PravatiPatrika

Thursday, May 28, 2020

উপন্যাস,ভ্রমন,ব্যাক্তিগত গদ্য ও কবিতা

            প্রশান্ত ভৌমিক-এর ধারাবাহিক উপন্যাস

                      ‘পাখির ডানার উড়ান

                               পর্ব এক

মদন স্যার কাল বলে গেছে আজ পড়া না পারলে পাঁচশ বার কান ধরে ওঠা-বসা করাবেন। গতকাল একটা উপপাদ্য লিখতে দিয়েছিলেন। তাতে সব মিলিয়ে চারটে কাটাকাটি হয়েছিল। আর সে কারণে চারশ বার কান ধরার শাস্তি দিলেন। আমার ভালো লাগে না এভাবে। বাবাকে যে বলব তাও সুযোগ পাচ্ছিনা। মদন স্যার আমাদের গ্রামের বাড়ির প্রতিবেশী। আর তাছাড়া ভালো শিক্ষক হিসেবেও এলাকায় খুব নাম ডাক। আমার কাকাতো ভাই অর্ণবও মদন স্যারের কাছে পড়ে। অর্ণব সব পরীক্ষায় প্রথম হয়। সবগুলো বৃত্তি পরীক্ষায় ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পায়। তাইতো অর্ণব মদন স্যারের খুব প্রিয় ছাত্র। এই যা! আমি তো আমার পরিচয়ই দিইনি। আমার নাম? নামটা না হয় না বলি। নাম দিয়ে কী হবে? আমি বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে। অবশ্যি আমার বড় দু’টি দিদি আছে। বাবা-মা ও দিদিরা আমায় খুব আদর করত। হয়তো এখনও করে। কিন্তু এখন আর তাদের কাছ থেকে আদর নেবার কিংবা আবদার করার কোনো সময় আমার নেই। আমাকে থাকতে হয় মদন স্যারের ভয়ে তটস্থ। বাসার সবাই যখন টিভি দেখে, তখন আমাকে বসে বসে পীথাগোরাসের উপপাদ্য পড়তে হয়। পীথাগোরাসের উপপাদ্য পড়তে পড়তে যত অভিশাপ আমি তাঁকে দিয়েছি, কে জানে পীথাগোরাস হয়তো কবরের মধ্যে পাশ ফিরে শুয়েছে। তাও কিছুতেই উপপাদ্যকে বাগে আনতে পারছি না।
আমরা গ্রামে থাকতাম। হাজিপুর বলে একটা গ্রামে। বাড়ির ঠিক সামনেই একটা খাল ছিলো। বর্ষাকালে খাল দিয়ে কত নৌকো চলতো। আমাদের দোকান চৌমুহনী বাজারে। বর্ষার দিনে বাড়ি থেকে চৌমুহনীতে যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম ছিলো নৌকো। ছোটবেলায় শুনতাম নজির মাঝি বলে একজন মাঝি ছিল, যে আমার বাবাকে প্রতিদিন নৌকোয় করে বাড়ি থেকে বাজারে নিয়ে যেত। আবার সন্ধ্যা পেরোলে বাজার থেকে বাড়ি ফিরিয়ে আনত। সে অবশ্য বেশ আগের কথা। বছর পাঁচ-সাত হলো নজির মাঝি মারা গেছে। আমার বাবাকে এরপর আনা-নেয়া করতো সাহাবুদ্দিন মাঝি। সাহাবুদ্দিনের বাড়ি ছিল আমাদের বাড়ির ঠিক পাশেই। আমার খুব ভয় লাগত বাবা যখন নৌকো করে রওনা দিতেন। আমার কেবলই মনে হত, নৌকো যদি ডুবে যায়। বাবা কি পারবেন সাঁতরে পাড়ে উঠতে? সারাদিন আমার খুব উৎকণ্ঠায় কাটত। রাত্রে যখন বাবা বাড়ি ফিরে আসতেন তখন আমি নিশ্চিন্ত হতাম। বাবাকে খুব ভালোবাসি তো তাই। সবাই মাকে বেশি ভালোবাসে। কিন্তু আমি মায়ের থেকেও বাবাকে বেশি ভালোবাসি। এর কারণ, বাবা কখনো মারতেন না কিংবা শাসন করতেন না আমায়। যত দুষ্টামিই করতাম, বলতেন- “এখন নয়। বার্ষিক পরীক্ষাটা যাক। তারপর খেলা দেখাব।”
সেই খেলা আমাকে কোনোদিনই দেখতে হয়নি। বরং সেভেন থেকে এইটে ওঠার পর বাবার সাথে আরো বেশিক্ষণ থাকার সুযোগ পেলাম। কারণ ততদিনে আমি চৌমুহনীর সবচেয়ে নামকরা স্কুলে ভর্তি হয়েছি। স্কুলে যাতায়াত করতাম বাবার সাথেই। সকালবেলা ‘জাম্বুরা’র রিক্সায় করে আমি আর বাবা রওনা হতাম। আসলে রিক্সার ড্রাইভারের নাম ছিলো নূরনবী। কিন্তু গ্রামের কারো বাড়ি থেকে জাম্বুরা চুরি করে খাওয়ার জন্য তার নাম হয়ে যায় জাম্বুরা। গ্রামের দিকে এসব স্বাভাবিক ঘটনা। আমার বাবা অবশ্য জাম্বুরাকে সম্মান করে ‘জাম সাহেব’ ডাকতেন। বোকা রিক্সার ড্রাইভার তাতেই অনেক খুশি। চার-পাঁচ মাস রিক্সায় যাতায়াত করার পর বর্ষা এলো। রিক্সায় যেতে আমার অবশ্য খারাপ লাগত না। বেশ আরামে বসে থাকা যেত। বাবা সারাক্ষণই আমার সাথে গল্প করতেন। স্কুলের গল্প। ক্লাসে পড়া পারছি কিনা। কোন স্যার কী পড়ান এসব।
এক সময় বর্ষা এলো। স্বাভাবিক নিয়মেই রাস্তার কোথাও হাঁটু জল। কোথাও কোথাও জলের উচ্চতা কোমরও ছাড়িয়ে গেলো। তাই এবার যাতায়াতে নৌকো ভরসা। আমি সাঁতার জানি না বলে নৌকোয় উঠতে চাইতাম না। বাবা অভয় দিতেন। আমি তাও নৌকোয় চড়ার ভয়ে একদিন স্কুলে গেলে তিনদিন কামাই করতাম। পরীক্ষার ফল খারাপ হলো। তাই বাবা-মা চিন্তা করলেন চৌমুহনী বাসা ভাড়া করে থাকবেন। আমি খুব খুশি হলাম। আজীবন গ্রামে থাকা আমার কাছে চৌমুহনীকে তখন মারাত্মক ব্যাপার মনে হত। সেখানে সারাদিন গাড়ি চলে, বইয়ের দোকান আছে, ফাস্টফুড পাওয়া যায়। মানে সব মিলিয়ে হুলুস্থুল ব্যাপার। চৌমুহনী এসে আমরা প্রথমে উঠলাম আমাদের সেজো পিশির বাসায়। আমরা পিশি বলতাম। অথচ আমার অধিকাংশ বন্ধুই তাদের বাবার বোনকে ফুফু বলত। আমি তখন পার্থক্যটা বুঝতাম না।
পিশির বর কিছু করত না। পিশির দু’টো ছেলে ছিলো যারা একটা দোকান চালাত। সেই পিশির বাসায় এসে বেশ কিছুদিন ছিলাম। এভাবে ক্লাস এইটের বছর কাটল। প্রমোশন পেয়ে উঠলাম নাইনে। অংক ভালো লাগে খুব। তাই সায়েন্সে ভর্তি হলাম। যখন বাড়িতে ছিলাম মদন স্যারের কাছে পড়তে যেতাম সন্ধ্যায়। চৌমুহনী আসার পর সেই পড়াটা অনিয়মিত হয়ে যায়।
নাইনে ওঠার পর বাবা মদন স্যারকে আমার প্রাইভেট টিচার হিসেবে নিযুক্ত করলেন। মদন স্যার সপ্তাহে দুইদিন আমাকে অংক শেখাতে আসবেন। আমরা নতুন বাসাতেও উঠলাম। মদন স্যার বিকেলে আসতেন। কিন্তু কোন দুইদিন আসবেন সেটা আগে থেকে বলে দিতেন না। ফলে আমার বিকেলটা হয়ে যেত বন্দি। আমি ক্রিকেট খেলতে যেতে পারতাম না। যদি কোনোদিন খেলতে যেতাম আর সেদিন মদন স্যার পড়াতে আসতেন তবে ব্যাপারটা দুঃখের হতো। মা কিংবা বাবা আমাকে ডেকে আনার জন্য যেতেন। আর ফেরার পথে বকতে বকতে নিয়ে আসতেন। তারপর বাসায় ফেরার পর মদন স্যারের সেই কান ধরার শাস্তি তো ছিলোই। বিরক্ত হয়ে একসময় খেলাধুলাই বন্ধ করে দিলাম। খেলার মাঠ এড়িয়ে চলতে গিয়ে বইয়ের জগতে ঢুকলাম।
স্যারের অত্যাচার দিন দিন বাড়তেই লাগলো। অত্যাচার মাত্রা ছাড়ালো প্রথম সাময়িক পরীক্ষার পরে। পরীক্ষার রেজাল্ট দেয়ার পরে দেখা গেলো আমি অংকে ফেল করেছি। কিন্তু উচ্চতর গণিতে ক্লাসের হাইয়েস্ট নাম্বার আমার। স্কুলের স্যারেরাও অবাক হলেন। যে ছেলে সাধারণ গণিতে ফেল করে, সে উচ্চতর গণিতে সর্বোচ্চ নাম্বার পায় কীভাবে? ক্লাস টিচার মোজাম্মেল স্যার বাবাকে ডেকে ব্যাপারটা বললেন। বাবা বাড়ি ফিরে এসে মদন স্যারকে কথাটা জানালেন। মদন স্যার বললেন, আমি নিশ্চয়ই উচ্চতর গণিতে নকল করেছি। কিংবা কারো থেকে দেখে দেখে লিখেছি। আমি স্যারকে কিছু না বলে পরে বাবাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম। মদন স্যারের পড়ানো আমি কিছুই বুঝতাম না। আর স্কুলের স্যারের করানো অংকের ধরণ আর স্যারের অংকের ধরণ অনেকটাই আলাদা ছিল। ফলে আমি বরাবরই ভুল করতাম। বিপরীতে উচ্চতর গণিতের ক্ষেত্রে স্কুলের শফিক স্যারের ক্লাস ফলো করেছি নিয়মিত। আর নিজেও চেষ্টা করেছি। তাই সেখানে সমস্যা হয়নি। বাবা বুঝতে চাইলেন না। এইটে পড়া আমার কাকাতো ভাই অর্ণবের প্রসঙ্গ টেনে আনলেন। বললেন- ওকেও তো মদন স্যারই পড়ান। যদি ও সব বুঝতে পারে, তাহলে আমি কেন নই? বাবাকে একটা উত্তর বলতে চেয়েও পারলাম না। ছোটবেলা থেকে অর্ণবের জন্য টিচার লাগিয়ে ওর ভিতটাকে শক্ত করে তোলা হয়েছে। আর উল্টোদিকে আমার ছোটবেলা সম্পূর্ণ অন্য রকম। গ্রামের অবহেলিত স্কুলে পড়েছি। যেখানে অন্য ছাত্ররা ক্লাস গোণাটাকেই মূল কাজ মনে করে, সেখানে আমি বরাবর প্রথম হয়েছি। বার্ষিক পরীক্ষার রেজাল্ট কার্ডে অধিকাংশ সময় দেখা যেত, আমি প্রথম। আর বাকিরা অকৃতকার্য। এই স্কুলে পড়েও যে পড়াশুনো চালিয়ে গেছি সেটাও কম নয় আমার কাছে। কারণ আমি এখন নাইনে পড়ি। কিন্তু আমার সাথে স্কুল জীবন শুরু করা অধিকাংশ ছাত্রই জীবন যুদ্ধে নেমে পড়েছে। সেদিন থেকে আমার এই রেজাল্ট খুব খারাপ কি?




ভ্রমণ কাহিনী: " বাঁকুড়া ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের কিছু বিখ্যাত স্থান ভ্রমণ "
                               টুম্পা মুখার্জী
 
প্রাক্ কথন

পুজোর ছুটি পড়ার পর থেকেই মনখারাপ।মন খারাপকে সঙ্গে নিয়েই বাড়ির দুর্গা পূজা আর লক্ষ্মী পূজা কাটালাম।কিন্তু এবার ঘ‍্যানঘ‍্যান করে ছানার বাবাকে অতীষ্ঠ করে তুললাম।আর তাতে ইন্ধন জোগালো ফেবুতে বন্ধু বান্ধবী কলিগদের বেড়াতে যাওয়ার পোস্ট। শেষে তিনি তিতিবিরক্ত হয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন ৩/৪ দিনের জন্য কাছে পিঠে কোথাও ঘুরে আসবেন। কিন্তু কোথায় যাব, কোথায় যাবো ভাবতে ভাবতে শেষে হঠাৎ করেই সুযোগ এসে গেল।আমাদের কিছু কাছের মানুষের বাড়ি বাঁকুড়ার ওন্দাতে। সিদ্ধান্ত নিলাম ওখানেই ঘাঁটি গাড়ব আর তার চারপাশে চরকি পাঁক খাবো।কিন্তু ছানার বাবা নিজের গাড়ি ছাড়া চলবে না, আর আমি বাস ছাড়া নড়ব না।শেষে প্রচণ্ড গৃহ সংগ্ৰামের পর জয়ী হলেন তিনি।

                             প্রথম দিন

               ২৭ অক্টোবর সকাল ৬:২৫ এ আমরা যাত্রা শুরু করলাম।আমাদের সাথী হল আমার অগ্ৰজ এবং তার স্ত্রী পুত্র। আমার অগ্ৰজ এবং ছানার বাবা দুজনেই অনভিজ্ঞ ড্রাইভার--এটাই তাদের প্রথম লংড্রাইভ। বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে হুমকি দিয়েছিলাম, গাড়ির গতি ৪০/৫০ এর বেশি উঠলেই ওখানে নেমে যাব আমি।যাইহোক ঠাকুরের ফুল বেলপাতা সঙ্গে নিয়ে, আর রাস্তার প্রতিটি মন্দির মসজিদ গীর্জায় প্রনাম করতে করতে দুরুদুরু বুকে চলতে লাগলাম।
আরামবাগ পেরিয়ে কামার পুকুর পৌঁছাতে পৌঁছাতে ১১:০০ বেজে গেল। একটি মাঠের মধ্যে গাড়ি পার্ক করে মূল মন্দিরে পৌঁছাতে ১১:২৫ বেজে গেল। এদিকে মন্দিরের গেট ১১:৩০তে বন্ধ হয়ে যায়। কোনো রকমে জুতো খুলে মন্দির চত্বরে ঢুকে পরলাম। সেখানে ভক্তদের খুব ভীড়। ঠাকুরের দর্শন পেতে পায়ের আঙ্গুলের উপর দাঁড়িয়ে ঘাড় টাকে এমন লম্বা করলাম যে দেখে বুঝি জিরাফও লজ্জা পেয়ে যাবে। ও হরি, মূল মন্দিরের পাশেই তো একটা বড় জানালা না দরজা যেন আছে। তাই দিয়েই দিব‍্যি ঠাকুরের দর্শন পেলাম। মন্দিরের বারান্দায় মাথা ঠেকিয়ে ঠাকুরের চরণে প্রণাম জানালাম অনেক ক্ষণ ধরে। আমার ভক্তিতে অতীষ্ঠ সেবিইতরা বললেন যান যান সামনে থেকে প্রণাম করুন, এখানে ভীড় বাড়াবেন না। শেষে নেমে এলুম। একে একে দেখলাম ঠাকুরের বৈঠকখানা, শোবার ঘর, ঠাকুরের দাদার ঘর,  ঠাকুরের বংশের কুলদেবতা। মন্দির থেকে বেড়িয়ে হোটেলে খাওয়ার পর সারথীরা আমাদের রথ নিয়ে আবার ছুট লাগালেন। রাস্তার দুপাশের দৃশ্য দেখে মনটা একটু বিমর্ষ। কারন, বাঁকুড়ার সেই চিরপরিচিত মাটির বাড়ির সংখ্যা প্রচণ্ড ভাবে কমে গেছে, সেখানে জায়গা করেছে কংক্রিটের দেওয়াল। জয়পুরের জঙ্গলের ভিতর দিয়ে হুহু করে গাড়ি ছুটছে। চারিদিকে সবুজের সমারোহ, মাঝে কালো পিচ ঢালা মসৃণ রাস্তা। বাঁ দিকে হঠাৎ বনলতার সঙ্গে দেখা। চুপি চুপি তার কানে কানে বললাম ফেরার পথে তোমার কাছে আসছি। জয়পুর পেরিয়ে বাইপাস ধরে খুব কম সময়ে আমরা ওন্দাতে পৌঁছালাম। সেখানে আত্মীয়র বাড়িতে ভরপেট খেয়ে রাতের দিকে পাড়ি দিলাম আমাদের হোমস্টে টোল গ্ৰামে। মেনরোড থেকে বাঁ দিকে গ্ৰামে ঢোকার মুখে আগে ছিল বাসস্ট্যান্ড আর ছোট্ট একটা পানবিড়ির গুমটি। এখন সেখানে বেশ কয়েকটি পাকা বড় বড় দোকান ঘর চোখে পড়ল। আর এখানেই ছিল রাস্তার দু পাশে শ্মশান, কিন্তু সেটাও দেখলাম না। তবে রাস্তা সেই একই রকম আছে। লাল মোরামের সরু রাস্তা।দুপাশে গুল্মজাতীয় গাছের ঝোপঝাড়। এরপর চন্দ্রকোনা গ্ৰামে ঢুকল গাড়ি। এটি বহু পুরাতন বর্ধিষ্ণু গ্ৰাম। শিব মন্দির, নাটমঞ্চ পুরাতন ঐতিহ্যর সাক্ষী বহন করছে। এরপর বাঁক নিয়ে পানের বরজকে ডানদিকে রেখে ঘন অন্ধকারের বুক চিরে আমাদের হুন্ডাই আই টেন অত‍্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে এগোতে লাগল, একটু এদিক ওদিক হলেই গাড়ি সোজা পাশের জমিতে গিয়ে পড়বে। শেষ পর্যন্ত আমরা নির্বিঘ্নে আমাদের পরিচিত সেই মাটির  দোতলা বাড়িতে পৌঁছলাম। রাতে দারুণ টেস্টি চিকেন সহযোগে আহার সেরে আমরা ছ'জনে একটা ঘরে আস্তানা গাড়লাম। শোয়ার আগে প্ল্যান করা হল কাল সকালে শুশুনিয়া পাহাড়ের উদ্দেশ‍্যে রওনা দেব। সকলকে গুডনাইট জানিয়ে বিছানায় লম্বমান হলাম।




                         ধারাবাহিক গদ্য  

            
                     নদী কথায় ভেসে যায়  .....
                         তীর্থঙ্কর সুমিত

                                 ( ১)

কত জমানো কথা ভেসে যায় নদী বুকে।কেউ খবর রাখেনা।কোনো গল্পের শেষ হয়না। শেষ হয় কথার।ওখানেই শুরু হয় নতুন গল্পের।নতুন থেকে চিরনতুন হতে হতে আটকে যায় চোখ।সেই চোখ থেকে সৃষ্টি হয় এক একটা গঙ্গা,এক একটা পদ্মা।ভালো থাকার লড়াইয়ে জলের স্রোতে ভেসে যায় অব্যাক্ত কত কথার যন্ত্রণা।হয়তো এভাবেই সৃষ্টি হয় কয়েকটা কথা, কয়েকটা চিহ্ন আর এক একটা মরুভূমি...
                                       



                                  (২)


প্রতিটা দিন কেটে যায় রাতের আঁধার বুকে নিয়ে।কবিরা জন্ম দেয় হাজারো কবিতার।সময়ের সাথে সাথে সময়কে বুকে নিয়ে ফিরে আসে ঢেউ।আজকের প্রশ্ন আগামী কাল পুরনো।নতুন থেকে চিরোনতুনের সন্ধানে আমরা সকলে । কখন যেনো একের পিঠে বহু শূন্য নিয়ে ওজন বাড়াই ।নিজের অচিরেই ফাঁকা হতে হতে কখনো আবার নদীর সাথে মিশে যাই ।গঙ্গা ,পদ্মার বুকে লিখে রাখা এক একটা যন্ত্রণা কত নষ্টা মেয়েকে সতীত্ব দিয়েছে।আর আমি নতুন হতে হতে কখন যেনো ঢেউ এর সন্ধান পেয়েছি ...



                                  মৃত্যু
                              রুকসানা

এই জীবনরথ চলতে চলতে কোনো একদিন
প্রকৃতির নিয়মে হঠাৎ করে থেমে যাবে,
সমাজের বুক থেকে কমে যাবে একটি বোঝা,
চিরতরে বিলিন হবে একটি মূল্যহীন অস্তিত্ব।
রঙীন এই পৃথিবী থেকে সবারই নিতে হয় বিদায়,
অমর তো কেউ কখনো হয় না।
তবু যেন রবি ঠাকুর, সুভাষ, নজরুল, টেরেসা
সবাই আজও মানুষের হৃদয়ের মধ্যে জীবন্ত।
এই মৃত্যু যে মৃত্যু নয়, এ তো অমরত্বের নিদর্শন।
এদের মৃত্যুর মধ্যে খুঁজে দেখো মৃত্যুর প্রকৃত অর্থ।
দেরিতে হলেও বুঝবে সেদিন কঠিন সত্য কে,
তোমার আমার মৃত্যু যে শুধুই ছলনা।
আমাদের মৃত্যু যে আসলে মৃত্যু নয়,
এ হল জীবনের কাছে নিজের পরম হার।



                           তোমার শহর  
                        ফিরদৌসী বেগম


কোন এক ভোরে ,
তোমার শহর ইচ্ছের  পিছু ছুটে স্বপ্নেরা  ভীর জমাবে  !
বিকেলের পড়ন্ত বেলায়  ,
কফি হাউসের গল্পটা  বেশ জমে উঠবে !
ব‍্যস্ততার মোর থেকে  একটু একটু চাপা হাসি  কানে বাজবে।
তুমি  আমি স্বপ্নের ঘোরে ডুবে গেছি  !
কত জমানো গল্প
ডায়েরির পাতায়  ,
আবার নতুন কবিতা জুড়ে লেখা হবে  !
ওই নীল আকাশের গভীরে ,
সময়ের  ঘুনসুটি ,
মেঘে মেঘে মিশে যাবে !
তোমার শহরের
রাতের  তারাদের ভীরে ,
নতুন একটা প্রেম নিয়ে ,
আবার গল্প জমবে।




                স্বপ্ন গুলো ভেসে বেড়ায় 
                     সুশোভন আদক


           স্বপ্ন গুলো ভেসে বেড়ায়,
              আধো ঘুমের ঘোরে;
   চেয়ে দেখি এ পৃথিবীর স্তব্ধতার ছবি।
 রেশন দ্রব্য মেলে না রেশন দোকানে,
    বাজারে মেলে না কোনো পণ্যদ্রব্য,
     নোঙর খানায় নোটিস ঝোলে,
         সরকারি অনুদান সব বন্ধ । ।

     পণ্যের  দাবিতে পথে নেমেছে ওরা;
     হাতে -পিঠে -গলায় নিয়ে পোস্টার,
      মাইক্রোফনে গলা ছেড়ে বলে—
   সরকার তোমায় ধিক্কার  ! সরকার ধিক্কার  !
     
   স্বপ্ন গুলো ভেসে বেড়ায় ঘুমের ঘোরে,
        চেয়ে দেখি মৃত্যুমিছিলের লাইন;
     সার বেঁধে পড়ে আছে রাস্তার ধারে,
           সাদা কাপড়ের মোড়কে,
     পায়েত ঝোলানো সংখ্যার এক দুই রাশি।

         স্বপ্ন গুলো ভেসে বেড়ায়
             আধো ঘূমের ঘোরে,
     চেয়ে দেখি রক্ত চোষা মানুষের দল;
        বেরিয়েছে পথের গলিতে,
         খাওয়ারের লোভে
          পেতেছে নোঙর খানা,
          নারীদেহ পাওয়ার আশায় ।




                              অনুভূতি
                         অঞ্জনা দেবরায়


অসহিষ্ণু অন্ধকার সময়ে চেয়ে আছি
হৃদপিণ্ডটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে আছে,
দুর্বোধ্য শব্দ প্রয়াসের মধ্যে অবিশ্বাসের গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে,
শরীরের ধমনী ও শিরায় বিষ রক্ত ছড়িয়ে গেছে ,
বেদনা জর্জরিত হৃদয় অবিরাম আঘাত হানছে বিশ্বাসের দেওয়ালে ।
বর্ণভেদ, জাতিভেদ কত সমস্যার কালো ধোঁয়ায় ঢেকেছে সমাজে আলো
দরজায় দরজায় দাঁড়িয়ে আছে অশুভ আত্মারা।
কোকিলের মধুর কন্ঠের গান আর ভেসে আসে না,
এ এক কঠিন ইতিহাস সামনে আসছে।
তবুও আমাদের হেঁটে যেতে হবে,
অসহায় মুখে আমরা তাকিয়ে থাকি
সেই নবজাগরণের দিকে।




         দুর্ভিক্ষের আঁশটে গন্ধ 
                       রিঞ্জক


তাড়া করছে মন্বন্তরের ইতিহাস-স্মৃতি
অভিশপ্ত পঞ্চাশ।
বিশ্বব্যাপী মহারণের তৎপরতা
আর্থিক মন্দা,মহামারী,
মুনাফালোভী সাম্রাজ্যবাদ,
প্রকৃতির প্রলয়-নৃত্য হুবহু তেতাল্লিশ।
বিশের বিষে বিষাক্ত।
বিদেশি শত্রুর হানা পঙ্গপালিক
অনাহারের ভ্রুকুটি।
দলগত আত্মহত্যা কূপে
বাঁকা শিরদাঁড়া ক্রমশ বঙ্কিম।
না-দেখার দৃশ্যমানতা চোখে
না-শোনার বধিরতা কর্ণের ভার
ওদের আর্তি-হাহাকার
বিকলাঙ্গিক 'আমি'
তখনও নাসারন্ধ্রের সরণিতে
দুর্ভিক্ষের আঁশটে গন্ধ পাই।
               


সামাজিক দেবতার গর্বাখ্যান
  রহমতুল্লাহ লিখন


আমরা কিন্তু দেবতা তুল্য জ্ঞানী।
আমরাই মাথা আর জাতির ছাতা
সমাজে আমরাই ভাবা প্রধান প্রাণী,
যা কিছু মহান সত্য আমরাই শুধু জানি।

তোমরা দেখ সাদা কালো দিয়ে
আমরা দেখি দৈব বরের আলগা চোখে,
তোমরা বাঁচ ভাত পাতে নিয়ে
আমরা বাঁচি বুদ্ধির সুখে।

তোমরা যখন চাবুকে ঝাঝরা
আমদের কাছে তা উন্নয়ন,
তোমরা যখন সুখের পায়রা
আমাদের মাথায় উজাড় বন।

তোমরা যখন তাড়নায় শহরমুখী
আমরা বলি এসবই তো যানজট,
ক্ষুধায় ছবলে তোমরা মরনমুখী
আমরা বলি মুখেই শুধু,
ঘৃণ্য সব, বিরুদ্ধে হোক ধর্মঘট।

আমরা সদা মুখ বুজে থাকি
যতক্ষণ না পাই স্বীয় আঘাত,
কলমের খাপে ঋণ ভরে রাখি
পদলেহনে  যদি ফোটে নাম যশ
তিন বেলার নিয়মে চাটতে নেই ব্যাঘাত।

জীবিকা মোদের  বুদ্ধি দিয়ে
যুক্তি সংলাপে উদরপূর্তি,
স্বভোজি জন্মে স্বভাবে  পরজীবি
জাতির ত্রাণকর্তা আমরা বুদ্ধিজীবি।



              বৈশাখী
           মহীতোষ গায়েন

নীল দিগন্তে দীপ্ত মেঘের ডানায়
ভাসে কষ্টকল্পিত জীবনের অভিপ্রেত,
অঙ্কের হিসেব মেলাতে মেলাতে
সুপ্ত আকাঙ্ক্ষায় আসে অশনিসংকেত।

নিদারুণ গুমোটে দিশেহারা চরাচর
উজান-ভাটির টানে স্বপ্ন চুরি যায়,
গ্রীষ্মের দাবদাহ ম্লান, উৎস-মানুষের
বাউল সুর পল্লবিত মাত্রা পায়।

সলজ্জ আম্রকুঞ্জে বৈশাখী বাতাসে
উদ্ভ্রান্ত হিমেল শিহরন জাগে,
বৃষ্টি-মেঘের আলিঙ্গনে উদাসী মন
সিক্ত হয় ইমন কল‍্যাণ রাগে।

সযত্নে রক্ষিত যৌবনের জলতরঙ্গে
সমর্পিত বর্ষালিপির ধারাপাত,
সংগ্রামক্লান্ত অতন্দ্র সৈনিকেরা
বিশ্রাম চায়,প্রত‍্য‍য়ী বৈশাখী রাত।

ভ্রমান্ধ সময়ে বিদ্ধ কোমলগান্ধার
মুক্তির আনন্দের প্রতীক্ষায় থাকে,
সৃষ্টি দিনে উৎকলিকা বৈশাখী
নীলিমার নীলে সোনালি ভবিষ্যৎ আঁকে।


              অপেক্ষা
   গোবিন্দ কুমার সরকার

অমিত প্রত‍্যাশার প্রহরগুলো, আজ
আগন্তুকের প্রতিক্ষায় অপেক্ষমান,
নির্মল সমীরণ প্রতিক্ষার অবসানের বার্তা বহন করে না,
বসন্তের কোকিল বিরহের সূর তোলে,
শুধু প্রেয়শীর বুকে জেগে থাকে,
একটু আশার প্রদীপ কিরণ।

অপেক্ষার মূল‍্য জানে কোকিল,
সারাটি বছর সূরের সাধনা ,
গান তোলে কিন্তু সূর ওঠেনা স্বরে,
অপেক্ষার অবসান সূরেলা বসন্তে।

অপেক্ষার মূল‍্য আছে বিরহীর কাছে,
প্রতি পলে, প্রতি নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে,
প্রিয়র আহ্বানে, যাঁর হৃদয়ে বিরহ সূর বাজে,
কত বসন্ত পরে প্রিয় এসেছে পাশে।
আজ আনন্দ লহর উথলিছে হৃদে,
আঁচলে ঢাকি লাজুক হাসি মুখ,
এসেছে প্রানসখা,প্রতীক্ষা টুটে।

অপেক্ষার মূল‍্য আছে প্রতিক্ষীত মায়ের,
যে চোঁখ দুটোর দৃশ‍্যমানতা ক্ষীণ,
অপত‍্যের মুখ চিনে শুধু হাতের স্পর্শে,
অপত‍্য আসার পথ ভিজে যাঁর চোঁখের জলে।

অপেক্ষার মূল‍্য আছে সেই প্রতিক্ষীত বন্ধুর,
সঞ্চিত কত কথা রেখেছে সাজিয়ে,
কতদিন পরে আসবে বন্ধু মোর,
দু,দন্ড শান্তি পাবো প্রান খুলে,
অবসান শত প্রতিক্ষার,আজি এ প্রাণে।



                      দৃষ্টিকোণ
                 সৌমেন সরকার

একা একা শুয়ে আছি খাটে,বালিশে
মাথাটি দিয়েছি এলিয়ে;ভাবছি তোমায়,
তোমার কথা,আর দেখছি বৃষ্টির প্রতিটা বিন্দু।
বারিধারার প্রতিটা কুঁচিতে খুঁজছি তোমাকে!
আঙুল দিয়ে ভাঙছি,গড়ছি;তবুও অসমর্থ;
তোমায় তন্নতন্ন করে খুঁজেও পাচ্ছিনা সাড়া।
ডান হাত বাড়িয়ে খুঁজছি তোমার ঠোঁট,আর
বাম হাতে এলোমেলো ভিজে চুল।নাকে পাচ্ছি
তোমার উষ্ণ গন্ধ!আর কান্না যত নালিশে!

কল্পনা করছি তোমার আজানুলম্বিত কেশবাহার!
হৃদয় দগ্ধ হয়ে গেল;চাই আলো,চাই বাতাস,
একটু বাঁচতে চাই,আর তোমার কথা চাই ভাবতে।
এলোমেলো চিন্তাগুলো শুধু করে বেড়াই তাড়া;
একটু দাঁড়াই,একটু বাঁচি,আর নিই প্রাণভরা নিঃশ্বাস!




                     অন্য সুখ
                   অমিত দত্ত

আশা আর প্রাপ্তির মাঝে যে টুকু ফাঁক থাকে
         তুই ভরিয়েছিলিস তা একটি লাল গোলাপ দিয়ে।
ঠোঁট আর কাপের মাঝে যে টুকু ফাঁক থাকে
          আমি দেখিনি তা তোর চোখে চোখ রেখে।
নাভি আর যোনির মাঝে যেটুকু পেরুতে হয়
       পেরুতে পেরুতেও থেমেছি আমি আগামীর কথা ভেবে।
যে মাতাল প্রতি রাতে তোর গান গেয়ে ফেরে
সেই তোকেই আমি পেয়েছি কত নিজের মতো করে।
ঝিমঝিম যে দুপুরে আমার কিছুই লাগে না ভালো
কোথা থেকে দিন কেটে যায় মুছে যায় যত আলো,
গড়িমসি বিছানায় আমি অলস পড়ে থাকি
হঠাৎ তুই এসে বলিস পথ যে অনেক বাকি;
এই পথের দুটি মোড়ের মাঝে থামতে গিয়েও থামিনি,
        থামা মাঝে মাঝে পাপের পথে নিয়ে চলে।
পাপ আর পুণ্যের মাঝে যে হাইফেনটুকু থাকে
অনেক সন্ধ্যে কেটেছে  সেখানে নামিনি আমরা পাঁকে
তুই ঈশ্বরে দেখাস কাঁচকলা আমি শয়তানে ভ্যাঙাই মুখ,
আমরা ভাসি নিজের স্রোতে এ যে অন্যরকম সুখ।

No comments:

Post a Comment