PravatiPatrika

Tuesday, August 18, 2020

মঙ্গলবারের পাতা

 উপাধি  ইচ্ছে

অর্ঘ্যদীপ বিষই


 আমার লেখা কবিতা  গুলো  নাই বা প্রকাশ পাক 

ছিঁড়ে যাওয়া সেই  ডাইরির উপর  না হয়  সুপ্ত ভাবেই থাক

আমার মতো কতজনের স্মৃতির মাঝে ইচ্ছে চড়ে

পূরণ হয়নি ইচ্ছে তাহার ডাইরির পাতা খসে যে পড়ে

 স্বপ্ন মাঝে ইচ্ছে শেষে ক্লান্ত প্রহর  এসছে মিশে

সময়কাল পেরিয়ে গেল স্বপ্নপূরণ আমি চাই না  শেষে

 ইচ্ছে এখন নেই তো হাতে  পরের কথাই ইচ্ছে ছুটে

কবিতা তোমার ইচ্ছে তো নয় অন্যের কথায় প্রকাশ ঘটে

 সমাজের এই জীবনচক্রে লেখা ছাপানোর ব্যবসা চলে

টাকা থাকলেই চাপবে তাহা  না হয়- ছড়ায় না পাখা সে বক্ষ মেলে

টাকা দিয়েই কিনার জন্য সবাই সম্মান এখন পায়

দৃষ্টিভ্রম হোক না সমাজ কিন্তু আমার কবি উপাধি চায়

খামখেয়ালীর উদ্দীপনায় কবি উপাধি নামের আগে  যে চিরে( চিরে মানে বসিয়ে)

 অন্তরস্রোত থেকে বলতে পারবে না তুমি আমি নতুন কবি আমি এসেছি ফিরে.




অবতল

শর্মিষ্ঠা সাহা


পাহাড়চূড়ায় বটগাছ দেখেছো কখনো?

এরকম কোন ক্যানভাসও হয় না ,

সমস্ত গুচ্ছমূল পাহাড়ী পাথর ভেদ করছে।

পাথরের ভেতর বালির শরীর,

বালিই একমাত্র জলশোষক ,

জন্ম হয় উষ্ণতাহীন বরফ পাহাড় ।

এভাবে পাথর ভাঙতে ভাঙতে

এলোমেলো রিনরিন চুড়ি লাল সাদা,

ত্রস্ত রঙ্গীন নখরঞ্জনির সাথে ।

মাস যায়, বছর যায়, যুগ যায় ,

বটগাছ বালিতে নেমে আসে ক্রমশ.....

ধীরে..........

কারণ, কোনো বালিয়াড়িতেই পাথর থাকে না।




পরাধীনতার অবসানে 

ডঃ রমলা মুখার্জী


স্বাধীন হয়েছে ভারতবর্ষ

        মুক্ত হয়েছে দেশ,

কত শহীদের রক্তধারায়

         পরাধীনতার শেষ।

স্বাধীনতার পূর্ণ মান

         তবেই পারবো দিতে -

জীবন যখন উৎসর্গ

          আর্তজনের হিতে।

স্বাধীনতার পুন্যতিথি 

         সেদিনই ভারতবর্ষে,

দেশের আকাশ ভরবে যবে

         ধনী-গরীবের হর্ষে।





অপেক্ষা (ছোট গল্প)

আব্দুল রাহাজ  

সময়টা ছিল রাতুলের শহরে পড়ার সময় সে গ্ৰামের ছেলে সরল সাদাসিধে খুব ভালো শহরে এসেছে এই দুই বছর হয়ে গেছে একবার এক রাতে কিছুতেই ঘুম আসছিলনা রাতুলের তার বন্ধু আলির কথা মনে পড়ে যাচ্ছে গ্ৰামের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে তবুও সে অপেক্ষায় আছে কবে পড়াশোনা শেষ করে আবার মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস ছোটাছুটি করবে হাত ধরাধরি খেলা করবে একথা মনে মনে ভাবতে থাকে। রাতুল আর আলি ওরা ছোট থেকে ভালো বন্ধু সবার বিপদে আপদে পাশে দাঁড়ায়। রাতুলের বাবা উকিল আলির বাবা চাষি ওদের সম্পর্ক টা বেশ ভালো ।গ্ৰামের পাঠশালায় ওরা যখন পড়তো বরাবরই ভালো পড়াশোনা করতো বিকাল বেলা গ্ৰামের ছেলে মেয়েদের সাথে নিশান দের বাগানে খেলা ও সে কী হই হল্লোড় করে খেলা  কাটতো খেলার শেষে ধু ধু ধুলো উড়িয়ে চিকাৎর করতে করতে  তানসিম দের পুকুরে হই  হই করে স্থান করে বাড়ি আসে। রাতুল আর আলি বিকালে ছুটির দিন গুলোতে সজোনবাদিয়ার ঘাটে গিয়ে বসতো ফুর ফুরে হাওয়ায় ওদের মনটা হালকা হয়ে যেত ওদের দিন গুলো বেশ ভালোই কাটতে  লাগলো এভাবেই গ্ৰামের পাঠশালায় চার বছর কেটে গেল ।এরপর সেই দিন যে দিন গ্ৰামের পাঠশালা শেষ হবে ওরা বেশ হাসি খুশি ছিল বিকাল বেলায় বট গাছের তলায় বসে রাতুল বললো কাল চলে যাচ্ছি রে তোর জন্য চিঠি লিখবো আলি চাপা গলায় বললো আচ্ছা তাই হবে তোর জন্য অপেক্ষায় থাকবো আজীবন । রাতুল বললো এই তুই কোথায় পড়বি জলপরিয়া হাই স্কুলে ভর্তি হবো আর কী করবো এই বলে দুজন চলে গেল পরের দিন সকাল বেলায় রাতুল চলে যাচ্ছে ফজরের নামাজ পরে আসার পথে দেখা রাতুল বললো আমি চললাম আচ্ছা যাও তাহলে অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকে বিদায় দিলো আর বললো বন্ধু তোমার জন্য অপেক্ষায় থাকবো আজীবন ।




 " মনের রাজ্য জয় " 

জুয়েল রুহানী


সৃষ্টি সুখের উল্লাসে আজ

দৃষ্টি তাহার পানে,

যাহার মাঝে স্বপ্ন খেলে-

দু চোখেরি কোণে।


কুন্তলে তার মেঘের ছোঁয়া

যায় না তারে পাওয়া,

এলো কেশে যায় হারিয়ে-

এলে ফাগুন হাওয়া।


রেগে-মেগে আগুন হয়ে

তাকিয়ে যখন রয়,

হংসী নাচে হৃদ যমুনায়-

ভর করে ডানায়।


তাহার পানে দৃষ্টি দিয়ে 

পলক ফেরার নয়,

স্বপ্ন রূপের ঝলসানিতে

মনের রাজ্য জয়!




Monday, August 17, 2020

সোমবারের পাতা

 সেই মেয়েটি (কবিতা)

আব্দুল রাহাজ  

সে আজও অপেক্ষায় আছে 

সোজনবাদিয়ার ঘাটে।

নীল আকাশে পাখি ডানা মেলে ওড়ে 

সেও যেন প্রিয় মানুষটিকে দেখার জন্য প্রকৃতির সবুজ মায়ের কোলে ভেসে বেড়াচ্ছে।

দিন পার হয় বছর পার হয় সে আজও আসেনা 

রাগে দুঃখে কষ্টে নদীর পাড়ে বসে ভাবতে থাকে তার সাথে দেখা আর এ জন্মে হবে কী।

সেই মেয়েটি আজও অপেক্ষায়

তার প্রিয় মানুষটিকে একপলকে দেখার

সেদিন সে হবে আনন্দিত পৃথিবীর সবচেয়ে খুশির মানুষ

হিমেল বাতাস বইবে চারিদিকে কিন্তু সেই দিনটি কবে হবে

সেই মেয়েটি যে অপেক্ষায় আছে।




 ধিক্কার 

নাসরাতুল হোসাইন নিশান 


ধিক্কার জানাই সেই মানুষ দের

যাদের জন্য আজ দেশের এই অবস্থা,

ধিক্কার জানাই সেই মানুষ দের

যারা এগুলো দেখেও নেই নি কোনো ব্যবস্থা!

তারা করেছে অনেক মানুষের জীবন নষ্ট 

আর অনেক মানুষ তো তাদের বড় ভক্ত। 

তারা করছে এই দেশকে শাসন শোষণ 

আর অনেক মানুষ হারাচ্ছে তাদের নির্বাসন! 

ধিক্কার জানাই তাদের

 যাদের জন্য হচ্ছে শত মায়ের বুক খালি, 

ধিক্কার জানাই তাদের 

যারা এগুলো দেখেও হেসে কাটিয়ে দিচ্ছে দিন গুলি। 

শোষনের জাঁতাকলে মানুষ হচ্ছে অস্থির

ভবিষ্যৎ জে বড়ই করুণ,

থাকবো কিভাবে সু-স্থির!!

আজ থাকবো না বসে ঘরে 

দেখি কে কি করে, 

প্রতিবাদ চলতে থাকবে 

চলবে রাত ভোরে! 

চলতে থাকুক এই আন্দোলন, 

চলতে থাকুক এই সংগ্রাম 

যেখানে অন্যায় দেখবো, 

সেখানেই আঘাত আনব!




সমাজের বিষবাষ্প

           ব্যর্থ লেখক


এখন দিগন্তের সেই আলোতে অবশ হওয়ার শোক।

 কাঁটার তারে আগুন জ্বলে লেগেছে বিক্ষোভ।

কথায় কথায় অগ্নিগোলক বারুদের-ই চাপ--জ্বরের ক্লান্তি.. নিঝুম রাত্রি..ভেঙ্গেছে থার্মোমিটার ধাপ।




তৃষ্ণাত্ব হৃদয়

 জুয়েল রূহানী।


তৃষ্ণাত্ব হৃদয়ের আত্মচিৎকারে যে সুর,

বিস্বাদ এর অবগাহনে আঁখি ব্যাথাতুর।

আঁখি পানে চেয়ে তৃষ্ণা মেটাতে এ মন

উন্মাদনায় ছুটে, আসে যদি শুভ ক্ষণ?

গোধূলি লগন অতিক্রান্তে রাত্রি যাপন,

রাত্রি শেষে রবির উদয় কত যে আপন।

রবি'র আলোয় ঝলমলে কেশ কারিলো এ মন,

মেঘলাকাশে এলো কেশে মায়া রূপ দর্শন,

শত উপমায় তবু দু'চোখে  জল বর্ষন!







Sunday, August 16, 2020

রবিবারেরপাতা

 শ্রেষ্ঠ স্বাধীনতা

আব্দুল রাহাজ  

আমরা পেয়েছি স্বাধীনতা হয়েছি মুক্ত বেঁচে আছি স্বাধীন ভারতবর্ষের ভূমিতে।

দুশো বছরে লাঞ্ছনা-বঞ্চনা অত্যাচার সহ্য করে শত লড়াই করে কত শত মায়ের সন্তানের রক্তের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি স্বাধীনতা।

দুশো বছরের ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হয়ে আজ আমরা মুক্ত বাতাসে ভেসে আছি। সত্যিই আমাদের স্বাধীনতা বিশ্বের দরবারে চিরজীবন শ্রেষ্ঠ

 শ্রেষ্ঠ

যা শ্রেষ্টতম অধিকার করে আছে আজীবন।



স্বাধীনতা

সত‍্যব্রত ধর


৭৪তম স্বাধীনতার প‍্যাকেজ ঝনঝনিয়ে উঠতেই,

আঙ্গুলের ফাঁক গলে বেড়িয়ে গেলো দেশের শূন‍্যস্থান।

দেশপ্রেমিকদের পিঠে চাবুকের দাগে জমাট রক্ত-ছবি,

স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার পুরোনো গল্প শোনায়।

মুক্তির স্বাদ স্হান-কাল-পাত্র ভেদে ফ‍্যাকাশে হলেও,

জন্মভূমিই সেরা বলে চেঁচিয়ে মরে আম জনতা।

আমি রোদের লগ্ন ভেঙে মেঘ ডেকে আনার পাশাপাশি,

বৃষ্টির নরম  বাষ্পে কান পাতি স্বাধীন হবো তা



পার্থিব

কপিলদেব সরকার


আছেন, তিনি আছেন।

মানুষের কায়াপৃথিবীতেই আছেন, 

     কল্পিত পরলোকে নয়।


শ্রমে আছেন, স্বেদে আছেন,

কৃষকের খেদে আছেন,

সৈনিকের বুলেটে আছেন,

অরণ্যের আর্তনাদে আছেন,

আমাদের নিষ্ক্রিয়তায় আছেন,

সান্ধ্য বিনোদনে, ছদ্মকবিতায় আছেন,

অরাজনৈতিকতায় আছেন,

চিৎকৃত দেশপ্রেমে আছেন।


তিনি তো সর্বময়, সর্বব্যাপী

তাঁর অনেক নাম, অজস্র রূপ।

কিন্তু তাঁর ধর্ম, ও কর্ম

                                 - একটাই

নিরন্তর জল মেপে মেপে

বিপদের দাগ কেটে যাওয়া

  - আমাদের ধৈর্য্যের বাঁধে।




বর্ষা রাণী

-----সত্যব্রত চৌধুরী


রুণু-ঝুনু নূপূর পায়

মেঘলা রং শাড়ি গায়

হেরো ঐ আকাশ পথে

বর্ষা রাণী কেমন ধায় ।।


ধায় সে আপন মনে

পাহাড় মরু বনতলে।

পশ্চিমে বা পুব গগনে

তা থৈ নাচে সমতলে ।।


নূপূরের আওয়াজ মধুর

টুপ টুপ টাপুর টুপুর ।

রিম ঝিম ঝর ঝর ঝর

নাচে রাণী সারা দুপুর ।।


ঢেকে যায় রবির আলো

ছেয়ে ফেলে গগন জুড়ে ।

ভেকগুলি অথৈ জলে

গেয়ে চলে আপন সুরে ।।


তারই সুরে নাচে চাষী

ছোটে সে লাঙল নিয়ে ।

মুখে  তার  তৃপ্ত  হাসি

চষে  মাঠ  ফলা  দিয়ে ।।




পঞ্চক 

রঞ্জন চৌধুরী


১.

গন্বুজের শীর্ষে আছে যে প্রাকারের রঙ

তাকে আমি রোজ দেখি

                             দাঁড়িয়ে আছে

                             বেড়ার সুরক্ষা বেদিতে

যেন এক প্রপঞ্চক

যেন এক সঙ। 


২.

চোখ চুম্বকে আটকে আছে যে নদী

সে নদী উপমারহিত  কোন প্রবাহিনী নয়

সরীসৃপ স্বভাবিনী মাটির চন্দন মাখা

আমার প্রণয়িণী পাগলিণী। 


৩.

প্রবেশ আর প্রস্থান মাঝে

যে ফাঁক আছে চিলতে, একটি

বসে আছি সেখানে চুপটি


আর স্নান জড়ানো আঁচল খসা বধূটি

ঝিম ধরা দুপুরে ঢাকছে তার বুক দু'টি। 


৪.

বৃষ্টি আমায় প্রথম শোনায়

স্কন্ধকাটা ঝড়ের কথা


ঝিনুক হাতে 

মাঠ বিকেলের বৃষ্টিদিনের বৃষ্টি সেদিন

দাঁড়িয়ে ছিল পদ্মপাতায়। 


৫.

এক আকাশ চাঁদ ছিল রাতে

আঁজলা রঙের মোহের


রোদ উঠতেই দেখি

গড়িয়ে পড়া ছায়াটা তার

সুতোয় মোড়া দাঁড়িয়ে প্রবেশপথে ।


                       


মুজিব হতে চাই

নাসরাতুল হোসাইন নিশান 


আমার শরীরে বইছে শত বছরের বাঙালির রক্ত

তাই আমায় হতে হবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবরের ভক্ত।


আমায় হতে হবে তার মতো প্রতিবাদি

আমায় হতে হবে তার মতো দেশের প্রতি নিষ্ঠাবান,

আমি করি সংকল্প প্রত্যেক সকাল

এ দেশের জন্য বিলিয়ে দিবো নিজের জান।


কারণ শেখ মুজিব আমার প্রান,

কারণ হৃদয়ে আমার শেখ মুজিব।

হৃদয়ে আমার বঙ্গবন্ধু! 


আমি তার মতো বাঘের গর্জন দিতে চাই

আমি তার মতো দেশের জন্য প্রান দিতে চাই

আমি স্বাধীন দেশের স্বাধীনতা রক্ষা করতে চাই।


মুজিব আমার দেহের রক্তে মিশে আছে

মুজিব আমার মধ্যে বেঁচে আছে,

মুজিব তোমার আমার সবার

সকলের মুজিব সকলের কাছে বাঁচে।


মুজিবকে করি আমি বারবার স্বরণ

মুজিবেতে আমার বেঁচে থাকা, মুজিবেতেই মরণ। 


আমি শুনেছি,

"রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব- 

এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ।"

তোমার এই ধ্বনি শুনে মানুষ আজো চোখ ভেজায়

তোমার স্বাধীন দেশের মানুষ তোমায় ভেবে দিন কাটায়।


আমার  বঙ্গবন্ধু, আমি তোমায় চাই

আমার মনে তুমি, আমি মুজিব হতে চাই,

আমি জাতির পিতার সৈনিক হতে চাই।




অনুভবে

         মৃন্ময় ভট্টাচার্য্য 


যারা এনেছিল স্বাধীনতা 

সয়েছিল অকথ্য ব্যাথা,

বুঝিনা আমরা তা 

সম অনুভবে ,

কাটাই এ'দিনটা

হুল্লোড়ে, কলরবে !


নিজেকে উজার করে

জীবনটা বাজী ধরে 

আমাদের সুখ চেয়ে

হয়েছিল নিঃস্ব ।

আমরা ভোগের খোঁজে

মা-মাটি-দেশ ভুলে

পাড়ি দিই বিশ্ব !


আজ শহীদ পূজার দিন 

স্মরী সে ত্যাগের ঋণ,

যাদের বলিদানে

হয়েছি স্বাধীন ।


জয় হিন্দ ।



Sunday, July 26, 2020

রবিবারের পাতা

খুব কাছ থেকে ফিরে গেলে
হীরক বন্দ্যোপাধ্যায়

খুব কাছ থেকে ফিরে গেলে মনে হয়
কিছু কি বলা হল না!
ভয় হয়, মাঝে মাঝে ওমুখে তাকাতে পারিনা
কি বলতে কি
বলে ফেলেছি ,কোথাও কি ফাঁক রয়ে গেল ?
যাকে বলতে এসেছি সে জানে সব কথা
তবু এত ই  তরল আজ মন
গেলাসে গড়িয়ে যায় রাত
যা কখনো প্রসাদ হবে না।
এখনো জল হাওয়া শিস দেয়
অরণ্য জুড়ে বাতাসের বৃষ্টিপতন,গাছেদের
ক্কচ্চিৎ কখনো নৈবেদ্য সাজাতে হলে
শ্রাবণ সঞ্চয় করা ভালো
আজ চারপাশে এত জ‍্যোৎস্না
তবু খুব কাছ থেকে ফিরে গেলে মনে হয়
কিছু কি বলা হল না !
যা বলার ছিল হয়তো সামান্য ই...





                  " সুখ বিলাসী "
                 হামিদুল ইসলাম
                 
পুকুরের পাড় আজ নিস্তব্ধ
শান বাঁধানো ঘাট
ঘাটে নামি
শান্ত জল
কেবল ওপারে ভাসে ক'টা বালিহাস   ।।

উড়ে যায় ওরা
আপন নীড়ে
সন্ধ‍্যা সমাসীন
হাতে রাখি হাত
উষ্ণতা বরাবর। চিনে রাখি জীবন    ।।

পাখিরা এখন ক্লান্ত
বাসায় আড্ডা জমায়
কোলকাতার কফি হাউসের মতো
হিমেল হাওয়ায় উড়ছে জীবন। জীবনের এলোকেশী লয়   ।।

এ জীবন আজ শান্ত
স্বচ্ছ জলের মতো
জলে তোমার ছায়া
তোমার অবয়ব।
বাংলার সমাজ ভেসে ওঠে জলে।।

আমরা সুখ বিলাসী





পশুবলি
কলমে- হরিহর বৈদ‍্য

প্রাণহত‍্যা মহাপাপ জেনো
তাই জীবে দয়া কর ভাই,
আজও কেন মোরা দেবতার নামে
তবু পশুবলি দিয়ে যাই।
যখন যেখানে দেবতার নামে
যত হয়েছে পশুবলি,
অবলা পশুর ক্রন্দন ধ্বনি
ছড়িয়েছে ওলি-গলি।
লক্ষ লক্ষ অবলা জীবের
প্রাণ হয় সংহার,
এই ভাবে কতদিন রবে
জাতির এ কুসংস্কার!
নিজের কোন মঙ্গলার্থে
এমন জীবনপাত--
এই অহেতুক কাজ, বিধির বিধানে
হবেনা কি প্রতিবাদ।
তবু নিজেকে মানুষ শ্রেষ্ঠভাবে
প্রাণিজগতের মাঝে,
এতটুকু ব‍্যথা পায়না তথাপি
নির্মম এই কাজে।
আমরা যদি নাহি দিতে পারি
শবদেহে ফিরে প্রাণ,
নির্দয়ভাবে কেন করি তবে
পশুদের বলিদান।
যিনি ঈশ্বর আমরা কি তাঁকে
করিতে পারি দান,
ধর্মের নামে অধর্ম এযে
মানবতার অপমান।
ভালোবাসা আর জীবে দয়া
সদা করে যেই জন,
দেবতার করুণা ধারা
পায় সে সর্বক্ষণ।
করজোড়ে তাই শুধু বলি ভাই
দিওনা মৃত‍্যুঘাত,
পরহীত তরে জীব- কল‍্যাণে
কর হে আত্মত‍্যাগ।
নিজের কথা না ভেবে যেজন
ভাবে মানুষের কল‍্যাণে,
তুষ্ট হন দেবতা ভীষণ
তার সেই মহাদানে।
থেকে অনাহারে যে জীবে দয়া করে
সেই তো শ্রেষ্ঠ দানী,
তবে কেন মিছে পশুবলি দিয়ে
রেখে যাই দ্বেষ-গ্লানি।




আরম্ভ
শর্মিষ্ঠা সাহা

আমার তোরণে মান্যতার বিষ্ফোরণ,
একটা কাব্যিক সন্ধ্যায়
জোৎস্না ভরা বেলুন ওড়ালাম,
শব্দের আরোহন  অবরোহন।
সমস্ত মুখোশমানুষ এর
মৃত্যু হোক, এই রাজপথে,
ঝিনুকের মুক্তা-আলিঙ্গনে
অসুখ ছেড়ে যাক এই রাতে।

ঘুম থেকে উঠে দরজা খুলে দেখি
সব ভালোলাগাগুলো একসাথে দাঁড়িয়ে,
অসংখ্য ঘাসমল,
অসংখ্য স্বীকৃত জারজ,
দরবারী কানাড়ায় গ্রামাফোন
মুহুর্মুহু মুছে যাওয়া দীর্ঘশ্বাস,
বৃষ্টিস্নাত সব পুরোনো অভ্যাস।

আমার দ্বন্দ্ব আর সম্মোহন
বুঝতে পারছিল না
দরজার দুপাশেই আমি,
যেন জাতিস্মর এর রাত্রিযাপন ।







বর্ষণমুখর রাতে
মিনতি গোস্বামী

বর্ষণমুখর রাতে একা আছি জেগে
নদী জানি ব ইছে আজ দুরন্ত বেগে


রাতে একা আছি জেগে বর্ষণমুখর
বিরহিনী গুণে যায় রাত্রি প্রহর

একা আছি জেগে বর্ষণমুখর রাতে
জানিনা বিহঙ্গ কি সংবাদ দেবে প্রভাতে

আছি জেগে বর্ষণমুখর রাতে একা
বৃষ্টির প্রতিটি ভাঁজে কবিতা লেখা

বর্ষণমুখর রাতে একা জেগে আছি
নিজের সঙ্গে নিজেই খেলছি কানামাছি।





       ভূতের রাজা
ডঃ       রমলা মুখার্জী

ভূতের রাজার বর পেয়ে যেই না বোঁচা চেয়েছে খাবার -
ওমনি ভূতের রাজা হাজির,
বলে,"মানুষ পাঝাড়া পাজির।
গড়েছে অভাব খাবার জলে,
জল প্রায় শেষ মাটির তলে।
জলাভাবে আমরাও মরবো,পৃথিবী কি কেবল তোদের বাবার?







      স্বাধীনতার অপেক্ষায়
    মোহাম্মাদ আবুহোসেন সেখ
           

ভারতের মাটি হলো স্বাধীন
যাদের রক্তের বিনিময়ে
তারা আজ পরোপারে,কিন্তু
মানবের মনে জাগ্রত আছে।
হাজারও মায়ের বুক শুন‍্য করে
দিলো জীবন অকাতরে
দেশও বাসীর কথা ভেবে
দিলো নিজেকে আত্তোবলীদান।
তাদের কারনে পেলাম আজ
মাথা গোঁজার ঠাঁই।
ভারত স্বাধীন দেশ আমার
ভারত স্বাধীন দেশ আমার।।
স্বাধীনতা জয় যুদ্ধের গান
আজও বাজে কানের ধার।
সেই বিদ্রোহের আগুন,জ্বলে ওঠে
প্রতি ক্ষণে ক্ষণে আজ।
প্রতিবারের মতো আবারও সাজাবো
সবুজ,সাদা,গেরুয়া রংয়ের সাজ।
ভারতস্বাধীনতা সংগ্রামী বীরদের জন‍্য
ফুলের মালা হাতে সারা ভারতবাসী
১৫ই আগষ্ট স্বাধীনতা দিনটি
ফিরে আসার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে।
ভারত স্বাধীন দেশ আমার
ভারত স্বাধীন দেশ আমার।।










            শশ্রু মাতা
           অদিতি সুর

"মা ও মা।কই গেলে গো?"
ঘরে ঢুকেই চিৎকার করে ডাকতে থাকে পিয়ালী।
"ডাকছো পিয়া?"
রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসেন  রুচিরা দেবী।
"না মানে।"
আমতা আমতা করে পিয়ালী ওনার মুখের দিকে তাকায়।প্রতিবার বাড়িতে ফিরে কিছুদিন আগেও ও এইভাবেই ওর মাকে ডাকতো।
"নিজের মায়ের কথা মনে পড়ছে নিশ্চয়ই?"
"না মামুনি।অভ্যাস হয়ে গেছে।ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে।"
"এই অভ্যাস কোন দিন যাবেনা পিয়া।এটা হলো মা মেয়ের সম্পর্ক।"
"তুমি সত্যি আমাকে এই কদিনে অনেক বোঝো মামুনি।"
কাছে এসে পিয়ালী ওর শাশুড়ির হাতে বাইরে থেকে আনা জিনিসগুলো দেয়।
"যাও ফ্রেশ হয়ে নাও,আমি জলখাবার করেছি তোমার জন্য আজ তো যাওয়ার সময় ভালো করে খেয়েও যেতে পারোনি।"
পিয়া বাথরুমের দিকে যেতে যেতে মনে মনে ভাবে -  তোমার মত শাশুড়ি সবাই পেলে  কারুর ঘরে এতো  অশান্তিই হতো না কখনো।







প্রকৃতি

          বিশ্বজিত মুখার্জ্জী

প্রকৃতিই দিয়েছে মনে আলোর ঠিকানা,
বনানী সবুজ ভরাই প্রকৃতির আঙ্গিনা।
পাহাড়ের বুকে নদীর স্রোত বহমান,
ঝর্ণা যেন প্রকৃতির অপার দান।
মাথার উপরে খেচর ওড়ার নীলাকাশ,
রবির আলোক মনে বাড়াই বিশ্বাস।
অতল সমুদ্র বুকে হাজার লহর,
হাজার বৈচিত্র্যে ফোটে প্রেমের বহর।
প্রকৃতির অদ্ভুত ভাঙাগরা চলমান অহর্নিশ,
আজ যা অমৃত কাল তা বিষ।
গ্রীষ্মের তপনের দাবদহে প্রকৃতি হুতাশন,
বর্ষার হাত ধরে জাগ্রত শ্রাবন।
বর্ষায় সুপ্ত বীচনের হয় অন্নপ্রাশন,
সুপ্তবীজের জীবন দেখে মহীরুহের স্বপন।
শীতে বনস্পতির ঝরে পড়ে পাতা,
বসন্ত আনে বয়ে নতুন বারতা।
কোকিল বনস্পতিরে কহে কেন এত ভয়?
বসন্ত আসিলে শাখে সবুজে ভরিবে নিশ্চয়!







সমীকরণ আর প্রশ্ন
কৃষ্ণেন্দু দাসঠাকুর

বালির চরে উপুড় হয়ে, কাদামাখা স্যারের লাশটা--- প্রতিবাদ ছিন্নভিন্ন, আদর্শ সারারাত শিয়াল কুকুরে খুবলেছে। বুকপকেটে নক্ষত্রের মতো তখনও জ্বলজ্বল করছে, যেটা উঁচিয়ে স্যার বলতেন-- "অসির চেয়ে মসি বড়"।

থানার দুঁদে অফিসার মার্ডারের ক্লু খুঁজছিল---  হঠাৎ আবিষ্কৃত হল স্যারের পাজামার পেছনে একটা পরিছন্ন ছুরি... গোঁজা।

স্যারের দিকে তাকালাম--- সবার অলক্ষ্যে, ঠোঁটে তখনও একটা ব্যাঙ্গের হাসি ঝুলে...
                                 






গদ্য:-'ম্যাচিউরিটি'   
                  লেখক:-সুদীপ সেন।       

          >>বিন্দুমাত্র অবগত না হয়েও অসংখ্য কর্মধারার মধ্যে নিজেকে এক অভূতপূর্ব মানসিকতার ভাবধারায় নিয়োজিত করে অসামান্য চিত্তে হস্ত প্রসারণ ও পদক্ষেপ গ্রহণের পরিচয়ই হল ম্যাচিউরিটি।রৌদ্রতপ্ত আবহের সঙ্গী হয়ে শরীরের ঘামকে পরিশ্রমের প্রমাণ ও ক্লান্তিকে ব্যস্ততার মাপকাঠি হিসেবে গ্রহণ করাই হল ম্যাচিউরিটি।মনকে সংযম ও সহনশীলতার পরিবেশে দীক্ষিত করে মুঠো শক্ত রেখে চরম থেকে চরমতম কঠিনকে অতি সহজেই আলিঙ্গন এবং ব্যর্থতার সাথে সখ্যতা স্হাপন করে সাফল্যের স্বপ্ন চোখে মেখে নেওয়াই হল ম্যাচিউরিটি।ম্যাচিউরিটি হল সেই আবেগ যার উপর প্রভূত্ব স্হাপন করতে গিয়ে বাস্তবও হার মেনে যায়।                              রাত্রিকালীন ঘুমের বিছানায় বালিশ কামড়ে নিজ অশ্রূধারা  প্রতিহত করেও যদি প্রত্যাশিত নিদ্রা কাছে আসতে অতিরিক্ত  সময় নেয়,তাহলে বুঝবে তুমি ম্যাচিউরিটির পথের পথিক।অনুভূতি ও তার প্রকাশের চাইতে আত্মসম্মানবোধ যখন তোমার সত্ত্বাকে অধিকতর প্রশান্তি প্রদান করবে,বুঝে নেবে তুমি ম্যাচিউরিটির দ্বারপ্রান্তে।                                     চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে  ফুটপাতের একপাশে কিছু একপেষে রাজনীতি ও ধর্মবিষয়ক নিত্য-নৈমিত্তিক দলীয় আসর যখন পরিচিতি ও ঘনিষ্টতার পথে বাধা হয়ে দাড়ায়,এবং তা সত্ত্বেও যদি আলোচ্য বিষয় ও বাস্তব পরিস্হিতির মধ্যে কোনো পরিবর্তন না আসে,তাহলে সেই জটিলতা থেকে পৃথক হয়ে নিজ বিবেকচেতনা ও চলতি সম্পর্ক বজায় রাখার অর্থই হল এই যে তুমি ম্যাচিউরিটির কক্ষে প্রবেশ করেছো।                                      তারপর আসবে এমন এক সময় যা তোমাকে মানসিক,শারীরিক বা পারিপার্শ্বিক অসুবিধাগত যন্ত্রণার মাঝেও সুস্হ মস্তিষ্কে টিকে থাকা ও টিকিয়ে রাখার প্রেরণা দান করবে।সেদিন বুঝে যাবে যে,তুমি কোনো ম্যাচিউরিটির মধ্যে নয়।...বরং তুমি যেন নিজেই 'ম্যাচিউরিটি'।...তখন তুমি হয়ে উঠবে অন্যের নক্সা,আদর্শ,এগিয়ে চলার তাগিদ,ভবিষ্যতের আঙ্গিক.....






খেদ্
🖋  বাপন দেব লাড়ু

কিছুটা জল গড়িয়ে গেল তোমার উঠোনে
আর কিছু নিরন্তর, অবিরত,
সুখের সময় আজ,
অনুভুতির অধুনা ভালোবাসায় মলিন ;
অনেকবারই ভেবেছি, দেশান্তরে যাবো।
যদি মুছে যায়,
যদি ঝরে যায়,
জমানো সব অভিমান, সব অভিযোগ।।
সব সব কল্পনা, লেখা,
ঝুলে আছে কার্নিশে ;
মাঝে মাঝে কানে আসে
পতনের টুপ্ টাপ্ শব্দ ;
খোলা চোখে বসে থাকি একা বারান্দায়
শব্দরা আজ মলিন,  মৃতপ্রায় ;
কান পেতে থাকি আগমনী বাতাসে
আসেনি এখনো কবিতার স্রোত
কলমে কাগজে।




 *দহন*
 শঙ্খজিৎ দাস 
[ মুজফ্ফরপুর স্টেশনে মৃত মায়ের সাথে অবুঝ শিশু--স্মরণে]

' ওঠো,ওঠোগো মা,জাগো---আমার খিদে পেয়েছে, '
নিথর শুকনো বুকে অনাথ শিশু কাঁদে .....।

সে এখন বেওয়ারিশ লাশ,
কেউ বলে---'ব্যামো ছিল',
কেউ বলে---'অনাহারে', কেউ-বা---'অপুষ্টিজনিত'।

এখন লাশকাটা ঘরে, যে ঠোঁট চুমু খায় সন্তানের মুখ---
মাছি এসে বসে তার ঠোঁটে ।

মা,----
যে আঁচলে আব্রু ঢাকো বেআব্রুর সমুখে
তারে তুমি ছিঁড়ে ফেলো, নগ্ন হও
ঊরু ফাঁক করে দেখাও----কোথায় রক্তপাতহীন ক্ষত
                  ------ কোথায় তোমার স্বদেশ

আর তুমি ঘুমিও না,মা----
ওঠো, জাগো---- আমাদের বড্ড খিদে পেয়েছে ।






শহীদের রক্ত( কবিতা)
আব্দুল রাহাজ

তোমরা বীর তোমরা মহান
জীবনকে উৎসর্গ করে
বাঁচিয়েছো মাতৃভূমি বাঁচিয়েছো দেশ মুক্ত করেছো দেশ।মুক্ত করেছো শক্রদের হাত থেকে
বন্ধ করেছো কামান গুলির আওয়াজ ।
তোমাদের তাজা রক্তে দেশ হয়েছে স্বাধীন
শত হারা মায়ের কান্না
বিজরিত সন্তান তোমরা
বীরের মতো বাঁচিয়েছো
আমাদের শস্য শ্যামলা দেশ।
আজ আমরা মুক্ত বাতাসে তা উপভোগ করি
তোমরা বীর তোমরা মহান
প্রতিটি মানুষের অন্তরে।






অরন্যর  দীর্ঘশ্বাস
                          সুব্রত দাস
উঁচু উঁচু টাওয়ার, বড় বড় অট্টালিকার পাশে,
ছোট্ট অরন্যটা ফ্যাকাসে  যাচ্ছে প্রতিনিয়ত ;
জনসংখ্যার চাপে গাছ গুলোও দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
নদীর চড়ে যেন ময়লা আবর্জনার আতুরঘর ।
অরন্যর সবুজ গুলো তামাটে বিবর্ণ হয়ে যায় ,
প্রকৃতির কোল শুকিয়ে শুকিয়ে কষ্ট আওড়ায় ।
বনপ্রহরী মানুষ হয়ে লিখে যায় পাখির কলতান
গাছেদের আর্তনাদ,আর কিছু স্মৃতির উন্মাদনা
মনে পড়ে  কাঞ্চনফুল,সারিসারি লম্বা গাছপালা, এঁকেছিল মনে ঘন শাল বাগান,চিরসবুজ মাঠ ।
ছোট ছোট ঘাস জলের বুকে শ্যাওলার গান ।
আজ সব অচেনা কাঁদে সত্তা অরন্যর দীর্ঘশ্বাস।‌।






  আকর্ষ
 শ্যামসুন্দর  মন্ডল


অর্ণা ও অর্পণ দুজনেই বনেদী পরিবারের সন্তান। পরিবারের অনেকটা অমতে ভালোবেসে দুজনের বাসা বাঁধা।কিন্তু বিয়ের পর প্রচন্ড সেন্টিমেন্টাল অর্ণার উপর মনস্তাত্ত্বিক পীড়ন হতে থাকে,অর্পণের অদৃশ্য অপারগতার কারণে। একদিন সহ্যের সমস্ত সীমা অতিক্রম করলে অর্ণা বন্ধনের অদৃশ্য সুতোটা ছিঁড়ে চলে যেতে প্রস্তুত হয়। ব্যর্থতার সমস্ত দায় ও কলঙ্ক মাথায় নিয়ে অর্ণা ন্যূব্জ। তবু্ও, একফোঁটা কলঙ্ক ও....। না, অর্পণকে দেয় নি অর্ণা।

সেদিন। খুব সকাল। অর্পণ ঘুম থেকে উঠে নি। অর্ণা মাথার কাছে দাঁড়িয়ে খুব শান্তভাবে ডাকে,"ওঠবে না।" অর্পণ পাশ ফিরতে ফিরতে বলে, "হুঁ।" অর্ণা তেমনি ভাবেই বলল," যাচ্ছি।" অর্পণ ঘুমঘুম চোখে জিজ্ঞেস করে,"কোথায়?" অর্ণা বলে,"জানি না।"
"মানে!" বলে অর্পণ ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। অর্ণা বলে চলে,"আমার প্রয়োজনীয়তা বোধহয় ফুরিয়েছে। আর অপ্রয়োজনীয়তা বহন করার বিড়ম্বনা,তাই বা কম কি! " তারপর নিঃস্ব আকাশের নিরবতা।

খানিকপরে আচমকা নিরবতা ভেঙে"তুমি অন্তত নিজের যত্নটুকু নিও।" অর্ণার এই শেষ কথাগুলোয় অর্পণের বুকের ভিতরটা যেন হুহু করে কেঁপে উঠল, যেন এক নিমিষেই মরুদ্যান ছাড়া ঊষর মরুভূমি হল। অর্পণ দেখল,যে লতাটি এত দিন ধরে একটু একটু করে উপরে উঠছিল,আজ আলগোছে হয়ে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কার হাওয়ায় ভীষণ দুলছে। অর্পণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে অর্ণার হাত দুটো খপকরে ধরে  নিজের বুকের উপর টেনে নিয়ে উৎকন্ঠায় বলে উঠে, "অর্ণা।" অর্ণা তার মুখের দিকে চেয়েই শান্তভাবে বলে," বলো।" অর্পণ কাঙালের মতো সমস্ত সংকোচ ও দ্বিধা কাটিয়ে বলে," অর্ণা,আমি আমাকে তোমাকেই দিলাম।পারো না নিতে?" আর ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। অর্ণার মুখে কথা নেই। শুধু দু'হাতে শক্ত করে অর্পণের গলা জড়িয়ে ধরে বুকের কাছে টেনে নিল। আর সমস্ত প্রতিরোধকে ব্যর্থ করে অশ্রু অর্ণার দুগাল বেয়ে বাথাতুর বুককে ছুঁয়ে অর্পণের উপর নিঃশব্দে পড়তে থাকল।






ডালিম গাছ
        সত‍্যব্রত ধর

গলির মোড়ে একটা গাছের প্রেতচ্ছায়া দাঁড়িয়ে!
আঁকাবাঁকা শুকনো কিছু কাঠির ডালপালা,
পাতা নেই...ফুল নেই...ফল নেই
আছে শুধু জীর্ণ রুক্ষ মেরুদন্ডের মত কাণ্ড।
নিরস সেই গাছের তলাতেই যাচ্ছিলাম!
রোজ যাই,
দিন ফুরোলে যাই,
জরুরী দরকারে যাই,
সেখানে বসে মনের গোপন কথা কই।
আর, বারেবারে মনভরে প্রার্থনা করি সাজুক সে।
অন্তত এক আঁচড় সবুজ তার গায়ে লাগুক।
প্রাণবন্ত হয়ে উঠুক আমার বন্ধু সেই ডালিম গাছ।


Monday, July 20, 2020

সোমবারের পাতায়

                                অনুভব
                        কপিলদেব সরকার

        পেয়ারাগাছটা মরতে বসেছে। বেশ কিছুদিন হল ওর শরীরটা হলদেটে হয়ে আসছে, পাতাগুলো কুঁকড়ে, শুকিয়ে, গুটিয়ে যাচ্ছে। এটা প্রথম বুঝতে পারে ঋক। ঋক গাছ ভালবাসে।  ফ্ল্যাট হয়ে যাবার আগে এই জমিটায় গাছপালা ছিল বেশ কিছু। প্রোমোটার কি কারণে জানি ওই একটা গাছকে ছাড় দিয়েছিল। গাছটা বাড়ির পুবদিকের পাঁচিল ঘেঁষে। আলো-হাওয়া পায়, বৃষ্টির জলও। দিব্যি ছিল একাই। মাথা দোলাত। ফলও ফলাত অল্পবিস্তর। তবে খেতে বিস্বাদ ছিল বলে চুরিটুরি হত না। পাখিতে খেত। একটা পুরুষ্টু ডাল কিভাবে ঋকের জানলার কাছে চলে এসেছিল। ঋক সেই ডালে মাঝে মাঝে হাত বোলাত। পাতায় আঙুল ছোঁয়াত। ডালের বাকল ছুঁয়ে বুঝতে পারত -  কখন ঋতু পাল্টাচ্ছে। পেয়ারাগাছটা নিজের পুরোনো বাকল খসিয়ে দিয়ে, নতুন সাজে সেজে উঠত। পুরোনো পাতা ঝরে গিয়ে ছোট ছোট নতুন পাতা আসত, তারা বড় হয়ে উঠত আস্তে আস্তে। ভারি আনন্দ পেত ঋক। কেউ কখনও জানতে পেরেছে পেয়ারাফুলেরও গন্ধ আছে? ঋক জানত।

         সেই ঋক-ই বুঝতে পারল - পেয়ারার ডাল ছুঁয়ে চেনা যে অনুভূতিটা হয়, সেটা বেশ কিছুদিন হল পাচ্ছেনা সে। কালো পিঁপড়ের দল সার বেঁধে যায় - ঋকের হাতেও উঠে পড়ে কেউ কেউ, ইতস্তত। তাও হচ্ছেনা ক'দিন হল। পাতায় হাত বুলিয়ে দেখেছে ঋক। কিছুই আর আগের মত নেই।

         এত বড় ফ্ল্যাটবাড়ি। এত মানুষ। কিন্তু কেউ দেখতে পায়নি - পেয়ারাগাছটা মরতে বসেছে। বেশ কিছুদিন হল ওর শরীরটা হলদেটে হয়ে আসছে, পাতাগুলো কুঁকড়ে, শুকিয়ে, গুটিয়ে যাচ্ছে।

         পেয়ারাগাছ, ও পেয়ারাগাছ। তুমি তো জান - তোমার বেঁচে থাকা - না থাকায় মানুষের কিছু যায়-আসে না। তারা টেলিভিশন আর ইন্টারনেট-এ ভেসে আসা মৃত্যুভয়ের খবরে সন্ত্রস্ত। সমস্ত দরজা আর জানলা বন্ধ করে তারা অসহায় হয়ে ডাকছে তাদের ঈশ্বর-আল্লাহ-গডকে। তাদের শেকড় নেই, পাতা নেই, সবুজ নেই, শুধু আছে হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে কোনোক্রমে টিকে থাকার রসদ জোগাড়ের চেষ্টা। তুমি শুকিয়ে মরে যাবে এভাবেই। তারপর তোমার শেষ চিহ্নটুকু মুছে যাবে। শোন - ঋক কাঁদছে। তবু কষ্ট পেয়ো না। জেনো - এক মূক, বধির ও জন্মান্ধ মানবসন্তান শুধু তোমায় ছুঁয়ে বেঁচেছিল, যে স্পর্শের আত্মীয়তা তার সমাজ অনেকদিন হল অস্বীকার করেছে।





                 অনুকবিতা
              শংকর হালদার

০১
ঝড়া পাতার ঘূর্ণন বুকে সময়ের মূল্যবোধ বাঁধা ,
পতিত ভূমিতে লোটানো জীবন অতীত ।

০২।
স্বপ্ন ঘোরে স্বপ্নদাতার অস্তিত্ব বিদ্যমান
তার-ই মাঝে সুখ-দুঃখ ,হাসি-
 কান্না
সব কিছুই যেন তার-ই অভিমান ।





         অপ্রেম
      শার্মিষ্ঠা সাহা

ফিসফিসিয়ে উজানের কানাকানি

ভাসবে দোঁহে, প্রেম বলে না জানি ।





            অনুগল্প... বুকের মাঝে
                    রমলা মুখার্জী

আত্মীয়স্বজন আর অতিথিদের আগমনে উদিতির ছোট্ট বাড়িটা যেন সানাই-এর সুরের সাথে আনন্দে হাসছে ।আজ যে তার মেয়ে ঝুলনের বিয়ে ।প্রিয় বান্ধবীর মেয়ের বিয়েতে হিমিকাও দারুণ ব্যস্ত।অনেক কষ্টে সুমনের কাছ থেকে হিমিকা আজকের ছুটিটা আদায় করতে পেরেছে ।অভিজ্ঞা বান্ধবীর ঘাড়ে বিয়ের প্রথাগত কাজকর্ম চাপিয়ে উদিতিও নিশ্চিন্ত ।গত শ্রাবণেই তো হিমিকার মেয়ে খুশির বিয়ে হল ।কত অশান্তি করেই না হোলো! খুশির পছন্দের আকাশ গরীব হলেও সৎ আর অনুভূতিপ্রবণ ছেলে ।কিন্তু সুমন কিছুতেই বিয়েতে রাজি ছিল না ।অর্থের দম্ভেই সুমন সব সময় ফুটছে, কারুর চাওয়া পাওয়াকে সে মূল্যই দেয় না ।ঘর পোড়া গরু হিমিকা কিন্তু খুশিকে  ভুল করতে দেয় নি ।অনেক লড়াই করে সে খুশির আকাশ ছুঁয়েছে ।হঠাৎ হিমিকার চিন্তার সুতো কেটে যায় একজনের মিষ্টি ডাকে,
-হিমু, আমায় চিনতে পারছ?
এই ডাক কি ভোলা যায়?
অতীত স্মৃতিতে হারিয়ে যায় হিমিকা
বড় সরকারি অফিসার সুমনের সাথে হিমিকার বাবা যখন হিমিকার বিয়ে ঠিক করলেন তখন গানের শিক্ষক তপনকে প্রত্যাখ্যান করে অনেক সুখের স্বপ্নে বিভোর হয়ে হিমিকা সুমনের গলায় মালা দিয়েছিল ।কিন্তু বিয়ের পর থেকে সুমনের ভয়ঙ্কর মেজাজ সামলাতে সামলাতেই হিমিকার এতটা বছর কেটে গেছে ।
-কি হল চুপ করে আছ কেন? সত্যিই কি চিনতে পার নি হিমু?
-চিনতে পেরেছি গো, তুমি ছাড়া এত আপন করে আমাকে আর কে ডাকবে বল?
-তুমি কি আর আগের মত গান কর? তোমার সুরেলা কন্ঠের সেই অসাধারণ গান কত দিন শুনিনি গো ।
-আর গান, দিনরাত মেজাজী বরের ফাইফরমাস খাটতে খাটতেই দিন চলে যায় ।
মনে পড়ে যায় হিমিকার তপনের সংগে নানান অনুষ্ঠানে গান করার কথা ।কত পরিচিতি তখন হিমিকার, আর নন্দন চত্বরে তপনের সাথে কাটানো প্রেমের দিনগুলো.... সত্যিই সুখ যেন উপছে পড়ত ।হিমিকার গাল বেয়ে নেমে আসে জলের ধারা।
-আমায় ক্ষমা করে দাও তপু ।
-ক্ষমা কিসের হিমু ।আমাকে সম্পূর্ণ করে বোঝার তোমার এই উপলব্ধি সেটাই তো আমার পরম প্রাপ্তি ।দুজনেই দুজনের বুকের মাঝে আছি সেটাই বা কম কিসের বল?






                 " কালবেলা
             হামিদুল ইসলাম।
               

প্রতিদিন এক দানব আসুরিক শক্তিতে ভেঙে ফেলে
সমস্ত সম্পর্কের বাঁধন
ভেঙে ফেলে চিলে কোঠা
সজীব প্রাণ
শক্তিই তার সঙ্গী
ইতিহাস এখন ম্রিয়মান   ।।

জলছবি তুলে ফেলি
মন থেকে
ফিরে আসে ভাগীরথী
সবুজ কেয়াফুলে সাজাই কুটির
এক একটি জীবন
প্রতিদিন এক একটি জীবনের কালবেলা    ।।









             বাড়িয়ে দাও হাত
              মহীতোষ গায়েন

অস্থির সময় এখন,মহামারী আতঙ্ক চরাচরে-
বিভেদ বৈষম্য ভুলে এসো বাড়িয়ে দাও হাত...
এসো,আগুনের পরশমণি ছুঁয়ে বিজয় গান গাই।

শপথের অঙ্গীকার নিয়ে আরো একবার অসহায়
মানুষের রুটি-রুজির সংগ্রামে সাথি হয়ে মানুষের সাথে মিশি;মানুষই মুমূর্ষু পৃথিবীর জিয়নকাঠি।





 
              সমীকরণ আর প্রশ্ন
               কৃষ্ণেন্দু দাসঠাকুর


বালির চরে উপুড় হয়ে, কাদামাখা স্যারের লাশটা--- প্রতিবাদ ছিন্নভিন্ন, আদর্শ সারারাত শিয়াল কুকুরে খুবলেছে। বুকপকেটে নক্ষত্রের মতো তখনও জ্বলজ্বল করছে, যেটা উঁচিয়ে স্যার বলতেন-- "অসির চেয়ে মসি বড়"।

থানার দুঁদে অফিসার মার্ডারের ক্লু খুঁজছিল---  হঠাৎ আবিষ্কৃত হল স্যারের পাজামার পেছনে একটা পরিছন্ন ছুরি... গোঁজা।

স্যারের দিকে তাকালাম--- সবার অলক্ষ্যে, ঠোঁটে তখনও একটা ব্যাঙ্গের হাসি ঝুলে...
                                 




অনুকবিতা :
শুভদীপ বিস্বাস
(১)
ভেজা বিকেল
কেউ আসেনি
মন ভিজেছে একলা ।

(২)
সন্ধ্যে টাকে
আটকে রাখে,
ইলেক্ট্রিকের আলো ।
ভালো ।

(৩)
বর্ষা রাতে,
বিছানা চমৎকার ।
একান্তই
একার ।

(৪)
অনেক দিনের পরে,
নিজের মত
নিজের মতন ঘরে ।






     
                 *পীড়া*
        --------------------- শঙ্খজিৎ দাস

  সাতসকালেই বাচ্চাটা কাঁদছিল.....

বাবা ওকে এক হাতে কোলে নিয়ে বাইর-বারান্দায় দ্রুত পায়চারি করছিল, আর চেষ্টা করছিল---গলিপথে পরিচিত কাউকে দেখা যায় কিনা। কারণ একটা বিড়ির খুব দরকার, উপরন্তু এক হাতে তার বিড়ি ধরাতেও অসুবিধা । টাইফয়েডে একটা হাত পঙ্গু । তারপর থেকে রোজগার আরও কম।ফলে বাধ্য হয়ে তাকে বি পি এল তালিকায় নামটা তুলতেই হয়,'বহুকষ্টে'।
  'বহুকষ্টে' এই কারণে যে বহুদিনের জমানো চাল বিক্রি করে সেই টাকা ঘুষ দিয়ে শেষমেশ সে ঐ তালিকাভুক্ত হয়। কিন্তু এখন আর চলছে না। 'করোনা'র কারণে লকডাউন চলছে।
         বাচ্চাটা ঘনঘন কাঁদছে।
  উপরন্তু বউ-এর খিস্তি। মাথাটা গরম হয়ে যায়। শেষে সেও লাইনে গিয়ে দাঁড়ায়। পাঁচ কেজি চাল আর দুই কেজি আলু। বাজারের মাঠে লম্বা লাইন। এবার  তার সামনে আর মাত্র দুজন দাঁড়িয়ে। তারপরেই তার পালা।

   কিন্তু লাইন থেকে হঠাৎ সে ছিটকে বেরিয়ে--- সোজা বাড়ি।
 
----" ক্যা,হঠাৎ কী এমন হইলো?"বউ-এর প্রশ্ন।
  দাওয়ায় বসে সে ছটফট করছিল। অনেকক্ষণ পরে সে উত্তর দিল-- "এই দয়ার দান আমি নিতে পারুম না।--ওরা ফটো তুইল্যা রাখতাছে।আর চাউল দিতাছে ঐ চেল্টু ন্যাতাটা, যারে আমি একদিন চাউল বেইচ্চা ঘুষ দিছিলাম।"

   বাচ্চাটা এবার তারস্বরে চীৎকার করে-----

ওর পিঠে জোড়সে একটা থাপ্পড় কষিয়ে বউ বলে---"এঃ,গরীব মাইনসের এত দ্যামাক কিসের---

    প্যাটে নাই যার ভাত
    দ্যাখ ক্যামন তার ঠাঁট!"






                    অরন্যর  দীর্ঘশ্বাস
                          সুব্রত দাস

উঁচু উঁচু টাওয়ার, বড় বড় অট্টালিকার পাশে,
ছোট্ট অরন্যটা ফ্যাকাসে  যাচ্ছে প্রতিনিয়ত ;
জনসংখ্যার চাপে গাছ গুলোও দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
নদীর চড়ে যেন ময়লা আবর্জনার আতুরঘর ।
অরন্যর সবুজ গুলো তামাটে বিবর্ণ হয়ে যায় ,
প্রকৃতির কোল শুকিয়ে শুকিয়ে কষ্ট আওড়ায় ।
বনপ্রহরী মানুষ হয়ে লিখে যায় পাখির কলতান
গাছেদের আর্তনাদ,আর কিছু স্মৃতির উন্মাদনা
মনে পড়ে  কাঞ্চনফুল,সারিসারি লম্বা গাছপালা, এঁকেছিল মনে ঘন শাল বাগান,চিরসবুজ মাঠ ।
ছোট ছোট ঘাস জলের বুকে শ্যাওলার গান ।
আজ সব অচেনা কাঁদে সত্তা অরন্যর দীর্ঘশ্বাস।‌।








                      পাগল জগনবাবু
                       উত্তম চক্রবর্ত্তী


জগন বাবু শিক্ষকতা থেকে রিটায়ার করেছেন। তাও কয়েক মাস হয়ে গেছে। কিন্তু ইদানীং সারা গ্রাম তন্ন তন্ন করে খুঁজেও  জগন বাবুকে পাওয়া গেল না। উনাকে আমার প্রভূত দরকার। বার দুই উনার বাড়ীতে খোঁজ করার পর এক মধ্য চল্লিশ মহিলা বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, " ত কি ব্যাপার, হামকে খুল্যে  বল, উয়াকে সকালের লে ধুঁইড়বার চাঁড়টা কিসের,  উয়াকে ইত কিসের দরকার ?"
বললাম, আমাদের আঞ্চলিক কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ওনাকে আমরা অঞ্চলের সেরা শিক্ষকের সংবর্ধনা দেব।
শুনেই মহিলা বললেন, " উটা আবার কি?
উটা দিয়ে কি হবেক্ ?"
বললাম সব কিছুর সাথে একটা স্বর্ণ পদক।
শুনেই মহিলা চুপিচুপি  বললেন, হা শুন, উ ইখন কাঁসাই লদীর আঁড়রি কোলে কোচুরির দিকে বট গাছট আছে ন, উখানেই সারাদিন বস্যে থাকে। কুলহি কুলহি চল্যে যাও ক্যানে ।উয়াকে উখানেই পাবে। তবে কাউকে উয়ার ডেরহাটা বইলহ না। "
প্রায় পড়ন্ত বিকেল। হাঁটা লাগালাম।
পৌঁছে দেখি, জগন বাবু আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে বার বার একটা খাতায় কি যেন লিখছেন।
কাছে গিয়ে ডাকলাম -জগনবাবু।
জগন বাবু একবার আমাকে দেখে আবার মুখটা ফিরিয়ে নিয়ে নিজের কাজে ব্যস্ত।
কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ---
জগনবাবু কি করছেন?
জগন বাবু আমার দিকে না তাকিয়ে বললেন, বক গুনছি ভায়া। আজ বক, গত কাল কাক, তার আগের দিন ট্যাঁসা গুনেছি। আগামীকাল চটি পাখি গুনতে হবে।
জিজ্ঞাসা করলাম, কেন?
আকাশের দিকেই তাকিয়ে জগন বাবু বললেন, আমার তরুনী স্ত্রী বলেছে, এখন পাগলের মত থাকবে, না হলে তোমার ভাইরা,রাবণের গুষ্ঠি আত্মীয় স্বজনেরা রিটায়ারম্যান্টের টাকা কারণে অকারণে চাইতে পারে। এখন পাগলের মত নদী তীরে বসে পাখি গুনবে।তাই আমার রিটায়ারমেন্টের সব টাকা তোমার বৌদি তার এক ভাইয়ের নামে এম, আই, এস করেছে। সুদের টাকা রেকারিং করে দিয়েছে। পেনসনের অর্ধেক টাকা তার এক জামাইবাবুর নামে ব্যাঙ্কে জমা করছে। বাকী অর্ধেক টাকা তোমার বৌদি স্নো-পাউডার, ক্রিম প্রভৃতি খাতে ব্যয় করে। আর আমার ছোট ভাইয়ের ব্যবসায় রক্ত জল করা উপার্জনের টাকায় সংসার চলছে। আমিও দেখলাম, বুদ্ধিটা মন্দ নয়। ঐ জন্যই তো বুদ্ধি করে তোমার বৌদি ছোট ভাইয়ার বিয়ে দিতে দিল না। সংসারে কানাকড়ি না দিয়েও সমাজ জানে আমিই সংসার চালাচ্ছি। তরুনী স্ত্রীর কথামতো চলছি বলে খাসা আছি ভায়া।
তা তুমি এখানে কি মনে করে?
সব বললাম।তাকে যে আঞ্চলিক কমিটি সংবর্ধনা দেওয়ার জন্য নির্বাচিত করেছে, তা শুনেই জগন বাবু আকাশ ফাটিয়ে হা-হা করে হাসতে লাগলেন। বুঝতে পারছি না , তিনি হাসছেন না কাঁদছেন। তারপর দুই হাঁটুর মাঝে মাথা নামিয়ে বসে রইলেন ।প্রাক সন্ধ্যায় কাঁসাইয়ের আদিম নিস্তব্ধতায় বসে আছি আমি ও জগনবাবু।
কিছুক্ষন পরে ধীরে ধীরে মাথা তুলে বসলেন। একটু ঝুঁকে আমার দিকে ভ্যাল ভ্যাল করে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলেন, তারপর নিরবতার বিরতি ঘটিয়ে  বললেন ," আজকাল আমিও বুঝতে পারি না ভায়া -হাসছি না কাঁদছি। " বলেই উঠে দাঁড়িয়ে ধেই ধেই করে নাচতে নাচতে কাঁসাইয়ের হাঁটু জল মাড়িয়ে ওপারের গলাকাটা ডুংরির দিকে আলো আবছা অন্ধকারে মিলিয়ে গেলেন। আমি একাকী নিস্তব্ধ কাঁসাই পারের বট তলায় যেন এক করুণ পরিণতির সাক্ষী হয়ে বসে আছি।
ভাবতে পারছি না, লোকটা পাগলের অভিনয় করতে করতে সত্যিই পাগল হয়ে গেল না তো !







             আকর্ষ
      শ্যামসুন্দর  মন্ডল


অর্ণা ও অর্পণ দুজনেই বনেদী পরিবারের সন্তান। পরিবারের অনেকটা অমতে ভালোবেসে দুজনের বাসা বাঁধা।কিন্তু বিয়ের পর প্রচন্ড সেন্টিমেন্টাল অর্ণার উপর মনস্তাত্ত্বিক পীড়ন হতে থাকে,অর্পণের অদৃশ্য অপারগতার কারণে। একদিন সহ্যের সমস্ত সীমা অতিক্রম করলে অর্ণা বন্ধনের অদৃশ্য সুতোটা ছিঁড়ে চলে যেতে প্রস্তুত হয়। ব্যর্থতার সমস্ত দায় ও কলঙ্ক মাথায় নিয়ে অর্ণা ন্যূব্জ। তবু্ও, একফোঁটা কলঙ্ক ও....। না, অর্পণকে দেয় নি অর্ণা।

সেদিন। খুব সকাল। অর্পণ ঘুম থেকে উঠে নি। অর্ণা মাথার কাছে দাঁড়িয়ে খুব শান্তভাবে ডাকে,"ওঠবে না।" অর্পণ পাশ ফিরতে ফিরতে বলে, "হুঁ।" অর্ণা তেমনি ভাবেই বলল," যাচ্ছি।" অর্পণ ঘুমঘুম চোখে জিজ্ঞেস করে,"কোথায়?" অর্ণা বলে,"জানি না।"
"মানে!" বলে অর্পণ ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। অর্ণা বলে চলে,"আমার প্রয়োজনীয়তা বোধহয় ফুরিয়েছে। আর অপ্রয়োজনীয়তা বহন করার বিড়ম্বনা,তাই বা কম কি! " তারপর নিঃস্ব আকাশের নিরবতা।

খানিকপরে আচমকা নিরবতা ভেঙে"তুমি অন্তত নিজের যত্নটুকু নিও।" অর্ণার এই শেষ কথাগুলোয় অর্পণের বুকের ভিতরটা যেন হুহু করে কেঁপে উঠল, যেন এক নিমিষেই মরুদ্যান ছাড়া ঊষর মরুভূমি হল। অর্পণ দেখল,যে লতাটি এত দিন ধরে একটু একটু করে উপরে উঠছিল,আজ আলগোছে হয়ে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কার হাওয়ায় ভীষণ দুলছে। অর্পণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে অর্ণার হাত দুটো খপকরে ধরে  নিজের বুকের উপর টেনে নিয়ে উৎকন্ঠায় বলে উঠে, "অর্ণা।" অর্ণা তার মুখের দিকে চেয়েই শান্তভাবে বলে," বলো।" অর্পণ কাঙালের মতো সমস্ত সংকোচ ও দ্বিধা কাটিয়ে বলে," অর্ণা,আমি আমাকে তোমাকেই দিলাম।পারো না নিতে?" আর ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। অর্ণার মুখে কথা নেই। শুধু দু'হাতে শক্ত করে অর্পণের গলা জড়িয়ে ধরে বুকের কাছে টেনে নিল। আর সমস্ত প্রতিরোধকে ব্যর্থ করে অশ্রু অর্ণার দুগাল বেয়ে বাথাতুর বুককে ছুঁয়ে অর্পণের উপর নিঃশব্দে পড়তে থাকল।



Sunday, July 19, 2020

রবিবারের স্পেশাল সংখ্যা




           যে ছড়া খুঁজছি আমি
             উৎপলকুমার ধারা

ছড়াটি কোথায় গেল,  ও-ছড়া খুঁজছি তোকে
ঘুম চোখে হাতড়ে বেড়াই তোকে আজ স্বপ্নলোকে
খুঁজছি আকাশ-পাতাল ধরতে পারছিটা কই
খুঁজে ঠিক আনবো তোকে ঘাঁটছি অজস্র বই !

খুঁজছি সেই ছড়া যে সকালের স্বপ্ন এঁকে
আতরের গন্ধ ছোটায় না-ফোটা কুঁড়ির থেকে
সুর তাল ছন্দ বুনে শিশুদের মাতন আনে
হাটখুলে পাখনা ম‍্যালে ছোটদের ছড়ার গানে !

যে ছড়া পাখির ঠোঁটে সুরেলা ছন্দ ফোটায়
রাতে বাঁশগাছের মাথায় জ‍্যোৎস্নার চাঁদকে ওঠায়
শিশু ও কিশোর মনে বাঁধভাঙা তুফান তোলে
যার সুরে ঘুমিয়ে পড়ে দুষ্টুরা মায়ের কোলে !

আমি সেই ছড়ার পাগল জেনে গেছে আজ অনেকেই
ছড়াতে ছন্দ পেলেই নাচি আমি ধেই ধেই ধেই
যে ছড়া খুঁজছি আমি পেলে তাকে সন্নিকটে
রাখবো যত্ন করে আমারই মনের পটে !!




           আলো ও ছায়ার সমীকরণ
              বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়


 নিস্তব্ধ মাঝরাতে আমি একদিন হঠাৎ কান্নার শব্দ শুনতে পেলাম। কেউ কাঁদছে।কোথায় কতদূরে তাও জানি না। শুধু শব্দ শুনতে পাচ্ছি। অনেকদিন আগেও আমার একবার এরকম হয়েছিল। ফলে ভয় না পেয়ে আমি জানলা দিয়ে তাকালাম। যতদূর চোখ যায় দেখতে লাগলাম। খুঁজতে লাগলাম শব্দের উৎসমুখ। শুনশান হয়ে গেছে চারদিক।জোনাকিরাও তাদের বাতি নিভিয়ে ঘরে ফিরে গেছে । স্তব্ধ জানালায় চোখ রেখে আমি তন্ন তন্ন করে দেখতে লাগলাম অন্ধকার। অন্ধকারের ভেতর লুকিয়ে থাকা কান্না ।কম্পিউটারে অসমাপ্ত গল্পের অক্ষরগুলো ঘুমিয়ে পড়লে এমনিতেই  নিজেকে একা লাগছিল । মনে হয়েছিল  সমগ্র পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এক নির্জন দ্বীপে নির্বাসিত আমি । তারপর এরকম এক রাত। যখন সমস্ত নিস্তব্ধতাকে চিরে কেউ কাঁদছিল ।প্রথমে আমি বুঝতে পারছিলাম না  এতই মৃদু ছি ল তার উচ্চারণ।তারপর আওয়াজটা ধীরে ধীরে বাড়তে লাগল। কেউ জেগে ছিল না সেদিন  সারা বাড়িতে। মা, বাবা, ছেলে মেয়ে ।শুভমিতা এক একদিন আমার সাথে পাল্লা দিয়ে অনেক রাত অবধি জেগে থাকে।সেও তখন স্বপ্নের দেশে।নানা রঙে ও মুদ্রায় অলীক এক পৃথিবী গড়ে তুলছিল সে।স্থির ও নীরব  তার ভাষা।গভীর জিজ্ঞাসায় তার স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছিলাম  আমি- মিতা তুমি কোন কান্না শুনতে পাচ্ছো?
তছনছ হয়ে যাওয়া ঘুম থেকে নিদ্রালু চোখ কচলাতে কচলাতে শুভমিতা বলেছিল -  না তো। কই কিছুই তো শুনতে পাচ্ছি না আমি।
অথচ কান্নার সেই ঢেউ আমাকে ভিজিয়ে দিচ্ছিল  তখনও। জানলা পেরিয়ে দূরে ধানখেতের পাশ দিয়ে একটা তরঙ্গ হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে এসে লাগছিল আমার কানে।
তুমি পাচ্ছো না? সত্যিই পাচ্ছো না? এক অবিশ্বাস থেকে গলার স্বর যেন তীব্র হয়ে উঠছিল।
শুভমিতা কান পেতেছিল  মৃদু ও মর্মভেদী কান্নার শব্দ শুনবে বলে। কিন্তু সে পায় নি । এক মোচড় দেওয়া কষ্ট নিয়ে বিলাপের ধ্বনি ভেসে আসছিল  অথচ কেউ শুনতে পাচ্ছিল  না শুধু আমি ছাড়া । এরকম হওয়ার কথা নয়  অথচ এরকমই হয়েছিল সেদিন । চুপচাপ জানলা বন্ধ করে আমি শুয়ে পড়েছিলাম ।এতেও শব্দ প্রতিহত হয়নি  বরং তা আরও গুমরে উঠেছিল।
অবিন্যস্ত চিন্তার ভেতর ধাক্কা মারছিল  হাহাকার। কেউ যেন আমার নাম ধরে ডাকছিল – মাধুর্য,মাধুর্য। তারপর এক আর্ত চীৎকার যে চিৎকৃত  শব্দের ভেতর কোন নির্দিষ্ট উচ্চারণ ছিল না ।পরিষ্কার কোন কথা ছিল না। শুধু কেউ  যেন নিজের সমস্ত হাহাকার নিংড়ে বাতাসে ঢেলে দিচ্ছিল  ক্রমাগত।তীব্র আকাশ ফাটানো সেই চীৎকার অন্যেরা শুনতে পাচ্ছিল না। তাহলে সবাই কি বধির হয়ে গেছে? আমি ভাবছিলাম।এত প্রাণপণ গোঙানি যে দরজা জানালা তছনছ হয়ে যাচ্ছিল। মনে হয়েছিল শুভমিতাকে বলি তোমার কানগুলো বোধহয় আর খুব বেশি  সক্রিয় নেই। বলা হয়নি সেকথা।  এসব ভাবতে ভাবতে কখন ঘুম এসেছিল আমি নিজেই জানি না। সূর্যের আলো  সকালবেলাকে আগের মতোই রাঙিয়ে দিয়েছিল আবার। শুভমিতা বলেছিল- তোমার পাগলামি দিন দিন বাড়ছে,আজ থেকে আর রাত জেগো না।পারলে একবার ডাক্তার দেখিয়ে নিও।শরীর দুর্বল থাকলে এরকম হয়।
পাগল! একই সত্যিই পাগলামি।  নিজের খুবই খারাপ লাগছিল। সবাই বিভ্রম মনে করলেও আমি তো স্পষ্ট শুনেছি সেই ডাক, সেই কাতরানি । যাইহোক সেসব যত তাড়াতাড়ি মন থেকে মুছে ফেলা যায় ততই মঙ্গল। ভুলেই গিয়েছিলাম।নিজের কাজের ভেতর মন জড়িয়ে পড়েছিল আনন্দে।এরকম ঘটনা তো রোজ রোজ ঘটার নয়। তাই কখন স্মৃতি থেকে মুছে গিয়েছিল  টেরই পাইনি।

হঠাৎ সেদিন সৌমিত ফোন করে বলল-  মাধুর্য,তুই খবরটা শুনেছিস?

কোন খবর? জিজ্ঞাসায় তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছিল  আমার স্নায়ু।

শুনিস নি?অর্পণ আর আমাদের মধ্যে নেই।

অর্পণ নেই। শব্দদুটো শোনার সাথে সাথে  মনটা কেমন হু হু করে উঠল। বুকের ভেতরটা শূন্য মনে হল এ হতেই পারে না। আমাদের স্কুল কলেজের সবচেয়ে উজ্জ্বল প্রাণবন্ত ছেলে ছিল সে।সজীব ও চঞ্চল। সবসময় কিছু না কিছু কাজ করার উন্মাদনা তাকে তাড়া করত। অত্যন্ত মেধাবী। যেকোন বিষয় নিয়ে অসীম তার পড়াশোনা।অথচ কী আশ্চর্য সে কোন চাকরি করল না।কোন চাকরির পরীক্ষায় বসল না অবধি।

আমি প্রশ্ন করেছিলাম – কী পাগলামি করছিস? জীবন কি এভাবেই চলবে?

হেসেছিল অর্পণ – আমার পিপাসা যে অনেক।

তাহলে বড় বড়  চাকরির পরীক্ষায় বোস।

এবার আরও এক উন্মাদ হাসিতে আমাকে তছনছ করে দিয়েছিল অর্পণ- মাধুর্য, আমার তৃষ্ণা এক জীবনে মিটবার নয়।যদি কোটি কোটি টাকা সঞ্চয় আমার স্বপ্ন হত। তাহলে হয়তো পূরণ করতে পারতাম চেষ্টা করলেই। কিন্তু সারা পৃথিবীতে যত মূল্যবান বই আছে সব পড়বার পিপাসা কি এক জীবনে শেষ হবে? জানি শেষ হবে না। তবু এই স্বপ্নটাই আমি দেখি।অসফল হবে জেনেও একটা বড় স্বপ্ন দেখতেই আমার ভালো লাগে।

সৌমিত চুপ করে ছিল মোবাইলের অন্যপ্রান্তে। আমার মনে পড়ে যাচ্ছিল  অনেক কথা। স্মৃতির ভেতর দিয়ে যেতে যেতেই সৌমিতকে প্রশ্ন করলাম- কী হয়েছিল? এত তাড়াতাড়ি তো ওর চলে যাওয়ার কথা নয়।

-      ক্যানসার। রক্তের ভেতর বাসা বেঁধেছিল মারণ রোগ। কাউকে বলেনি। আমি যখন জেনেছিলাম তখন প্রায় শেষ অবস্থা।

সময় কত নিষ্ঠুর । এভাবে বললে সময়ের উপর সব ভার চাপিয়ে নিজেকে মুক্ত করা যায়।কিন্তু আসলে আমরা প্রত্যেকেই উদাসীন।এত কাছের বন্ধু। হরিহর আত্মা বলতে যা বোঝায় তাই। অথচ পরবর্তীক্ষেত্রে তার ন্যুনতম খবরটুকু রাখার দরকারও আমি মনে করিনি।আমি বা আমার মতো অনেকেই।

সৌমিতের গলার স্বরে বেদনা  - ওর কষ্ট সহ্য করা যাচ্ছিল না। শেষবার যখন  ওকে দেখতে যাই তখন শরীরটা মিশে গিয়েছিল বিছানায়।মর্মভেদী চীৎকার ছাড়া আর কিছুই ছিল না। আকাশ কাঁপানো শব্দে কান্নার ধ্বনি মিশে এক হাহাকারের রূপ নিচ্ছিল।সে যে কী ভয়ানক তোকে বোঝাতে পারব না মাধুর্য।কান্নার ভেতর বারবার করে বলছিল  তোর কথা।তোকে দেখতে চেয়েছিল অন্তত একবার।

নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছিল আমার।এক ভয়ংকর অপরাধী।এর যেন কোন ক্ষমা নেই।  সৌমিত ফোন ছেড়ে দেওয়ার আমার কেবলই মনে হচ্ছিল এই কান্নার ধ্বনিই তো আমি শুনতে পাচ্ছিলাম সেদিন রাতে।কতদূর থেকে অর্পণ আমাকে ডাকছিল।হাজার কিলোমিটার দূর থেকে।একসময় যার সাথে সব যন্ত্রণা ভাগ করে নিতাম। জীবনের আলো অন্ধকার, প্রতিটি মনখারাপ।সেই অর্পণ তার জীবনের চুড়ান্ত বেদনা কি আমার।





                পাখির ডানার উড়ান
                   প্রশান্ত ভৌমিক 

                            ছয়

আজকে ধর্ম পরীক্ষা বিকেলবেলা। সকাল থেকে খুব টেনশন হচ্ছে। গতকালের ইংরেজি পরীক্ষা খুব ভাল হয়েছে। কিন্তু অন্য বিষয়ের চাপে সারা বছর ধর্ম খুব ভাল করে পড়া হয়নি। অথচ অন্য ছাত্ররা কেউ ধর্ম নিয়ে টেনশন করছে না। আমি গত ১৫ দিন ধরে শুধু পড়া নিয়েই ছিলাম। খুব মন দিয়ে পড়েছিলাম। তাও মদন স্যারের ক্রোধ থেকে বাঁচতে পারিনি। নানা রকম পদ্ধতি আবিষ্কার করে তিনি আমায় শাস্তি দিয়েছেন, অপমান করেছেন। আমি গায়ে মাখিনি। ওনার মত উনি চলেছেন, আর আমার মত আমি চলেছি।
তবে আমার সত্যিই খারাপ লেগেছিল যেদিন তিনি প্রথম আমায় কান ধরে উঠতে বসতে বলেন। আমি এর আগে কল্পনাও করতে পারিনি ২০০২ সালে এসেও এরকম ধরনের কোন শাস্তির মুখোমুখি হতে পারি। আচ্ছা, ব্যাপারটা খুলেই বলি। একদিন মদন স্যার একটি অংক করতে দিয়েছিলেন। আমি করতে পারিনি। পারার কথাও নয়। কারণ, লগারিদমের এই অংকগুলো স্যার আগে আমাকে করান নি। কিন্তু না পারার শাস্তি স্বরূপ স্যার আমাকে বললেন ২৫ বার কান ধরে উঠবস করতে। আমি ভেবেছিলাম স্যার বোধহয় আমার সাথে দুষ্টামি করছেন। তাই আমি গুরুত্ব দেইনি কথাটাকে। আমি কান ধরছি না দেখে স্যার শুধু জিজ্ঞেস করলেন- তুই কান ধরবি কি ধরবি না?
আমি না বলাতে স্যার আর কিছু বললেন না। স্বাভাবিকভাবে পড়ালেন। পড়ানো শেষ করে চলেও গেলেন। কিন্তু এরপর আর অনেক দিন পড়াতে এলেন না। এক সপ্তাহ, দুই সপ্তাহ করে এক মাস পার হয়ে গেল, কিন্তু স্যার আর আসেন না। বাবা আমাকে একদিন জিজ্ঞেস করলেন স্যার আসছেনা কেন?
আমি বললাম- জানি না।
বাবা জানালেন অর্ণবকে তো নিয়মিতই পড়াতে যাচ্ছেন। স্যার আমাকে সপ্তাহে দুই দিন অংক করালেও অর্ণবকে ছয় দিন পড়াতে আসতেন। ওকে ইংরেজি ছাড়া বাকি বিষয়গুলো তিনিই পড়াতেন। আর ইংরেজি পড়ানোর জন্য মদন স্যারের বন্ধু নেপাল স্যারকে রাখা হয়েছিল।
বাবা আর কিছু বললেন না। পরের দিন বাবা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন মদন স্যারের কোন কথা আমি শুনিনি?
আমি হঠাৎ করে ভেবে পেলাম না বাবা এমন কথা বলছেন কেন? বাবাই খুলে বললেন ঘটনাটি। মদন স্যারকে আজ বাবা জিজ্ঞেস করেছিলেন না আসার কারণ। স্যার বলেছেন, আমি স্যারের কোন কথা মেনে চলি না, তাই তিনি আমাকে পড়াবেন না।
আমি একটু ভাবতেই মনে পড়ল স্যার আমাকে কান ধরে উঠ-বস করতে বলেছেন, আমি করি নি। তখন বাবাকে পুরো ঘটনা খুলে বললাম। সাথে আগের সব কথা। মানে মদন স্যারের করা অপমানের কথা, অন্যায় অত্যাচারের কথা। বাবা চুপচাপ সব শুনলেন। কিন্তু গুরুত্ব দিলেন বলে মনে হল না। শুধু বললেন- আমি কথা বলব।
পরদিন বাবা কথা বললেন। রাতে এসে আমাকে জানালেন স্যারের সঙ্গে কথা বলেছেন। সাথে বললেন, এখন থেকে যেন স্যারের সব কথা মেনে চলি। পাশাপাশি যেন মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করি।
আমি দিশেহারা বোধ করলাম। এতদিন ভরসা ছিল মদন স্যারের অত্যাচারের হাত থেকে নিশ্চয়ই বাবা আমাকে মুক্ত করবেন। কিন্তু সে আর হল কই? এখন দেখছি সে গুড়ে বালি। আমি বাবাকে আবারো সব কথা বোঝাবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু বাবা আমাকে থামিয়ে দিলেন। বললেন, স্যার নাকি অর্ণবদের বাসায় সবার সামনেই বলেছেন আমি কোন পড়াশুনোই করি না। আর যাই হোক, আমাকে দিয়ে কোন ফলাফল আশা করা যায় না। তাই বাবাকে বুদ্ধি দিয়েছেন যত দ্রুত সম্ভব আমাকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে কোন দোকানের কাজে কিংবা রিক্সা চালানোতে লাগিয়ে দিতে। শুনে বাবা খুব দুঃখ পেয়েছেন। তাই তিনি চান, আমি যেন ভাল ফল করি পরীক্ষায়। কারণ, যখন মদন স্যার অর্ণবদের বাসায় বসে এসব কথা বলছিলেন তখন অর্ণবের মা-ও ভেতর থেকে হাসাহাসি করছিলেন। বাবা খুব অপমান বোধ করেছেন। তাই স্যারকে বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজি করিয়েছেন আবার পড়াতে আসার জন্য। সাথে কথা দিয়ে এসেছেন, আমি এরপর থেকে সব কথা মেনে চলব।
বাবা কথা দিয়ে এসেছেন। আমিও মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম, বাবার দেয়া কথা রাখব। দু’দিন পরে মদন স্যার পড়াতেও এলেন। বাকিটা ইতিহাস!
নবপর্যায়ে প্রথম দিন এসেই স্যার স্বমূর্তি ধারণ করলেন। ঘরে ঢুকে প্রথম ডায়লগই হল- সেদিন ২৫ বার কান ধরতে বলেছিলাম। যেহেতু সেদিন ধরিসনি, তাই আজ সেটা ২৫০ বার করতে হবে। আমি বিনা বাক্য ব্যয়ে শুরু করলাম। জেদের বসে ২৫০ বার কান ধরে উঠ-বস করতে শুরু করা আর ২৫০ বার কান ধরে উঠ-বস করা- সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার। ৬০-৭০ বারের পর থেকে আমার খুব কষ্ট হতে লাগল। কিন্তু আমি দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে চালিয়ে যেতে লাগলাম। ১৫০ বারের পর আর কোনমতেই করতে পারছিলাম না বলে স্যারকে বললাম, বাকি ১০০ বার একটু পরে করব। স্যার বিদ্রুপ মেশানো হাসি দিয়ে বললেন- তাহলে আমি চলে যাচ্ছি। বাকি কথা তোর বাবার সঙ্গে বলে নেব।
আমি স্যারকে আর কিছু না বলে আবার উঠ-বস করতে শুরু করলাম। যখন ২৫০ বার শেষ হল, লক্ষ্য করলাম ততক্ষণে পার হয়ে গেছে ৩৫ মিনিট সময়। তার মানে স্যার আর ২৫ মিনিট পড়াবেন। আমি মোড়ায় বসার চেষ্টা করতে গিয়ে দেখলাম আমি সোজা হয়ে দাঁড়াতেই পারছি না।
ফ্লোরে বসে বসেই পড়তে লাগলাম। পা দু’টো যেন আমার নয়। নাড়াতেই পারছিলাম না। স্যারের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হল, খুব খুশি হয়েছেন আমার দুর্দশা দেখে। মুচকি মুচকি হাসছেন। আমি অপেক্ষা করছি ১ ঘণ্টা পার হয়ে যাওয়ার। কিন্তু আমার ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে স্যার সেদিন ২ ঘণ্টারও অধিক সময় পড়ালেন।
স্যার চলে যাওয়ার পর আমি মেঝেতেই শুয়ে পড়লাম এবং শুয়ে রইলাম বেশ কিছুক্ষণ। এরপর কোনমতে উঠে দেয়াল ধরে ধরে বাথরুমে গেলাম। বাথরুম থেকে বেরিয়ে শুয়ে পড়লাম বিছানায়। রাতে যে উঠে ভাত খাব, সেই শক্তিটুকুও অবশিষ্ট নেই। মা ভেবেছিলেন আমার বোধহয় জ্বর কিংবা পেটের গোলমাল। তাই ঠিকঠাক না চলার জন্য কিছুক্ষণ বকাবকি করলেন। তারপর ভাত খাইয়ে দিলেন। আমি চেতন-অচেতনের মাঝামাঝি থেকে ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরদিন ভোরবেলা উঠে দেখি, আমি আর কোন পা নাড়াতে পারি না। মা প্রথমে ভাবলেন আমি খেলতে গিয়ে পায়ের এই অবস্থা করেছি। পরে মনে করে দেখলেন, আমি গত দুই মাসেও কোথাও খেলতে যাই নি। জানতে চাইলেন, ব্যাপার কী? আমি সব খুলে বললাম। মা সব কথা বাবাকে জানালেন। কিন্তু কোন ভাবান্তর নেই কারোরই। তিন-চারদিন ভুগে স্বাভাবিক হলাম। আমার জীবনযাত্রাও স্বাভাবিক হয়ে পড়ল। অস্বাভাবিকতার মধ্যে শুধু কানে ধরে উঠ-বস করাটা আমার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে পড়ল।
আজ এতদিন পরে কথাগুলো মনে পড়তে প্রথমে শিউরে উঠলাম। পরে আর তেমন কোন অনুভূতি হল না। আমি এসব শাস্তি পেতে পেতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। একদিনে সর্বোচ্চ ২৯০০ বার কান ধরেও স্বাভাবিকই ছিলাম।
ধর্ম পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে নিতে বিভিন্ন কাহিনি পড়ে অবাক হলাম। সত্যিই কি এমন হয়? দেবতাদের সত্যিই এত ক্ষমতা? তাহলে তাঁরা কেন আমাকে এই অত্যাচারী শিক্ষকের হাত থেকে বাঁচাবেন না? নাকি শিক্ষকই ঠিক? আমি ভুল করছি বারবার।
সিদ্ধান্ত নিলাম, পরীক্ষাটা শেষ হয়ে যাক, এখন থেকে পুজো-আর্চায় মন দেব পুরোপুরি। তাহলে যদি কপাল ভাল হয়! দ্বিগুণ মনোযোগে পড়া শুরু করলাম। গীতার শ্লোকটি প্রায় শেখা হয়ে এসেছে। আবার পড়া শুরু করলাম-
অনেক বাহুদরবক্রনেত্রং...



এসো, তুমি এসো
                            অমিত দত্ত

আজ যে স্থান শূন্য
কাল হবে পরিপূর্ণ

আজ যে রিক্ত
আগামীতে সে সিক্ত

আজ তুমি পিপাসার্ত
কাল পূর্ণ হবে তব পাত্র

আজ ধূসর চোখে রুক্ষ্মতা খেলা করে
আগামী বর্ষায় সজল আহবাণ সবারে

আজ সাদা কালো ভেদাভেদ প্রতি কোণে
প্রেমবারি আগামীতে থাকবে প্রতি মনে

মেঘমল্লার রাগে নীর তুমি নামো ঝরোঝরো
রক্তসিক্ত ভূমি তুমি পূণ্যতীর্থ করো

আজ কঠোর কঠিন মন কোমল পরশ চায়
উঁচিয়ে থাকা ব্যারেলও তোমাতে মাতৃগন্ধ পায়

বরষা তুমি নেমে এস শুধু নামার কারণে নয়
তুমি এলে পরে আজও ক্যাকটাসে ফুল হয়




            স্বত্তা
    বিশ্বজিত মুখার্জ্জী

জীবনবোধে জেগে কালো স্বার্থের পুঁজি,
অসাড় অস্তিত্বে বাঁচার মানে খুঁজি।
হাত আছে তাই হাতাহাতিতেই ব্যস্ত,
ঘুমন্ত হৃদয় হৃদয়হীন হতে অভ্যস্ত।
জীবন রঙ্গিন পাপড়িগুলোকে করতে উন্মুক্ত,
অসহায় মানুষগুলোকে জড়িয়ে ধরতে বিরক্ত।
অস্তিত্ব প্রমাণে স্থবির থেকে অনড়,
মানব খুঁজে ফেরে চারিত্রিক বিবর।
পোড়া আগুন স্পর্শে মন বিদ্রোহী,
জীবন অস্তিত্বের আড়ালে লড়াইয়ে আগ্রহী।
সমাজের জানালায় ডুকছে তাজা বাতাস,
অসাড় আমিত্বে ঘুমিয়ে মনের ক্যানভাস।






                      বৃষ্টি ভেজা রাত
                         সুতপা মন্ডল

টুপ টাপ বৃষ্টি পরেই যাচ্ছে ঘরের ভিতর। বালতি, বাটি, গামলা, গ্লাস রেখে জল থেকে বাঁচার চেষ্টা।
  টানাটানির সংসারে, ছাদ সারানোর অতিরিক্ত খরচা কিছুতেই জোগাড় করতে পারছে না জয়ন্ত। ভেবেছিল, এপ্রিলের প্রথমে ইনক্রিমেন্টের টাকাটা পেলে ছাদটা সারিয়ে নেবে।তার আগেই বসন্তে অকাল বর্ষণ রাতের ঘুম কেড়েছে।
বৃষ্টি কমলো কিনা দেখতে, জানালা খুলতেই ফুটপাতের ছোটো ছেলেটাকে দেখতে পায় সে,  ভিজে ঠান্ডায় কাঁপছে। না, আর কপালের দোষ দেবে না, মাথার ওপর কমপক্ষে ছাদটা  আছে। দরজার বাইরে পা বাড়ায়........





       পর্যটন এবং....
     শর্মিষ্ঠা সাহা

ঝমঝম করে বৃষ্টির জল
পাহাড়ী ঢাল বেয়ে নেমে আসছিল
রৈখিক মননে,
তারপর উঁচু নীচু সিঁড়ি বেয়ে
মিলিয়ে গেল নীচে কোথাও
সমচ্চোশীল ধর্মে ।
আমি ঐ সিঁড়ি ধরে নামতে নামতে
দেখলাম, প্রত্যেক সিঁড়ির গায়ে
কাহিনী খলনায়কের,
আর নীচে জলে ভেসে যাচ্ছে
লোমহীন, চামড়াহীন দেহ,
সবই জাতক ।
দেখতে দেখতে ভ্রান্ত হলো আমার গন্তব্য
উৎস আর মোহানার গতিমুখ ,
আমি নারী পর্যটক ।।






                 শূন্য মিনা
         হীরক বন্দ্যোপাধ্যায়

শূন্য মিনারের পাশে শতছিন্ন দেহ বাতাসে উড়ছে
পৃথিবী যে বানিয়েছিল বাতাস কিংবা নদী
পাহাড় কিংবা ঝর্ণা গ্রীষ্মের হাতপাখা
চাষ করে এনেছিল যারা শস্যধারা,কারখানা থেকে লৌহ ইস্পাত শতাব্দী রাজধানী ছুটিয়েছিল দুরন্ত, সে যদি ভুখা থাকে শ্রেণীহীন রাষ্ট্রহীন গণতন্ত্র কোথায় মুখ লুকিয়ে থাকে

এখন যেদিকে তাকায় দেখি নি:শব্দে মুহুর্মুহু
হাওয়া ওঠে খুব মনে হয় সমুদ্র কাছাকাছি বোধহয়, যে দেশে মীরজাফর বিভীষণ নরেন গোসাই ভায়েদের ভাতের হাড়ির খবর পাচার করে ছত্রহীন করেছিল বিপ্লব সে দেশে
স্বর্গরাজ‍্য হবে নিশ্চিত, এ তো স্বত:সিদ্ধ
যেদেশে আ্যন্টিসেপটিক থেকে কন্ট্রাসেপটিভ
কেলেঙ্কারি কোলগেট স্ক‍্যাম চিটফান্ড আই পি এল বেটিং সারদা নারদা সেদেশের ছেলেরা যে হাজারো ধর্ষক হবে এ আর বেশি কথা কি ?
লোভ ঈর্ষাকাতরতা থেকে বন্ধুত্বের অপমান
প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে কাকড়া কালচার
শুয়ার কা বাচ্চা ,কালো কুত্তা ...পুতুপুতু প্রেমজন্ম নেবে সেবাদাস সেবাদাসী

যে ভাগ্যবান নিষ্প্রাণ বরফের মতো সাদা
ছায়াপথে মিছিলের মুখগুলি নিষ্কলুষ নীল হয়ে যায়,আর এদিকে সুন্দর শুভেচ্ছা মূর্তি
পাজামা পাঞ্জাবীতে অবিচল তুমি এখনো
কুরুক্ষেত্র আর অযোধ্যা নিয়ে কবিতা লিখে যাও রাসকেল ....





                মিষ্টি বৃষ্টি
            ডঃ রমলা মুখার্জী

 ধুৎ তেরি, অঝর ধারায় হঠাৎ এল বৃষ্টি....
কি করি এখন, কোথায় যাই, একি অনাসৃষ্টি!
অগত্যা একটু দাঁড়াই ঐ পাশের দোকানে-
কত টুকরো কথা আসছে ভেসে দু কানে।
বড় চেনা একটা আওয়াজ যেন কানে আসে......
চকিতে তাকাই আমি এ পাশ ও পাশে।
ওকে দেখেই হৃদয়-মাঝে লাগল খুশির দোল-
স্নায়ু-স্পন্দনে বয়ে গেল আনন্দের হিল্লোল।
ও বললে," বৃষ্টি থামতে হবে হয় তো দেরি -
চল আজ আমরা দুজন অকাজেতেই ঘুরি"।
বৃষ্টি তুমি বড় মিষ্টি প্রিয়কে দিলে এনে-
টিপ্ টিপ্ পড়বে যখন ভিজবো তাতে দুজনে।






               শ্রম
      মহীতোষ গায়েন

বহুদিন সূর্য দেখিনি,আকাশ দেখিনি
শুনিনি পাখির ডাক,দেখিনি মুঠোভাত,
রুটির জন্য হাড়ে কালশিটে দাগ...
হাড়ভাঙ্গা খেটে কাটে বিনিদ্র রাত।

এখন চারিদিকে নানা নিষেধ জারি...
মরণের সাথে লড়ে জীবন আসর;
এলোমেলো পড়ে থাকে ঘর সংসার
চোখের জলে ভাসে শ্রমের বাসর।






অস্থির সময়
               অপূর্ব রায়

এই ঝাঁ চকচকে  শহর
কোথায় ও মাটি নেই
শুধু পাথর, ইট ,কাঠ
স্থান নেই !
কংক্রিট বুক জড়িয়ে ধরে প্রাচীন শিকড়
আরো একটু সময় বাঁচতে চায়
উঁচু আকাশের নীচে স্বপ্ন স্বাদ নিতে চায়
                    [  ১]

  ওকে ঝাড়েমূলে কেঁটে ফেল
 না হলে  , দেওয়াল ভেঙে যাবে
অনেক যাযাবর পাখিরা আসবে ;
ঘর নোংরা হবে
সারা রাত ক্যারম্যাচর
ঘুম হবেনা
ওকে ঝাড়ে মূলে কেঁটে ফেল
           (  ২ )
সময় টা স্থির নয়
সূর্য এখন মাথার উপরে
ঠা ঠা রোদ্দুর
দৃষ্টি চলে না
মনে হল একটা প্রাচীন সবুজ আশ্রয় প্রয়োজন আছে
সে সুসময় হোক আর অসময় হোক
ঝাড়ে মূলে তাকে উচ্ছেদ করো না
                (  ৩)
সময় চক্র স্থির না
একদিন তুমিও ...
সে দিন সন্ধ্যা নামবে
বলবে ঝাড়ে মূলে বিদায় করো.





পালোয়ান
অনিক চক্রবর্তী

নাম তার
দামোদর
       বড়ো পালোয়ান
কুস্তি তে
হারিয়েছে
       হাজারো জোয়ান
সারা দিন
কাজ তার
      মুগুর ই ভাজা
তাতে নাকি
দেহ মন
      হয় তর তাজা
যা পায়
তাই খায়
       নেই কোনো মানা
এমন কোনো
পালোয়ান
      আছে কারোর জানা?

   



গাইডলাইন
--চিরঞ্জিৎ বৈরাগী

ভাঙাচোরা পেরিয়ে কংক্রিটের দেওয়াল
পিছনে নীল কিংবা ভারত মহাসাগর
ব্যারিকেডহীন শূন্যতায় অদ্বিতীয়

কয়েকটি বিকল্প
                হিম-উষ্ণ লড়াই
                মিশরীয় মমি
আর বাউন্ডারিহীন হিমালয়

আনকোরা দাড়ি
জিলেটে সাফ কীট-বসন্ত

ফেলে আসা টিসু পেপার
শুকনো রক্তেও স্রোতের উপকূল

একটা সম্বন্ধের পরেই অন্যটি
দামি আঠা কমদামী কপাল
যদিও আপেক্ষিকের পরেও অকৃত্রিম

বিজয়ী অথবা জবানী

                          চিরন্তন গাইডলাইন!







জীবন্ত ইতিহাস
( ভাষা - মানভূঁইয়া)
 উত্তম চক্রবর্ত্তী

ডুহা আস্যে বইলল
বদনা রে যা ক্যানে --
তোর হাড় জির জিরা বাপ ট
বড় বাঁধের আগালে
খকলা প্যাটে হাপর টাইনছ্যে  --
আগুইড়টা টান্যে দিহে
ছুইটত্যে ছুইটত্যে গেলহি
সব আঁড়রিকোল ইথানে বিথানে
খুঁজলি -- আঁড়রাই ডাকলি --
বাপ্ হে --- কুথায় তুই -- ?
পালহি , তবে আর হাপর টানে নাই
হামার লিকপিক্যা গতরে
বাপ ট কে কাঁধে লিহে
সটান হাসপাতাল,
ডাগতর সাব দ্যাখেই বইলল --
ক্যানে আনলি বাপ্,
অপুষ্টিতে পেরান বাইরাই গ্যাছে।

ভাবলি আঁড়রাই কাঁদি
লারলি, চখেও জল নাই
অব্বেবু হয়্যে ভাল্যে আছি
বাবু জনতার দিকে --
কেউ বলে খাত্যেই দেই নাই
তাই পইটক্যে গ্যাছে।

সি দুবছর আগের কথা
ঘরে হামি, পোয়াতি বৌ আর বাপ্,
হামার লিকপিক্যা গতর
তাই জমি জিরেতে কেউ
কাইজ দেই নাই
খাবার কুথায় পাব --- ?
ভকু খুড়া বইলল রেশনে দুটাকা কেজি চাল
আন ক্যানে -- ফুটাই খা,
ট্যাঁকে পয়সা নাই, দে ন খুড়া দু-টাকা
ইকদিন প্যাট ভইরে খাই ,শোধ দিব।
দিলহ নাই, ইঁড়ক্যে পাল্যাল।
রেশন বাবুকে বইললম্ --
কেজি চাল দিবে ব
পরে টাকা দিব ---
দূর দূর কইরে কুকুরের পারা
লেতাড়্যে দিলহ -----

হামি দিশা হারা
ছুইটত্যে ছুইটত্যে গেলম্
উপাড়ার মা ঠাকরুনের কাছে
দেখি মা ফ্যান গড়াছ্যেন,
বইললম্ ,মা গো ফ্যানটুকু দাও ক্যানে --
ঠাকরুন বইললেন --দ্যাখ বদনা
ঘরে গভীন বকনা, তবে টুকু পাবি
জামবাটি আন ----

এক জামবাটি ধুঁয়া উঠা মাড়,ভাতের গন্ধ
হামি, বৌ আর বাপ্
তিনদিকে বস্যে হাপুরছি
লিশ্বাস ফেলি নাই, পাছে কম পড়ে!

মাড়ে কি আর পুষ্টি হয় বাবু --
পোয়াতি বৌ গেল সইটক্যো
চল্যে গেলহ কন আকাশে তারা হয়্যে
ইখন আর চিনত্যে লারি --
কন টা বঠে উ --
আর ইবারে চল্যে গেলহ বাপ্ --
বাঁচ্যে কি আর আছি ---- ?

ইখন হামি জীবন্ত ইতিহাস  !






   বিশ্বায়নের ঢেউ এ ভেসে যাচ্ছে পুরনো সংস্কার
                    -ভাস্কর বাগচী



আজ  হাটবার । পুরুলিয়া জেলার সেনাবনার হাট । ইতি উতি বিকোচ্ছে মুরগি , হাঁস , জংলি কাঠ , মাছ ধরার গলুই , কমদামী শাড়ি , গামছা , লুঙ্গি , প্লাস্টিকের চটিজুতো , নানারকমের কাঁচের চুড়ি আর টিপ । আর একপাশে আলু , ঝিঙে , টাটকা ফুলকপি , বাঁধা কপি , পালং শাক আর টমাটো , স্থানীয় ভাষায় বিলাতি ।

          এই হাটেই শাক সব্জি বিক্রি করে অযোধ্যা পাহাড়ের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা গুরুবারি । গুরুবার অর্থাৎ বৃহস্পতিবারে জন্ম তাই নাম গুরুবারি । গুরুবারি জাতিতে বিরহোড় । শোনা যায় বিরহোড় জনগোষ্ঠী দ্রাবিড় শাখার উপজাতি । আর্যদের আগমনের ফলে এরা ছোটনাগপুরের জঙ্গল ঘেরা অঞ্চলে বসবাস শুরু করে । পশ্চিমবঙ্গ , ঝাড়খন্ড , বিহার , ওড়িশা ও মধ্যপ্রদেশের জঙ্গল মহলেই এরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে । অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষা গোষ্ঠীর পর্যায়ভুক্ত বিরহোড়রা দেখতে শারীরিক ভাবে মাঝারি গড়নের । স্ফুরিত ও ঈষৎ চাপা নাসার অধিকারী কালো রঙের এই জনজাতি প্রটো-অস্ট্রেলয়েড গোষ্ঠীভুক্ত । বির মানে  জঙ্গল । তা থেকেও এদের নাম বিরহোড় হতে পারে । বিরহোড় সম্প্রদায়ের কোঁকড়ানো চুল অনার্য গোষ্ঠীভুক্ত অন্যান্য  সম্প্রদায়েরই মতো ।

        বুদ্ধ পূর্ণিমার দিন অযোধ্যা পাহাড়ের শিকার পরবে গেলেই পাহাড়ের ভূমিপুত্র বিরহোড়দের দেখা যায় হেসে নেচে –গেয়ে সারা পাহাড় মাতিয়ে রাখতে । পাহাড়ি জোড়ের ধারে ওরা দিন মজুরিতে ছাগল চরায় । সময়ে বীরভুমের পাথর খাদানে কখনও ইটভাটায় পূব খাটতে যায় ।

       নিমতেল ও মহুয়ার গন্ধে এদের একটা নিজস্বতা আছে যা শহুরে মানুষদের থেকে এদের আলাদা করে রাখে । অকৃতদার এক মানুষ  সুবোধবাবু শহর থেকে এসে এদের নিয়েই বহুদিন ধরে নিঃশব্দে কাজ করে চলেছেন এ অঞ্চলে । নৃতাত্ত্বিক গবেষণা করতে সেই কবে এসেছিলেন । সোজা সাপ্টা মানুষ গুলোর মায়া আর কাটাতে পারলেন না । সেই সুবোধ বাবুই বলছিলেন – এখানে পাতুমুড়া বা সুবল শবরের অনাহারে মৃত্যু নিয়ে বিতর্ক হয় । সাংবাদিকরা শহর থেকে আসেন স্কুপ নিউজের আশায় , সমস্যার কথা সবাই বলেন । সমাধানের রাস্তায় হাঁটার চেষ্টা নেই কারও । প্রেস থেকে প্রশাসন ক’দিন হইচই হয় । আবার সব চুপচাপ । লোকগুলো যে তিমিরে সেই তিমিরেই থাকে ।

    সুবোধবাবুই হঠাত একদিন বাজারের থলি হাতে নিয়ে বাজারে গিয়ে খেয়াল করলেন – গুরুবারি চুলে যেন কলপ করেছে মনে হচ্ছে । গুরুবারির বয়স পঞ্চাশ বলে মনে হয় তার । আবার পয়ত্রিশও হতে পারে । রুখা সুখা এই অঞ্চলের প্রকৃতির রুক্ষতায় মেয়েদের প্রকৃত বয়স বোঝা যায় না । তবে এই ভূমি কন্যাদের চুল কখনও পাকতে দেখেন নি সুবোধবাবু । রিঠা দিয়ে চুল পরিষ্কার করে চপচপে করে নিমতেল মাখতেই দেখা যায় সবাইকে ।

         জিগ্যেস করাতে গুরুবারির ব্যতিক্রমী উত্তর –

“ রিঠাতে কাজ হছে নাই কাকা । সব চুল পাকে যাছে । টুকুন এই তেলট লাগাছি” ।  কথা বলে বোঝা গেল টিভির মাধ্যমে গুরুবারি ভালোই চিনেছে প্রসাধনীগুলোকে । জানা গেল প্রাইমারি স্কুলের মাস্টার মশায় বঙ্কিমবাবুর বাড়িতে সে টিভি দেখে নিয়মিত । বিস্মিত সুবোধবাবু সে সত্যিই টিভি দেখে কিনা জানার জন্য জিগ্যেস করলেন –

- পিভি সিন্ধু কে জানো ? দেখেছ টিভিতে ?

- হ বাবু ।

- বল তো কে ? কোন মন্ত্রী ?

- মন্ত্রী হবেক কেনে ? ঢ্যাঙা পারা মেইয়ে লোক ট । দমে দৌড় ঝাপ করে । খেলা ট কি তা বইলতে লাইরব । তবে চিনি উয়াকে ।

হাঁ হয়ে গেলেন সুবোধবাবু । এই প্রান্তিক জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের নিরক্ষর মহিলাটি ভারতের ক্রীড়াজগতের এখনকার পয়লা নম্বর ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডরকে ভালই চেনে ।

নৃতাত্ত্বিক সুবোধবাবুর এ অঞ্চলে এক যুগ হয়ে গেল । এখানে এসেই ‘চিহড়’ লতা চিনেছিলেন । বুনো চিহড় লতা দিয়ে বুনে বাসস্থান ‘কুমভা’ তৈরি করত বিরহোড়রা । অপদেবতা ‘বোঙ্গা বুরু’র ভয়ে লতার বাড়িতে কোনও জানালা থাকত না । দরজাও এতো নিচু যে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকতে হত । সাদা পাথরে তেল সিঁদুর মাখানো দেবতা ‘বুরিয়া মাই’ এর পুজো  করত এরা । সরকারি সাহায্যে বানানো সিমেন্টের ঘর বাড়িতে থাকা কিছুদিন আগেও পছন্দ করত না বিরহোড়রা । সময়ের সাথে সাথে ওদের সংস্কার , সংস্কৃতিও দ্রুত পাল্টাচ্ছে । কাঁসাই , কুমারী , টটকো , বান্দু , শিলাই নদী দিয়ে অনেক জল বয়ে চলেছে । রুখা মাটির টিলায় জেগেছে নতুন বার্তা । পাহাড়তলির আদিগন্ত বিস্তৃত ক্ষেতে দোল খাচ্ছে শশার ফুল । পাশেই শহর থেকে আসা লরিতে বোঝাই হচ্ছে ঝুড়ি ঝুড়ি টম্যাটো । বাতাসে আজ নতুন দিনের ইঙ্গিত । বিশ্বায়নের ঢেউ বুঝি একেই বলে ।

 মনে পড়ছে অনেক দিন আগে পড়া তারাশঙ্করের ‘হাসুলি বাঁকের উপকথা’ । সেখানেও রক্ষণশীল বনোয়ারির সযত্ন লালিত ভূমিতে নতুন যুগের সূচনা করেছিল করালী । যুগে যুগে এমনই হয় । পুরনো মুল্যবোধকে সরিয়ে নতুন যুগ তার নিজস্ব পথ করে নেয় ।





নদী কথায় ভেসে যায় .......
              তীর্থঙ্কর সুমিত

জমানো অনেক কথা বলার থেকে, না বলাটাই বাকি থাকে ।বহুল প্রচলিত কথা কখনো কখনো নতুন হয়ে ওঠে ।আর দূরের হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলো বড় কাছের হয়ে ওঠে।এভাবেই দিন - মাস - বছর পেড়িয়ে যায় ।ফিরে আসে কথার জোয়ার।আর অপেক্ষা সৃষ্টি করে বেঁচে থাকার রসদ।এখানেই হয় কলমের সূচনা।
না হয় কথাগুলো ই বাঁচিয়ে রাখুক পাওয়া না পাওয়ার অন্তিম মুহুর্ত ।





     

Wednesday, July 15, 2020

আজকের সংখ্যা

           একাকীত্ব
         সুতপা মন্ডল


একাকীত্ব আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধেছে আমাকে
ক্রমশ হারিয়ে ফেলছি নিজের সত্তাকে
ভুলে যাচ্ছি জীবনের গতিময় ছন্দকে
জীবন এমন বেরঙিন হতো না যদি তুমি থাকতে।

রাতের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকি একা
কোথাও রাত পাখি ডেকে ওঠে
আমি ভাবলেশহীন নির্বিকার চেয়ে থাকি
তুমি যদি থাকতে জ্যোৎস্নার আলো মেখে
নিশ্চুপ প্রেমে মনে মনে কইতাম চুপকথা।

ঘরের বাইরে যাওয়া হয়ে ওঠে না অনেকদিন
মানুষের ভিড়, কথার আওয়াজ ভালো লাগে না
ভালো লাগে না, রাস্তার চোখ ধাঁধানো আলো
অথচ কত উচ্ছল কত অন্য রকম ছিল সেই দিনগুলো।

শরৎ এসেছে আকাশে বাতাসে আগমনীর সুর
পিছনের বাগানে শিউলি পড়েছে ঝরে
আমি জানি শিউলির সুবাস তোমার প্রিয়
তুমি যদি থাকতে আঁচলা ভরে কুড়িয়ে এনে
সাজিয়ে দিতাম তোমার ঘরে মুঠো ভরে।
কার জন্য সাজাবো এখন! আমি নিজেই এলোমেলো।

একলা স্মৃতির খাতার পাতায় হাজার অনুভূতি
ঝাপসা চোখে আলতো ছুঁই তোমার মধুর স্মৃতি।
আলমারির তাকে থরে থরে সাজানো তোমার কাপড় জামা
 রোজ হাত বুলায় অনেক অনেকক্ষণ
ওর গন্ধ বুকে নিয়ে  তোমাকে, তোমাকে খুঁজি।




চন্দননগরের ডেপুটি ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট দেবদত্তা রায়ের (৩৮বছর) করোনা আক্রান্ত হয়ে অকাল প্রয়াণ স্মরণ করে তার স্মৃতিতে রচিত আমার কবিতা.......

             অমর দেবদত্তা
                 --- চিত্তরঞ্জন দাস

সবাই যখন ভীষণ ভয়ে
         গুটিয়ে আছেন ঘরে
 চাকরিতেও যান না অফিস
        যান না ইচ্ছা করে,
 তখন তুমি বুকের মাঝে
          অসীম সাহস ধরে
পরিযায়ী ভাই-বোনেদের
          পাঠাও তাদের ঘরে!

 দিনে রাতে কাজ করে যাও
             নিজের কথা ভুলে ---
করোনা ভয় তুচ্ছ করে
           উচ্চে মাথা তুলে।
 তোমার তরে হাজার শ্রমিক
               ফিরল অবশেষে ---
করোনা আজ থমকে দাঁড়ায়
               তোমার কাছে এসে !

জেলাশাসক নও তুমি ,
         তুমিই দশভুজা ---
করোনা ভয় বিনাশকারী,
           নাও আমাদের পূজা।
 দেবদত্তা নামটি তোমার
           সত্যি দেবের দান ---
মরণকামী মহামারী
        কাড়লো তোমার প্রাণ।

 অন্যের প্রাণ বাঁচাতে আজ
           নিজেই শহীদ হলে
শত প্রণাম তাইতো জানাই
              তোমার চরণতলে !
তোমার মত দুর্গারা মা
             সত্যিই মহীয়ান ---
 এই বাংলার গর্ব তুমি,
                   অমর তোমার নাম।

               





   পাশ_ফেল
অনিক চক্রবর্তী


ঘরে বসে
পড়ছি আমি
         মজার মজার ছড়া
এই দেখে
বলে মা
        ছেড়ে দিতে পড়া
সারা দিন
তুমি শুধু
       পড়া পড়া করো
পুঁথি পড়ে
কজনই বা
       হয়েছে মস্ত বড়?
পাশ ফেল
উঠে গেছে
         জানো নাতো তুমি!
তাই শুধু
বলে বেড়াও
           ফেল করবো আমি।





     আশা
  তাপস বর্মন

পৃথিবী আবার সুস্থ হোক
    আশা একটু খানি,
ঘুচুক যত উৎকণ্ঠা
     মুছুক চোখের পানি।
কিল বিল ভাবনা গুলো
    সাজুক নতুন করে,
এবার তারা প্রাণ পাক
   আশার হাত ধরে।
সচল হোক কর্ম জীবন
   সচল যাওয়া আসা,
স্পন্দন আসুক শিরায় শিরায়
    মুখে ফিরুক ভাষা।
         




    বোধি-পীঠ
কপিলদেব সরকার

আমি ধরেই নিয়েছিলাম,
আমি অবাক হতে ভুলে গিয়েছি
দেরিতে হলেও, অবশেষে
বিস্ময় ছেড়ে গিয়েছে আমার হৃদয়স্থলী।

আমি ধরেই নিয়েছিলাম,
পায়ে পা মেলাতে আর
কোন বাধা র‌ইল না আমার,
ফিরে দেখার, একা থাকার, নিঝুম অলিগলি
রাজপথে দিয়ে দিলাম সর্বস্ব অঞ্জলি।

আমি ধরেই নিয়েছিলাম,
আমার উত্থান কেউ রুখতে পারবে না আর,
কেননা শাদার বিপরীতে কালোই,
ছেঁড়া জামা উল্টে নিলে গলাবদ্ধ কোট,
দেওয়ালিতে অন্ধ ছুঁচোবাজি কেউ পোড়ায় না আর,
প্রাণপণ চেপে ধরে রকেটের মেঘপুচ্ছ, রঙিন, তুলোট।

আমার বীজরাশিপুঞ্জ সবেগে ধাবিত হল
ভেবেই নিলাম, পথ বিলকুল সোজা,
তবু একদিন তারা আচম্বিতে থমকে দাঁড়াল।
আমি চমকে উঠলাম।

লোকারণ্য রাস্তায়, তবু অদূরেই
একটা বুড়ো বিকেলের মত একা গলি।
তার প্রথম বাড়িটার
   তেতলায় জানলার গ্রিলে
একজোড়া চোখ জেগে আছে।
একজোড়া মাতৃহীন চোখ।
একজোড়া ভাষাহীন চোখ।
একজোড়া ভূমিহীন চোখ।
অস্তিত্ব ঘুলিয়ে দেওয়া
বোবা আর বোধহীন চোখ।

ঈশ্বরের দোহাই, ঐ পথের‌ই কিনারে
আমার বীজেরা কাল মহীরূহ হোক।





          সহযাত্রী
             ‎    সুনন্দ মন্ডল

ও পাড়ায় দেখ কার বাড়িতে যেন আগুন লেগেছে
ধোঁয়া কুণ্ডুলি পাকিয়ে আকাশ ছুঁতে চাইছে।

এ পাড়ার লোকজন দরজা জানালায় খিল তুলেছে
যার গেল তার গেল, ভেবে কী লাভ?

সময়ে আপনি বাঁচলে বাপের নাম!
এখন কে আর করে বল হরি নাম?

নিজের বাড়িতে কিংবা নিজের পাড়ায় আগুন জ্বললে
চিৎকারে সারা গ্রাম জাগিয়ে তোলে, পাশে থাকতে অনুরোধ করে।

তখন সময়টাও সময়ের দিকে তাকিয়ে অট্টহাস্য করে।

ওদের শরীরে ভাইরাস!
ওরা হাসপাতালে শুয়ে!
ওদের চিন্তায় যত মাথা ব্যথা,
রাতদিন ক্লান্তিহীন প্রার্থনা, আর অঞ্জলিতে স্থিতিশীলতার  চেষ্টা।

আর এরা সব আবর্জনা, চিৎ হয়ে থাক,
ডাস্টবিনে জমে থাকা অব্যবহার্য্যের মতোই
পাশ ফিরানোর দরকার নেই এদের!
এদের দরকার নেই হাসপাতাল,
অসুখ থাকলেও ওষুধ নেই।
নেই কোনো সহানুভূতি, আর একটু সকলের প্রার্থনা।

আসলে আমরা চাই না কেউই কারও সহযাত্রী হতে।
              



         


                           দাম...
                      রাহুল পাত্র

সকালে বাজারে বেরিয়ে নবীনের সাথে পান্ডুর দেখা l দুজনেই সরকারি স্কুলের শিক্ষক l নবীন অংকের আর পান্ডু বাংলা l রথের দিন, স্কুল ছুটি l দুজনেই বেরিয়েছে খাসির মাংস কিনতে l

নবীন - কত করে কিলো নিলো রে?

পান্ডু - সাড়ে সাতশ টাকা ভাই l

নবীন - কোন দোকান দিয়ে নিলি?

পান্ডু - ঐতো বাজারের শেষ মাথায় মোবারক-এর দোকান দিয়ে l

নবীন - ও আচ্ছা, আমি সেলিমের দোকান থেকে নিলাম, টোটালে 50 টাকা কম নিল l

পান্ডু - তোর ছেলেকে কোথায় ভর্তি করলি?

নবীন- বোসবাবুর পাড়ার ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলটায় l জানিস, ক্লাস ওয়ান-এর অ্যাডমিশন ফি কুড়ি হাজার টাকা l ভাবা যায়! আমাদের সময় 100 টাকায় সারা বছর চলত l

পান্ডু- আমার মেয়েটা ওই 'মহেশ্বরী বালিকা বিদ্যালয়ে'ই পড়াশোনা করে l সরকারি বাংলা মাধ্যম স্কুল l ভালো স্কুল l

নবীন- ওখানে এখন পড়াশোনা হয় নাকি? ওসব বহুকাল আগে হতো l এখন স্রেফ আড্ডা! মুখস্ত মেরে দাও l বুঝলে ভালো, নয়তো আরো ভালো l

পান্ডু- না ভাই, মহেশ্বরী স্কুলের একটা আলাদা সুনাম আছে l

নবীন - ধুর! ওসব বাজে কথা l বাংলা মিডিয়াম এখন আর চলে না l ইংলিশ মিডিয়াম এখন শিক্ষার পিলার l এর ধারে কাছে টিকবে না বাংলা মিডিয়াম স্কুলগুলো l

পান্ডু- বাদ দে বাবা! তর্কে কাজ নেই l তা কাল তোর ক্লাস কখন?

নবীন - কাল মঙ্গলবার, ফার্স্ট ক্লাস থাকে l একটু দেরি করে ঢুকব, নাম ডাকব, ত্রিকোনমিতির দুটো অংক করাবো l তারপর ওই মিড-ডে-মিলের কাজ দিয়েই গোটা দিনটা ম্যানেজ করে দেব l

পান্ডু - আসছি রে, দেরি হয়ে গেল l চালিয়ে যা!





আমার দুঃখ হরণ দিনগুলো 
             সুকুমার কর 

দুঃখ হরণ দিনের আশায় নিজের ছায়ার সঙ্গে পাঞ্জা লড়ি| পোড়া হৃদয় ভাসাই নোনা জলে | ডুবতে থাকি শূন্য থেকে শূন্যে |মুঠোয় বন্দি করি খরস্রোতা নদী |পাড় ভাঙছে আমি ভাঙছি একান্ত অবসরে নির্বাক সংলাপে  |গড়াতে গড়াতে টুপ্ করে সূর্য ডুবে গেলে অন্ধকারের  ঝর্না নামে|অসম্ভব লম্বা রাত ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঝিমুতে থাকে  |হাসি খুশি মুখে অনায়াসে মেখে নিই কালির দাগ |ভেতর থেকে কড়া নাড়ার শব্দ শুনি |অকপট ঢেউ আছড়ে পড়ে বেলাভূমে |এ আসলে নাব্যতা হারানোর ইতিহাস |ছন্নছাড়া জীবনে ভালোবাসার জ্যোৎস্না পড়লে সেতার বেজে উঠে |মাঝে মাঝে উড়ে যাওয়া পাখি ফিরে আসে, শুকনো ডালে পাখি বাসা বানায় |বন্ধ্যা মাটিতে স্বপ্নের বীজ বোনে |গভীর ভাতের অনবদ্য পদ্য লেখা হয় |





টেস্টটা জরুরী 
  শ্রীরণজিৎ

   সামান্য একটু বৃষ্টিতে ভিজেছিল, তাই বলে কি বুলির ছয় বছর বয়সী মেয়েটাকে পাঁচদিন ধরে জ্বরে ভুগতে হবে?  আর এখন তো সামান্য একটু জ্বর হলেই তার মধ্যে করোনার গন্ধ খোঁজা শুরু হয়ে যায়। ইতিমধ্যে কত লোকের কত রটনাই না রটেছে তবে বুলির বেলায় কেন নয়?
  
  হাতুরে ডাক্তারের দেওয়া ওষুধে কি সবসময় কাজ হয়? আজ বিকেলে তার শরীরের তাপমাত্রাটা আরো বেড়ে গেছে। দুর্বল মুখে কীসব আবোলতাবোল বকে চলেছে। ডাক্তার অবশ্য কমিশনের ধান্দায় বার বার ''করোনা-টেস্ট' করিয়ে নিতে বলেছিল। এতে আবার কতগুলি টাকার গচ্ছা। বুলির কাছে অত টাকা কোথায়। অন্যের জমিতে কাজ করে একা হাতে তিনটা পেট চালায়। তাও আবার সবসময় কাজ থাকেনা। অনেকদিন আগেই তো রাক্ষুসী মেয়েটা গিলে খেয়েছে তার বাপটাকে যেদিন সে অতিরিক্ত মদের নেশায় বুদ হয়ে পড়েছিল নর্দমায়! যৌবনাবতী বুলির শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে রেখে যাওয়া মদের চিহ্নগুলি নিশ্চয়ই এখন আর বুলির মনে যন্ত্রণা দেয় না! এখন নুন খাক পান্তা খাক নিজেই তার চালিকাশক্তি। অতএব হাতুরে ডাক্তারই তার একমাত্র ভরসা। 

    রমেন ডাক্তারকে আসতে বলার জন্য অনেকবার ফোন লাগানো হয়। এক দুপুর করোনার প্যাঁচাল শোনার পর জবাব আসতে থাকে, "..... পরিসেবা সীমার বাইরে আছেন" নতুবা "পুত পুত পুত...."। 
ইদানিং তো ফোনে ঠিকঠাক টাওয়ার-ই পায়না। দুই কথা হতে না হতেই শুরু হয়ে যায় ক্যাতকুত! দুপাশ থেকেই "হ্যালো হ্যালো" বলতে বলতে জান যায়।

   তার মোবাইলের টোল খাওয়া ব্যাটারিতে এমনিতেই চার্জ টেকে না তার উপর সারাটা দিন ধরে লোডশেডিং। টুক করে মোবাইলটা সুইচ অফ হয়ে যাওয়ায় ডাক্তারের সঙ্গে বুলির আর কথা হয়ে উঠেনা। 

      দুশ্চিন্তা ক্রমশ ঘনিয়ে ওঠে বুলির অন্ধকার আকাশে। বৃষ্টির মধ্যেই মেয়েটাকে কোলে নিয়ে  একক্রোশ পিচ্ছিল পথ ডিঙিয়ে হেঁটে যেতে হয় তাকে রমেন ডাক্তারের কাছে। রিলিফ ফান্ডের ৫০০ টাকার মধ্যে হাতে অবশিষ্ট আছে মাত্র দুশো টাকা, এদিকে ঘরে একটাও খরচ নেই। রেশন কার্ডে কী একটা গন্ডগোল থাকায় চালটাও পেল না। এদিকে লকডাউনের বাজার, জিনিশপত্রের দাম এমনিতেই বেশি। ছেলেটার আবার আম খাওয়ার সখ জেগেছে। 
       অনেকক্ষণ অনুনয় বিনয় দেখানোর পর রমেন ডাক্তার সম্মত হয়ে বলে--"তোমাকে সেদিনই বলেছি, হাসপাতালে গিয়ে আগে টেস্টটা করিয়ে নাও। কিন্তু তোমরা সে কথা শুনবে না। আরে বাবা, কার মধ্যে কী আছে সেটা তো আর মুখ দেখে বলা যাবে না....। যাকগে,  এই ওষুধগুলো নিয়ে খাইয়ে দেখো, কী হয়। আর হ্যাঁ, ঐ টেস্টটা কিন্তু অবশ্যই জরুরী।" 

--"কত হলো, ডাক্তারবাবু?"

--"এখন হলো ৭৫ টাকা আর আগের আছে ৪৫, মোট ১২০টাকা।"

দুশো টাকার নোটটি দিয়ে বুলি পঞ্চাশ টাকা কাটতে বলে। কিন্তু রমেন দোকানে মাল করার কথা বলে একশো টাকা রেখে দেয়। আর টেস্ট করার কথাটা আবারও মনে করিয়ে দেয়।

বুলি এগিয়ে চলে বাড়ির দিকে।  দিব্বি তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে, পাড়ার লোক সহ পঞ্চায়েত এসে তার বাড়িটাকে সিল করে দিয়ে শাসিয়ে গেছে যাতে তারা কেউ বাড়ি থেকে না বের হয়। তারপর দেখছে, পাড়ার লোক কেউ গ্রামের বাইরে যেতে পারছে না। কোনো লোক তার বাড়িতে আসছে না। কেউ কথা বলছে না। আর তার কানের মধ্যে কেবল প্রতিধ্বনি হয়ে বাজতে থাকে রমেন ডাক্তারের সেই কথাগুলি.....।







Tuesday, July 14, 2020

কবিতা,শুধুই কবিতা



       শ্রাবণের হাত ধরে
        মিনতি গোস্বামী

শ্রাবণের হাত ধরে শিখে ফেলি পদ‍্য
বন্দীঘরে জীবনতো হয়ে গেছে গদ‍্য।

কাব‍্যাকারে যত ছন্দ শিখে ফেলি আজ
মহাকাব্য লেখা হলে জানি দেবে কাজ।

মন নয় মাটিওতো আজ রসবতী
শ্রাবণের ধারা মেখে হবে গর্ভবতী।

ফুলে ফলে ভরা ঋতু শ্রাবণের ঋণী
তার জেরে জগতের সব বিকিকিনি।

ভালোবাসা ভালোথাকা সব জলময়
জলহীন হলে সব মরিচীকা হয়।

আকাশের ময়দানে আজ  কোলাহল
মুছে দেবে পৃথিবীর যত হলাহল।

আলোময় মধুময় হবে ধূলিকণা
ধারা জলে ধুয়ে যাবে সব আবর্জনা।






          জীবন
    কবিতা ভট্টাচার্য

আমার  সমস্ত জীবন জুড়ে  আছে
এক শীতের দুপুর
পায়ে পায়ে পাতার  শব্দ
আর মহুয়া ফুলের  মিষ্টি  গন্ধ ।।





তোমার পথ চেয়ে
         তাপস বর্মন

জানালা খুলে তাকিয়ে আছি
     তোমার পথটি চেয়ে,
একটি বার আসবেনা প্রিয়
     স্মৃতির সরনী বেয়ে?
কত বসন্ত পেরিয়ে গেলো
     তোমায় ডেকে ডেকে,
পলাশ শিমুল কৃষ্ণচূড়াদের
     নীরব সাক্ষী রেখে।
মনের ভেলা ভাসিয়ে দিলাম
    তোমার উজান স্রোতে,
পারলে তারে সাজিয়ে রেখো
     চলবে সাথে সাথে।
             



   

          অলৌকিক ফুল 
          সৌম্য ঘোষ
     

এক দ্বীপ থেকে অন্য এক দ্বীপ
এক অনুভব থেকে অন্য চেতনার তরঙ্গ
মূর্ছিত হয় হৃদয়বত্তা জুড়ে ।

একদিন উদার মাঠে ভরে ছিল কনক ফসলের গন্ধ
স্বপ্নে দেখা সেই অলৌকিক ফুলের পাপড়ি ,
যে সবকিছু নির্মল তরঙ্গ হয়ে
ছড়িয়ে পড়েছিল সমগ্র সত্তায়
সেই আশ্চর্য বর্ণালীর ছটা ,
দেখলাম শিল্পের গাঢ় মুগ্ধতায় ।


রক্তে আমার গভীর অদম্য আকর্ষণ
ইতিহাস পরিত্যক্ত আদিম আত্মার ইশারায় ;
যখন ভাষার সৃষ্টি হয়নি ,
সেই মহাকালের প্রান্তরে
আমি যাবো, তার প্রতীক্ষায় অধীর হৃদয়
অনুরাগের সত্তাকে বিস্তৃত করে দেব
সেই অলৌকিক ফুলের মতো ।


তন্ময় রাত্রে যখন ক্রমশ: চিত্রিত হচ্ছে
শিল্পিত মেঘমালা ; সেই নিবিড় একাত্ম মঞ্চে
আলোর নৃত্য ও নর্তকীর মধ্যে সেই অলৌকিক
ফুলের আতর গন্ধ পাই  ।।





          পথ
--চিরঞ্জিৎ বৈরাগী

খাতাগুলো ছিঁড়লেও
অগোচরে থেকে যাবে একশোভাগ হিসেব

তোমার থেকেই অন্যতুমি
মনে রেখো
 সুন্দর সকালের উল্টোপিঠে দুঃখ-রাত

তর্জনী যতো উঠবে
বৃদ্ধাঙ্গুলি তত কাছে

ব্যক্তি এক। পথ অগাধ
বেছে নেওয়া তোমার কর্তব্য




    ধরো যদি
নির্মলেন্দু কুণ্ডু

ধরো যদি
তাপাঙ্ক কমে যায় শূন্যে
শান্তিগুলো খুঁজে পায় গোর
বাড়াবো হাত তখনও৷
খুঁজে পাই যদি সহজাতকে
বুঝে নেব
তুমিও গিয়েছো কোন থার্মোমিটার-খোঁজে
হয়তো বা পেয়ে গেছো
জোড়া শালিখের খোঁজ৷
আমিও দিয়েছি পাড়ি
কোন এক দিকশূন্যপুরে
সাথে নেব শুধু এক
পারদশূন্য থার্মোমিটার...





বল, সুবিনয়
কপিলদেব সরকার

এ বড় কঠিন কাজ, বড়
ভারি হয়ে এসেছে বোঝাটা
কাঁধ নুয়ে পড়েছে, মাটিতে
থেমে থেমে থমকিয়ে হাঁটা

বন্ধুকে বাহুতে জড়িয়ে
ধরতেও কি যে লাগে বাধো
চোখের চাউনি পুড়ে গেছে
নেই তার চিলেকোঠা ছাদ‌ও

কি আগুন জ্বলল হাওয়াতে
কোন পথে নিয়ে এল চাকা
তুই আজ বল সুবিনয়
এইভাবে যায় বেঁচে থাকা?

কি হত খারাপ হয়ে গেলে?
তোর মত খারাপ হ‌ওয়াটা
বরং এক দ্বিধাহীন, ঋজু
নিঃশঙ্ক পদক্ষেপে হাঁটা

সুবিনয়, ধুলোপথ ধরে
তোর পথে পাড়ি দেব আমি
ভাঙার সাহস রাখে যারা
জীবন তাদের অনুগামী।



   বল, সুবিনয় (২)


এই পথ, এই অন্ধকার
পিচ্ছিল এই অনুগ্রহ, চোরা বাঁক,
    চকমকি পাথরের আবিষ্কারমুহূর্তের মত
তোর অপেক্ষায় আছে, সুবিনয়।

আগুনের পাখি হয়ে উড়ে গেছিস
তীব্র ডানা ঝাপটিয়ে আকাশে
পালক কুড়িয়ে নিয়ে রেখেছিলাম
   একটা, দুটো
আজ তার সূচ্যগ্র নিব্
   ক্রমাগত ঝরাচ্ছে স্ফুলিঙ্গ,
   ঝরাছে অনিবার্য বর্ণমালা।

সুবিনয়, কি দৃপ্ত বিনয়ে তুই বলেছিলি
    মানুষকে শেখাবে তার প্রয়োজন
         প্রয়োজন মানে পাঠশালা।





         অপেক্ষা 
     রাজকুমার ঘোষ

স্মৃতির চাদরে মোড়া সেদিন আজও মনে পড়ে
মেঘলা দিনের ক্লান্ত শহর---
ব্যাথা বেদনা ভুলে ছুটে এসেছিলে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে,
উন্মুক্ত হৃদয় দ্বার ----
বারে বারে উপেক্ষাতেও যা রুদ্ধ হয়নি।

না বলা অনেক কথা কবিতার ভাষা হয়ে ওঠেনি,
ভালোবাসার মন মন্দিরে স্থান হয়েছিলো,
অবজ্ঞার চোরাস্রোতেও যা ভেসে যায়নি
তাইতো আস্তাকুঁড়ে পড়ে গিয়েও ফিরে এসেছ সদা জাগ্রত এই মন্দিরে---
নিরাপত্তার বলয়ে ঠাঁই পেয়ে বিকশিত করেছ। 

কালের নিয়মে স্থায়ী হয়েছ,
জীবনের বন্ধন মজবুত ভীতে গড়েও উঠেছে
এ হৃদয় দ্বারে অবারিত আসা যাওয়ায় মুখফুটে বলার প্রয়োজনও হয়নি
যা সকলের দৃষ্টিতে সুদৃঢ় ছিল---

সব কিছু মিথ্যা প্রমান করে আবার ডানা মেলে মুক্ত আকাশে
নতুন কোনো মোহে ভাসিয়ে
প্রাপ্তির ভান্ডার শূন্য করে দিয়েছ-- 
অস্তিত্ত্বহীন হয়ে অন্ধকারে সঁপে দিয়েছ, আলোকে আসতেও চাওনি 
মুক্ত প্রাণবায়ু হয়ত অসহ্য লাগে
তবুও উদ্দেশ্যহীন জীবনের গাঁথা যদি শোনাতে চাও,
হৃদয় দ্বার তো উন্মুক্ত আছেই---- 
এসো তবে অপেক্ষা না হয়, আবার করবো।





-পাশবিক হত্যা
                  ব্যর্থ লেখক

আকাশে সপ্তর্ষিমণ্ডলের স্বপ্রভ বৈদ্যুতিক ছটার স্তব্ধতা।
নীচে কাঠপোকারা অনলশিখায় তুলছে চিহ্নহীন মাংস।
যার নরম কামড়ে রয়েছে চুরুট বারুদের শুকনো গন্ধ।
তারা নিজেদের স্বার্থে পাশবিক হয়ে হত্যালীলা ব্যস্ত।
এখন রক্তে রাঙাগোধূলি বন্দি হয় দিগন্তরেখার প্রান্তে।
মরুপথিক দিশাহীন পালভাঙ্গা রঙ্গমঞ্চে মেষ পালকের ন্যায় অজান্তে।
জীর্ণ শরীরের বিদীর্ণ রক্তে ভরে উঠেছে উন্মাদ হাড়কাঠ।
আজ লাজুক মূর্তির না বলা বিশ্বাস বন্ধ করেছে কপাট।






    ধর্ষণ
       সত‍্যব্রত ধর

যাযাবরের মতো হেঁটে যেতে যেতে...
ধাক্কা খাওয়া দৃষ্টি পিছন ফিরে তাকাতেই,
মশালের লাল আলোটা
ধক্ করে জ্বলে উঠে নিভে গেলো!
ম্লান গোধূলির আলোয় দেখতে পেলাম,
দেওয়াল থেকে রক্তের ফিকে গন্ধটা ভেসে আসছে!
ঝকঝকে ইস্পাতের ফালার অস্ত্রসহ
কয়েকটি পায়ের মাটি কাঁপানো শব্দ,
 কানে ধাক্কা খেলো।
হাত পাঁচেক ধোঁয়াটে রঙের কাপড় পরে,
বিধবা যুবতী হঠাৎ আমায় এসে জড়িয়ে ধরলো!
তারপর বিনা বাক‍্যব‍্যয়ে পরিত্যক্ত পোড়ো বাড়িতে
ধর্ষিতার নিঃশ্বাসের শব্দ কয়েকবার প্রতিধ্বনিত হয়ে,
থেমে গেলো!
অসহায় আমি চিৎকার করে বলে উঠলাম...
হে ঈশ্বর আর কততততত....?





           ভালোবাসা
                        শিবপ্রসাদ গরাই

আমি কি কখনও ভালবাসতে পেরেছি ?
আমি কি কখনও কাউকে ভালবাসতে পেরেছি?
নদী -ফুল- ফল -পাতা- সমুদ্র
ভালবাসতে পেরেছি কাউকে
কাউকে কখনও ভালবাসতে পারিনি ।

ভালোবাসা কাকে বলে ?
একদিন কোন এক ক্ষুধার্ত শিশুর সামনে
এক থালা ভাত রেখে দেখো
খুশিতে চোখগুলো কেমন চকচকে হয়ে ওঠে । সাতদিন অনাহারে থাকা কোন এক বালকের কাছে একগামলা মাড় রেখে দেখো
তার সুগন্ধে কেমন সুবাসিত হয়ে ওঠে তার চোখ- তার মুখ-তার সর্বাঙ্গ।
দেখো, রেখে দেখো ।
আর আমরা, শালা, ফুল- ফল- পাতা নিয়ে ন্যাকামি করে বেড়াচ্ছি।

ভালোবাসতে যদি হয়, ওই ক্ষুধার্ত শিশু গুলোকে ভালোবাসো
আমি ওই শিশুদের জন্য কিছুই করতে পারিনি ,
ভালও বাসতে পারিনি কাউকে ।

ভালোবাসা কি এতই সোজা ?
যে চাইলেই কাউকে ভালোবাসা যায়!






বাসর সিরিজ-৩

জীবন
মহীতোষ গায়েন

এখন আমার জীবন হারায়
ঠগ-ঠগিনীর হাটে,
তখন আমার চাঁদ উঠতো
ভুবনডাঙ্গার মাঠে।

সন্ধ্যেবেলা বাসর সাজাই
সূর্য গেছে পাটে,
বিষাদ সুরে বাজছে সানাই
উজানতলির ঘাটে।





           তুমি নারী
      বাপন দেব লাড়ু


সেই মেয়েটা ! লোকে যাকে পাগলী বলে।
স্বাভাবিক নয় বলেই সামাজিকতা আজ সংজ্ঞাহীন;
অর্থের মায়া আর শরীরি আহ্বান নিরর্থক,
তবুও একদিন তাকে নিতে হয়েছিল কলঙ্কের দায় ভার।
একদল পৌরুষ আঙুল দিয়েছিল সাজা।
বাল্মিকী ও এড়াতে পারেনি সমাজ
সীতাকেও দিতে হয়ছিল প্রমাণ সতীত্বের।
কিন্তু কি দোষ ছিল সেই মেয়েটার?
সৃষ্টি মূলের সন্ধানে  উল্টে গেছিল  ইতিহাসের পাতা।
তাই সে আজ কলঙ্কীনি বটে।
এও কি শুধুই তার দোষ?
এরকম  অসংখ্য ইতিহাস এড়িয়ে গেলেও
ছেঁড়া ছেঁড়া ভাস্কর্যের ভেতরে ভেতরে
লুকোনো থাকবে সৌন্দর্য তোমার
মুগ্ধতার প্রতিলিপি হয়ে তুমি নারী।
স্বাক্ষী হয়ে থাক, পুরোনো প্রমান ;
সৃষ্টি-সারণী দিয়ে খুঁজে গেলে
পাওয়া যাবে নিশানা পাথর,
ঠিকই বুঝবে একদিন এই সমাজ
এ ইতিহাস গৌরবের নয়।





    কোথায় মাতৃভাষা 
        আব্দুল রহিম


বুকের তরতাজা রক্ত ক্ষরণে এসেছে
মোদের প্রাণের এ বাংলা ভাষা
কিন্তু আজ'কে কি বাঙালি ভুলে গেছে ?
কলঙ্ক ইতিহাসের সে ভয়াবহ পাতা
তবে কি আজ সালাম রফিক বরকতের রক্ত মিথ‍্যা ?

আজ বাঙালিকে গ্রাস করেছে আধুনিক সভ‍্যতা
তাই কিছু আর বেচেঁ নেই বাংলা ভাষার স্পর্শতা
আজ দেশ জুড়ে সৃষ্টি হয়েছে শত শত জাতি
কোথায় বাঙালি কোথায় বাংলার সংস্কৃতি
কজন বলে মোরা বাংলা ভাষাকে ভালোবাসি।।

কিন্তু মনে রাখা দরকার বাংলা ছাড়া
বাঙালির সুখের জীবন  হাহাকার
মোদের বাংলা ভাষা স্বপ্ন দেখায়
মোদের বাংলা ভাষা বাঁচতে শেখায়
কিন্তু সব আবদ্ধ স্মৃতির জরাজীর্ণ পাতায়।।

আজ আর নেই নবজাতকের প্রথম ডাক মা
আজ আর নেই কাজী রবি বিবেকের কালি
আজ আর নেই দাদা দাদু বাবা মা নামের শব্দ
আমরা সবাই সভ‍্যর আড়ালে ভয়ঙ্কর বিপদ গ্রস্থ
তাই  চল চল এগিয়ে চল ২১-এর ভাষা দিবসে।।




         মরণ
  জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়

এরপর সেই দিনটাও এলো
কীভাবে যেন টুকুস করে দরজার ওপারে

ভূমিকম্পের লাইন প্রায় টেটের লাইন
আমি হটলাইনে সোজা ল-ক্লার্ক চিত্রগুপ্ত।
বলি,স্যার আমার টিকিট!
চিত্র স্যার বলেন,স্যার নয় বৎস,বলো মহাশয়।
মুখ বাঁকাই,হাইকোর্টের জজও স্যার আর উনি!

ব্যাজার মুখে তিনি বলেন,ধম্মকম্মো তো কিছুই করোনি!
কোনও পুণ্যি নাই,নরকবাস।বলেই তিনহাত লম্বা ফর্দ
দেখে কীসব হিসাব করে রায় দেন,প্রথমে দর্শন নরক
তারপর ভোগ নরক।চল্লিশ বছর চামচাগিরি বলে দেয়
প্রথমে দেখে শেখো পরে গ্ল্যাডিয়েটর হও।
যমরাজের কুমিরচোখ একবার দেখেই বন্ধ।

দু চার দিন বেশ কাজকম্মো নেই ঘুমিয়ে কাটাবো ভেবে
চিতপাত।কিন্তু ঘুম আর আসে না।নেতার প্রতিশ্রুতি হয়ে
সে যে কোথায় উধাও কে জানে!
নারকীয় শাস্তি দেখে আমি তো হেসেই খুন!
এ শাস্তি না পুরস্কার! পঞ্চাশবছর যা ভোগ করেছি......
এ তো স্বর্গ ছাড়া কিছুই নয়! চার যুগের কন্ট্রাক্ট চাই বলে
দুমদাম কয়েকটা লাথি মারতেই সত্যযুগের দরজা উধাও....






          হাত
    হামিদুল ইসলাম
                 

তোমাকে চেয়েছিলাম
আঁধার ভাঙা রাত
অঝোর ধারায় বৃষ্টি
অথৈ জল, ধরেছি তোমার হাত ।।

তোমার হাতের স্নায়ুতে উত্তেজনা
প্রতিক্ষণে বারবার
হারিয়ে যাচ্ছি আমি বৃষ্টির জলে
হিসেব নেই কো তার   ।।

হিসেবের খাতা এখন গরমিল
বুকের গভীরে শিহরণ
তোমার নিতম্বে হাত রাখি
এ হাত অন‍্য কোথাও করে না বিচরণ   ।।

প্রাণে প্রাণে গরমবোধ
হাতের বৃষ্টি হয়ে ওঠে জীবন
গরম বৃষ্টিতে স্নান করি দুজনেই
জলে জড়াজড়ি, জলরঙা দুনয়ন    ।।

অদৃশ‍্য এক সুতোর টানে
আজ হারিয়ে যাই কোথায়
তুমি আছো, ধরেছি তোমার হাত
কোনো বাধা নেই এ হাত যাক যেখানে যেথায়    ।।





 "অর্থের ফল"
    জুয়েল রূহানী

অন্তহীন সুখের ঠিকানায়
আবাস গড়বো বলে
ছুটে চলেছি অর্থ-বিত্ত-প্রাচুর্যতার পিছু,
পাইনি কিছু,
পেয়েছি শুধুই নিরস প্রানের কাতরতা!
যৌবনে যত স্বাদ-আহ্লাদ-
ছিল যত হাসি-তামাশা,
নানান রঙ্গের দিনগুলি সব-
কেড়ে নিয়েছে ঘোর অমানিশা!





Saturday, July 11, 2020

রবিবারের পাতা

     

                    সাক্ষাৎকথায় প্রচেত গুপ্ত
                        প্রশান্ত ভৌমিক

যখন স্রষ্টা নিজেই আত্মপ্রচারে নামেন, তখন তিনি সন্দেহের প্রশ্ন নিয়ে ঘোরেন


প্রচেত গুপ্ত- সাহিত্যিক, সাংবাদিক। সহ-সম্পাদক হিসেবে কাজ করছেন কলকাতার প্রসিদ্ধ দৈনিক 'আজকাল'-এ। অর্থনীতিতে স্নাতক। 'দেশ' পত্রিকার মতে, বর্তমান সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় দু'জন লেখকের একজন তিনি। লেখালেখি এবং পেশাগত দায়িত্ব নিয়ে প্রচণ্ড ব্যস্ত সময় পার করছেন। তার ফাঁকেই 'আজকাল'-এর অফিসে এক গ্রীষ্মের সন্ধ্যায়(২৮-০৫-২০১৯) লেখকের মুখোমুখি।

প্রশান্ত ভৌমিকঃ প্রথমেই আপনার ছোটবেলা সম্পর্কে, আপনার বেড়ে ওঠা সম্পর্কে জানতে চাইবো।

প্রচেত গুপ্তঃ আমার পরিবারের কথাই বলি আগে। এককথায় বলতে গেলে আমার পরিবার শিক্ষক পরিবার। আমার বাবা ডক্টর ক্ষেত্র গুপ্ত শিক্ষক ছিলেন। তিনি বাংলা সাহিত্যের একজন অধ্যাপক, শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক। তাঁর জন্ম সেই সময়ের পূর্ববঙ্গে। দেশভাগের সময় তিনি এখানে চলে আসেন।

প্রশান্ত ভৌমিকঃ বাংলাদেশের কোথায় বাড়ি ছিল আপনাদের?

প্রচেত গুপ্তঃ আমার ঠাকুর্দা ছিলেন বরিশালের মানুষ। পিরোজপুর। দেশভাগের সময় এখানে আসেন, পড়াশুনো করেন। খুব মেধাবী ছিলেন। সাতখানা গোল্ড মেডেল পান কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। রেকর্ড নম্বর পেয়েছিলেন। এখানে তো বটেই, তিনি বাংলাদেশের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়েই গেস্ট লেকচারার হিসেবে পড়িয়েছেন, সেমিনার করেছেন। বাংলা সাহিত্যের নিয়ে  ২৫০ টির ওপর প্রবন্ধের বই আছে তার। আমার মা-ও বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপিকা। ডক্টর জ্যোৎস্না গুপ্ত। রামমোহন কলেজের ডীন ছিলেন।

প্রশান্ত ভৌমিকঃ আপনার মায়ের বাড়ি কি কলকাতাতেই?

প্রচেত গুপ্তঃ হ্যাঁ। আমার মায়ের কলকাতাতেই বাড়ি। আমরা ৩ ভাই।  ভাই পুষ্কর গুপ্ত শিক্ষক ছিলেন। তিনি প্রয়াত হয়েছেন। আমার স্ত্রী ডক্টর মিত্রা গুপ্ত অধ্যাপনা করেন। শুধু আমি শিক্ষক নই। আমি সাংবাদিক। আমার দাদা পূ্যন গুপ্ত ও তাই। তিনি ৩৬৫ দিন সংবাদপত্রের সম্পাদক।
ছোটবেলা থেকেই লেখালেখি আমার নেশা ছিল। সেই লেখালেখির মধ্যেই জড়িয়ে পড়ি। স্বপ্ন ছিল, লিখব। তবে লেখক হব সেই স্বপ্ন আমার ছিল না। স্কুল জীবন থেকেই লেখালেখি শুরু করি। তখন মনে করতাম, আমি যা কিছু বলতে চাই সেটা কেবল শুধু লিখেই বলতে পারবো। বালক বয়সে সবাই যেমন খেলাধুলা করে, আমিও করতাম। সঙ্গে লেখালেখিও। আমার যতই পড়াশুনোর চাপ থাকুক না কেন, দিনে একটু না একটু লিখতাম। বাড়িতে প্রচুর বই আসতো। বড়দের বই, ছোটদের বই- প্রচুর বই আসতো। আমরা বইয়ের মধ্যেই থাকতাম। আমি পড়াশুনোয় বিশেষ কৃতি ছিলাম না। গল্প, উপন্যাস, মৌলিক রচনা এসব পড়তে খুব ভালোবাসতাম। প্রচুর জায়গায় লেখা পাঠাতাম। নামী-দামী সব পত্রিকাতেই পাঠাতাম। বেশিরভাগ সময় ছাপা হত না। ১২ বছর বয়সে আমি প্রথম গল্প লিখি আনন্দমেলা পত্রিকায়।

প্রশান্ত ভৌমিকঃ সিরিয়াস ভাবে লেখালেখি শুরু করলেন কবে?

প্রচেত গুপ্তঃ আমি বড়দের জন্য সিরিয়াস ভাবে লেখালেখি শুরু করি খুব বেশিদিন আগে নয় কিন্তু। আজ থেকে ১৯-২০ বছর আগে। আমার প্রায় সব বই-ই এই ২০ বছরের মধ্যে। প্রথমে গল্প লিখতে শুরু করি। তারপরে উপন্যাস। নানা ঘটনার মধ্যে দিয়ে শুরু হয় আসলে। আমি শৈশবে লিখতাম, কৈশোরে লিখতাম, তারুণ্যেও লিখতাম। কিন্তু এক সময় লেখালেখিটা আর নেশা থাকে না। এরমধ্যে খানিকটা পেশাও ঢুকে যায়। একটা সময় পর্যন্ত আমার ধারণাই ছিলো না, আমার কাছে থেকে কোনো সম্পাদক, প্রকাশক লেখা চাইতে পারেন! এখন পাঠকদের শুভেচ্ছা, আপনার মতো মানুষ যারা পড়েন তাঁদের শুভেচ্ছায় শুধু নিজের খুশি হলে লিখব এমনটা পারি না। প্রকাশক, সম্পাদক, পাঠকদের চাপেও লিখতে হয়।

প্রশান্ত ভৌমিকঃ বাংলা সাহিত্যকে আন্তর্জাতিকভাবে কোন জায়গাটায় দেখেন?

প্রচেত গুপ্তঃ  বাঙালির গর্ব করার মতো ব্যাপার আছে দুটোই। সাহিত্য আর চলচ্চিত্র। এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। বাংলা সাহিত্য আর চলচ্চিত্র চিরকালের সেরাদের সঙ্গে লড়তে পারে। বিজ্ঞানী আছেন, শিক্ষাবিদ আছেন, চিত্রকর আছেন, হয়তো আরো কিছু আছেন খানিকটা খানিকটা। কিন্তু সাহিত্য এবং চলচ্চিত্রের মতো এতটা নেই। চলচ্চিত্রে তো সত্যজিৎ রায় একাই ২০ জনকে নিয়ে বসে আছেন। সাহিত্যে দুই বাংলা মিলিয়ে যা আছে একাই যে কারো সঙ্গে লড়াই করতে পারে। ওয়ার্ল্ড ক্লাস! ওয়ার্ল্ড স্ট্যান্ডার্ড!





      মলমাস
       অর্ঘ্যকমল পাত্র

অথচ, শীতকাল।কিন্তু কোনো
হলুদ জমেনি চরাচরে

তবু কিছু ছিল।হয়তো মদের বোতল।
হয়তো বা ভাঙা কাঁচ

এবং বুদবুদে কৃষকের পা কেটে গেলে
বেরিয়ে আসে, নির্লজ্জ রক্ত




            বৃষ্টিস্নান
   ---সৌমিত্র মজুমদার

বর্ষার জলে ভিজিয়ে নিয়েছি
      নিজের সবটুকু
তবু ভিজলো না সত্তা,
ভিজলো না অহংকার কিম্বা
হিংস্রতার চিহ্ন একটুও,
কামনার বহ্নি, না, সে-ও নয় !
ক্রমশ প্রকট হচ্ছে ভাঙ্গন-বিবর
চোরা গহ্বরে ঢুকে চলেছে--
বিষধর গোখরো'র অপরিমেয় বিষ
ধরাশায়ী সময় হয়তো নীরব এখন,
তবে সময় হলে সেও দেবে
'কৃত্রিম সভ্যতা' ধ্বংসের চরম উত্তর।




            ইতিহাসের খোঁজে
              সমীরণ বেরা

পৃথিবীর বুকে এক এক সভ্যতা
মানুষকে দিয়েছে বৈভব জ্ঞানের আলো
দুর্দশা অন্ধ বিশ্বাস সংস্কার,
আমি সেই আগুন জ্বালা থেকে চাকা আবিষ্কার
দাস প্রথা সতীদাহ থেকে নব যুগের আলোয়
প্রয়োজন আর নৈশব্দিক বিপ্লব গ্রন্থের মহাসঙ্গীতময়
এক এক সময় নিজেকে কীটের মত মনে হয়।
আবার কখনো অমৃতের পুত্রের তেজস্বিতায়
অন্য কোন বোধে অন্য আমির জন্ম দেয়।

ক্ষণকালীন সেই জন্ম আর মৃত্যুর মাঝেই আমি বেড়ে উঠি
আমিই দেখেছি আমার দু চোখে যোগ্যহীন সাফল্যের চূড়ায়
আমিই দেখেছি দাবার চালের মত অযোগ্যের কিস্তিমাত
প্রতিভার আলো জ্বেলে কেমন করে বিপথে চালিত হয়
এ আর এক পদ্ধতিগত যান্ত্রিক সভ্যতার বিষের বীজ
আমি দেখেছি আমার এই দু চোখে কী নিদারুণ ভাবে
ওরা মরে আর ওরা মারে; দিনের শেষে ওরাই হাসে!
তাই ইতিহাসের সভ্যতার আলো এ যুগে অন্য মানে ।

এই যুগের ইতিহাসও তো একদিন লেখা হবে!
সেখানে কি থাকবে গভীরতর ষঢ়যন্ত্রের প্রতিচ্ছবি?
আমি বা আমরা তো ক্ষুদ্র মানুষ যুগে যুগে এমনি অবহেলিত
ইতিহাস রাজার কথা বলে এক সাম্রাজ্যের পরে আর এক সাম্রাজ্য
আমরা তো নেহাত ক্ষুদ্র পাতার মত
তাই আমাদের ঝরে যাওয়া আর গজিয়ে ওঠা সমার্থক
আমাদের হতে চাওয়া আমাদের আকাঙ্ক্ষা সব কিছু
চাপা পড়ে যায় বালির স্তূপে পাথরের ভাঁজে
কোন জীবাশ্ম খুঁজে পেলে একবার পরীক্ষা করে দেখো তো
তার অস্তিত্বের বিবরণ নয় তার বুকের দীর্ঘশ্বাস
তোমরা কি আগামীতে এই ইতিহাসের খোঁজ পাবে?




        নোনতা সংলাপ
       আশিষ মজুমদার

তারপর, অন্তহীন পথ; নির্জন রাস্তা
ঘনিয়ে আসা একরাশ মৌনতা
দ্বিধাগ্রস্ততায় রুদ্ধ আবেগ
অত:পর নোনতা সংলাপ
নির্বাক সংলাপে আক্ষেপ - "চিনেছ কি আমাকে?"
দহন সংলাপ পুষে রেখেছি হৃদয়ে l
নির্জন দিগন্ত খোঁজে মম দহন জ্বালা l
সংকীর্ণতার প্রাচীর দীর্ঘ পথ চলায়!
অত:পর মৌনতা খুঁজি দগ্ধ হৃদয়ে!
নোনতা পাহাড় মৌন হৃদয়ে



             মানুষী
         শার্মিষ্ঠা সাহা

একটা খাদের ধরে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় দেখাটা
আমার অভ্যাস, নিয়ম ও বলা যায়।
ওই খাদের থেকে উঠে আসে
উপেন্দ্রকিশোর এর অসংখ্য টুনটুনি,
প্রত্যেক সূর্যোদয়ের সাথে
এতটুকু একঘেয়েমি কখনও লাগেনি।
কিচির মিচিরে কখন বেলা গড়ালো,
সূর্যাস্তের সাথে বোধোদয়।
সমস্ত কায়ার ছায়া নিবিড়,অত্যন্ত রূপসী,
আমি পেঁচা নই,
আমি বাদুড় ও নই,নই নিশাচর
আমি মনুর পুত্রী, মানুষী।




                              গন্ধ
                   রামামৃত সিংহ মহাপাত্র

এরকম গন্ধ,বলা ভালো দুর্গন্ধ তাও আবার মানুষের গায়ে যে হতে পারে সে ব্যাপারে কোন ধারণা ছিল না অতসীর। হয়তো জানতেও পারতো না এখানে স্কুলের চাকরীতে জয়েন না করলে। পুরাণে পড়েছে, রূপকথার গল্পে শুনেছে সেকালের সুন্দরী নারীদের গা থেকে সুন্দর গন্ধ বের হতো। কারও কারও গায়ে দুর্গন্ধও বের হতো অবশ্য,যেমন সত্যবতী। ওর গা থেকে বেরোতো মাছের গন্ধ,যদিও পরাশর মুনির বরে সেই গন্ধ সুরভিত হয়ে ওঠে। কিন্তু এসব সেই সময়ে হতো, এখন তো আর মানুষ চাইলেই গায়ের গন্ধ বদলে ফেলতে পারে না। ফলে সতীশের গায়ের এই গন্ধটা বদলে ফেলার কোন উপায় নেই। সতীশ অতসীর মতোই মুনিয়াডাংগা আপার প্রাইমারী স্কুলের সহ-শিক্ষক।  জয়েন করার দিনই স্টাফরুমে বসে গন্ধটা টের পেয়েছিল অতসী। কিন্তু গন্ধটাকে ওর জানা  কোন গন্ধের সঙ্গে মেলাতে পারছিল না। না,ঘামের বোঁটকা গন্ধ নয়, কোন কিছু পচে যাবার গন্ধও নয়। গন্ধটা স্টাফ্রুমে ছড়িয়ে পড়ে সতীশ এসে ঢুকতেই। ওর চোখমুখের অস্বস্তি দেখে স্নিগ্ধা,ওর স্কুলের অন্য একজন শিক্ষিকা বলে,'ওটা সতীশ স্যারের গায়ের গন্ধ।'

-ওনার গায়ে এরকম দুর্গন্ধ কেন? বডি স্প্রে লাগাতে পারেন তো?

-কাজল দি তো প্রায়ই বলেন ,'ভাই সতীশ গায়ে একটু সেণ্ট ফেন্ট লাগিয়ে স্কুল এলেই তো পারো?

-লাগাই তো

-তা সত্ত্বেও গন্ধ যায় না

-ভাল করে সাবান দিয়ে চান করবে

-তাও করি

-তাও যায় নি

-না।

-ডাক্তার দেখাও, বলা তো যায় না কোন স্কিন ডিজিজের কারনেও হতে পারে। আসলে গায়ে এরকম গন্ধ থাকলে কোন মেয়ে তোমার কাছে ঘেঁষবে না।বিয়ে সাদি করবে কী করে? এটা অবশ্য একটা সমস্যা। তবে এই সমস্যাটা নিয়ে সতীশ যে খুব একটা দুর্ভাবনা দেখিয়েছে এমনটাও নয়। বরং কাজল দি সহ অনান্যরা যতটা ভেবেছে সতীশ তার বিন্দুমাত্র ভেবেছে বলে মনে হয় না। তবে একটা ব্যাপার নিয়ে ও ভেবেছে, যেহেতু এই গন্ধটা স্টাফ্রুমের সবার অস্বস্তির কারন হয়ে দাঁড়ায় তাই পারতপক্ষে চেষ্টা করে যাতে স্টাফ রুমে না ঢুকতে হয়। কেউ বারণ করেছে এমনটা নয় নিজের থেকেই ঢুকে না। স্টাফ রুমের বাইরে একটা ফাইবারের চেয়ারে চুপচাপ বসে বই পড়ে। কখনো কখনো উদাস মনে আকাশের দিকে চেয়ে থাকে। ব্যাস গায়ের গন্ধটুকু খারাপ ,অতসী অন্য আর কোন কিছুই খারাপ দেখতে পায়নি সতীশের মধ্যে। ক্লাসে খবর নিয়ে দেখেছে জলের মতো সহজ করে অংক বোঝাতে পারে ও। দেখতেও তেমন মন্দ নয়। লম্বা, চওড়া কাঁধ, মেদহীন পুরুষালী শরীর।

আর সবচেয়ে আকর্ষণীয় দুটো চোখ। বহুবার সতীশ কে দেখে অতসী,তবে সরাসরি নয়,এক্টু লুকিয়ে। হয়তো সতীশ উদাস ভাবে আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে আছে, ক্লাস নিয়ে হেঁটে হেঁটে ফিরছে অতসী,সেই সময় এক দৃষ্টিতে,বসে থাকা সতীশের দিকে তাকিয়ে হাঁটছে অতসী। দু একবার চোখাচোখি হয় না এমনটা নয়। তবে মুহূর্তে চোখ নামিয়ে নিয়েছে অতসী। পরক্ষণেই চোখ তুলে চেয়ে দেখেছে ওর চেয়ে বেশি লজ্জার আভা ছড়িয়েছে সতীশের চোখেমুখে। আসলে অন্যকিছু নয় ঐ গন্ধটাই অতসী কে আগ্রহী করে তুলেছে সতীশের প্রতি। কিন্তু শুধুমাত্র গন্ধের জন্য তো আর লোকটার বাকি গুন গুলোকে অস্বীকার করা যায় না। আর অতসী তা করতেও চায় না,তাই একদিন সরাসরি কথা বলল ওর মেয়ের জন্য।মেয়ে টুকাই কে এই স্কুলেই ভর্তি করেছে ক্লাস সিক্স এ। এছাড়া আর অন্য উপায় ভেবে পায় নি অতসী। পাঁচজন শিক্ষক শিক্ষিকার তিন জন আসেন জেলাসদর বহরমপুর থেকে।এখান থেকে প্রায় পয়ষট্টি কিলোমিটারের রাস্তা। এখানে চাকরিটা পাবার পর অতসী প্রথমে ভেবেছিল ওদের মতো বহরমপুর থেকে যাতায়াত করবে। কিন্তু টুকাইকে কার কাছে রেখে আসবে?তাই ভবনাচিন্তাকরে এই মুনিয়াডাংগা গ্রামে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। গ্রাম টা খারাপ না কিন্তু পড়াশোনার পরিবেশ সেরকম নেই। এখানে আসার পর থেকে টুকাইয়ের জন্য একজন ভালো অংকের মাস্টারমশায় খুঁজছে কিন্তু পাচ্ছে না। টুকাই পড়াশোনা খারাপ করে না,তবে একটাই দোষ অংক কিছুতেই করতে চায় না।ওর জন্যেই সতীশের সঙ্গে কথা বলবে বলে অপেক্ষা করছিল অতসী।যাবার তাড়া থাকে বলে ছুটির ঘণ্টা পড়লে কেউ আর দাঁড়ায় না।তবে সতীশের তাড়া নেই।ও এই গ্রামেই থাকে।নিজের বাড়ি করেছে।বুধবার ক্লাস এইটে লাস্ট পিরিয়ড ক্লাস থাকে সতীশের।ছুটির  ঘন্টা পড়ার প্রায় মিনিট দশেক পরে ক্লাস থেকে বেরিয়ে এলো সতীশ।হেলতে দুলতে হেঁটে আসছে স্টাফ রুমের দিকে ।স্টাফ রুমের বাইরে সাইকেল থাকে ওর।স্টাফ রুমের বাইরের  বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল অতসী ।সতীশ কাছে আসতেই  অতসী বলে, ' আপনার সঙ্গে  একটু কথা ছিল'।শুনে কিছুটা বিস্মিত হয় সতীশ ।স্টাফ রুমের কারও বিশেষত কোন দিদিমণির যে ওর সঙ্গে দরকার থাকে  এটা ভাবতে পারে না সতীশ ।তাই বিস্মিত গলায় জানতে চায়, ' আমার সঙ্গে? '

-হ্যাঁ, বলছিলাম আমার মেয়েটাকে  অঙ্কটা একটু দেখিয়ে দিতে হবে ।

-না মানে আমি তো টিউশন পড়াই না

-আসলে কি বলুন তো, ও পড়াশোনা ভালোই করে অঙ্কটাতে কিছুতেই ভীতি কাটাতে পারছি না।আমিও বেশিরভাগ  অঙ্ক ভুলে গেছি ।মেয়ের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি  আপনার  অঙ্কের ক্লাস  ওর খুব পছন্দ ।

-কিন্তু জানেনই তো আমার গায়ের গন্ধের ব্যাপারটা।যদি কোন অসুবিধা হয়।কিন্তু কিন্তু করে কথাটা বলে সতীশ ।এবার থমকায় অতসী।অনুভব করার চেষ্টা করে গন্ধটা।আশ্চর্য হয় ভেবে গন্ধটা  প্রথম দিনকার মতো উৎকট নয়।কারণটা খুঁজে পায় না ।ভাবে তবে কি কোন কারণে গন্ধ দূর হতে শুরু করেছে?

-না না ওটা কোন অসুবিধার কারণ হবে না ।টুকাই কে জিজ্ঞেস করেছি বিশ্বাস করুন ওরা কিন্তু আপনার গায়ের কোন গন্ধ পায়না।তবুও সতীশ  কিছু বলছে না দেখে গলাদা খাদে নামিয়ে বলে, 'অঙ্কের টিচার খুঁজছি আসার পর থেকেই, কিন্তু পাচ্ছি না ।মাঝে মাঝে খুব দুশ্চিন্তা হয় মেয়েটাকে নিয়ে ।কথাটা শুনে অতসীর দিকে তাকায় সতীশ।শূন্য স্কুল নতুন গড়ে ওঠা চারটি রুম দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ।ছাত্র ছাত্রীরা  চলে গেলে ফাঁকা স্কুল ক্যাম্পাস বড্ড শূন্য শূন্য লাগে।শেষ বিকেলের আলোয় বড্ড বিষন্ন লাগে অতসীকে।ওর মনখারাপ করা মুখের দিকে তাকিয়ে সতীশ আর বেশি কিছু বলতে পারে না ।বলে 'বেশ তাহলে পড়াবো।'

-আপনাকে কী বলে যে ধন্যবাদ দেবো।আপ্লুত হয়ে বলে অতসী ।

-না না এতে ধন্যবাদ দেবার কী আছে?পড়ানোই তো আমার কাজ।বিনয়ী হয়ে বলে সতীশ।

-চলুন এবার বাড়ি ফিরতে হবে।মেয়ে অপেক্ষা করছে ।মাঝে সাইকেল দুপাশে অতসী আর সতীশ ।গ্রাম্য মোরাম ঢালা রাস্তা ।দুপাশে ফাঁকা মাঠ ।এবার বৃষ্টি নেই তাই খাঁ খাঁ করছে চারধার।চাষীরা ধান লাগাতে পারেনি ।পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে অতসী টের পায় সতীশের গায়ের গন্ধটা।কিন্তু সরে যেতে পারে না ওর পাশ থেকে।কিছুদূর গিয়ে রাস্তা দুভাগ হয়ে গেছে ।এখান থেকেই দুজনার পথ বেঁকে যাবে দুদিকে।পৃথক হবার আগে মোড়ের মাথায় দাঁড়ায় দুজনে।অতসী জেনে নেয়, ' আজ থেকে আসছেন তো?'

হুম ।নিজের পথ ধরে অতসী।অতসীর চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সতীশ ।বারবার পিছন ফিরে সতীশকে দেখে অতসী।ও দাঁড়িয়ে আছে দেখে বুকের ভেতর টা কেমন করতে থাকে অতসীর।মনে হয় একটা মনখারাপ বুকের ভেতর থেকে উঠে এসে বিষন্ন করে তুলছে পুরো পরিবেশ।

   এরকম আদরযত্ন করে সতীশকে কেউ এর আগে খেতে দেয়নি।পড়াতে এসে প্রায় দিনই রাতের খাবার খেয়ে ফিরতে হয় সতীশকে।বিশেষত সেদিনের পর থেকে যেদিন অতসী জানতে পেরেছে সতীশ ছাড়া এপৃথিবীতে সতীশের আর কেউ নেই ।সেদিন সন্ধে থেকে বৃষ্টি নেমেছিল। এই বর্ষার প্রথম বৃষ্টি। আর পড়তে চাইছিল না টুকাই।একটু দূরত্ব থেকে গল্প জুড়ে  অতসী।'টুকাই অঙ্ক  কেমন পারছে স্যার?'

-পারে তো

-একটু দেখবেন। আসলে জানেনই তো  আমি ছাড়া ওর আর কেউ নেই।টুকাই এর ব্যাপারে বেশিকিছু জানে না সতীশ। আসলে অন্যের ব্যাপারে ওর তেমন একটা আগ্রহ নেই।কিন্তু অতসী সেদিন নিজের থেকেই বলেছিলো সব কথা ।বলেছিলো, 'ওর বাবা যখন মারা যায়  টুকাইয়ের বয়স তখন দুবছর।ছত্তিশগড়ে পোস্টিং ছিল ।দিন দুই পরে ছুটি নিয়ে বাড়ি আসার কথা ছিল।মাওবাদীরা সি আর পি এফ এর একটা কনভয় উড়িয়ে দেয়।সেই কনভয়ে ওর বাবাও ছিল।কথা গুলো বলতে বলতে গলাটা আটকে আসে অতসীর।একটু থামে ।দুঃখ গিলে বলতে শুরু করে 'চোখ বন্ধ করলে এখনো চোখে ভেসে ওঠে আমার শ্বশুরবাড়ির শ্মশান ঘাট টা।জাতীয় পতকায় মোড়া মৃতদেহ ঘিরে রেখেছে  জংলা পোশাক পরা ওর সহকর্মী আর অফিসারেরা।গ্রাম ভেঙে লোক এসেছিলো দেখতে।সব হারিয়ে টুকাইকে কোলে নিয়ে এক কোনে অন্ধকারে মিশে যাচ্ছিলাম আমি।চমকে উঠলাম তোপ ধ্বনিতে।সজোরে কাঁদতে শুরু করে টুকাই

।তোপধ্বনীর সঙ্গে সঙ্গে সব শেষ।'বলতে বলতে চোখের জলে ভরে ওঠে অতসীর চোখ।হঠাৎ সচকিত হয়ে ছুটে যায় টুকাইয়ের আর্তনাদে।পিছন পিছন সতীশ ।গিয়ে জড়িয়ে ধরে টুকাইকে 'কি হলো রে মা?'

-মাকড়সা

-তো কি হয়েছে? মাকড়সা কী করবে তোর

-ভয় লাগছে মা

-মাকড়সা কিচ্ছু করতে পারবে না। বলে সতীশ।

-কিন্তু স্যার যদি কামড়ে দেয়

-মাকড়সা কামড়ায় না

-যদি জালে আটকে ফেলে

-ধুর বোকা ঐ টকু জালে মানুষ কখনো আটকা পড়ে? ওটা তো ওদের শিকার ধরার জাল। দুজনকে গল্প করতে দেখে মনটা ভালো লাগে অতসীর।বলে 'অনেকটা দেরী হয়ে গেলো আজ তাহলে এখানেই খেয়ে যাবেন।'

-না না তা কেন?আপনি শুধু শুধু আমার জন্য কষ্ট করতে যাবেন কেন?

-আমার কোন কষ্ট হবে না। তবে সেদিন খেতে খেতে শুনেছিল সতীশের কষ্টকর জীবনের কথা। জানতে চাইতে হয় নি নিজেই শুনিয়েছিল আতসীর দুঃখের কথা শুনে। টূকাই কে আগেই খাইয়ে দিয়েছিল খাবার পর নিজের মতো সময় কাটাচ্ছিল টুকাই। খাবার বেড়ে একটা চেয়ার টেনে পাশে বসেছিল অতসী। স্টাফ রুমে যে যাই ব্লুক সতীশের গায়ের তীব্র গন্ধটা তটতা আর অসহনীয় লাগে না আতসীর।মনে হয়েছিল হয়তো সবই অভ্যাস। ওর পাশে বসে শোনাচ্ছিল টুকাইয়ের বাবা মারা যাওয়ার পরবর্তী ঘটনা। 'ওর বাবা মারা যাবার পর প্রথম আঘাতটা আসে আমার শ্বশুর বাড়ি থেকে। সরকার থেকে যা ক্ষতিপূরণ দিয়েছিল ওরা চেয়েছিল সবকিছু আমার দেওয়ের নামে করে দি।রাজী হইনি।সরাসরি বলেছিলাম টুকাইয়ের ভবিষৎ নেই?

-টুকাই কে কি ওর কাকা ফেলে দেবে

-বলা যায়,এখন ওর কাকার সংসার হয় নি।হলে তখন? তাতেও দমে না ওরা। দেওরকে বিয়ে করার জন্য আমাকে প্রস্তাব দেয় ।রাজী না হতে চাপ দিতে থাকে।তখন শ্বশুর বাড়ী ছেয়ে বাবা মায়ের কাছে চলে আসি।আমার দাদা প্রস্তাবটা দেয়,'তোর তো ইংরেজীতে অনার্স ছিল,চেষ্টা করে দেখ না এস এস সি তে লাগাতে পারিস কিনা?'

-সাবজেক্টের সঙ্গে যে অনেকদিন কোন যোগাযোগ নেই রে দাদা।

-তাতে কি হয়েছে, করে নে চেষ্টা করলে নিশ্চয়ই পারবি।চেষ্টা করেছিলাম, টুকাইয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে ।পেয়ে যেমন  আনন্দ হয়েছিল তেমনি  ভয় পেয়েছিলাম এতদূরে চাকরি করতে আসতে হবে ভেবে। তবে এসে আপনাদের পেয়ে ভয়টা কাটতে শুরু করেছে জানেন।মেয়েটাও নিজের মতো জীবন পেয়েছে একটা।ঝপ করে  অন্ধকার নেমে আসে ।লোডসেডিং।টুকাই  ছুটে বসে বসে পড়ে অতসীর চেয়ারে।অতসী উঠে যায় মোমবাতির খোঁজে।মোমের আলোয় নিজের কথা বলে যায় সতীশ ।'শুধু  টুকাই নয় ওকে পড়াতে এসে আমিও একটা অন্য জীবন খুঁজে পেয়েছি জানেন।একটা সময়ে এই জীবনটাকে বাঁচিয়ে রাখার কোন মানে খুঁজে পেতাম না ।যখন ক্লাস সেভেন  এ পড়ি সেইসময় খুন হন আমার বাবা।

-খুন। অ্যাঁৎকে ওঠে অতসী।

-হ্যাঁ।বাবা ছিলেন সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী ।দলের লোকেদের সঙ্গে মতভেদ হওয়ায় খুন হয়ে যান বাবা।বাবা মারা যাবার পর কথা বন্ধ হয়ে যায় মায়ের।মাকে বাঁচিয়ে রাখার লড়াই শুরু হয় আমার।দিনমজুরি করে পড়াশোনা করেছি পেটের ভাত জোগাড় করেছি ।কেউ কোনদিন  একটু সহানুভূতি দেখায় নি।ভালোবাসার কোন লোক ছিল না ।ভালোবাসা না পেয়ে পেয়ে জীবনের প্রতি মায়া হারিয়ে ফেলেছিলাম।বলতে বলতে থামে সতীশ ।অতসী বুঝতে পারে সতীশের গা থেকে  বেরোনো গন্ধটা ভালোবাসা না পাবার গন্ধ।নিশ্চুপ সতীশ মুখ খোলে অতসীর কৌতূহলে 'আপনার মা কি এখানে আপনার সঙ্গে থাকেন?'

-না

-তবে?

-আমি যেদিন আমার চাকরি পাবার খবর পাই, ছুটে গিয়েছিলাম ঘরে মাকে জানাবো বলে।ছেলের আনন্দের খবরে মা যদি হারিয়ে যাওয়া ভাষা খুঁজে পান সেই আশায়।গিয়ে ভাষা হারিয়ে ফেলি আমি।দেখি ফেন থেকে ঝুলছেন মা।বলে স্তব্ধ হয়ে যায় সতীশ।নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকে অতসী।অনেকক্ষণ পর সতীশ বলে 'কার জন্য বাঁচবো বলতে পারেন ?'ছলছল চোখে  অতসী তাকায় মাথা নিচু করে বসে থাকা সতীশের দিকে।মৌনতা ভঙ্গ করে টুকাই, 'কি হলো স্যার আপনি কাঁদছেন কেন?'কোনো কথা  বলতে পারে না সতীশ।টুকাইক জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে ওঠে ।সঙ্গে সঙ্গে  ইলেকট্রিক এসে আলোয় ভরে দেয় ওদের ছোট্ট ঘরটাকে।অতসী খেয়াল করে অদ্ভুত ভাবে বদলে গেছে সতীশের গায়ের গন্ধ ।গন্ধ বদলে যাবার ব্যাপারটা পরেরদিন টের পায় পুরো স্টাফরুম।সেটা বোঝা যায় আলোচনা আর ফিসফিসানি তে।সেদিন বর্ষা ঢোকে মুনিয়াডাংগায়।স্কুল শেষে বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য  অতসী নিজের ছাতার তলায় ডেকে নেয় সতীশকে।একই ছাতা আশ্রয় করে পাশাপাশি হাঁটতে থাকে দুজনে। বৃষ্টি সব গন্ধ ভাসিয়ে নিয়ে গিয়ে জাগিয়ে তোলে একটা অদ্ভুত ভালোলাগার গন্ধ।ভালোবাসার গন্ধ







          ধ্বংস
   হীরক বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রেম ভালোবাসা তো অনেক রকম
অথচ তুমি একজন ই
তোমার প্রাসাদ ঘরে উঠে যাই নেমে আসি
তুমি বুঝি দেখেও দ‍্যাখোনা
শিরা উপশিরা শক্ত করে বাধি
অথচ এতদিন জেনেছি
তুমি ই বিস্ফোরণ
সোম তুমি হোম তুমি, তুমি ঘৃতাহুতি দিতে আসা আত্মজন,দিন ও রাত্তিরে সাপে আর নেউলে
চোর আর গেরস্তে
অবিস্মরণীয় পাঠ উপর নীচে দুদিকেই জ্বলো
আর সব কাম ধ্বংস হয়ে যায়...






                   প্রীতিকাতরতা
                সোমনাথ মুখার্জী

সব তুমি এভাবে মুছে দেবে
সে কথা প্রেমের ঘাসজমিতে সেভাবে বলোনি তুমি,
নিরুপমা। বাদাম,চাঁদের অলস আলো, ফেসবুক, অন‍্যান‍্য যন্ত্রজাদু, কেউ আর কার‌ও ন‌ই। মৃত্যু শিয়রে ঠিকই---
তবুও, প্রেম এক শব্দময় প্রঞ্জা। মৃত্যুভয়  তোমায় এভাবে বদলাবে ভেবে,
বড় কষ্ট বুকের গাছেদের। ডালপালা ভেঙে যায়, পাখি বদল করে বাসা, নির্ভরতা নীরবে ভাঙে। আমি আজ‌ও--
সরল ভালোবাসায় বাঁচি, তুমিও এসো রাত শেষ হলে,
ভোরের অলৌকিক প্রীতিছন্দে।
           





দাড়াও তীর্যক
শ্যামসুন্দর মন্ডল


আমি পীঠ পেতে দিচ্ছি
বাতাস,বন্ধ কর তোমার হাত বাড়ানো।
বৃষ্টিকে সম্পূর্ণা হতে দাও উলম্বপ্রবাহে।


পুবের মাঠে ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতা।
সুতোর উন্নতিকোন মেপে গোপন ঈর্ষায়
সুতোর বাড়ায় ইন্ধন যুগিয়ে মাটিতে ঘুড়ির ছায়া ফেলার চেষ্টা।
ছায়া পড়ে না,অন্তত ঘুড়ি যতক্ষন উড়তে থাকে।

এরপরে ও কৌশল!
বন্ধ করো সব।
দাঁড়াও তীর্যক,উন্নত কর শির,বাড়াও তোমার হাত।






      যো ওয়াদা কিয়া ওহ....
         সপ্তর্ষি মন্ডল 

এই দেশ , এই মাটি , এই পৃথিবী
এক ঐক্যের সুর

এই সাম্রাজ্য বিশাল আন্তরিকতার
এক ভাতৃত্বে গাঁথা ।

তবু দানব আছে , সর্ষের মধ্যেই
গদি যাদের লক্ষ এক

সাধারণ মানুষ মরছে মরুক
ধর্ম যে ওদের চোখে বহু ।

কোনদিন গীতা চিনেছো , পড়েছ কুরানের আয়াত
কোনদিন মসজিদ গেছিলে হুজুর ,
লাগিয়েছ মন্দিরে সাত পাক ?

না , কোনটাই করোনি তাই
বিষে লিখেছো ভাই ভাই

ভেদের আগুন জ্বেলে
চিনতে চেয়েছ মানুষ পোশাকে ।

বাইরে দেখো চেয়ে , অর্থের পাতা ঘেঁটে
ঘোর অধঃপতন সরেজমিনে ,
যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার ছলে ।

গদির লোভ সর্বনাশি
বিধাতার ঠোঁটে দেখবে ওই বক্র হাসি
পনেরো লক্ষের হিসাব , চাইবে যখন হিন্দু মুসলমান ।

হে রাজন ,
যো ওয়াদা কিয়া ওহ নিভানা তো পরেগা ...





           দোস্তি..!
      অমিত পন্ডিত

তার চোখের হজম শক্তি জানে
আমি শূন্য হয়েছি নেমেছি জাহান্নামে..

আমি সকাল হয়েছি, সন্ধ্যা হয়েছি, রাত্রি হয়েছি নির্দিধায় নির্জনে
আমি চিবানো হয়েছি, গেলা হয়েছি, হজম হয়েছি তার সব খানে..

সে আমার আকাশ পাতাল চিনে
স্বর্গ, নরক প্রতিরাতে দাম দিয়ে নিয়েছে কিনে

... আমি ১০.. ৯.. ৮.. করে শূন্য হয়েছি প্রতিদিনে
সেই শুধু এ জন্মের বর্ধিত ব্লাড গ্রুপ আমার জানে..





         এহেন স্বপ্ন দেখে যে মেয়ে
            আবদুস সাত্তার বিশ্বাস
         
প্রতিদিন বিকেলে ঘাটের ধারে মন্দিরের পিছনে কয়েকজন ছেলে বসে।তরুণ ছেলে।সেখানে তারা আড্ডা দেয়।চায়ের দোকানের বেঞ্চে বা মাচানে বসে গুণ্ডা মার্কা লোকেরা যে ধরনের আড্ডা দেয় সেরকম আড্ডা নয়।সাহিত্য আড্ডা।এখানে রোজ একজন করে তরুণ স্বরচিত কবিতা ও গল্প পাঠ করে শোনায়।অর্থাৎ যার যেদিন পালা পড়ে।আর অন‍্যরা তা শুনে মতামত দেয়।শুনে যাকে যেমন লাগে সে তেমনটিই জানায়।সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে সাহিত্য আড্ডা যদিও এখন আর এভাবে বসে হয় না বললেই চলে।কিন্তু এখানে হয় দেখে ভালো লাগল।যাইহোক,আজ অমরেন্দ্রর পালা। অর্থাৎ অমরেন্দ্র আজ তার স্বরচিত লেখা পাঠ করে শোনাবে।অমরেন্দ্র আড্ডায় এসে বসতেই অন‍্যরা তাই বলতে লাগল,"অমরেন্দ্র দা,আজ কিন্তু আপনার পালা।মনে আছে তো?"
"মনে আবার থাকবেনা?খুব মনে আছে।আজ একটা গল্প পাঠ করবো।"অমরেন্দ্র গল্প-কবিতা দু-রকমই লেখে বলে কথাটা বলল।
সবাই খুশি হয়ে বলল,"খুব ভালো হবে।"
পরে কমল নামে একজন বলল,"দাদা,আপনার গল্পের মাধুর্যই আলাদা।তাই আপনার গল্প শুনতে আমাদের সবার খুব ভালো লাগে।আপনি যে আজ গল্প পাঠ করবেন এটা আপনি না বললেও আমরা কিন্তু আপনাকে আজ একটা গল্প পাঠ করতেই বলতাম।আপনি আসার আগে আমাদের এ বিষয়ে কথাও হয়েছে যে,আপনাকে আমরা আজ কবিতা নয়,একটা গল্প পাঠ করতে বলবো। রিয়েলি,দাদা।বিশ্বাস না হয় আরো যারা আছে তাদের জিজ্ঞেস করুন!"
অমরেন্দ্র জিজ্ঞেস করল না।কিন্তু জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মেলে সবার মুখের দিকে তাকালো।সবাই তখন ওই কথাটাই বলল।যে কথাটা কমল আগে বলেছিল।

দুই

সবার যখন ইচ্ছা অমরেন্দ্র তখন একটা গল্প পাঠ করবে।সে প্রস্তুত।ঠিক এইসময় তার মোবাইলটা বাজতে শুরু করল,"তেরি মেরি কাহানি..." মানে ফোন এল।ফলে অমরেন্দ্র গল্প পাঠ শুরু না করে আগে ফোনটা ধরলো,"হ‍্যালো!"
"কে,অমরেন্দ্র দা বলছেন?"
"হ‍্যাঁ,বলছি।"
"আমি সবিতা বলছি।"
এই সবিতা মেয়েটা হল অমরেন্দ্রর বোনের বান্ধবী। অমরেন্দ্রর বোন কঙ্কনা কিছুদিন আগে তাকে একবার তাদের বাড়িতে বেড়াতে এনেছিল।তখনই সবিতার সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছিল।অমরেন্দ্র তাদের বাড়িতে তাকে প্রথম দেখে চিনতে না পেরে কঙ্কনাকে জিজ্ঞেস করেছিল,"এটা কে রে,কঙ্কনা? চিনতে পারলাম না।"
কঙ্কনা বলেছিল,"আমার বান্ধবী।নাম সবিতা।"
অমরেন্দ্র বলেছিল,"ও,আচ্ছা।"
কঙ্কনা তখনই অমরেন্দ্রর সঙ্গে সবিতার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল,"আর সবিতা,এ হল আমার দাদা।নাম অমরেন্দ্র সরকার।খুব ভালো লেখে। দাদার লেখা পড়লে তুই মুগ্ধ হয়ে যাবি।এত ভালো লেখে!"
সবিতা তখন অমরেন্দ্রকে প্রণাম জানিয়ে পরে বলেছিল,"তাই নাকি,দাদা?"তারপর জিজ্ঞেস করেছিল,"কি লেখেন?"
অমরেন্দ্র নীরব ছিল।তার নীরব থাকা দেখে কঙ্কনা নিজে বলেছিল,"দাদা বলবেনা,আমি বলছি।"বলে সে বলেছিল,"দাদা গল্প,কবিতা,উপন্যাস সব রকমই লেখে।খুব ভালো লেখে।"
অমরেন্দ্র তখন কঙ্কনাকে বলেছিল,"সেই তখন থেকে তো খুব ভালো লেখে ভালো লেখে করছিস।তুই কি আমার লেখা পড়েছিস?"
কঙ্কনা বলেছিল,"পড়িনি তো এমনি বলছি?"
অমরেন্দ্র বলেছিল,"মিথ্যা কথা বলার জায়গা পাস না?কবে পড়লি?"
কঙ্কনা তখন বলেছিল,"বিকালে তুই যখন  বাড়িতে থাকিস না।সাহিত্য আড্ডায় বেরিয়ে যাস।আমি তখন তোর লেখা গুলো বসে বসে মন দিয়ে পড়ি! কি সুন্দর লাগে পড়তে!তোর লেখা পড়ে কতদিন আমার কি মনে হয়েছে জানিস?তুই আমার নিজের দাদা না হয়ে যদি সবিতার দাদা হতিস বা রক্তের সম্পর্ক ছাড়া পাড়ার কেউ হতিস তো আমি তোর নির্ঘাত প্রেমে পড়ে যেতাম।"
অমরেন্দ্র অমনি চমকে উঠেছিল শুনে,"কি বললি!"
কঙ্কনা বলেছিল,"হ‍্যাঁ রে দাদা,ঠিকই বলছি।তোর লেখায় যা আবেগ আর অনুভূতি!"
সবিতা তখন চুপ করে বসে তাদের দুই দাদা বোনের কথা শুনছিল।কঙ্কনা আর অমরেন্দ্রর। আর মাঝে মাঝে অমরেন্দ্রকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল।সবিতাকে অমরেন্দ্র তখন বলেছিল,"তুমি কঙ্কনার কথা একদম বিশ্বাস করবেনা,সবিতা।ও কি বলতে কি যে কখন বলে ফেলে ও নিজেই জানেনা।তাইতো আমরা ওকে ক্ষেপী বলি।আমি মোটেও ভালো লিখতে পারিনা।মনের খোরাক মেটানোর জন্য মনে যখন যা আসে তাই তখন লিখি মাত্র।কিন্তু সেগুলো মোটেও ভালো লেখার মধ্যে পড়ে না।তবে আমাদের একটা সাহিত্য আড্ডা হয়।সেই আড্ডায় অনেকেই  খুব ভালো লেখে।"
সবিতা তার উত্তরে তবু স্মিত হাস‍্য মুখে বলেছিল,"আপনি বললেও আপনার কথা বিশ্বাস করবো না।কঙ্কনার কথাই বিশ্বাস করবো।"
অমরেন্দ্রও বলেছিল,"তা তো করবেই।তোমরা দু-জন এক যে।আর আমি পর যে।"অমরেন্দ্র এমন ভাবে কথাগুলো বলেছিল যে,সবিতা ভীষণ মজা পেয়েছিল।তার পাতলা ঠোঁটের মিষ্টি হাসি দেখে অমরেন্দ্র সেটা বুঝতে পেরেছিল।আজ সবিতার ফোন পেয়ে অমরেন্দ্রর সেসব কথা সব মনে পড়ে গেল।কিন্তু অতীতের সেসব কথা সে এখন ফোনে কিছু বলবে না।কিচ্ছু বলবেনা।সে শুধু বলল,"বলো।"
সবিতা বলল,"ভালো আছেন?"
"হ‍্যাঁ,ভালো আছি।"অমরেন্দ্র বলল,"তুমি ভালো আছো?"
"চলে যাচ্ছে।"সবিতা বলল,"আপনার নাম্বারটা কঙ্কনার কাছে নিলাম।"
"বেশ,কি খবর বলো।"
সবিতা বলল,"দারুণ খবর!একটা দারুণ খবর!"
অমরেন্দ্র কিছু বুঝে উঠতে না পেরে শুধু জিজ্ঞেস করল,"কি দারুণ খবর?"
সবিতা তখন বলল,"স্বপ্নে আমি শিয়ালদহ স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছি।"
অমরেন্দ্র জিজ্ঞেস করল,"স্টেশনের ভেতরে?না বাইরে?"
সবিতা বলল,"স্টেশনের বাইরে।মানে স্টেশন চত্বরে দাঁড়িয়ে আছি।"
"বেশ,দাঁড়িয়ে কি দেখলে বলো।"
সবিতা বলল,"একটা লোক।মানে একটা লোক। লোকটা দেখতে ছিপছিপে গড়ন।মাথায় বেশ লম্বা।গায়ের রং কৃষ্ণ বর্ণ।মুখে কয়েকদিন না কাটা কাঁচা পাকা দাড়ি।গায়ে ফুল শার্ট।সাদার উপর কালো দাগ টানা।আর পরনে নীল জিনস প‍্যান্ট।পা দুটো জড়ানো।সে আমার কাছে এসে বলল,"দারুণ খবর!একটা দারুণ খবর!"
আমি জিজ্ঞেস করলাম,"কি দারুণ খবর?"
লোকটা এবার তার পিঠের ব‍্যাগ থেকে একটা ম‍্যাগাজিন বের করে বলল,"এই ম‍্যাগাজিনে একটা উপন্যাস বেরিয়েছে।তরুণ লেখকের একটা উপন্যাস।বেরনোর সঙ্গে সঙ্গে পাঠক মহলে বিশাল সাড়া পড়ে গেছে।গত পঞ্চাশ বছরে নাকি বাংলার কোনো কবি সাহিত্যিক এরকম ভালো উপন্যাস লিখতে পারেননি।তাই এটাই হল দারুণ খবর।"
"তাই নাকি!"আমি একটু নড়ে দাঁড়ালাম।
"হ‍্যাঁ।"
"কি উপন্যাস?"
"আলো-অন্ধকার।"
"ম‍্যাগাজিনটা একটু দেখি!"
"না,দেখানো যাবেনা।"
"না দেখালে ম‍্যাগাজিন বিক্রি হবে?মানুষ কিনবে?"
"কিনবে কিনবে।"
"কিনবে তো একজনও কিনছে না!"
"ঠিক কিনবে।বিমান বন্দরে যখন যাবো সব বিক্রি হয়ে যাবে।পয়সা অলা মানুষ ওখানে বেশি থাকে তো।"
"ঠিক আছে।না দেখাবে লেখকের নাম তো বলবে?"
"হ‍্যাঁ,তা বলব।"
"তো বলো!"
"লেখকের নাম অমরেন্দ্র সরকার।"
"কি নাম বললে!"
"অমরেন্দ্র সরকার।"
"আচ্ছা?"
"বলুন!"
"কাছে তোমার লেখকের কোনো ছবি আছে?"
"আছে।দেখবেন নাকি?"
"একটু দেখাও দেখি!"
ম‍্যাগাজিনটা না দেখালেও সে লেখকের ছবিটা দেখাল পকেট থেকে বের করে,"এই দেখুন!"
ছবিটা হাতে নিয়ে আমি তো দেখে অবাক,এ যে আপনার ছবি।কি সুন্দর আপনি ছবিতে হাসছেন। আপনার দাঁত গুলো কি সুন্দর ঝকঝক করছে। আর আপনার গালের তিলটাও স্পষ্ট।
পরে লোকটা যখন ছবিটা আমার কাছ থেকে নিল আমি তখন বললাম,"উনি আমার পরিচিত।"
"পরিচিত!আপনার?হা-হা-হা---"আমার কথা লোকটার বিশ্বাস হল না।উপহাস করল।
আমি তখন বললাম,"হ‍্যাঁ গো,উনি আমার সত্যি পরিচিত।আমার বান্ধবীর দাদা।"
লোকটা তখন আমাকে বলল,"কি যা তা বলছেন! আপনার মাথা খারাপ হয়েছে নাকি?ইনি আপনার বান্ধবীর দাদা হতে যাবেন কেন?ইনি হলেন বিখ্যাত কথা সাহিত্যিক অমরেন্দ্র সরকার।যাঁর এখন অনেক দাম।অনেক নাম।"
"আমার বান্ধবীর দাদাও অমরেন্দ্র সরকার।তিনিও লেখালেখি করেন।এবং খুব ভালো লেখেন।"
"উনি আপনার বান্ধবীর দাদা অমরেন্দ্র সরকার। লেখালেখি করেন বলে উনি লেখক নন।আর ইনি হলেন লেখক।লেখক অমরেন্দ্র সরকার।দুটি লোক তাহলে এক হলেন?"
"কিন্তু ছবি দেখে আমি যে স্পষ্ট চিনতে পারলাম। উনি আমার বান্ধবীর দাদা।"
বিরক্ত হয়ে লোকটা এবার কষে ধমক মারলো একটা,"থামুন তো!যত্তসব!"
সঙ্গে সঙ্গে আমি চুপ করে গেলাম।গিয়ে পরে বললাম,"একটা ম‍্যাগাজিন নেবো।দাম বলো!"
"দাম দু-হাজার টাকা।"লোকটা বলল।
দাম শুনে আমি তো অবাক,"কি!একটা ম‍্যাগাজিনের দাম দু-হাজার টাকা!কি যা তা বলছ তুমি!"
"আমি যা তা বলছি না ম‍্যাডাম,আমি ঠিকই বলছি।"
"না,তুমি ঠিক বলছ না।"
"আমি ঠিকই বলছি।আপনার যদি মনে ধরে তো নেবেন।মনে না ধরে নেবেন না।"
লোকটাকে আমি তখন প্রশ্ন করলাম,"একটা ম‍্যাগাজিনের দাম কখনো দু-হাজার টাকা হয়? আমরা ম‍্যাগাজিন বুঝি কিনে পড়ি না!"
"পড়েন না তা কখন বললাম?"
"মুখে বলছ না।কিন্তু তোমার কথা শুনে সেটাই মনে হচ্ছে।যাইহোক,পাঁচশো টাকায় দেবে?"
লোকটা সরাসরি বলে দিল,"দেবোনা।"
আমি বললাম,"আর পঞ্চাশ টাকা ধরে নাও!সাড়ে পাঁচশো টাকা নাও!নিয়ে একটা ম‍্যাগাজিন দাও।"
লোকটা তখন বলল,"দু-হাজার টাকার জিনিস সাড়ে পাঁচশো টাকায়!আমার কি মাথা টাথা খারাপ হয়েছে?"
"তাহলে দেবেনা বলছ?"
লোকটা তখন বিরক্ত হয়ে বলতে লাগল,"কেন খামোখা শুধু শুধু বকাচ্ছেন বলুন তো!হবে কি হবেনা দেখেও কি বুঝতে পারেন না?"
"নাহলে কিছু করার নেই।"আমি লোকটার কাছ থেকে দূরে সরে দাঁড়ালাম।
"আপনার কিছু করার না থাকলে আমারই বা কি করার আছে বলুন!"বলে ভিড়ে কোথায় যে লোকটা হারিয়ে গেল আমি আর দেখতে পেলাম না।পেলাম না তো পেলাম না।আমার তারপর ঘুম ভেঙে গেল।"

তিন

ফোনে অনেকটা সময় চলে গেল বলে অমরেন্দ্র আজ আর গল্প পাঠ করল না।সবিতার স্বপ্নটা নিয়ে গল্পের মতো শুধু আলোচনা করল। আলোচনা শুনে সবাই বলল,"দারুণ!"তারপর অমরেন্দ্রকে জিজ্ঞেস করল,"দাদা,মেয়েটা আপনার কে হয়?"
"আমার কেউ হয়না।আমার বোনের বান্ধবী হয়।"
"মেয়েটা দেখতে?"
"রূপসী বললে খুব কম বলা হবে।"
"আইবড় তো?"
"অবশ্যই আইবড়।"
সবাই তখন অমরেন্দ্রকে পরামর্শ দিল,"এক কাজ করুন তাহলে,মেয়েটাকে ধরে বেঁধে ফেলুন!শক্ত করে ধরে বেঁধে ফেলুন!"
অমরেন্দ্র হাসলো শুনে।আজ রাত্রি ন'টার পরে তো সে এইজন্যই ফোন করবে।এহেন স্বপ্ন দেখে যে মেয়ে তাকে যে ধরে বেঁধে ফেলতেই হবে।শক্ত করে ধরে বেঁধে ফেলতে হবে।সেই বাঁধনের কথাটাই রাত্রি ন'টার পরে হবে।
                       






                       কোকিলের ডাক
                            কবিরুল

অফিসের কাজ সারতে সারতে প্রায় সাতটা বেজে গেল । পায়ের একটা খসখসে আওয়াজ শুনে মুখ তুলে দেখি রমেন দাঁড়িয়ে ।
" বাড়ি যাবেন না স্যার ? অফিসে তো আর কেউ নেই । সবাই চলে গেছে । " কথাগুলো বলেই রমেন ফাইলটা এগিয়ে দেয়।
 "  আর বোলোনা , আমাদের কন্ট্রাক্টর মৃত্যুঞ্জয় বাবুর মেয়ের বিয়ে । অনেক করে চেকটা ক্লিয়ার করে দিতে বলেছিল । তারই বিলটা রেডি করতে করতে দেরি হয়ে গেল । " আমি ফাইলটা নিয়ে আলমারিতে রাখি।
যাক্‌ সাড়ে সাতটার লোকালটা পেয়ে গেছি । আজ কেন জানি না ট্রৈনটা একটু ফাঁকা ফাঁকা । পা ছড়িয়ে বসতে যাব ট্রেনটা ছেড়ে দিল ! অমনি হূড়মুড়িয়ে একজন মহিলা সাথে বছর তিনেকের এক বাচ্চা নিয়ে একেবারে আমার উল্টোদিকের সিটটায় মুখোমুখি বসে পড়ল ! এক নজরে মনে হল মহালা  অনিন্দ্য সুন্দরী ! কিন্তু কোন শারীরিক বা মানসিক কষ্ট ওর মুখ ও শরীরে যেন আলকাতরার পোচ দিয়ে দিয়েছে । পা সরিয়ে ভালো করে বসতে গিয়ে মহিলার  সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল । বুকটা ছ্যাৎ করে উঠলো । এ মুখ যেন কতকালের চেনা ! কে !
 "  ভালো আছো অরুনদা ? আমি দূদিন কিছু খাইনি । কিছু খাওয়াবে আমায় ? সুলেখা প্রশ্ন করে।
   " দুদিন খাওনি ? কেন ? কি এমন হয়েছে যে তোমার পেটে কিছু পড়েনি ? "  আমি একটু ভয় পেয়ে ওকে প্রশ্ন করি।
        আমার কথা শুনেই সুলেখা হাউ হাউ করে  কেঁদে উঠল। আমি ট্রেনেই কিছু খাবার আর জলের বোওল কিনে তর দিকে এগিয়ে দি।   অনেক্ষণ পর চোখের জল মুছে সুলেখা একটু স্বাভাবিক হল। খেতে খেতে ও যা বলল তাতে আমি আঁতকে উঠলাম।
            অনেক বছর আগের কথা। আমি সদ্য বারো ক্লাস পাস করে কলেজে অ্যাভমিশন নিয়েছি। কেমিষ্ট্রি অনার্স। বিল্বদল স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়ছি। সুলেখার মা ঐ বাড়িতে কাজ করত। মাঝে মাঝে ও বাড়িতে  মায়ের কাজে হাত লাগাত। তখন থেকেই সুলেখাকে চিনি। গরীব ঘরের মেয়ে সুলেখা খুব মিষ্টি দেখতে ছিল। চোখগুলো অসম্ভব সুন্দর। যেন কবিতার মত!
           বেশ কিছু মাস পর উপলব্ধি করলাম আমি সুলেখাকে ভালবেসে ফেলেছি। কিন্তু সেটা প্রকাশ করতে পারছি না। একটা চাপা কষ্ট। সুলেখা আগেই বুঝতে পেরেছিল। মুখে কিছু বলেনি। স্যারও বিষয়টা টের পেলেন। উনি বেশ কড়া ধাঁচের মানুষ। কোচিং এ পড়তে এসে এইসব কিছুই পচ্ছন্দ করেন না। তাই আমাকে কোচিং ক্লাস থেকে বের করে দিলেন।
            বন্ধুরা পাশে এসে দাঁড়াল। সুলেখাকে প্রোপোজ করলাম। বেশ কিছু বছর প্রেম চলল বটে। তবে পড়াশোনা একটু হ্যাম্পার হল।
            এরপর সুলেখার পরিবার থেকে ওর উপর  বিয়ের জন্যে চাপ আসতে থাকল। আমার তখন পায়ের তলায় মাটিও নেই। বাড়িতে অসুস্থ বাবা মা। তার উপর ছোট ভাই বোন আর দিদি আছে। দিদিরও বিয়ে দিতে হবে। আমি বেশ নিরূপায় হয়ে সুলেখার কাছ থেকে দু এক বছর সময় চাইলাম। সুলেখা আমাকে ভালবেসেছিল। তবে ওর পরিবার আমাকে খুব একটা পচ্ছন্দ করত না। একেই বেকার। টিউশন ভরসা। তাছাড়া আমার বাড়ি ঘরের অবস্থা ভাল ছিল না।
            সব মেয়েই চাই শ্বশুড়বাড়ি একটু গোছানো স্বচ্ছল হোক। সুলেখা সব দিক ভেবে আস্তে আস্তে আমার ছীবন থেকে সরে আসল। তারপর ওর বিয়ে ঠিক হয়।
            এরপর আট   বছর কেটে গেছে।  আমি অনেক কষ্টে একটা সরকারী চাকরি পায়। একদিন বিল্বদল স্যারকে প্রণাম করতে গিয়ে শুনি সুলেখার সাথে ওর স্বামীর সেপারেশন হয়ে গেছে।  দুজনের রেজিষ্ট্রি হয়েছিল। এক ছাদের নীচে থাকতে শুরু করলেও আনুষ্ঠানিক বিয়েটা হব হব করে আর হয়ে ওঠেনি। সুলেখা প্রেগন্যান্ট হয়ে যায়। পরে ও জানতে পারে ওর স্বামীর আরো সম্পর্ক আছে। শেষে সুলেখাকে ছেড়ে বাংলাদেশ চলে যায়।
           পরে সুলেখা একটা প্রাইভেট হসপিটালে আয়ার কাজ জোটায়। সেখানেও যৌনতার শিকার হয়। শেষে হাওড়া স্টেশনে প্লাটফর্মে ছেলেকে নিয়ে  থাকা শুরু করে। কোন রকমে এ ওর  কাছ থেকে চেয়ে দিন চলে।
             আছ বহু বছর পরে সুলেখার সাথে দেখা হতে পুরানো ভালবাসাটা আবার চাগিয়ে উঠল। সুলেখা প্রথম থেকেই আমাকে " অরুণদা " বলে ডাকত। ঐ ডাকটা বহুদিন কানে বাজার পর থেমে গিয়েছিল। আজ আবার নতুন করে ধ্বনিত হল।
                 সুলেখাকে ভালবেসে ঠকে ছিলাম। ও কিছুটা  স্বার্থপরের মতন চলে গিয়েছিল। আমিও রাগে অভিমানে আর বিয়ে করার কথা ভাবিনি।
             সময় থেমে থাকেনি। বদলির চাকরি নিয়ে আসানসোলে আসতেই পূর্বাশা আমার জীবনে আসে। ও আমার সব খেয়াল রাখে। সামনের ফাল্গুনেই চার হাত এক হবে। যদিও আমাদের দুছনের বেশ বয়স হয়েছে।
           সুলেখাকে কথাটা বলতে চাই নি। মুখ ফসকে বেরিয়ে আসল। মৃত্যুঞ্জয়বাবুকে অনুরোধ   করে উনার ফার্মে সুলেখার জন্যে একটা ভাল কাজের ব্যবস্থা করে দিলাম।
            সুলেখা সব শুনে একটু বিচলিত হল। চোখ ছল ছল করছে।
            আমার মনে কোথায় যেন কোকিল ডেকে উঠল। প্রেমের কোকিল। তবে সেই ডাক বেশ কান্না ভেজা।
             ট্রেন থেকে নামার সময় সুলেখা হাত দুটো ধরে ধরা গলায় বলে উঠল , " ভাল থেকো অরুণদা "।
               কোকিলের ডাকটা ট্রেন চলার শব্দে ধীরে ধীরে  মিলিয়ে গেল।



সুস্মিতা পালের আঁকা ছবি(শ্রেনী - সপ্তম)