সুবোধবাবুর এ অঞ্চলে এক যুগ হয়ে গেল । এখানে এসেই ‘চিহড়’ লতা চিনেছিলেন । বুনো চিহড় লতা দিয়ে বুনে বাসস্থান ‘কুমভা’ তৈরি করত বিরহোড়রা । অপদেবতা ‘বোঙ্গা বুরু’র ভয়ে লতার বাড়িতে কোনও জানালা থাকত না । দরজাও এতো নিচু যে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকতে হত । সাদা পাথরে তেল সিঁদুর মাখানো দেবতা ‘বুরিয়া মাই’ এর পুজো  করত এরা । সরকারি সাহায্যে বানানো সিমেন্টের ঘর বাড়িতে থাকা কিছুদিন আগেও পছন্দ করত না বিরহোড়রা । সময়ের সাথে সাথে ওদের সংস্কার , সংস্কৃতিও দ্রুত পাল্টাচ্ছে । কাঁসাই , কুমারী , টটকো , বান্দু , শিলাই নদী দিয়ে অনেক জল বয়ে চলেছে । রুখা মাটির টিলায় জেগেছে নতুন বার্তা । পাহাড়তলির আদিগন্ত বিস্তৃত ক্ষেতে দোল খাচ্ছে শশার ফুল । পাশেই শহর থেকে আসা লরিতে বোঝাই হচ্ছে ঝুড়ি ঝুড়ি টম্যাটো । বাতাসে আজ নতুন দিনের ইঙ্গিত । বিশ্বায়নের ঢেউ বুঝি একেই বলে ।

 মনে পড়ছে অনেক দিন আগে পড়া তারাশঙ্করের ‘হাসুলি বাঁকের উপকথা’ । সেখানেও রক্ষণশীল বনোয়ারির সযত্ন লালিত ভূমিতে নতুন যুগের সূচনা করেছিল করালী । যুগে যুগে এমনই হয় । পুরনো মুল্যবোধকে সরিয়ে নতুন যুগ তার নিজস্ব পথ করে নেয় ।





নদী কথায় ভেসে যায় .......
              তীর্থঙ্কর সুমিত

জমানো অনেক কথা বলার থেকে, না বলাটাই বাকি থাকে ।বহুল প্রচলিত কথা কখনো কখনো নতুন হয়ে ওঠে ।আর দূরের হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলো বড় কাছের হয়ে ওঠে।এভাবেই দিন - মাস - বছর পেড়িয়ে যায় ।ফিরে আসে কথার জোয়ার।আর অপেক্ষা সৃষ্টি করে বেঁচে থাকার রসদ।এখানেই হয় কলমের সূচনা।
না হয় কথাগুলো ই বাঁচিয়ে রাখুক পাওয়া না পাওয়ার অন্তিম মুহুর্ত ।





     

3 comments:

  1. কিছু কিছু কবিতা যেমন 'জীবন্ত ইতিহাস ', 'মিষ্টি বৃষ্টি ', 'পালোয়ান' খুবই ভালো । গল্পও ভালো লেগেছে ।

    ReplyDelete
  2. মন দিয়ে পড়লাম । আন্তরিকতা আছে ।

    ReplyDelete