PravatiPatrika

Monday, July 20, 2020

সোমবারের পাতায়

                                অনুভব
                        কপিলদেব সরকার

        পেয়ারাগাছটা মরতে বসেছে। বেশ কিছুদিন হল ওর শরীরটা হলদেটে হয়ে আসছে, পাতাগুলো কুঁকড়ে, শুকিয়ে, গুটিয়ে যাচ্ছে। এটা প্রথম বুঝতে পারে ঋক। ঋক গাছ ভালবাসে।  ফ্ল্যাট হয়ে যাবার আগে এই জমিটায় গাছপালা ছিল বেশ কিছু। প্রোমোটার কি কারণে জানি ওই একটা গাছকে ছাড় দিয়েছিল। গাছটা বাড়ির পুবদিকের পাঁচিল ঘেঁষে। আলো-হাওয়া পায়, বৃষ্টির জলও। দিব্যি ছিল একাই। মাথা দোলাত। ফলও ফলাত অল্পবিস্তর। তবে খেতে বিস্বাদ ছিল বলে চুরিটুরি হত না। পাখিতে খেত। একটা পুরুষ্টু ডাল কিভাবে ঋকের জানলার কাছে চলে এসেছিল। ঋক সেই ডালে মাঝে মাঝে হাত বোলাত। পাতায় আঙুল ছোঁয়াত। ডালের বাকল ছুঁয়ে বুঝতে পারত -  কখন ঋতু পাল্টাচ্ছে। পেয়ারাগাছটা নিজের পুরোনো বাকল খসিয়ে দিয়ে, নতুন সাজে সেজে উঠত। পুরোনো পাতা ঝরে গিয়ে ছোট ছোট নতুন পাতা আসত, তারা বড় হয়ে উঠত আস্তে আস্তে। ভারি আনন্দ পেত ঋক। কেউ কখনও জানতে পেরেছে পেয়ারাফুলেরও গন্ধ আছে? ঋক জানত।

         সেই ঋক-ই বুঝতে পারল - পেয়ারার ডাল ছুঁয়ে চেনা যে অনুভূতিটা হয়, সেটা বেশ কিছুদিন হল পাচ্ছেনা সে। কালো পিঁপড়ের দল সার বেঁধে যায় - ঋকের হাতেও উঠে পড়ে কেউ কেউ, ইতস্তত। তাও হচ্ছেনা ক'দিন হল। পাতায় হাত বুলিয়ে দেখেছে ঋক। কিছুই আর আগের মত নেই।

         এত বড় ফ্ল্যাটবাড়ি। এত মানুষ। কিন্তু কেউ দেখতে পায়নি - পেয়ারাগাছটা মরতে বসেছে। বেশ কিছুদিন হল ওর শরীরটা হলদেটে হয়ে আসছে, পাতাগুলো কুঁকড়ে, শুকিয়ে, গুটিয়ে যাচ্ছে।

         পেয়ারাগাছ, ও পেয়ারাগাছ। তুমি তো জান - তোমার বেঁচে থাকা - না থাকায় মানুষের কিছু যায়-আসে না। তারা টেলিভিশন আর ইন্টারনেট-এ ভেসে আসা মৃত্যুভয়ের খবরে সন্ত্রস্ত। সমস্ত দরজা আর জানলা বন্ধ করে তারা অসহায় হয়ে ডাকছে তাদের ঈশ্বর-আল্লাহ-গডকে। তাদের শেকড় নেই, পাতা নেই, সবুজ নেই, শুধু আছে হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে কোনোক্রমে টিকে থাকার রসদ জোগাড়ের চেষ্টা। তুমি শুকিয়ে মরে যাবে এভাবেই। তারপর তোমার শেষ চিহ্নটুকু মুছে যাবে। শোন - ঋক কাঁদছে। তবু কষ্ট পেয়ো না। জেনো - এক মূক, বধির ও জন্মান্ধ মানবসন্তান শুধু তোমায় ছুঁয়ে বেঁচেছিল, যে স্পর্শের আত্মীয়তা তার সমাজ অনেকদিন হল অস্বীকার করেছে।





                 অনুকবিতা
              শংকর হালদার

০১
ঝড়া পাতার ঘূর্ণন বুকে সময়ের মূল্যবোধ বাঁধা ,
পতিত ভূমিতে লোটানো জীবন অতীত ।

০২।
স্বপ্ন ঘোরে স্বপ্নদাতার অস্তিত্ব বিদ্যমান
তার-ই মাঝে সুখ-দুঃখ ,হাসি-
 কান্না
সব কিছুই যেন তার-ই অভিমান ।





         অপ্রেম
      শার্মিষ্ঠা সাহা

ফিসফিসিয়ে উজানের কানাকানি

ভাসবে দোঁহে, প্রেম বলে না জানি ।





            অনুগল্প... বুকের মাঝে
                    রমলা মুখার্জী

আত্মীয়স্বজন আর অতিথিদের আগমনে উদিতির ছোট্ট বাড়িটা যেন সানাই-এর সুরের সাথে আনন্দে হাসছে ।আজ যে তার মেয়ে ঝুলনের বিয়ে ।প্রিয় বান্ধবীর মেয়ের বিয়েতে হিমিকাও দারুণ ব্যস্ত।অনেক কষ্টে সুমনের কাছ থেকে হিমিকা আজকের ছুটিটা আদায় করতে পেরেছে ।অভিজ্ঞা বান্ধবীর ঘাড়ে বিয়ের প্রথাগত কাজকর্ম চাপিয়ে উদিতিও নিশ্চিন্ত ।গত শ্রাবণেই তো হিমিকার মেয়ে খুশির বিয়ে হল ।কত অশান্তি করেই না হোলো! খুশির পছন্দের আকাশ গরীব হলেও সৎ আর অনুভূতিপ্রবণ ছেলে ।কিন্তু সুমন কিছুতেই বিয়েতে রাজি ছিল না ।অর্থের দম্ভেই সুমন সব সময় ফুটছে, কারুর চাওয়া পাওয়াকে সে মূল্যই দেয় না ।ঘর পোড়া গরু হিমিকা কিন্তু খুশিকে  ভুল করতে দেয় নি ।অনেক লড়াই করে সে খুশির আকাশ ছুঁয়েছে ।হঠাৎ হিমিকার চিন্তার সুতো কেটে যায় একজনের মিষ্টি ডাকে,
-হিমু, আমায় চিনতে পারছ?
এই ডাক কি ভোলা যায়?
অতীত স্মৃতিতে হারিয়ে যায় হিমিকা
বড় সরকারি অফিসার সুমনের সাথে হিমিকার বাবা যখন হিমিকার বিয়ে ঠিক করলেন তখন গানের শিক্ষক তপনকে প্রত্যাখ্যান করে অনেক সুখের স্বপ্নে বিভোর হয়ে হিমিকা সুমনের গলায় মালা দিয়েছিল ।কিন্তু বিয়ের পর থেকে সুমনের ভয়ঙ্কর মেজাজ সামলাতে সামলাতেই হিমিকার এতটা বছর কেটে গেছে ।
-কি হল চুপ করে আছ কেন? সত্যিই কি চিনতে পার নি হিমু?
-চিনতে পেরেছি গো, তুমি ছাড়া এত আপন করে আমাকে আর কে ডাকবে বল?
-তুমি কি আর আগের মত গান কর? তোমার সুরেলা কন্ঠের সেই অসাধারণ গান কত দিন শুনিনি গো ।
-আর গান, দিনরাত মেজাজী বরের ফাইফরমাস খাটতে খাটতেই দিন চলে যায় ।
মনে পড়ে যায় হিমিকার তপনের সংগে নানান অনুষ্ঠানে গান করার কথা ।কত পরিচিতি তখন হিমিকার, আর নন্দন চত্বরে তপনের সাথে কাটানো প্রেমের দিনগুলো.... সত্যিই সুখ যেন উপছে পড়ত ।হিমিকার গাল বেয়ে নেমে আসে জলের ধারা।
-আমায় ক্ষমা করে দাও তপু ।
-ক্ষমা কিসের হিমু ।আমাকে সম্পূর্ণ করে বোঝার তোমার এই উপলব্ধি সেটাই তো আমার পরম প্রাপ্তি ।দুজনেই দুজনের বুকের মাঝে আছি সেটাই বা কম কিসের বল?






                 " কালবেলা
             হামিদুল ইসলাম।
               

প্রতিদিন এক দানব আসুরিক শক্তিতে ভেঙে ফেলে
সমস্ত সম্পর্কের বাঁধন
ভেঙে ফেলে চিলে কোঠা
সজীব প্রাণ
শক্তিই তার সঙ্গী
ইতিহাস এখন ম্রিয়মান   ।।

জলছবি তুলে ফেলি
মন থেকে
ফিরে আসে ভাগীরথী
সবুজ কেয়াফুলে সাজাই কুটির
এক একটি জীবন
প্রতিদিন এক একটি জীবনের কালবেলা    ।।









             বাড়িয়ে দাও হাত
              মহীতোষ গায়েন

অস্থির সময় এখন,মহামারী আতঙ্ক চরাচরে-
বিভেদ বৈষম্য ভুলে এসো বাড়িয়ে দাও হাত...
এসো,আগুনের পরশমণি ছুঁয়ে বিজয় গান গাই।

শপথের অঙ্গীকার নিয়ে আরো একবার অসহায়
মানুষের রুটি-রুজির সংগ্রামে সাথি হয়ে মানুষের সাথে মিশি;মানুষই মুমূর্ষু পৃথিবীর জিয়নকাঠি।





 
              সমীকরণ আর প্রশ্ন
               কৃষ্ণেন্দু দাসঠাকুর


বালির চরে উপুড় হয়ে, কাদামাখা স্যারের লাশটা--- প্রতিবাদ ছিন্নভিন্ন, আদর্শ সারারাত শিয়াল কুকুরে খুবলেছে। বুকপকেটে নক্ষত্রের মতো তখনও জ্বলজ্বল করছে, যেটা উঁচিয়ে স্যার বলতেন-- "অসির চেয়ে মসি বড়"।

থানার দুঁদে অফিসার মার্ডারের ক্লু খুঁজছিল---  হঠাৎ আবিষ্কৃত হল স্যারের পাজামার পেছনে একটা পরিছন্ন ছুরি... গোঁজা।

স্যারের দিকে তাকালাম--- সবার অলক্ষ্যে, ঠোঁটে তখনও একটা ব্যাঙ্গের হাসি ঝুলে...
                                 




অনুকবিতা :
শুভদীপ বিস্বাস
(১)
ভেজা বিকেল
কেউ আসেনি
মন ভিজেছে একলা ।

(২)
সন্ধ্যে টাকে
আটকে রাখে,
ইলেক্ট্রিকের আলো ।
ভালো ।

(৩)
বর্ষা রাতে,
বিছানা চমৎকার ।
একান্তই
একার ।

(৪)
অনেক দিনের পরে,
নিজের মত
নিজের মতন ঘরে ।






     
                 *পীড়া*
        --------------------- শঙ্খজিৎ দাস

  সাতসকালেই বাচ্চাটা কাঁদছিল.....

বাবা ওকে এক হাতে কোলে নিয়ে বাইর-বারান্দায় দ্রুত পায়চারি করছিল, আর চেষ্টা করছিল---গলিপথে পরিচিত কাউকে দেখা যায় কিনা। কারণ একটা বিড়ির খুব দরকার, উপরন্তু এক হাতে তার বিড়ি ধরাতেও অসুবিধা । টাইফয়েডে একটা হাত পঙ্গু । তারপর থেকে রোজগার আরও কম।ফলে বাধ্য হয়ে তাকে বি পি এল তালিকায় নামটা তুলতেই হয়,'বহুকষ্টে'।
  'বহুকষ্টে' এই কারণে যে বহুদিনের জমানো চাল বিক্রি করে সেই টাকা ঘুষ দিয়ে শেষমেশ সে ঐ তালিকাভুক্ত হয়। কিন্তু এখন আর চলছে না। 'করোনা'র কারণে লকডাউন চলছে।
         বাচ্চাটা ঘনঘন কাঁদছে।
  উপরন্তু বউ-এর খিস্তি। মাথাটা গরম হয়ে যায়। শেষে সেও লাইনে গিয়ে দাঁড়ায়। পাঁচ কেজি চাল আর দুই কেজি আলু। বাজারের মাঠে লম্বা লাইন। এবার  তার সামনে আর মাত্র দুজন দাঁড়িয়ে। তারপরেই তার পালা।

   কিন্তু লাইন থেকে হঠাৎ সে ছিটকে বেরিয়ে--- সোজা বাড়ি।
 
----" ক্যা,হঠাৎ কী এমন হইলো?"বউ-এর প্রশ্ন।
  দাওয়ায় বসে সে ছটফট করছিল। অনেকক্ষণ পরে সে উত্তর দিল-- "এই দয়ার দান আমি নিতে পারুম না।--ওরা ফটো তুইল্যা রাখতাছে।আর চাউল দিতাছে ঐ চেল্টু ন্যাতাটা, যারে আমি একদিন চাউল বেইচ্চা ঘুষ দিছিলাম।"

   বাচ্চাটা এবার তারস্বরে চীৎকার করে-----

ওর পিঠে জোড়সে একটা থাপ্পড় কষিয়ে বউ বলে---"এঃ,গরীব মাইনসের এত দ্যামাক কিসের---

    প্যাটে নাই যার ভাত
    দ্যাখ ক্যামন তার ঠাঁট!"






                    অরন্যর  দীর্ঘশ্বাস
                          সুব্রত দাস

উঁচু উঁচু টাওয়ার, বড় বড় অট্টালিকার পাশে,
ছোট্ট অরন্যটা ফ্যাকাসে  যাচ্ছে প্রতিনিয়ত ;
জনসংখ্যার চাপে গাছ গুলোও দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
নদীর চড়ে যেন ময়লা আবর্জনার আতুরঘর ।
অরন্যর সবুজ গুলো তামাটে বিবর্ণ হয়ে যায় ,
প্রকৃতির কোল শুকিয়ে শুকিয়ে কষ্ট আওড়ায় ।
বনপ্রহরী মানুষ হয়ে লিখে যায় পাখির কলতান
গাছেদের আর্তনাদ,আর কিছু স্মৃতির উন্মাদনা
মনে পড়ে  কাঞ্চনফুল,সারিসারি লম্বা গাছপালা, এঁকেছিল মনে ঘন শাল বাগান,চিরসবুজ মাঠ ।
ছোট ছোট ঘাস জলের বুকে শ্যাওলার গান ।
আজ সব অচেনা কাঁদে সত্তা অরন্যর দীর্ঘশ্বাস।‌।








                      পাগল জগনবাবু
                       উত্তম চক্রবর্ত্তী


জগন বাবু শিক্ষকতা থেকে রিটায়ার করেছেন। তাও কয়েক মাস হয়ে গেছে। কিন্তু ইদানীং সারা গ্রাম তন্ন তন্ন করে খুঁজেও  জগন বাবুকে পাওয়া গেল না। উনাকে আমার প্রভূত দরকার। বার দুই উনার বাড়ীতে খোঁজ করার পর এক মধ্য চল্লিশ মহিলা বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, " ত কি ব্যাপার, হামকে খুল্যে  বল, উয়াকে সকালের লে ধুঁইড়বার চাঁড়টা কিসের,  উয়াকে ইত কিসের দরকার ?"
বললাম, আমাদের আঞ্চলিক কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ওনাকে আমরা অঞ্চলের সেরা শিক্ষকের সংবর্ধনা দেব।
শুনেই মহিলা বললেন, " উটা আবার কি?
উটা দিয়ে কি হবেক্ ?"
বললাম সব কিছুর সাথে একটা স্বর্ণ পদক।
শুনেই মহিলা চুপিচুপি  বললেন, হা শুন, উ ইখন কাঁসাই লদীর আঁড়রি কোলে কোচুরির দিকে বট গাছট আছে ন, উখানেই সারাদিন বস্যে থাকে। কুলহি কুলহি চল্যে যাও ক্যানে ।উয়াকে উখানেই পাবে। তবে কাউকে উয়ার ডেরহাটা বইলহ না। "
প্রায় পড়ন্ত বিকেল। হাঁটা লাগালাম।
পৌঁছে দেখি, জগন বাবু আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে বার বার একটা খাতায় কি যেন লিখছেন।
কাছে গিয়ে ডাকলাম -জগনবাবু।
জগন বাবু একবার আমাকে দেখে আবার মুখটা ফিরিয়ে নিয়ে নিজের কাজে ব্যস্ত।
কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ---
জগনবাবু কি করছেন?
জগন বাবু আমার দিকে না তাকিয়ে বললেন, বক গুনছি ভায়া। আজ বক, গত কাল কাক, তার আগের দিন ট্যাঁসা গুনেছি। আগামীকাল চটি পাখি গুনতে হবে।
জিজ্ঞাসা করলাম, কেন?
আকাশের দিকেই তাকিয়ে জগন বাবু বললেন, আমার তরুনী স্ত্রী বলেছে, এখন পাগলের মত থাকবে, না হলে তোমার ভাইরা,রাবণের গুষ্ঠি আত্মীয় স্বজনেরা রিটায়ারম্যান্টের টাকা কারণে অকারণে চাইতে পারে। এখন পাগলের মত নদী তীরে বসে পাখি গুনবে।তাই আমার রিটায়ারমেন্টের সব টাকা তোমার বৌদি তার এক ভাইয়ের নামে এম, আই, এস করেছে। সুদের টাকা রেকারিং করে দিয়েছে। পেনসনের অর্ধেক টাকা তার এক জামাইবাবুর নামে ব্যাঙ্কে জমা করছে। বাকী অর্ধেক টাকা তোমার বৌদি স্নো-পাউডার, ক্রিম প্রভৃতি খাতে ব্যয় করে। আর আমার ছোট ভাইয়ের ব্যবসায় রক্ত জল করা উপার্জনের টাকায় সংসার চলছে। আমিও দেখলাম, বুদ্ধিটা মন্দ নয়। ঐ জন্যই তো বুদ্ধি করে তোমার বৌদি ছোট ভাইয়ার বিয়ে দিতে দিল না। সংসারে কানাকড়ি না দিয়েও সমাজ জানে আমিই সংসার চালাচ্ছি। তরুনী স্ত্রীর কথামতো চলছি বলে খাসা আছি ভায়া।
তা তুমি এখানে কি মনে করে?
সব বললাম।তাকে যে আঞ্চলিক কমিটি সংবর্ধনা দেওয়ার জন্য নির্বাচিত করেছে, তা শুনেই জগন বাবু আকাশ ফাটিয়ে হা-হা করে হাসতে লাগলেন। বুঝতে পারছি না , তিনি হাসছেন না কাঁদছেন। তারপর দুই হাঁটুর মাঝে মাথা নামিয়ে বসে রইলেন ।প্রাক সন্ধ্যায় কাঁসাইয়ের আদিম নিস্তব্ধতায় বসে আছি আমি ও জগনবাবু।
কিছুক্ষন পরে ধীরে ধীরে মাথা তুলে বসলেন। একটু ঝুঁকে আমার দিকে ভ্যাল ভ্যাল করে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলেন, তারপর নিরবতার বিরতি ঘটিয়ে  বললেন ," আজকাল আমিও বুঝতে পারি না ভায়া -হাসছি না কাঁদছি। " বলেই উঠে দাঁড়িয়ে ধেই ধেই করে নাচতে নাচতে কাঁসাইয়ের হাঁটু জল মাড়িয়ে ওপারের গলাকাটা ডুংরির দিকে আলো আবছা অন্ধকারে মিলিয়ে গেলেন। আমি একাকী নিস্তব্ধ কাঁসাই পারের বট তলায় যেন এক করুণ পরিণতির সাক্ষী হয়ে বসে আছি।
ভাবতে পারছি না, লোকটা পাগলের অভিনয় করতে করতে সত্যিই পাগল হয়ে গেল না তো !







             আকর্ষ
      শ্যামসুন্দর  মন্ডল


অর্ণা ও অর্পণ দুজনেই বনেদী পরিবারের সন্তান। পরিবারের অনেকটা অমতে ভালোবেসে দুজনের বাসা বাঁধা।কিন্তু বিয়ের পর প্রচন্ড সেন্টিমেন্টাল অর্ণার উপর মনস্তাত্ত্বিক পীড়ন হতে থাকে,অর্পণের অদৃশ্য অপারগতার কারণে। একদিন সহ্যের সমস্ত সীমা অতিক্রম করলে অর্ণা বন্ধনের অদৃশ্য সুতোটা ছিঁড়ে চলে যেতে প্রস্তুত হয়। ব্যর্থতার সমস্ত দায় ও কলঙ্ক মাথায় নিয়ে অর্ণা ন্যূব্জ। তবু্ও, একফোঁটা কলঙ্ক ও....। না, অর্পণকে দেয় নি অর্ণা।

সেদিন। খুব সকাল। অর্পণ ঘুম থেকে উঠে নি। অর্ণা মাথার কাছে দাঁড়িয়ে খুব শান্তভাবে ডাকে,"ওঠবে না।" অর্পণ পাশ ফিরতে ফিরতে বলে, "হুঁ।" অর্ণা তেমনি ভাবেই বলল," যাচ্ছি।" অর্পণ ঘুমঘুম চোখে জিজ্ঞেস করে,"কোথায়?" অর্ণা বলে,"জানি না।"
"মানে!" বলে অর্পণ ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। অর্ণা বলে চলে,"আমার প্রয়োজনীয়তা বোধহয় ফুরিয়েছে। আর অপ্রয়োজনীয়তা বহন করার বিড়ম্বনা,তাই বা কম কি! " তারপর নিঃস্ব আকাশের নিরবতা।

খানিকপরে আচমকা নিরবতা ভেঙে"তুমি অন্তত নিজের যত্নটুকু নিও।" অর্ণার এই শেষ কথাগুলোয় অর্পণের বুকের ভিতরটা যেন হুহু করে কেঁপে উঠল, যেন এক নিমিষেই মরুদ্যান ছাড়া ঊষর মরুভূমি হল। অর্পণ দেখল,যে লতাটি এত দিন ধরে একটু একটু করে উপরে উঠছিল,আজ আলগোছে হয়ে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কার হাওয়ায় ভীষণ দুলছে। অর্পণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে অর্ণার হাত দুটো খপকরে ধরে  নিজের বুকের উপর টেনে নিয়ে উৎকন্ঠায় বলে উঠে, "অর্ণা।" অর্ণা তার মুখের দিকে চেয়েই শান্তভাবে বলে," বলো।" অর্পণ কাঙালের মতো সমস্ত সংকোচ ও দ্বিধা কাটিয়ে বলে," অর্ণা,আমি আমাকে তোমাকেই দিলাম।পারো না নিতে?" আর ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। অর্ণার মুখে কথা নেই। শুধু দু'হাতে শক্ত করে অর্পণের গলা জড়িয়ে ধরে বুকের কাছে টেনে নিল। আর সমস্ত প্রতিরোধকে ব্যর্থ করে অশ্রু অর্ণার দুগাল বেয়ে বাথাতুর বুককে ছুঁয়ে অর্পণের উপর নিঃশব্দে পড়তে থাকল।



No comments:

Post a Comment