PravatiPatrika

Saturday, July 11, 2020

রবিবারের পাতা

     

                    সাক্ষাৎকথায় প্রচেত গুপ্ত
                        প্রশান্ত ভৌমিক

যখন স্রষ্টা নিজেই আত্মপ্রচারে নামেন, তখন তিনি সন্দেহের প্রশ্ন নিয়ে ঘোরেন


প্রচেত গুপ্ত- সাহিত্যিক, সাংবাদিক। সহ-সম্পাদক হিসেবে কাজ করছেন কলকাতার প্রসিদ্ধ দৈনিক 'আজকাল'-এ। অর্থনীতিতে স্নাতক। 'দেশ' পত্রিকার মতে, বর্তমান সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় দু'জন লেখকের একজন তিনি। লেখালেখি এবং পেশাগত দায়িত্ব নিয়ে প্রচণ্ড ব্যস্ত সময় পার করছেন। তার ফাঁকেই 'আজকাল'-এর অফিসে এক গ্রীষ্মের সন্ধ্যায়(২৮-০৫-২০১৯) লেখকের মুখোমুখি।

প্রশান্ত ভৌমিকঃ প্রথমেই আপনার ছোটবেলা সম্পর্কে, আপনার বেড়ে ওঠা সম্পর্কে জানতে চাইবো।

প্রচেত গুপ্তঃ আমার পরিবারের কথাই বলি আগে। এককথায় বলতে গেলে আমার পরিবার শিক্ষক পরিবার। আমার বাবা ডক্টর ক্ষেত্র গুপ্ত শিক্ষক ছিলেন। তিনি বাংলা সাহিত্যের একজন অধ্যাপক, শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক। তাঁর জন্ম সেই সময়ের পূর্ববঙ্গে। দেশভাগের সময় তিনি এখানে চলে আসেন।

প্রশান্ত ভৌমিকঃ বাংলাদেশের কোথায় বাড়ি ছিল আপনাদের?

প্রচেত গুপ্তঃ আমার ঠাকুর্দা ছিলেন বরিশালের মানুষ। পিরোজপুর। দেশভাগের সময় এখানে আসেন, পড়াশুনো করেন। খুব মেধাবী ছিলেন। সাতখানা গোল্ড মেডেল পান কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। রেকর্ড নম্বর পেয়েছিলেন। এখানে তো বটেই, তিনি বাংলাদেশের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়েই গেস্ট লেকচারার হিসেবে পড়িয়েছেন, সেমিনার করেছেন। বাংলা সাহিত্যের নিয়ে  ২৫০ টির ওপর প্রবন্ধের বই আছে তার। আমার মা-ও বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপিকা। ডক্টর জ্যোৎস্না গুপ্ত। রামমোহন কলেজের ডীন ছিলেন।

প্রশান্ত ভৌমিকঃ আপনার মায়ের বাড়ি কি কলকাতাতেই?

প্রচেত গুপ্তঃ হ্যাঁ। আমার মায়ের কলকাতাতেই বাড়ি। আমরা ৩ ভাই।  ভাই পুষ্কর গুপ্ত শিক্ষক ছিলেন। তিনি প্রয়াত হয়েছেন। আমার স্ত্রী ডক্টর মিত্রা গুপ্ত অধ্যাপনা করেন। শুধু আমি শিক্ষক নই। আমি সাংবাদিক। আমার দাদা পূ্যন গুপ্ত ও তাই। তিনি ৩৬৫ দিন সংবাদপত্রের সম্পাদক।
ছোটবেলা থেকেই লেখালেখি আমার নেশা ছিল। সেই লেখালেখির মধ্যেই জড়িয়ে পড়ি। স্বপ্ন ছিল, লিখব। তবে লেখক হব সেই স্বপ্ন আমার ছিল না। স্কুল জীবন থেকেই লেখালেখি শুরু করি। তখন মনে করতাম, আমি যা কিছু বলতে চাই সেটা কেবল শুধু লিখেই বলতে পারবো। বালক বয়সে সবাই যেমন খেলাধুলা করে, আমিও করতাম। সঙ্গে লেখালেখিও। আমার যতই পড়াশুনোর চাপ থাকুক না কেন, দিনে একটু না একটু লিখতাম। বাড়িতে প্রচুর বই আসতো। বড়দের বই, ছোটদের বই- প্রচুর বই আসতো। আমরা বইয়ের মধ্যেই থাকতাম। আমি পড়াশুনোয় বিশেষ কৃতি ছিলাম না। গল্প, উপন্যাস, মৌলিক রচনা এসব পড়তে খুব ভালোবাসতাম। প্রচুর জায়গায় লেখা পাঠাতাম। নামী-দামী সব পত্রিকাতেই পাঠাতাম। বেশিরভাগ সময় ছাপা হত না। ১২ বছর বয়সে আমি প্রথম গল্প লিখি আনন্দমেলা পত্রিকায়।

প্রশান্ত ভৌমিকঃ সিরিয়াস ভাবে লেখালেখি শুরু করলেন কবে?

প্রচেত গুপ্তঃ আমি বড়দের জন্য সিরিয়াস ভাবে লেখালেখি শুরু করি খুব বেশিদিন আগে নয় কিন্তু। আজ থেকে ১৯-২০ বছর আগে। আমার প্রায় সব বই-ই এই ২০ বছরের মধ্যে। প্রথমে গল্প লিখতে শুরু করি। তারপরে উপন্যাস। নানা ঘটনার মধ্যে দিয়ে শুরু হয় আসলে। আমি শৈশবে লিখতাম, কৈশোরে লিখতাম, তারুণ্যেও লিখতাম। কিন্তু এক সময় লেখালেখিটা আর নেশা থাকে না। এরমধ্যে খানিকটা পেশাও ঢুকে যায়। একটা সময় পর্যন্ত আমার ধারণাই ছিলো না, আমার কাছে থেকে কোনো সম্পাদক, প্রকাশক লেখা চাইতে পারেন! এখন পাঠকদের শুভেচ্ছা, আপনার মতো মানুষ যারা পড়েন তাঁদের শুভেচ্ছায় শুধু নিজের খুশি হলে লিখব এমনটা পারি না। প্রকাশক, সম্পাদক, পাঠকদের চাপেও লিখতে হয়।

প্রশান্ত ভৌমিকঃ বাংলা সাহিত্যকে আন্তর্জাতিকভাবে কোন জায়গাটায় দেখেন?

প্রচেত গুপ্তঃ  বাঙালির গর্ব করার মতো ব্যাপার আছে দুটোই। সাহিত্য আর চলচ্চিত্র। এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। বাংলা সাহিত্য আর চলচ্চিত্র চিরকালের সেরাদের সঙ্গে লড়তে পারে। বিজ্ঞানী আছেন, শিক্ষাবিদ আছেন, চিত্রকর আছেন, হয়তো আরো কিছু আছেন খানিকটা খানিকটা। কিন্তু সাহিত্য এবং চলচ্চিত্রের মতো এতটা নেই। চলচ্চিত্রে তো সত্যজিৎ রায় একাই ২০ জনকে নিয়ে বসে আছেন। সাহিত্যে দুই বাংলা মিলিয়ে যা আছে একাই যে কারো সঙ্গে লড়াই করতে পারে। ওয়ার্ল্ড ক্লাস! ওয়ার্ল্ড স্ট্যান্ডার্ড!





      মলমাস
       অর্ঘ্যকমল পাত্র

অথচ, শীতকাল।কিন্তু কোনো
হলুদ জমেনি চরাচরে

তবু কিছু ছিল।হয়তো মদের বোতল।
হয়তো বা ভাঙা কাঁচ

এবং বুদবুদে কৃষকের পা কেটে গেলে
বেরিয়ে আসে, নির্লজ্জ রক্ত




            বৃষ্টিস্নান
   ---সৌমিত্র মজুমদার

বর্ষার জলে ভিজিয়ে নিয়েছি
      নিজের সবটুকু
তবু ভিজলো না সত্তা,
ভিজলো না অহংকার কিম্বা
হিংস্রতার চিহ্ন একটুও,
কামনার বহ্নি, না, সে-ও নয় !
ক্রমশ প্রকট হচ্ছে ভাঙ্গন-বিবর
চোরা গহ্বরে ঢুকে চলেছে--
বিষধর গোখরো'র অপরিমেয় বিষ
ধরাশায়ী সময় হয়তো নীরব এখন,
তবে সময় হলে সেও দেবে
'কৃত্রিম সভ্যতা' ধ্বংসের চরম উত্তর।




            ইতিহাসের খোঁজে
              সমীরণ বেরা

পৃথিবীর বুকে এক এক সভ্যতা
মানুষকে দিয়েছে বৈভব জ্ঞানের আলো
দুর্দশা অন্ধ বিশ্বাস সংস্কার,
আমি সেই আগুন জ্বালা থেকে চাকা আবিষ্কার
দাস প্রথা সতীদাহ থেকে নব যুগের আলোয়
প্রয়োজন আর নৈশব্দিক বিপ্লব গ্রন্থের মহাসঙ্গীতময়
এক এক সময় নিজেকে কীটের মত মনে হয়।
আবার কখনো অমৃতের পুত্রের তেজস্বিতায়
অন্য কোন বোধে অন্য আমির জন্ম দেয়।

ক্ষণকালীন সেই জন্ম আর মৃত্যুর মাঝেই আমি বেড়ে উঠি
আমিই দেখেছি আমার দু চোখে যোগ্যহীন সাফল্যের চূড়ায়
আমিই দেখেছি দাবার চালের মত অযোগ্যের কিস্তিমাত
প্রতিভার আলো জ্বেলে কেমন করে বিপথে চালিত হয়
এ আর এক পদ্ধতিগত যান্ত্রিক সভ্যতার বিষের বীজ
আমি দেখেছি আমার এই দু চোখে কী নিদারুণ ভাবে
ওরা মরে আর ওরা মারে; দিনের শেষে ওরাই হাসে!
তাই ইতিহাসের সভ্যতার আলো এ যুগে অন্য মানে ।

এই যুগের ইতিহাসও তো একদিন লেখা হবে!
সেখানে কি থাকবে গভীরতর ষঢ়যন্ত্রের প্রতিচ্ছবি?
আমি বা আমরা তো ক্ষুদ্র মানুষ যুগে যুগে এমনি অবহেলিত
ইতিহাস রাজার কথা বলে এক সাম্রাজ্যের পরে আর এক সাম্রাজ্য
আমরা তো নেহাত ক্ষুদ্র পাতার মত
তাই আমাদের ঝরে যাওয়া আর গজিয়ে ওঠা সমার্থক
আমাদের হতে চাওয়া আমাদের আকাঙ্ক্ষা সব কিছু
চাপা পড়ে যায় বালির স্তূপে পাথরের ভাঁজে
কোন জীবাশ্ম খুঁজে পেলে একবার পরীক্ষা করে দেখো তো
তার অস্তিত্বের বিবরণ নয় তার বুকের দীর্ঘশ্বাস
তোমরা কি আগামীতে এই ইতিহাসের খোঁজ পাবে?




        নোনতা সংলাপ
       আশিষ মজুমদার

তারপর, অন্তহীন পথ; নির্জন রাস্তা
ঘনিয়ে আসা একরাশ মৌনতা
দ্বিধাগ্রস্ততায় রুদ্ধ আবেগ
অত:পর নোনতা সংলাপ
নির্বাক সংলাপে আক্ষেপ - "চিনেছ কি আমাকে?"
দহন সংলাপ পুষে রেখেছি হৃদয়ে l
নির্জন দিগন্ত খোঁজে মম দহন জ্বালা l
সংকীর্ণতার প্রাচীর দীর্ঘ পথ চলায়!
অত:পর মৌনতা খুঁজি দগ্ধ হৃদয়ে!
নোনতা পাহাড় মৌন হৃদয়ে



             মানুষী
         শার্মিষ্ঠা সাহা

একটা খাদের ধরে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় দেখাটা
আমার অভ্যাস, নিয়ম ও বলা যায়।
ওই খাদের থেকে উঠে আসে
উপেন্দ্রকিশোর এর অসংখ্য টুনটুনি,
প্রত্যেক সূর্যোদয়ের সাথে
এতটুকু একঘেয়েমি কখনও লাগেনি।
কিচির মিচিরে কখন বেলা গড়ালো,
সূর্যাস্তের সাথে বোধোদয়।
সমস্ত কায়ার ছায়া নিবিড়,অত্যন্ত রূপসী,
আমি পেঁচা নই,
আমি বাদুড় ও নই,নই নিশাচর
আমি মনুর পুত্রী, মানুষী।




                              গন্ধ
                   রামামৃত সিংহ মহাপাত্র

এরকম গন্ধ,বলা ভালো দুর্গন্ধ তাও আবার মানুষের গায়ে যে হতে পারে সে ব্যাপারে কোন ধারণা ছিল না অতসীর। হয়তো জানতেও পারতো না এখানে স্কুলের চাকরীতে জয়েন না করলে। পুরাণে পড়েছে, রূপকথার গল্পে শুনেছে সেকালের সুন্দরী নারীদের গা থেকে সুন্দর গন্ধ বের হতো। কারও কারও গায়ে দুর্গন্ধও বের হতো অবশ্য,যেমন সত্যবতী। ওর গা থেকে বেরোতো মাছের গন্ধ,যদিও পরাশর মুনির বরে সেই গন্ধ সুরভিত হয়ে ওঠে। কিন্তু এসব সেই সময়ে হতো, এখন তো আর মানুষ চাইলেই গায়ের গন্ধ বদলে ফেলতে পারে না। ফলে সতীশের গায়ের এই গন্ধটা বদলে ফেলার কোন উপায় নেই। সতীশ অতসীর মতোই মুনিয়াডাংগা আপার প্রাইমারী স্কুলের সহ-শিক্ষক।  জয়েন করার দিনই স্টাফরুমে বসে গন্ধটা টের পেয়েছিল অতসী। কিন্তু গন্ধটাকে ওর জানা  কোন গন্ধের সঙ্গে মেলাতে পারছিল না। না,ঘামের বোঁটকা গন্ধ নয়, কোন কিছু পচে যাবার গন্ধও নয়। গন্ধটা স্টাফ্রুমে ছড়িয়ে পড়ে সতীশ এসে ঢুকতেই। ওর চোখমুখের অস্বস্তি দেখে স্নিগ্ধা,ওর স্কুলের অন্য একজন শিক্ষিকা বলে,'ওটা সতীশ স্যারের গায়ের গন্ধ।'

-ওনার গায়ে এরকম দুর্গন্ধ কেন? বডি স্প্রে লাগাতে পারেন তো?

-কাজল দি তো প্রায়ই বলেন ,'ভাই সতীশ গায়ে একটু সেণ্ট ফেন্ট লাগিয়ে স্কুল এলেই তো পারো?

-লাগাই তো

-তা সত্ত্বেও গন্ধ যায় না

-ভাল করে সাবান দিয়ে চান করবে

-তাও করি

-তাও যায় নি

-না।

-ডাক্তার দেখাও, বলা তো যায় না কোন স্কিন ডিজিজের কারনেও হতে পারে। আসলে গায়ে এরকম গন্ধ থাকলে কোন মেয়ে তোমার কাছে ঘেঁষবে না।বিয়ে সাদি করবে কী করে? এটা অবশ্য একটা সমস্যা। তবে এই সমস্যাটা নিয়ে সতীশ যে খুব একটা দুর্ভাবনা দেখিয়েছে এমনটাও নয়। বরং কাজল দি সহ অনান্যরা যতটা ভেবেছে সতীশ তার বিন্দুমাত্র ভেবেছে বলে মনে হয় না। তবে একটা ব্যাপার নিয়ে ও ভেবেছে, যেহেতু এই গন্ধটা স্টাফ্রুমের সবার অস্বস্তির কারন হয়ে দাঁড়ায় তাই পারতপক্ষে চেষ্টা করে যাতে স্টাফ রুমে না ঢুকতে হয়। কেউ বারণ করেছে এমনটা নয় নিজের থেকেই ঢুকে না। স্টাফ রুমের বাইরে একটা ফাইবারের চেয়ারে চুপচাপ বসে বই পড়ে। কখনো কখনো উদাস মনে আকাশের দিকে চেয়ে থাকে। ব্যাস গায়ের গন্ধটুকু খারাপ ,অতসী অন্য আর কোন কিছুই খারাপ দেখতে পায়নি সতীশের মধ্যে। ক্লাসে খবর নিয়ে দেখেছে জলের মতো সহজ করে অংক বোঝাতে পারে ও। দেখতেও তেমন মন্দ নয়। লম্বা, চওড়া কাঁধ, মেদহীন পুরুষালী শরীর।

আর সবচেয়ে আকর্ষণীয় দুটো চোখ। বহুবার সতীশ কে দেখে অতসী,তবে সরাসরি নয়,এক্টু লুকিয়ে। হয়তো সতীশ উদাস ভাবে আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে আছে, ক্লাস নিয়ে হেঁটে হেঁটে ফিরছে অতসী,সেই সময় এক দৃষ্টিতে,বসে থাকা সতীশের দিকে তাকিয়ে হাঁটছে অতসী। দু একবার চোখাচোখি হয় না এমনটা নয়। তবে মুহূর্তে চোখ নামিয়ে নিয়েছে অতসী। পরক্ষণেই চোখ তুলে চেয়ে দেখেছে ওর চেয়ে বেশি লজ্জার আভা ছড়িয়েছে সতীশের চোখেমুখে। আসলে অন্যকিছু নয় ঐ গন্ধটাই অতসী কে আগ্রহী করে তুলেছে সতীশের প্রতি। কিন্তু শুধুমাত্র গন্ধের জন্য তো আর লোকটার বাকি গুন গুলোকে অস্বীকার করা যায় না। আর অতসী তা করতেও চায় না,তাই একদিন সরাসরি কথা বলল ওর মেয়ের জন্য।মেয়ে টুকাই কে এই স্কুলেই ভর্তি করেছে ক্লাস সিক্স এ। এছাড়া আর অন্য উপায় ভেবে পায় নি অতসী। পাঁচজন শিক্ষক শিক্ষিকার তিন জন আসেন জেলাসদর বহরমপুর থেকে।এখান থেকে প্রায় পয়ষট্টি কিলোমিটারের রাস্তা। এখানে চাকরিটা পাবার পর অতসী প্রথমে ভেবেছিল ওদের মতো বহরমপুর থেকে যাতায়াত করবে। কিন্তু টুকাইকে কার কাছে রেখে আসবে?তাই ভবনাচিন্তাকরে এই মুনিয়াডাংগা গ্রামে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। গ্রাম টা খারাপ না কিন্তু পড়াশোনার পরিবেশ সেরকম নেই। এখানে আসার পর থেকে টুকাইয়ের জন্য একজন ভালো অংকের মাস্টারমশায় খুঁজছে কিন্তু পাচ্ছে না। টুকাই পড়াশোনা খারাপ করে না,তবে একটাই দোষ অংক কিছুতেই করতে চায় না।ওর জন্যেই সতীশের সঙ্গে কথা বলবে বলে অপেক্ষা করছিল অতসী।যাবার তাড়া থাকে বলে ছুটির ঘণ্টা পড়লে কেউ আর দাঁড়ায় না।তবে সতীশের তাড়া নেই।ও এই গ্রামেই থাকে।নিজের বাড়ি করেছে।বুধবার ক্লাস এইটে লাস্ট পিরিয়ড ক্লাস থাকে সতীশের।ছুটির  ঘন্টা পড়ার প্রায় মিনিট দশেক পরে ক্লাস থেকে বেরিয়ে এলো সতীশ।হেলতে দুলতে হেঁটে আসছে স্টাফ রুমের দিকে ।স্টাফ রুমের বাইরে সাইকেল থাকে ওর।স্টাফ রুমের বাইরের  বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল অতসী ।সতীশ কাছে আসতেই  অতসী বলে, ' আপনার সঙ্গে  একটু কথা ছিল'।শুনে কিছুটা বিস্মিত হয় সতীশ ।স্টাফ রুমের কারও বিশেষত কোন দিদিমণির যে ওর সঙ্গে দরকার থাকে  এটা ভাবতে পারে না সতীশ ।তাই বিস্মিত গলায় জানতে চায়, ' আমার সঙ্গে? '

-হ্যাঁ, বলছিলাম আমার মেয়েটাকে  অঙ্কটা একটু দেখিয়ে দিতে হবে ।

-না মানে আমি তো টিউশন পড়াই না

-আসলে কি বলুন তো, ও পড়াশোনা ভালোই করে অঙ্কটাতে কিছুতেই ভীতি কাটাতে পারছি না।আমিও বেশিরভাগ  অঙ্ক ভুলে গেছি ।মেয়ের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি  আপনার  অঙ্কের ক্লাস  ওর খুব পছন্দ ।

-কিন্তু জানেনই তো আমার গায়ের গন্ধের ব্যাপারটা।যদি কোন অসুবিধা হয়।কিন্তু কিন্তু করে কথাটা বলে সতীশ ।এবার থমকায় অতসী।অনুভব করার চেষ্টা করে গন্ধটা।আশ্চর্য হয় ভেবে গন্ধটা  প্রথম দিনকার মতো উৎকট নয়।কারণটা খুঁজে পায় না ।ভাবে তবে কি কোন কারণে গন্ধ দূর হতে শুরু করেছে?

-না না ওটা কোন অসুবিধার কারণ হবে না ।টুকাই কে জিজ্ঞেস করেছি বিশ্বাস করুন ওরা কিন্তু আপনার গায়ের কোন গন্ধ পায়না।তবুও সতীশ  কিছু বলছে না দেখে গলাদা খাদে নামিয়ে বলে, 'অঙ্কের টিচার খুঁজছি আসার পর থেকেই, কিন্তু পাচ্ছি না ।মাঝে মাঝে খুব দুশ্চিন্তা হয় মেয়েটাকে নিয়ে ।কথাটা শুনে অতসীর দিকে তাকায় সতীশ।শূন্য স্কুল নতুন গড়ে ওঠা চারটি রুম দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ।ছাত্র ছাত্রীরা  চলে গেলে ফাঁকা স্কুল ক্যাম্পাস বড্ড শূন্য শূন্য লাগে।শেষ বিকেলের আলোয় বড্ড বিষন্ন লাগে অতসীকে।ওর মনখারাপ করা মুখের দিকে তাকিয়ে সতীশ আর বেশি কিছু বলতে পারে না ।বলে 'বেশ তাহলে পড়াবো।'

-আপনাকে কী বলে যে ধন্যবাদ দেবো।আপ্লুত হয়ে বলে অতসী ।

-না না এতে ধন্যবাদ দেবার কী আছে?পড়ানোই তো আমার কাজ।বিনয়ী হয়ে বলে সতীশ।

-চলুন এবার বাড়ি ফিরতে হবে।মেয়ে অপেক্ষা করছে ।মাঝে সাইকেল দুপাশে অতসী আর সতীশ ।গ্রাম্য মোরাম ঢালা রাস্তা ।দুপাশে ফাঁকা মাঠ ।এবার বৃষ্টি নেই তাই খাঁ খাঁ করছে চারধার।চাষীরা ধান লাগাতে পারেনি ।পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে অতসী টের পায় সতীশের গায়ের গন্ধটা।কিন্তু সরে যেতে পারে না ওর পাশ থেকে।কিছুদূর গিয়ে রাস্তা দুভাগ হয়ে গেছে ।এখান থেকেই দুজনার পথ বেঁকে যাবে দুদিকে।পৃথক হবার আগে মোড়ের মাথায় দাঁড়ায় দুজনে।অতসী জেনে নেয়, ' আজ থেকে আসছেন তো?'

হুম ।নিজের পথ ধরে অতসী।অতসীর চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সতীশ ।বারবার পিছন ফিরে সতীশকে দেখে অতসী।ও দাঁড়িয়ে আছে দেখে বুকের ভেতর টা কেমন করতে থাকে অতসীর।মনে হয় একটা মনখারাপ বুকের ভেতর থেকে উঠে এসে বিষন্ন করে তুলছে পুরো পরিবেশ।

   এরকম আদরযত্ন করে সতীশকে কেউ এর আগে খেতে দেয়নি।পড়াতে এসে প্রায় দিনই রাতের খাবার খেয়ে ফিরতে হয় সতীশকে।বিশেষত সেদিনের পর থেকে যেদিন অতসী জানতে পেরেছে সতীশ ছাড়া এপৃথিবীতে সতীশের আর কেউ নেই ।সেদিন সন্ধে থেকে বৃষ্টি নেমেছিল। এই বর্ষার প্রথম বৃষ্টি। আর পড়তে চাইছিল না টুকাই।একটু দূরত্ব থেকে গল্প জুড়ে  অতসী।'টুকাই অঙ্ক  কেমন পারছে স্যার?'

-পারে তো

-একটু দেখবেন। আসলে জানেনই তো  আমি ছাড়া ওর আর কেউ নেই।টুকাই এর ব্যাপারে বেশিকিছু জানে না সতীশ। আসলে অন্যের ব্যাপারে ওর তেমন একটা আগ্রহ নেই।কিন্তু অতসী সেদিন নিজের থেকেই বলেছিলো সব কথা ।বলেছিলো, 'ওর বাবা যখন মারা যায়  টুকাইয়ের বয়স তখন দুবছর।ছত্তিশগড়ে পোস্টিং ছিল ।দিন দুই পরে ছুটি নিয়ে বাড়ি আসার কথা ছিল।মাওবাদীরা সি আর পি এফ এর একটা কনভয় উড়িয়ে দেয়।সেই কনভয়ে ওর বাবাও ছিল।কথা গুলো বলতে বলতে গলাটা আটকে আসে অতসীর।একটু থামে ।দুঃখ গিলে বলতে শুরু করে 'চোখ বন্ধ করলে এখনো চোখে ভেসে ওঠে আমার শ্বশুরবাড়ির শ্মশান ঘাট টা।জাতীয় পতকায় মোড়া মৃতদেহ ঘিরে রেখেছে  জংলা পোশাক পরা ওর সহকর্মী আর অফিসারেরা।গ্রাম ভেঙে লোক এসেছিলো দেখতে।সব হারিয়ে টুকাইকে কোলে নিয়ে এক কোনে অন্ধকারে মিশে যাচ্ছিলাম আমি।চমকে উঠলাম তোপ ধ্বনিতে।সজোরে কাঁদতে শুরু করে টুকাই

।তোপধ্বনীর সঙ্গে সঙ্গে সব শেষ।'বলতে বলতে চোখের জলে ভরে ওঠে অতসীর চোখ।হঠাৎ সচকিত হয়ে ছুটে যায় টুকাইয়ের আর্তনাদে।পিছন পিছন সতীশ ।গিয়ে জড়িয়ে ধরে টুকাইকে 'কি হলো রে মা?'

-মাকড়সা

-তো কি হয়েছে? মাকড়সা কী করবে তোর

-ভয় লাগছে মা

-মাকড়সা কিচ্ছু করতে পারবে না। বলে সতীশ।

-কিন্তু স্যার যদি কামড়ে দেয়

-মাকড়সা কামড়ায় না

-যদি জালে আটকে ফেলে

-ধুর বোকা ঐ টকু জালে মানুষ কখনো আটকা পড়ে? ওটা তো ওদের শিকার ধরার জাল। দুজনকে গল্প করতে দেখে মনটা ভালো লাগে অতসীর।বলে 'অনেকটা দেরী হয়ে গেলো আজ তাহলে এখানেই খেয়ে যাবেন।'

-না না তা কেন?আপনি শুধু শুধু আমার জন্য কষ্ট করতে যাবেন কেন?

-আমার কোন কষ্ট হবে না। তবে সেদিন খেতে খেতে শুনেছিল সতীশের কষ্টকর জীবনের কথা। জানতে চাইতে হয় নি নিজেই শুনিয়েছিল আতসীর দুঃখের কথা শুনে। টূকাই কে আগেই খাইয়ে দিয়েছিল খাবার পর নিজের মতো সময় কাটাচ্ছিল টুকাই। খাবার বেড়ে একটা চেয়ার টেনে পাশে বসেছিল অতসী। স্টাফ রুমে যে যাই ব্লুক সতীশের গায়ের তীব্র গন্ধটা তটতা আর অসহনীয় লাগে না আতসীর।মনে হয়েছিল হয়তো সবই অভ্যাস। ওর পাশে বসে শোনাচ্ছিল টুকাইয়ের বাবা মারা যাওয়ার পরবর্তী ঘটনা। 'ওর বাবা মারা যাবার পর প্রথম আঘাতটা আসে আমার শ্বশুর বাড়ি থেকে। সরকার থেকে যা ক্ষতিপূরণ দিয়েছিল ওরা চেয়েছিল সবকিছু আমার দেওয়ের নামে করে দি।রাজী হইনি।সরাসরি বলেছিলাম টুকাইয়ের ভবিষৎ নেই?

-টুকাই কে কি ওর কাকা ফেলে দেবে

-বলা যায়,এখন ওর কাকার সংসার হয় নি।হলে তখন? তাতেও দমে না ওরা। দেওরকে বিয়ে করার জন্য আমাকে প্রস্তাব দেয় ।রাজী না হতে চাপ দিতে থাকে।তখন শ্বশুর বাড়ী ছেয়ে বাবা মায়ের কাছে চলে আসি।আমার দাদা প্রস্তাবটা দেয়,'তোর তো ইংরেজীতে অনার্স ছিল,চেষ্টা করে দেখ না এস এস সি তে লাগাতে পারিস কিনা?'

-সাবজেক্টের সঙ্গে যে অনেকদিন কোন যোগাযোগ নেই রে দাদা।

-তাতে কি হয়েছে, করে নে চেষ্টা করলে নিশ্চয়ই পারবি।চেষ্টা করেছিলাম, টুকাইয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে ।পেয়ে যেমন  আনন্দ হয়েছিল তেমনি  ভয় পেয়েছিলাম এতদূরে চাকরি করতে আসতে হবে ভেবে। তবে এসে আপনাদের পেয়ে ভয়টা কাটতে শুরু করেছে জানেন।মেয়েটাও নিজের মতো জীবন পেয়েছে একটা।ঝপ করে  অন্ধকার নেমে আসে ।লোডসেডিং।টুকাই  ছুটে বসে বসে পড়ে অতসীর চেয়ারে।অতসী উঠে যায় মোমবাতির খোঁজে।মোমের আলোয় নিজের কথা বলে যায় সতীশ ।'শুধু  টুকাই নয় ওকে পড়াতে এসে আমিও একটা অন্য জীবন খুঁজে পেয়েছি জানেন।একটা সময়ে এই জীবনটাকে বাঁচিয়ে রাখার কোন মানে খুঁজে পেতাম না ।যখন ক্লাস সেভেন  এ পড়ি সেইসময় খুন হন আমার বাবা।

-খুন। অ্যাঁৎকে ওঠে অতসী।

-হ্যাঁ।বাবা ছিলেন সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী ।দলের লোকেদের সঙ্গে মতভেদ হওয়ায় খুন হয়ে যান বাবা।বাবা মারা যাবার পর কথা বন্ধ হয়ে যায় মায়ের।মাকে বাঁচিয়ে রাখার লড়াই শুরু হয় আমার।দিনমজুরি করে পড়াশোনা করেছি পেটের ভাত জোগাড় করেছি ।কেউ কোনদিন  একটু সহানুভূতি দেখায় নি।ভালোবাসার কোন লোক ছিল না ।ভালোবাসা না পেয়ে পেয়ে জীবনের প্রতি মায়া হারিয়ে ফেলেছিলাম।বলতে বলতে থামে সতীশ ।অতসী বুঝতে পারে সতীশের গা থেকে  বেরোনো গন্ধটা ভালোবাসা না পাবার গন্ধ।নিশ্চুপ সতীশ মুখ খোলে অতসীর কৌতূহলে 'আপনার মা কি এখানে আপনার সঙ্গে থাকেন?'

-না

-তবে?

-আমি যেদিন আমার চাকরি পাবার খবর পাই, ছুটে গিয়েছিলাম ঘরে মাকে জানাবো বলে।ছেলের আনন্দের খবরে মা যদি হারিয়ে যাওয়া ভাষা খুঁজে পান সেই আশায়।গিয়ে ভাষা হারিয়ে ফেলি আমি।দেখি ফেন থেকে ঝুলছেন মা।বলে স্তব্ধ হয়ে যায় সতীশ।নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকে অতসী।অনেকক্ষণ পর সতীশ বলে 'কার জন্য বাঁচবো বলতে পারেন ?'ছলছল চোখে  অতসী তাকায় মাথা নিচু করে বসে থাকা সতীশের দিকে।মৌনতা ভঙ্গ করে টুকাই, 'কি হলো স্যার আপনি কাঁদছেন কেন?'কোনো কথা  বলতে পারে না সতীশ।টুকাইক জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে ওঠে ।সঙ্গে সঙ্গে  ইলেকট্রিক এসে আলোয় ভরে দেয় ওদের ছোট্ট ঘরটাকে।অতসী খেয়াল করে অদ্ভুত ভাবে বদলে গেছে সতীশের গায়ের গন্ধ ।গন্ধ বদলে যাবার ব্যাপারটা পরেরদিন টের পায় পুরো স্টাফরুম।সেটা বোঝা যায় আলোচনা আর ফিসফিসানি তে।সেদিন বর্ষা ঢোকে মুনিয়াডাংগায়।স্কুল শেষে বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য  অতসী নিজের ছাতার তলায় ডেকে নেয় সতীশকে।একই ছাতা আশ্রয় করে পাশাপাশি হাঁটতে থাকে দুজনে। বৃষ্টি সব গন্ধ ভাসিয়ে নিয়ে গিয়ে জাগিয়ে তোলে একটা অদ্ভুত ভালোলাগার গন্ধ।ভালোবাসার গন্ধ







          ধ্বংস
   হীরক বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রেম ভালোবাসা তো অনেক রকম
অথচ তুমি একজন ই
তোমার প্রাসাদ ঘরে উঠে যাই নেমে আসি
তুমি বুঝি দেখেও দ‍্যাখোনা
শিরা উপশিরা শক্ত করে বাধি
অথচ এতদিন জেনেছি
তুমি ই বিস্ফোরণ
সোম তুমি হোম তুমি, তুমি ঘৃতাহুতি দিতে আসা আত্মজন,দিন ও রাত্তিরে সাপে আর নেউলে
চোর আর গেরস্তে
অবিস্মরণীয় পাঠ উপর নীচে দুদিকেই জ্বলো
আর সব কাম ধ্বংস হয়ে যায়...






                   প্রীতিকাতরতা
                সোমনাথ মুখার্জী

সব তুমি এভাবে মুছে দেবে
সে কথা প্রেমের ঘাসজমিতে সেভাবে বলোনি তুমি,
নিরুপমা। বাদাম,চাঁদের অলস আলো, ফেসবুক, অন‍্যান‍্য যন্ত্রজাদু, কেউ আর কার‌ও ন‌ই। মৃত্যু শিয়রে ঠিকই---
তবুও, প্রেম এক শব্দময় প্রঞ্জা। মৃত্যুভয়  তোমায় এভাবে বদলাবে ভেবে,
বড় কষ্ট বুকের গাছেদের। ডালপালা ভেঙে যায়, পাখি বদল করে বাসা, নির্ভরতা নীরবে ভাঙে। আমি আজ‌ও--
সরল ভালোবাসায় বাঁচি, তুমিও এসো রাত শেষ হলে,
ভোরের অলৌকিক প্রীতিছন্দে।
           





দাড়াও তীর্যক
শ্যামসুন্দর মন্ডল


আমি পীঠ পেতে দিচ্ছি
বাতাস,বন্ধ কর তোমার হাত বাড়ানো।
বৃষ্টিকে সম্পূর্ণা হতে দাও উলম্বপ্রবাহে।


পুবের মাঠে ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতা।
সুতোর উন্নতিকোন মেপে গোপন ঈর্ষায়
সুতোর বাড়ায় ইন্ধন যুগিয়ে মাটিতে ঘুড়ির ছায়া ফেলার চেষ্টা।
ছায়া পড়ে না,অন্তত ঘুড়ি যতক্ষন উড়তে থাকে।

এরপরে ও কৌশল!
বন্ধ করো সব।
দাঁড়াও তীর্যক,উন্নত কর শির,বাড়াও তোমার হাত।






      যো ওয়াদা কিয়া ওহ....
         সপ্তর্ষি মন্ডল 

এই দেশ , এই মাটি , এই পৃথিবী
এক ঐক্যের সুর

এই সাম্রাজ্য বিশাল আন্তরিকতার
এক ভাতৃত্বে গাঁথা ।

তবু দানব আছে , সর্ষের মধ্যেই
গদি যাদের লক্ষ এক

সাধারণ মানুষ মরছে মরুক
ধর্ম যে ওদের চোখে বহু ।

কোনদিন গীতা চিনেছো , পড়েছ কুরানের আয়াত
কোনদিন মসজিদ গেছিলে হুজুর ,
লাগিয়েছ মন্দিরে সাত পাক ?

না , কোনটাই করোনি তাই
বিষে লিখেছো ভাই ভাই

ভেদের আগুন জ্বেলে
চিনতে চেয়েছ মানুষ পোশাকে ।

বাইরে দেখো চেয়ে , অর্থের পাতা ঘেঁটে
ঘোর অধঃপতন সরেজমিনে ,
যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার ছলে ।

গদির লোভ সর্বনাশি
বিধাতার ঠোঁটে দেখবে ওই বক্র হাসি
পনেরো লক্ষের হিসাব , চাইবে যখন হিন্দু মুসলমান ।

হে রাজন ,
যো ওয়াদা কিয়া ওহ নিভানা তো পরেগা ...





           দোস্তি..!
      অমিত পন্ডিত

তার চোখের হজম শক্তি জানে
আমি শূন্য হয়েছি নেমেছি জাহান্নামে..

আমি সকাল হয়েছি, সন্ধ্যা হয়েছি, রাত্রি হয়েছি নির্দিধায় নির্জনে
আমি চিবানো হয়েছি, গেলা হয়েছি, হজম হয়েছি তার সব খানে..

সে আমার আকাশ পাতাল চিনে
স্বর্গ, নরক প্রতিরাতে দাম দিয়ে নিয়েছে কিনে

... আমি ১০.. ৯.. ৮.. করে শূন্য হয়েছি প্রতিদিনে
সেই শুধু এ জন্মের বর্ধিত ব্লাড গ্রুপ আমার জানে..





         এহেন স্বপ্ন দেখে যে মেয়ে
            আবদুস সাত্তার বিশ্বাস
         
প্রতিদিন বিকেলে ঘাটের ধারে মন্দিরের পিছনে কয়েকজন ছেলে বসে।তরুণ ছেলে।সেখানে তারা আড্ডা দেয়।চায়ের দোকানের বেঞ্চে বা মাচানে বসে গুণ্ডা মার্কা লোকেরা যে ধরনের আড্ডা দেয় সেরকম আড্ডা নয়।সাহিত্য আড্ডা।এখানে রোজ একজন করে তরুণ স্বরচিত কবিতা ও গল্প পাঠ করে শোনায়।অর্থাৎ যার যেদিন পালা পড়ে।আর অন‍্যরা তা শুনে মতামত দেয়।শুনে যাকে যেমন লাগে সে তেমনটিই জানায়।সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে সাহিত্য আড্ডা যদিও এখন আর এভাবে বসে হয় না বললেই চলে।কিন্তু এখানে হয় দেখে ভালো লাগল।যাইহোক,আজ অমরেন্দ্রর পালা। অর্থাৎ অমরেন্দ্র আজ তার স্বরচিত লেখা পাঠ করে শোনাবে।অমরেন্দ্র আড্ডায় এসে বসতেই অন‍্যরা তাই বলতে লাগল,"অমরেন্দ্র দা,আজ কিন্তু আপনার পালা।মনে আছে তো?"
"মনে আবার থাকবেনা?খুব মনে আছে।আজ একটা গল্প পাঠ করবো।"অমরেন্দ্র গল্প-কবিতা দু-রকমই লেখে বলে কথাটা বলল।
সবাই খুশি হয়ে বলল,"খুব ভালো হবে।"
পরে কমল নামে একজন বলল,"দাদা,আপনার গল্পের মাধুর্যই আলাদা।তাই আপনার গল্প শুনতে আমাদের সবার খুব ভালো লাগে।আপনি যে আজ গল্প পাঠ করবেন এটা আপনি না বললেও আমরা কিন্তু আপনাকে আজ একটা গল্প পাঠ করতেই বলতাম।আপনি আসার আগে আমাদের এ বিষয়ে কথাও হয়েছে যে,আপনাকে আমরা আজ কবিতা নয়,একটা গল্প পাঠ করতে বলবো। রিয়েলি,দাদা।বিশ্বাস না হয় আরো যারা আছে তাদের জিজ্ঞেস করুন!"
অমরেন্দ্র জিজ্ঞেস করল না।কিন্তু জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মেলে সবার মুখের দিকে তাকালো।সবাই তখন ওই কথাটাই বলল।যে কথাটা কমল আগে বলেছিল।

দুই

সবার যখন ইচ্ছা অমরেন্দ্র তখন একটা গল্প পাঠ করবে।সে প্রস্তুত।ঠিক এইসময় তার মোবাইলটা বাজতে শুরু করল,"তেরি মেরি কাহানি..." মানে ফোন এল।ফলে অমরেন্দ্র গল্প পাঠ শুরু না করে আগে ফোনটা ধরলো,"হ‍্যালো!"
"কে,অমরেন্দ্র দা বলছেন?"
"হ‍্যাঁ,বলছি।"
"আমি সবিতা বলছি।"
এই সবিতা মেয়েটা হল অমরেন্দ্রর বোনের বান্ধবী। অমরেন্দ্রর বোন কঙ্কনা কিছুদিন আগে তাকে একবার তাদের বাড়িতে বেড়াতে এনেছিল।তখনই সবিতার সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছিল।অমরেন্দ্র তাদের বাড়িতে তাকে প্রথম দেখে চিনতে না পেরে কঙ্কনাকে জিজ্ঞেস করেছিল,"এটা কে রে,কঙ্কনা? চিনতে পারলাম না।"
কঙ্কনা বলেছিল,"আমার বান্ধবী।নাম সবিতা।"
অমরেন্দ্র বলেছিল,"ও,আচ্ছা।"
কঙ্কনা তখনই অমরেন্দ্রর সঙ্গে সবিতার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল,"আর সবিতা,এ হল আমার দাদা।নাম অমরেন্দ্র সরকার।খুব ভালো লেখে। দাদার লেখা পড়লে তুই মুগ্ধ হয়ে যাবি।এত ভালো লেখে!"
সবিতা তখন অমরেন্দ্রকে প্রণাম জানিয়ে পরে বলেছিল,"তাই নাকি,দাদা?"তারপর জিজ্ঞেস করেছিল,"কি লেখেন?"
অমরেন্দ্র নীরব ছিল।তার নীরব থাকা দেখে কঙ্কনা নিজে বলেছিল,"দাদা বলবেনা,আমি বলছি।"বলে সে বলেছিল,"দাদা গল্প,কবিতা,উপন্যাস সব রকমই লেখে।খুব ভালো লেখে।"
অমরেন্দ্র তখন কঙ্কনাকে বলেছিল,"সেই তখন থেকে তো খুব ভালো লেখে ভালো লেখে করছিস।তুই কি আমার লেখা পড়েছিস?"
কঙ্কনা বলেছিল,"পড়িনি তো এমনি বলছি?"
অমরেন্দ্র বলেছিল,"মিথ্যা কথা বলার জায়গা পাস না?কবে পড়লি?"
কঙ্কনা তখন বলেছিল,"বিকালে তুই যখন  বাড়িতে থাকিস না।সাহিত্য আড্ডায় বেরিয়ে যাস।আমি তখন তোর লেখা গুলো বসে বসে মন দিয়ে পড়ি! কি সুন্দর লাগে পড়তে!তোর লেখা পড়ে কতদিন আমার কি মনে হয়েছে জানিস?তুই আমার নিজের দাদা না হয়ে যদি সবিতার দাদা হতিস বা রক্তের সম্পর্ক ছাড়া পাড়ার কেউ হতিস তো আমি তোর নির্ঘাত প্রেমে পড়ে যেতাম।"
অমরেন্দ্র অমনি চমকে উঠেছিল শুনে,"কি বললি!"
কঙ্কনা বলেছিল,"হ‍্যাঁ রে দাদা,ঠিকই বলছি।তোর লেখায় যা আবেগ আর অনুভূতি!"
সবিতা তখন চুপ করে বসে তাদের দুই দাদা বোনের কথা শুনছিল।কঙ্কনা আর অমরেন্দ্রর। আর মাঝে মাঝে অমরেন্দ্রকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল।সবিতাকে অমরেন্দ্র তখন বলেছিল,"তুমি কঙ্কনার কথা একদম বিশ্বাস করবেনা,সবিতা।ও কি বলতে কি যে কখন বলে ফেলে ও নিজেই জানেনা।তাইতো আমরা ওকে ক্ষেপী বলি।আমি মোটেও ভালো লিখতে পারিনা।মনের খোরাক মেটানোর জন্য মনে যখন যা আসে তাই তখন লিখি মাত্র।কিন্তু সেগুলো মোটেও ভালো লেখার মধ্যে পড়ে না।তবে আমাদের একটা সাহিত্য আড্ডা হয়।সেই আড্ডায় অনেকেই  খুব ভালো লেখে।"
সবিতা তার উত্তরে তবু স্মিত হাস‍্য মুখে বলেছিল,"আপনি বললেও আপনার কথা বিশ্বাস করবো না।কঙ্কনার কথাই বিশ্বাস করবো।"
অমরেন্দ্রও বলেছিল,"তা তো করবেই।তোমরা দু-জন এক যে।আর আমি পর যে।"অমরেন্দ্র এমন ভাবে কথাগুলো বলেছিল যে,সবিতা ভীষণ মজা পেয়েছিল।তার পাতলা ঠোঁটের মিষ্টি হাসি দেখে অমরেন্দ্র সেটা বুঝতে পেরেছিল।আজ সবিতার ফোন পেয়ে অমরেন্দ্রর সেসব কথা সব মনে পড়ে গেল।কিন্তু অতীতের সেসব কথা সে এখন ফোনে কিছু বলবে না।কিচ্ছু বলবেনা।সে শুধু বলল,"বলো।"
সবিতা বলল,"ভালো আছেন?"
"হ‍্যাঁ,ভালো আছি।"অমরেন্দ্র বলল,"তুমি ভালো আছো?"
"চলে যাচ্ছে।"সবিতা বলল,"আপনার নাম্বারটা কঙ্কনার কাছে নিলাম।"
"বেশ,কি খবর বলো।"
সবিতা বলল,"দারুণ খবর!একটা দারুণ খবর!"
অমরেন্দ্র কিছু বুঝে উঠতে না পেরে শুধু জিজ্ঞেস করল,"কি দারুণ খবর?"
সবিতা তখন বলল,"স্বপ্নে আমি শিয়ালদহ স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছি।"
অমরেন্দ্র জিজ্ঞেস করল,"স্টেশনের ভেতরে?না বাইরে?"
সবিতা বলল,"স্টেশনের বাইরে।মানে স্টেশন চত্বরে দাঁড়িয়ে আছি।"
"বেশ,দাঁড়িয়ে কি দেখলে বলো।"
সবিতা বলল,"একটা লোক।মানে একটা লোক। লোকটা দেখতে ছিপছিপে গড়ন।মাথায় বেশ লম্বা।গায়ের রং কৃষ্ণ বর্ণ।মুখে কয়েকদিন না কাটা কাঁচা পাকা দাড়ি।গায়ে ফুল শার্ট।সাদার উপর কালো দাগ টানা।আর পরনে নীল জিনস প‍্যান্ট।পা দুটো জড়ানো।সে আমার কাছে এসে বলল,"দারুণ খবর!একটা দারুণ খবর!"
আমি জিজ্ঞেস করলাম,"কি দারুণ খবর?"
লোকটা এবার তার পিঠের ব‍্যাগ থেকে একটা ম‍্যাগাজিন বের করে বলল,"এই ম‍্যাগাজিনে একটা উপন্যাস বেরিয়েছে।তরুণ লেখকের একটা উপন্যাস।বেরনোর সঙ্গে সঙ্গে পাঠক মহলে বিশাল সাড়া পড়ে গেছে।গত পঞ্চাশ বছরে নাকি বাংলার কোনো কবি সাহিত্যিক এরকম ভালো উপন্যাস লিখতে পারেননি।তাই এটাই হল দারুণ খবর।"
"তাই নাকি!"আমি একটু নড়ে দাঁড়ালাম।
"হ‍্যাঁ।"
"কি উপন্যাস?"
"আলো-অন্ধকার।"
"ম‍্যাগাজিনটা একটু দেখি!"
"না,দেখানো যাবেনা।"
"না দেখালে ম‍্যাগাজিন বিক্রি হবে?মানুষ কিনবে?"
"কিনবে কিনবে।"
"কিনবে তো একজনও কিনছে না!"
"ঠিক কিনবে।বিমান বন্দরে যখন যাবো সব বিক্রি হয়ে যাবে।পয়সা অলা মানুষ ওখানে বেশি থাকে তো।"
"ঠিক আছে।না দেখাবে লেখকের নাম তো বলবে?"
"হ‍্যাঁ,তা বলব।"
"তো বলো!"
"লেখকের নাম অমরেন্দ্র সরকার।"
"কি নাম বললে!"
"অমরেন্দ্র সরকার।"
"আচ্ছা?"
"বলুন!"
"কাছে তোমার লেখকের কোনো ছবি আছে?"
"আছে।দেখবেন নাকি?"
"একটু দেখাও দেখি!"
ম‍্যাগাজিনটা না দেখালেও সে লেখকের ছবিটা দেখাল পকেট থেকে বের করে,"এই দেখুন!"
ছবিটা হাতে নিয়ে আমি তো দেখে অবাক,এ যে আপনার ছবি।কি সুন্দর আপনি ছবিতে হাসছেন। আপনার দাঁত গুলো কি সুন্দর ঝকঝক করছে। আর আপনার গালের তিলটাও স্পষ্ট।
পরে লোকটা যখন ছবিটা আমার কাছ থেকে নিল আমি তখন বললাম,"উনি আমার পরিচিত।"
"পরিচিত!আপনার?হা-হা-হা---"আমার কথা লোকটার বিশ্বাস হল না।উপহাস করল।
আমি তখন বললাম,"হ‍্যাঁ গো,উনি আমার সত্যি পরিচিত।আমার বান্ধবীর দাদা।"
লোকটা তখন আমাকে বলল,"কি যা তা বলছেন! আপনার মাথা খারাপ হয়েছে নাকি?ইনি আপনার বান্ধবীর দাদা হতে যাবেন কেন?ইনি হলেন বিখ্যাত কথা সাহিত্যিক অমরেন্দ্র সরকার।যাঁর এখন অনেক দাম।অনেক নাম।"
"আমার বান্ধবীর দাদাও অমরেন্দ্র সরকার।তিনিও লেখালেখি করেন।এবং খুব ভালো লেখেন।"
"উনি আপনার বান্ধবীর দাদা অমরেন্দ্র সরকার। লেখালেখি করেন বলে উনি লেখক নন।আর ইনি হলেন লেখক।লেখক অমরেন্দ্র সরকার।দুটি লোক তাহলে এক হলেন?"
"কিন্তু ছবি দেখে আমি যে স্পষ্ট চিনতে পারলাম। উনি আমার বান্ধবীর দাদা।"
বিরক্ত হয়ে লোকটা এবার কষে ধমক মারলো একটা,"থামুন তো!যত্তসব!"
সঙ্গে সঙ্গে আমি চুপ করে গেলাম।গিয়ে পরে বললাম,"একটা ম‍্যাগাজিন নেবো।দাম বলো!"
"দাম দু-হাজার টাকা।"লোকটা বলল।
দাম শুনে আমি তো অবাক,"কি!একটা ম‍্যাগাজিনের দাম দু-হাজার টাকা!কি যা তা বলছ তুমি!"
"আমি যা তা বলছি না ম‍্যাডাম,আমি ঠিকই বলছি।"
"না,তুমি ঠিক বলছ না।"
"আমি ঠিকই বলছি।আপনার যদি মনে ধরে তো নেবেন।মনে না ধরে নেবেন না।"
লোকটাকে আমি তখন প্রশ্ন করলাম,"একটা ম‍্যাগাজিনের দাম কখনো দু-হাজার টাকা হয়? আমরা ম‍্যাগাজিন বুঝি কিনে পড়ি না!"
"পড়েন না তা কখন বললাম?"
"মুখে বলছ না।কিন্তু তোমার কথা শুনে সেটাই মনে হচ্ছে।যাইহোক,পাঁচশো টাকায় দেবে?"
লোকটা সরাসরি বলে দিল,"দেবোনা।"
আমি বললাম,"আর পঞ্চাশ টাকা ধরে নাও!সাড়ে পাঁচশো টাকা নাও!নিয়ে একটা ম‍্যাগাজিন দাও।"
লোকটা তখন বলল,"দু-হাজার টাকার জিনিস সাড়ে পাঁচশো টাকায়!আমার কি মাথা টাথা খারাপ হয়েছে?"
"তাহলে দেবেনা বলছ?"
লোকটা তখন বিরক্ত হয়ে বলতে লাগল,"কেন খামোখা শুধু শুধু বকাচ্ছেন বলুন তো!হবে কি হবেনা দেখেও কি বুঝতে পারেন না?"
"নাহলে কিছু করার নেই।"আমি লোকটার কাছ থেকে দূরে সরে দাঁড়ালাম।
"আপনার কিছু করার না থাকলে আমারই বা কি করার আছে বলুন!"বলে ভিড়ে কোথায় যে লোকটা হারিয়ে গেল আমি আর দেখতে পেলাম না।পেলাম না তো পেলাম না।আমার তারপর ঘুম ভেঙে গেল।"

তিন

ফোনে অনেকটা সময় চলে গেল বলে অমরেন্দ্র আজ আর গল্প পাঠ করল না।সবিতার স্বপ্নটা নিয়ে গল্পের মতো শুধু আলোচনা করল। আলোচনা শুনে সবাই বলল,"দারুণ!"তারপর অমরেন্দ্রকে জিজ্ঞেস করল,"দাদা,মেয়েটা আপনার কে হয়?"
"আমার কেউ হয়না।আমার বোনের বান্ধবী হয়।"
"মেয়েটা দেখতে?"
"রূপসী বললে খুব কম বলা হবে।"
"আইবড় তো?"
"অবশ্যই আইবড়।"
সবাই তখন অমরেন্দ্রকে পরামর্শ দিল,"এক কাজ করুন তাহলে,মেয়েটাকে ধরে বেঁধে ফেলুন!শক্ত করে ধরে বেঁধে ফেলুন!"
অমরেন্দ্র হাসলো শুনে।আজ রাত্রি ন'টার পরে তো সে এইজন্যই ফোন করবে।এহেন স্বপ্ন দেখে যে মেয়ে তাকে যে ধরে বেঁধে ফেলতেই হবে।শক্ত করে ধরে বেঁধে ফেলতে হবে।সেই বাঁধনের কথাটাই রাত্রি ন'টার পরে হবে।
                       






                       কোকিলের ডাক
                            কবিরুল

অফিসের কাজ সারতে সারতে প্রায় সাতটা বেজে গেল । পায়ের একটা খসখসে আওয়াজ শুনে মুখ তুলে দেখি রমেন দাঁড়িয়ে ।
" বাড়ি যাবেন না স্যার ? অফিসে তো আর কেউ নেই । সবাই চলে গেছে । " কথাগুলো বলেই রমেন ফাইলটা এগিয়ে দেয়।
 "  আর বোলোনা , আমাদের কন্ট্রাক্টর মৃত্যুঞ্জয় বাবুর মেয়ের বিয়ে । অনেক করে চেকটা ক্লিয়ার করে দিতে বলেছিল । তারই বিলটা রেডি করতে করতে দেরি হয়ে গেল । " আমি ফাইলটা নিয়ে আলমারিতে রাখি।
যাক্‌ সাড়ে সাতটার লোকালটা পেয়ে গেছি । আজ কেন জানি না ট্রৈনটা একটু ফাঁকা ফাঁকা । পা ছড়িয়ে বসতে যাব ট্রেনটা ছেড়ে দিল ! অমনি হূড়মুড়িয়ে একজন মহিলা সাথে বছর তিনেকের এক বাচ্চা নিয়ে একেবারে আমার উল্টোদিকের সিটটায় মুখোমুখি বসে পড়ল ! এক নজরে মনে হল মহালা  অনিন্দ্য সুন্দরী ! কিন্তু কোন শারীরিক বা মানসিক কষ্ট ওর মুখ ও শরীরে যেন আলকাতরার পোচ দিয়ে দিয়েছে । পা সরিয়ে ভালো করে বসতে গিয়ে মহিলার  সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল । বুকটা ছ্যাৎ করে উঠলো । এ মুখ যেন কতকালের চেনা ! কে !
 "  ভালো আছো অরুনদা ? আমি দূদিন কিছু খাইনি । কিছু খাওয়াবে আমায় ? সুলেখা প্রশ্ন করে।
   " দুদিন খাওনি ? কেন ? কি এমন হয়েছে যে তোমার পেটে কিছু পড়েনি ? "  আমি একটু ভয় পেয়ে ওকে প্রশ্ন করি।
        আমার কথা শুনেই সুলেখা হাউ হাউ করে  কেঁদে উঠল। আমি ট্রেনেই কিছু খাবার আর জলের বোওল কিনে তর দিকে এগিয়ে দি।   অনেক্ষণ পর চোখের জল মুছে সুলেখা একটু স্বাভাবিক হল। খেতে খেতে ও যা বলল তাতে আমি আঁতকে উঠলাম।
            অনেক বছর আগের কথা। আমি সদ্য বারো ক্লাস পাস করে কলেজে অ্যাভমিশন নিয়েছি। কেমিষ্ট্রি অনার্স। বিল্বদল স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়ছি। সুলেখার মা ঐ বাড়িতে কাজ করত। মাঝে মাঝে ও বাড়িতে  মায়ের কাজে হাত লাগাত। তখন থেকেই সুলেখাকে চিনি। গরীব ঘরের মেয়ে সুলেখা খুব মিষ্টি দেখতে ছিল। চোখগুলো অসম্ভব সুন্দর। যেন কবিতার মত!
           বেশ কিছু মাস পর উপলব্ধি করলাম আমি সুলেখাকে ভালবেসে ফেলেছি। কিন্তু সেটা প্রকাশ করতে পারছি না। একটা চাপা কষ্ট। সুলেখা আগেই বুঝতে পেরেছিল। মুখে কিছু বলেনি। স্যারও বিষয়টা টের পেলেন। উনি বেশ কড়া ধাঁচের মানুষ। কোচিং এ পড়তে এসে এইসব কিছুই পচ্ছন্দ করেন না। তাই আমাকে কোচিং ক্লাস থেকে বের করে দিলেন।
            বন্ধুরা পাশে এসে দাঁড়াল। সুলেখাকে প্রোপোজ করলাম। বেশ কিছু বছর প্রেম চলল বটে। তবে পড়াশোনা একটু হ্যাম্পার হল।
            এরপর সুলেখার পরিবার থেকে ওর উপর  বিয়ের জন্যে চাপ আসতে থাকল। আমার তখন পায়ের তলায় মাটিও নেই। বাড়িতে অসুস্থ বাবা মা। তার উপর ছোট ভাই বোন আর দিদি আছে। দিদিরও বিয়ে দিতে হবে। আমি বেশ নিরূপায় হয়ে সুলেখার কাছ থেকে দু এক বছর সময় চাইলাম। সুলেখা আমাকে ভালবেসেছিল। তবে ওর পরিবার আমাকে খুব একটা পচ্ছন্দ করত না। একেই বেকার। টিউশন ভরসা। তাছাড়া আমার বাড়ি ঘরের অবস্থা ভাল ছিল না।
            সব মেয়েই চাই শ্বশুড়বাড়ি একটু গোছানো স্বচ্ছল হোক। সুলেখা সব দিক ভেবে আস্তে আস্তে আমার ছীবন থেকে সরে আসল। তারপর ওর বিয়ে ঠিক হয়।
            এরপর আট   বছর কেটে গেছে।  আমি অনেক কষ্টে একটা সরকারী চাকরি পায়। একদিন বিল্বদল স্যারকে প্রণাম করতে গিয়ে শুনি সুলেখার সাথে ওর স্বামীর সেপারেশন হয়ে গেছে।  দুজনের রেজিষ্ট্রি হয়েছিল। এক ছাদের নীচে থাকতে শুরু করলেও আনুষ্ঠানিক বিয়েটা হব হব করে আর হয়ে ওঠেনি। সুলেখা প্রেগন্যান্ট হয়ে যায়। পরে ও জানতে পারে ওর স্বামীর আরো সম্পর্ক আছে। শেষে সুলেখাকে ছেড়ে বাংলাদেশ চলে যায়।
           পরে সুলেখা একটা প্রাইভেট হসপিটালে আয়ার কাজ জোটায়। সেখানেও যৌনতার শিকার হয়। শেষে হাওড়া স্টেশনে প্লাটফর্মে ছেলেকে নিয়ে  থাকা শুরু করে। কোন রকমে এ ওর  কাছ থেকে চেয়ে দিন চলে।
             আছ বহু বছর পরে সুলেখার সাথে দেখা হতে পুরানো ভালবাসাটা আবার চাগিয়ে উঠল। সুলেখা প্রথম থেকেই আমাকে " অরুণদা " বলে ডাকত। ঐ ডাকটা বহুদিন কানে বাজার পর থেমে গিয়েছিল। আজ আবার নতুন করে ধ্বনিত হল।
                 সুলেখাকে ভালবেসে ঠকে ছিলাম। ও কিছুটা  স্বার্থপরের মতন চলে গিয়েছিল। আমিও রাগে অভিমানে আর বিয়ে করার কথা ভাবিনি।
             সময় থেমে থাকেনি। বদলির চাকরি নিয়ে আসানসোলে আসতেই পূর্বাশা আমার জীবনে আসে। ও আমার সব খেয়াল রাখে। সামনের ফাল্গুনেই চার হাত এক হবে। যদিও আমাদের দুছনের বেশ বয়স হয়েছে।
           সুলেখাকে কথাটা বলতে চাই নি। মুখ ফসকে বেরিয়ে আসল। মৃত্যুঞ্জয়বাবুকে অনুরোধ   করে উনার ফার্মে সুলেখার জন্যে একটা ভাল কাজের ব্যবস্থা করে দিলাম।
            সুলেখা সব শুনে একটু বিচলিত হল। চোখ ছল ছল করছে।
            আমার মনে কোথায় যেন কোকিল ডেকে উঠল। প্রেমের কোকিল। তবে সেই ডাক বেশ কান্না ভেজা।
             ট্রেন থেকে নামার সময় সুলেখা হাত দুটো ধরে ধরা গলায় বলে উঠল , " ভাল থেকো অরুণদা "।
               কোকিলের ডাকটা ট্রেন চলার শব্দে ধীরে ধীরে  মিলিয়ে গেল।



সুস্মিতা পালের আঁকা ছবি(শ্রেনী - সপ্তম)


No comments:

Post a Comment