ভাত
রিকি ঘোষ
ওরা যে গরীব ভীষণ
ভাতের খোঁজ চারিদিকে আজ,
পঞ্চপদ আর জোটে না কপালে
একমুঠো ভাতেই আনন্দের সাজ।
দুঃখ তবুও যায় না চলে
বেঁধে আছে গাট ঘরের কোণে,
সামান্য একটু ভাতের জন্যে
হাসি ফুটিয়েছে তারা দুঃখের মনে।
ওরা যে গরীব ভীষণ
দিতে চায় সুখের দেশে পাড়ি,
তবুও দুঃখ, অভাব করেছে তাড়া
চড়েনা হেন সুখের হাড়ি।
প্রভাবশালীর প্রভাব আজ
কেরেছে গরীবের মুখের ভাত,
দেখছে সমাজ বেজায় হাস্যে
বাড়ায়নি কেহ সাহায্যের হাত।
আঁধার যে করেছে গ্রাস
সুখ ও হাসির চলন্ত রথ,
চোখের ওই নোনা জলের তরেও
পেয়েও পেলনা ভাতের পথ।
বলছে সকলে, "হে ঈশ্বর;
আমরা বড়োই অসহায়",
কি করিলে পাব বলো
ভাতের সন্ধান হেন আশায়।
হবে একদিন ঠিকই তাদের
সমস্ত দুঃখের সর্বশেষ,
প্রভাবশালী দেখবে সেদিন
কাটাবে বসে ভ্রান্তির রেশ।
অশরীরী ঈশ্বরী
রুপম
কাল রাতে আমি এক স্বপ্ন দেখেছি
স্বপ্নে শুনেছি তোমার নূপুরের ছম ছম ।
তুমি ঈশ্বরের বেদী হতে নেমে ধেয়ে আসছো মানব সভ্যতার তীরে ,
তোমার হাতে ছিল অমরত্বের সুধা পূর্ণ মঙ্গল ঘট ,
তোমার গায়ে ছিল সূর্য সম আভা ,
কেমন যেনো সে ঈশ্বর হতে মানসী হচ্ছিল মনের দেওয়াল ঘড়িতে ,
যেমন করে রূপকথার নায়ক থাকে ছোট্ট বাচ্চার চোখের ঠুলিতে ।
আমি কাল রাতে এক স্বপ্ন দেখেছি
স্বপ্নে আমি ঈশ্বর পেয়েছি যেমন করে সাধক পায় আরাধ্যাকে ,
আমি ছুয়ে দেখেছি তোমার হাতের রেখা গুলো
যেমন করে ছুয়ে থাকে ছোট্ট শিশু আবিষ্কারের নেশাতে।
আমি কাল রাতে এক স্বপ্নে বেঁচেছি মরেছি ,
জীবনচক্র পূরণ করেছি এক রাতে
আমরা কাল রাতে ছিলাম তারকাটা ফেলা একই বিছানাতে ।
আমি সকালের আলোয় এক ছায়া দেখেছি ,
আমার ক্ষত বিক্ষত কায়া দেখেছি মন আয়নার প্রতিবিম্বে ।
আমি একযুগ বেঁচে মরেছি কাল রাতে ,
উরে বেড়িয়েছি কাল রাতে
যেমন করে পিপীলিকা ওরে পাখা গজানোর সুখে
মৃত্যু ক্ষণ ভুলে ।
বিচ্ছেদ
শিবপ্রসাদ গরাই
বিচ্ছেদ তো হয়েই গেছে অনেকদিন
এখন শুধু স্মৃতি গুলো খুলে খুলে রাখা
মৃতদেহ চিতায় উঠলে, যেমন পরনের বস্ত্র গুলোকে এক এক করে খুলে রাখে ;
তেমনই
নগ্ন শরীরটা যেমন নিমেষেই পুড়ে খাক হয়ে যায় ,
তেমন স্মৃতি-শূন্য হয়েই বাঁচতে চাই আমি।
এরকমভাবে বাঁচা আসলে মরতে চাওয়া ,
একটু একটু করে জলের অতল গভীরে ডুবে যাওয়া।
ডুবতে না চাওয়া বা মরতে না চাওয়া যেখানে অর্থহীন ।
স্মৃতিমেদুরতা মানুষের বাঁচার জন্য ভালো না,
ভুলে যাওয়া বা মনে করতে না চাওয়া
দুটোই তো আর এক নয় ।
প্রতিটা বিচ্ছেদ আসলে এক-একটা মিলন
ওই যে কবিগুরু বলেছেন -
'লিখি দিল বিশ্বনিখিল দু বিঘার পরিবর্তে'
তেমনই আর কি!
শঙ্কা
বিশ্বজিত মুখার্জ্জী
নগরেরপ্রান্তরে,বাজারেরঅন্দরে,ওরা ঘোরে দলেদলে প্রতি পলেপলে,
জানে নাকো কাল,কি হবে হাল,ওদের কপালে?
চোখেমুখে আতঙ্কের ছবি,তবুও বেঁচে থাকার স্বপন,
কার অপেক্ষায় কাদের যেন মন ভীষণ উচাটন।
যদি ধরে ছোঁয়াচে কঠিন জ্বরে,জীবন সঙ্গিন,
হবেই যেতে ঘরের বাহিরে যতই হোক দুর্দিন।
মানেনা কোন বাধা,উপেক্ষিত সরকারি পরোয়ানা,
নাস্তানাবুদ হয়েও,ওরা রাজি দিতে জরিমানা।
গৃহবন্দি মানুষ আজ মনরোগী,মনেতে ভীষন চাপ,
সমাজ রোগেতে তফাৎ গড়েছে,বেড়েছে মনস্তাপ।
তন্দ্রাহীন নিকশকালো রাত্রি,ব্যারিকেডে মৌনি শহর,
ঝড়েরবেগে আসছে ধেয়ে,প্রতিক্ষিত মৃত্যুর লহর।
ক্রমশ গিলোটিন
হীরক বন্দ্যোপাধ্যায়
ছুরির ফলা এগিয়ে আসছে
তিন দুই এক শূন্য...
বিস্ফোরণ, নিরীহ বুর্জোয়া শব্দটির পাশে
এখন আর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই
লড়াই মিছিলের মতো শুধু এক ধূসর পৃথিবী
একে একে ফিরে গেছে অক্ষৌহিনী সেনা
এখন কেউ তার কোনও হিসেব ও রাখেনা
বিমূঢ় বিক্ষোভে কান্নারত শৈশব
ঘন কুয়াশার ভিতর
ডুবে যাচ্ছে গাছের মর্মরধ্বনি
তুমি দেখেও দ্যাখো না
এখন আমাদের সব ই নিয়ন্ত্রিত
সত্য উচ্চারণে সহস্র গিলোটিন নেমে আসে
তুমুল বৃষ্টিপাতের ঘটনা আজ আর মনে পড়ে না
নি:শ্বাসের বায়ু ,উদ্ধারের আঙুল
বৌদ্ধযুগের ভাঙামূর্তির মতো
দমিত,স্বাধীনতাহীন...
বিষয় হারানোর মতো একটি অশেষ ধন্যবাদ ছাড়া এখন আর আমাদের কোনো গত্যন্তর নেই...
কাউকে কি চেনা যায়?
পাখী
হারিকেনের টিমটিমে আলোয় যেদিন প্রথম আমাকে দেখেছিলে বলেছিলে চিনতে পেরেছ...
বকুলের ডালে দোলনায় ঝুলতে ঝুলতে তোমাকে যেদিন দেখেছিলাম
মনে হয়েছিল চিনতে পেরেছি...
তার পর যেখানে যেখানে দেখেছি চিনেছি তোমাকে...
সন্ধ্যার শেষ ম্লান আলো মিলিয়ে যেতে যেতে শেষবারের মতো বলে গেল
সে তোকে ভালোবাসে
আনন্দে পাখি গাইল গান
নেচে উঠল দখিনা বাতাস
শিস দিয়ে উঠল বাঁশপাতারা...
অন্ধকার সরিয়ে সরিয়ে পরম যত্নে দুহাতে তুলে নিলে আমার মুখ জোছনায় চোখ রেখে পাগল হলে মুগ্ধ হলে
ভুলে গেলে স্বপ্ন দেখা...
ফিসফিসিয়ে শুধু একবার বললে
চিনতে পেরেছি
যুগ যুগ ধরে এই দুটি চোখইতো খুঁজছি
যার অতলান্ত গভীরতায় ডুবে থাকা যায় হাজার হাজার বছর...
তার পর কেটে গেছে অনেক আলোকবর্ষ
পুরোনো হয়েছে অনেক কিছু
সারা বসন্ত ঢেকে থাকে এখন বিবর্ণ ঝরা পাতায়...!
মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে মনে
তুমি বা আমি বা আমরা দুজনেই সত্যিই কি চিনতে পেরেছি একে অপরকে...?
সত্যিই কি কাউকে চেনা যায়????
চলো ঘুরে দাঁড়াই
শুভঙ্কর দাস
হারিয়ে যাবো এক দূরদুরান্তের হিমের দেশে
ভোরের শীতল শুভ্র কুয়াশায় ধূসর চিলের ভেসে ভেসে।
শিশির হয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় পড়বো ঝরে মৃতুল ঘাসে,,,
বাঁধবো ঘর, বাঁধবো সোনার সংসার.....এই সবুজ বন ও সবুজ পৃথিবীকে ঘিরে;
দেখবো হাজারো স্বপ্ন, লড়বো দৃঢ়তার সাথে বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে।
আসবে হাজারো প্রতিবন্ধকতা.........
করবো জয় নিজের বাহুবলের জোরে।
রাখবো শত-শত ঈর্ষা ও ক্ষোভকে ভূলুন্ঠিত করে,
বিশ্ববিজেতা আলেকজান্ডারের মতন হেসে-খেলে করবো সমগ্র বিশ্বজয়।
ক্ষোভে ফেটে পড়বে গর্জন, জ্বলে উঠবে পৃথিবী,,,,,,,,
আত্মবিশ্বাসের অগ্নিতে সমগ্র প্রতিবন্ধকতা, হিংসা, গর্জন ভস্মীভূত হবে।
ভালোবাসি
ফিরদৌসী বেগম
প্রকৃতি তোমায় ভালোবাসি
আজও বাসি !
তোমার তীক্ষ্ণ অনুভূতি আজও শরীরে ছোঁয়াই !
তোমার ওঠা নামা আজও আমার রাজ্যেজুড়ে আঁকড়ে ধরে !
যেখানে ভোর হয় মেঘেদের ভীরে ,
তরুণী হাসে পদ্মার দেখা !
শঙ্কচিল উড়ে তৃণ রাশে ,
গঙ্গার দুকূল এপার ওপার সাজে !
প্রকৃতি সবুজ লতা
আজও তোমার রঙ ধরে !
তোমার রাতের রহস্য শত নক্ষত্র রুপ ধরা দেয় জীবন্ত জোৎস্নায় !
আঁধারের দেখা হয় স্বপ্নের ঘোরে !
প্রকৃতি তোমার অস্তবেলা
আজও ফেরায় ঘরের ঠিকানায় !
ভালোবাসি আজও বাসি !
ভালোবাসা
মিত্রা ঘোষ
অনীশ সমস্ত টেষ্ট রিপোর্টগুলো ফাইল বন্দি করে বেড়িয়ে এলো ডাক্তারের চেম্বার থেকে।
পৃথিবীটা যেন দুলতে লাগলো ওর চোখের সামনে,
মনের ভেতর ভেসে যাচ্ছে জীবন স্মৃতির এপিসোডের পর এপিসোড।
বি.কম. ফাইনালের মাঝে বাবার চলে যাওয়া,
প্রথম কর্পোরেট অফিসে চাকরি পাওয়া. মধুমিতার সাথে, প্রেম, বিয়ে, আট বছরের ছেলে অম্বরকে নিয়ে ওর ঘর এখন আলো ঝলমলে, তবে এত গাঢ় অন্ধকার কেন নেমে এল তার জীবনে ?
ক'দিন হল ছোট ছোট ফোসকায় ভরে যাচ্ছে ওর সারা শরীর,
ডাক্তারবাবু রিপোর্ট দেখে বললেন ক্যান্সারের থার্ড স্টেজ।
খবরটা শুনেই মিতা কেমন রুক্ষ হয়ে উঠলো, ক'দিন ধরে ও লক্ষ্য করছে মিতা কেমন বদলে গেছে , অফিস থেকে রোজ অনেক রাত করে বাড়ি ফেরে, সাথে এক ভদ্রলোক থাকেন ।
অনীশ একদিন ওনার পরিচয় জানতে চাওয়াতে মিতা খরখরে গলায় বলেছিল,
" তুমি অসুস্থ হয়ে শুয়ে আছো, শুয়েই থাক না ! এসব জেনে তুমি কি করবে ? "
অনীশ নিশ্চল।
অনীশের ফোস্কাগুলো আরও বেশী করে মাথা, মুখ, সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো , রাতদিন যন্ত্রণায় ছটফট করে সে।
এদিকে মিতার বয় ফ্রেণ্ড রবীনবাবু অনীশের বাড়িতেই থাকেন আজকাল।
মিতার কাছে অনীশ ওনার থাকার কারণ
জানতে চাওয়াতে মিতা হিংস্র বাঘিনীর মতো গর্জন করে রবীন রবীন বলে চেঁচাতে শুরু করলো, রবীনবাবু ঘরে ঢুকতেই মিতা ওকে জড়িয়ে ধরে চুমু দিতে লাগলো পাগলের মতো,ওই অবস্থাতেই অনীশের সামনের বিছানায় বসে ওরা লিপ্ত হল আরও গভীর আলিঙ্গনে।
তখন অনীশের লজ্জায়, অপমানে চেতনা লুপ্ত হয়ে এল।
যখন অনীশের জ্ঞান ফিরলো মাঝরাত পেরিয়ে গেছে, ঘরের ভেতর ঘুটঘুটে অন্ধকার কেউ তার ঘরে আলো জ্বালায়নি।
ওর বালিশের পাশে মোমবাতি আর দেশলাই রাখা থাকে তাই জ্বালিয়ে ও দেখলো রাত আড়াইটে পেরিয়ে গেছে,
ও দেশলাই কাটিগুলো জ্বালিয়ে জ্বালিয়ে বিছানার চারিদিকে ছড়িয়ে দিল , আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে যেতে লাগল ওর খাট বিছানা, তার মাঝে ও।
দান সৌমেন সরকার
একমুঠো ভাতের জন্য মানুষকে কি কি কাজই না করতে হয়!দিনমজুরি,যুদ্ধ,অসামাজিক কাজকর্ম এমনকি নিষিদ্ধপল্লীরও সঙ্গী হতে হয়।আর এসবের মূলে আছে ওই একমুঠো ভাত।
নীহারিকা সেনগুপ্তের বাড়ীর বিশাল অবস্থা!আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে দারুণ পসার জমিয়ে বসেছেন মেমসাহেব।তাঁর স্বামী মারা গেছেন বছর দশেক হল।চার ছেলে-নবীন,শ্রীবাস,বুদ্ধদেব ও ভবেশ।প্রথম দুজন বিবাহিত।নবীনের এক ছেলে রাহুল,মাত্র সাত বছর বয়স।আর শ্রীবাসের একমাত্র কন্যা মণিমালা,মাত্র বছর চারেক বয়স।আদরকরে সবাই ডাকে রাই বলে।এই দুই ভাইই বাবার ব্যবসা সামলাচ্ছে মায়ের সাথে কাঁধে কাঁধ আর হাতে হাত মিলিয়ে।বুদ্ধদেব সবেমাত্র ডাক্তারি পাশ করে প্র্যাকটিস শুরু করেছে দিল্লীতে।নীহারিকা দেবী এখন তার বিয়ের কথা ভাবছেন।আর বাড়ীর সবথেকে আদরের ছোটকর্তা ভবেশ কলেজে পড়ে।ইচ্ছা আচ্ছে অঙ্কের প্রফেসর হবেন।তবে তিনি সাহিত্যিক আর একটু ভবঘুরে প্রকৃতির।সবমিলিয়ে বেশ হাসিখুশী-জমজমাট পরিবার নীহারিকা দেবীর।
একান্নবর্তী এমন পরিবার খুঁজে পাওয়া দুষ্কর,যেখানে বড় বৌমা শিউলি ঠিক যেন লক্ষ্মী আর মেজ বৌমা প্রিয়াঙ্কা যেন স্বয়ং সরস্বতী।
তাদের বাড়ীতে কাজ করে কালু আর তার বড় মেয়ে পুঁটি।ছোট মেয়ে ডলি সবে ক্লাস টু-তে উঠেছে।বাবা আর বড় মেয়ে সেনগুপ্ত বাড়ীতে কাজ করে সংসার ও ছোট মেয়ে ডলির লেখাপড়া চালায়।
পুঁটির বয়স বার হলেও সংসারের সকল কাজে এক্কেবারে পটুঁ।সকালে রান্নাবান্না করে সকলকে খাইয়ে ও নিজে খেয়ে সেনগুপ্ত বাড়ীতে কাজে বেরিয়ে পড়ে বাবার সাথে।দুপুরে এসে স্নানাহার সেরে আবার কাজে চলে যায়।রাতে ফেরে দশটা নাগাদ।ওদের বাড়ী থেকে নীহারিকা দেবীর বাড়ী মাত্র দশ মিনিটের হাঁটা পথ।পুঁটির সাথে রাহুল আর রাই-এর দারুণ ভাব।পুঁটির প্রধান কাজ মূলতঃ ওদেরকেই দেখাশোনা করা। বাপ বেটিতে যা মাইনে পায় তাতে হাসতে খেলতে তিনজনের সংসার চলে যায়।
ঘটনাটা ঘটল শ্রীবাসের একমাত্র শ্যালক কাঞ্চনের আসার ঠিক পরদিন।
কাঞ্চন প্রিয়াঙ্কার ছোট ভাই।সে একটু নষ্ট প্রকৃতির বাউন্ডুলে বকাটে ছেলে।বড়লোক বাপের বিগড়ে যাওয়া কুলাঙ্গার আর কি!
পুঁটিকে আজ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে কাঞ্চনের গেস্টরুম পরিষ্কার করার।মেজ বৌমা প্রিয়াঙ্কা বলল-
"এই পুঁটি!কাঁচু মামা এসেছে জানিস তো।আজ ওর ঘরটা একটু সাফাই করে রাখিস।তেমন পরিষ্কার নয় ঘরটা।"
ভাই কাঞ্চনকে সে আদরকরে কাঁচু বলে ডাকে।মানে বাবার লাই এর সাথে সাথে দিদির আদরেরও তার বকাটে হবার পশ্চাতে যথেষ্ট অবদান আছে।পু্ঁটি মাথা নীচু করে বলল-
"আচ্ছা ঠিক আছে মেজ কাকিমা।আমি এখনই করছি।"
-"হ্যাঁ,তাই কর।হয়ে গেলে বলিস আমায়।"
পুঁটির মিষ্টি ও শান্ত স্বভাবের জন্য তাঁকে বাড়ীর সকলে খুব ভালোবাসে।কারও কোন প্রয়োজন হলে পুঁটির ডাক অবসম্ভাবী।
পুঁটি ঘর মুছতে ব্যস্ত এমন সময় কাঞ্চন নিঃশব্দে পুঁটির পিছনে এসে দাঁড়ায়।কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে যখন দেখল কেউ আসছে না তখন সে পুঁটির হাত টেনে ধরে।পুঁটি থতমত খেয়ে উঠতেই পিছনদিক থেকে পেটের ওপর দুহাত দিয়ে চেপে ধরে।তারপর পুঁটি সামনে ঘুরতেই কাঞ্চন ওকে সামনের দিক থেকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করে।পুঁটি তৎক্ষণাৎ কোনরকমে সেঘর থেকে পালিয়ে আসে।
(১)
তার সারা শরীর কাঁপতে থাকে থরথর করে।কিন্তু কাউকে কিছু বলার সাহস পায় না সে।কারণ,গরীবদের জন্য কোন আদালত যে নেই।তাদের কান্না চাপা পড়ে ধনীদের সম্পদের তলায়।
তবে এথেকে কাঞ্চনের সাহস দিন দিন বাড়তে থাকে।কেউ জানত না বলে তার স্পর্ধা আরও বেড়ে গিয়েছিল।
এই ঘটনার দিন সাতেক পরে যে মারাত্মক ঘটনাটা ঘটিয়ে বসে কাঞ্চন,তা ভাবলেই শরীরের রক্ত গরম হয়ে ওঠে!
ঘটনাটা বলি।
সবাই গেছে পিকনিকে।কিন্তু কাঞ্চন পেট খারাপের ভান করে থেকে গেছে বাড়ীতে।আর কাজ করতে রয়ে গেছে কালু আর পুঁটি।অবশ্য ওদের বলা হয়েছিল,কিন্তু ওরা যায়নি।
কালু আগের ব্যাপারটা কিছুই জানত না।তাই পুঁটিকে বাড়ীতে রেখে সে দুপুরবেলা চলে গেল বাজার করতে।
কাঞ্চন হাঁক দিল-
"এই পুঁটি!একটু চা দিয়ে যাস তো।"
পুঁটির হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল কাঞ্চনের কথা শুনে।সারাবাড়ী খুঁজেও বাবাকে পেলনা সে।তখন নিতান্ত নিরুপায় হয়েই চা নিয়ে গেল পু্টি।ঘরে ঢুকে দেখে ঘরে কেউ নেই।হঠাৎ খুট্ করে শব্দ হতেই দেখল দরজার কপাট বন্ধ করে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে কাঞ্চন!সে হাসিতে যেন লালা মেশানো।চোখের চাহনিতে শ্বাপদের উষ্নতা বিচ্ছুরিত হচ্ছে।তখন হাত থেকে চায়ের কাপ সশব্দে পড়ে গেল মেঝতে।কিছুক্ষণ খাটের চারপাশে বেড়াল-ইঁদুরের খেলা হল যেন।তারপর ক্লান্ত হয়ে পড়লে কাঞ্চনের বাহুডোরে বদ্ধ হয়ে পড়ে সে।খাটের ওপর প্রবল ধস্তাধস্তিতে জর্জরিত হয়ে পড়ে।পুঁটি অনুভব করে কাঞ্চনের শরীরে যেন অসুরের শক্তি ভর করেছে।কোনভাবেই তার নাগপাশ থেকে নিজেকে বন্ধনমুক্ত করতে পারছেনা।সে নওতান্তই নিরুপায়।ওদিকে কাঞ্চনের উত্তপ্ত নিঃশ্বাসে তখন প্রথম রিপুর বিষম উত্তাপ!কাঞ্চনের ঠোট নিমেষে শুষে নিচ্ছে পুঁটির কচি ঠোঁটের শেস রসবিন্দু।শেষে রক্তক্ষরণ শুরু হল পুঁটির ঠোঁট থেকে।তার শরীরও ধীরে ধীরে অবশ হয়ে পড়ছে যেন।তবুও শেষ চেষ্টা করতেই হবে।ও বারে বারে অনুনয়ের সুরে বলছে-
"আমার এমন সর্বনাশ করবেন না মামাবাবু।আপনি সম্পর্কে মামা হন,আর মামা তো বাবারই সমান।"
সে টোটকাতেও চিড়ে ভিজল না।কাঞ্চন কামের নেশায় জর্জরিত-চরম উত্তপ্ত হয়ে লালামিশ্রিত গলায় বলল-
"কিছু হবেনা পুঁটি...আমার পুঁটি...আয়...আরও কাছে...আজ মনের সব জ্বালা জুড়িয়ে দে!" আরও বেশী জোরে জড়িয়ে ধরে সে পুঁটিকে।
মুহূর্ত যখন চরম বিপদের তখন খাটের পাশে থাকা টেবিলের ওপর থেকে কি একট শক্ত বস্তু যেন পুঁটির হাতে ঠেকল।শরীরের সব শক্তি একত্রিত করে সেই বস্তুটা দিয়ে চরম আঘাত হানে কাঞ্চনের মাথায়।সে খাট থেকে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ক্রমশ।
ভয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেল সে।বেচারি জানতেও পারলনা যে তার ফুলদানির আঘাতে তৎক্ষণাৎ মৃত্যু ঘটেছে কাঞ্চনের।
পুলিশ এসে তদন্ত শুরু করে ও পুঁটির ওপরেই সবার আগে সকলের সন্দেহ যায়।কারণ,ঘটনার পর থেকে সে নিরুদ্দেশ।পরে তদন্তে জানা যায় যে পুঁটিদের বাড়ীর সামনের রেল লাইনে রেলে কেটে মারা গেছে সে!মুণ্ডুহীন দেহের পোশাক দেখে কালুই তাকে সনাক্ত করে।তার অবস্থা শোচনীয়।কেঁদেকেটে একাকার করছে শুধু।
কিন্তু এর পিছনে থাকা প্রকৃত কারণটা ধামাচাপা পড়ে যায় সকলের অগোচরে।সকলে জানে কাঞ্চনকে খুন করে পুঁটি আত্মহত্যা করেছে।এমনকি আসল কারণটা পর্যন্ত খোঁজার দিকে কোন ভ্রূক্ষেপ নেই কারও।
(২)
এরপর সেনগুপ্ত বাড়ী থেকে কালুকে ছাড়িয়ে দিয়ে অন্য কাজের লোক রাখা হয়।কালু হাতে-পায়ে ধরে অনেক কাকুতিমিনতি করে,তবুও মন গলেনি সেনগুপ্ত পরিবারের কোন সদস্যের।যদিও সকলে কাঞ্চনকে হাড়ে হাড়ে চেনে।আসল ঘটনাটা যে কি তা আন্দাজ হয়ত সক্কলেই করতে পারছে।তবুও বাড়ীর সম্মান বাঁচাতে মৌন ব্রতই সঠিক মনে করেছেন তারা।কেবল রাহুল আর রাই কেঁদে বলেছে-
"পু্টি দিদি ভালো...ওকে এনে দাও..."
ভাগ্য ভালো এক বন্ধুরর সহযোগিতায় একটা ভ্যান ভাড়াতে পায় কালু।তাই দিয়েই কোন মতে চলে তাদের দুজনের সংসার।
হঠাৎ একদিন ডলি খুব অসুস্থ্য হয়ে পড়ে।ধুম জ্বর আর জ্বরের ঘোরে প্রায় বেহুঁশ হয়ে বারে বারে বলছে "দিদি!দিদি! বাবা,দিদি আমায় ডাকছে!আমি দিদির কাছে যাব..."
ডাক্তার ডেকে আনা হল।তিনি ওষুধ দিলেন।তবে কিছু খাবার পর তা খাওয়াতে হবে।খালিপেটে একদম নয়।ওর বয়স মাত্র আট বছর।ঘরে দাদাপানি বলতে কিছুই নেই।দোকানে আর বাজারে এত দেনা যে এমন চরম সঙ্কটজনক অবস্থাতেও কেউ সাহায্য করতে রাজী হবে না।
তখন কালু ছুটে গেল মনিব বাড়ীতে।সেনগুপ্ত বাড়ীর বাইরে দাঁড়িয়েই চেঁচাতে লাগল-
"দিদিমণি!একটিবার দয়া করুণ।মেয়েটা আমার না খেতে পেয়ে মরে যাবে!কিছু খাবার দিন..." বলে অঝোরে কাঁদতে থাকে।কিন্তু সেপরিবারের সকলের যেন পাষাণ হৃদয়।মুখের ওপরেই বলে দিল শিউলী-
"তোদের মত ভিখিরিদের এমন হওয়াই উচিৎ!যা,না খেতে পেয়ে মরুক মাগী!বর রস,তাই না!"
এত অপমান সত্ত্বেও বাড়ীত গিয়ে হাতে-পায়ে ধরে কেঁদেছে,তবুও পাথর গলাতে পারেনি এক হতভাগ্য পিতার করুন আর্তনাদ আর অশ্রু।ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিল এবং মুখের ওপর দরজা সপাটে বন্ধ করেদিল তখনই।
এবার বাড়ীর পিছনদিকে রান্না ঘরের পাশে গিয়ে জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে বলল-
"কিছু অন্তত দিন মা ঠাকরুণ।মেয়েটা আমার না খেতে পেয়ে মরে যাবে!"
তখনই একটা হাঁড়ি জানালা দিয়ে বাইরে চলে এল।শোনা গেল-
"এই নাই কালুকাকা,ডলি দিকে খাওয়াও।রাত হয়েছে তো,তাই ভাতে জল দেওয়া হয়ে গেছে।পান্তা করে রেখেছে!"
চমকে উঠল কালু!এতো ছোট দিদিমণি রাই-এর গলা।-"একশ বছর বাঁচুন ছোট দিদিমণি" এই আশীর্বাদ করে কালু হাঁড়িটা নিয়ে বেরিয়ে আসে।কিন্তু গেটের কাছে এসে হোঁচট খেয়ে পড়তেই হাতের অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়িটাও সশব্দে মাটিতে আছাড় খায়।ওদিকে এই আওয়াজে সবাই "চোর! চোর!" করে সেনগুপ্ত বাড়ী থেকে বেরিয়ে পড়েছে ততক্ষণে।
ওদিকে কালু হাঁড়িটাকে কোনমতে তুলে ছুটছে বাড়ীর দিকে।বাড়ী আগে রেললাইন।ওখানে এসে চেঁচাতে লাগল-
"ওরে ডলি মা!এই দ্যাখ্!রাই দিদিমণি তোর জন্য পান্তা পাঠিয়েছে।এবার তুই ওষুধ খেয়ে ঠিক সেরে উঠবি দেখিস!"
(৩)
কালুর কথা শেষ হতে না হতেই রেললাইনের ওপর আবার হোঁচট খেয়ে পড়েছে সে।এবার কিন্তু ও ওঠার আগেই সেনগুপ্ত বাড়ীর লোকজন তাকে ধরে ঘিরে ফেলেছে।মিনিট পনের পর দেখা গেল সাদা পান্তা লাল হয়ে গেছে আর হাত-পা ছড়িয়ে উপুর হয়ে পড়ে আছে কালুর স্পন্দনহীন নিথর রক্তাক্ত দেহটা।কিছু দূরে পড়ে আছে অ্যালুমিনিয়ামের একটা হাঁড়ি।সবাই সরে যেতেই একটা প্যাসেঞ্জার ট্রেন চলে গেল কালুর দেহের ওপর দিয়ে।আর চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে লাল লাল পান্তাভাত!
পরদিন সকালে ডলির মৃতদেহ বের হল কালুর ঘর থেকে।ডাক্তার বললেন,দিন তিনেক কিছু খাওয়া হয়নি বাচ্চাটার...আর পেটে একফোঁটা ওষুধও পড়েনি...
স্বপ্ন
কবিরুল
" শোন সরমা , তোমার এই মেয়ে বংশের কলংক। ও আর পাঁচটা মেয়ের মতন স্বাভাবিক নয়। গুরুজী ঠিকই বলেছিলেন তোমার ছেলে না হয়ে মেয়েই হবে। তখন তোমার এই অলুক্ষণে মেয়েকে আমাদের গর্ভেই বিনাশ করা উচিৎ ছিল। "
একুশ বছর আগে শ্বাশুড়ির ঝাঁঝালো বাক্যবাণ গুলো আজও সরমার মনে আছে। সেদিন থেকেই ঠিক করেছিল নিজের কন্যা সন্তানকে এমনভাবে তৈরী করবে যাতে সে আর পাঁচটা পুরুষের সাথে টেক্কা দিতে পারে।
সরমার জেদের কাছে ওর স্বামী প্রলয় অবশেষে হার মেনেছিল। অত্যাচারও কম করেনি সরমার উপর। সরমাকে প্রতিদিন রাতে মারধোর করত। গালাগাল দিত। সরমা মেয়ের ক্যারিয়ার তার লেখাপড়ার কথা ভেবে মুখ বুজে সব সহ্য করেছে।
যদিও স্বামী অন্য মেয়ের সাথে পরে ঘর সংসার পেতেছিল। সরমা তখন রিম্পাকে নিয়ে অথৈ জলে। একবারে জীবনযুদ্ধে হেরে না গিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই শুরূ করেছিল। মেয়েকে জুগিয়েছিল স্বাধীনভাবে বাঁচার সাহস।
শ্বাশুড়ি বেঁচে নেই। স্বামী অনেক দূরে সরে গেছে। তবে শরীরের কালো দাগগুলো সরমার লড়াইকে আজও কুর্নিশকে করে। মেয়ের ইচ্ছে ছিল বড় আইপিএস অফিসার হবে। সমস্ত অপরাধের মোকাবিলা করবে। উইম্যান ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করবে। কিরণ বেদী ওর আদর্শ। কিন্তু সরমা সব সময় চাইত মেয়ে ডাক্তার হয়ে রুগীদের সেবা করূক। বিনা পয়সাতে গরীব মানুষদের চিকিৎসা করুক।
রিম্পা মায়ের কথা রেখেছে। মেডিসিন নিয়ে পড়াশোনার পরে আইপিএস পরীক্ষায় পাশ করেছে।বিশাল বড় পুলিশ অফিসার হয়ে অনেক নির্যাতিতার পাশে দাঁড়িয়েছে। মেয়েদের নিয়ে কন্যা ভ্রূণ হত্যার বিরুদ্ধে লড়াই করেছে।
এ বছর ওর কাজে খুশী হয়ে নারী দিবসের দিনে কেন্দ্রীয় সরকার রিম্পা ও তার টিম মেম্বারদের পুরষ্কৃত করেছে। সরমা পুরো অনুষ্ঠানটাই টিভিতে দেখেছে। আবেগে চোখ ছলছল করে উঠেছিল। শ্বাশুড়ির কথা মনে পড়ছিল সেদিন। উনি ঐ ভাবে সেদিন তিরষ্কার না করলে রিম্পা এতটা এগোতে পারত না।
করোনা ভাইরাসের তাণ্ডব বাড়তেই রিম্পার বিভিন্ন হসপিটালে দায়িত্ব পড়েছে। ও তো নিজেই একজন ভাক্তার।
একদিন ওর হসপিটালেই এক রোগী করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হল। ভদ্রলোককে খুব যত্ন সহকারে সেবা করেছে রিম্পা ও তার সকল স্টাফ আর নার্সরা। উনি সুস্থ হতেই রিম্পার নাম ঠিকানা , বাবার নাম জানতে চাইলেন। সব শুনে উনার চোখে জল।
প্রলয়বাবু ভাবতেই পারেনি সেদিনের ছোট্ট রিম্পার এত নামডাক হবে।
সামনে বছর হয়ত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ডাকে বিদেশ যাবে। সেমিনারে যোগ দিতে।
একটা লড়াই , একটা কন্যা , একটা নারীর স্বপ্ন যেন পূর্ণতা পেল।
সরমা যেন দেখতে পাচ্ছে একটা প্লেন স্বপ্নের ডানায় ভেসে নীল মেঘের দিকে ছুটে চলেছে।
মানিকতলা (ছোট গল্প)
আব্দুল রাহাজ
গ্রামটির নাম ছিল শালপুর। গ্রামটি ছিল আশেপাশের এলাকা থেকে খুব বড়ো। গ্রামটিতে বসবাস করতেন হিন্দু মুসলিম ধর্মের মানুষ দেখলে মনে হয় সবাই যেন ভাই ভাই এতটাই মেলবন্ধন তাদের মধ্যে আবদ্ধ আছে। গ্রামের ভিতরে এক জায়গায় একটি বড়ো গাছ ছিল গ্রামের লোকেরা সেই গাছের বয়স আজ জানতে পারেনি তবে গ্রামের প্রবীণদের কাছ থেকে শোনা যায় এই গাছটি রাতারাতি জন্মেছিল এটাই ছিল এই গাছের জন্ম বৃত্তান্ত। গ্রামের লোকেরা নাম দিয়েছেন মানিকতলা। বর্তমানে কাজটি বিশাল আকারে অবস্থান করছে। গাছটির ঝুড়ি নেমেছে দেখলে মনে হয় বটগাছটি বছরের পর বছর সেখানে প্রোথিত হয়ে আছে। এই গাছটির পশ্চিম দিকে মাছ চাষ করা বড় বড় পুকুর আর পূর্ব দিকে রাস্তা যেখানে মানুষ প্রতিনিয়ত চলাচল করে রাস্তার পাশে মানুষের জনবসতি মনে হয় সম্প্রীতির বার্তা মেলবন্ধন সবসময় বহন করে আসছে। মানিক গাছের আশেপাশে গাছপালা সারিসারি অবস্থান সবুজায়ন সৃষ্টি করেছেন। গাড়ির আওয়াজ মানুষের দৈনন্দিন কাজকর্ম সব জেনে কাজ প্রতিনিয়ত প্রত্যক্ষ করে যাচ্ছে। কিভাবে রাস্তা দিয়ে হাজার হাজার মানুষের আনাগোনা উৎসব অনুষ্ঠান দেখে গাছ আজ বর্তমান সময়ে এসে প্রবীণ অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু তাকে দেখলে মনে হয় কিন্তু তাকে দেখলে মনে হয় ভরা যৌবন নিয়ে আজীবন কাল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। এখানকার ছোট ছেলেরা যখন তার নিচে খেলা করে তখন সেই ছেলেরা কাজ থেকে দেখেই প্রথমে কি সব ভাবতে থাকে। শতাধিক বর্ষের এই গাছ আজ সবার মনে বিরাজ করে আছে। গ্রামের বৃদ্ধরা গাছের সম্বন্ধে নানা গল্প অপরাহ্ণে নিস্তেজ সূর্যের ছায়ায় ছোট্ট ছেলেদের গল্প শোনাতো এভাবেই মানিক গাছের গল্প ছোট ছেলেরা শান্তভাবে শুনে সন্ধ্যার প্রাক্কালে বাড়ির উদ্দেশ্যে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিতো। একবার একদিন বর্ষা শুধু হল সারাদিন বৃষ্টি তখন গ্রামের মোড়ল খুবই বৃদ্ধ গ্রামের সবাইকে এক ঘরে ডেকে নিয়ে গল্প করতে লাগলেন তার মতে ফকিরচাঁদ বলে উঠলেন দাদু আমাদের মানিকতলা নিয়ে কিছু বলুন তখন শিমুরালি বললেন তবে শোনো তার গল্প। আমরা তখন খুব ছোট আমার বাবা তখন মাঠে কাজ সেরে বাড়ি ফিরেছে আমি তখন খেলা করছি সেই সময় আমাদের গ্রামের একজন বলল ও নদের চাঁদ জানো কাল রাতে গ্রামের পশ্চিম দিকে ওই পুকুর পাড়ে রাতারাতি গাছ জন্মেছে আমার বাবা তাহলে চলো দেখে আসি তারপর সেখানে নিয়ে উপস্থিত হলে দেখা যায় সত্যিই বড় গাছ। তখন গ্রামের লোক বেশি ছিল না সবাই দেখলাম সেখানে উপস্থিত। তারপর থেকে কেউ যেন বলল একটা মানিকজোড় গাছ পেলাম সেখান থেকেই না হল মানিকতলা। এইভাবে দিন যায় দিন আসে বউ পরিবর্তন পালাবদলের পর গাছটি বড় হতে থাকে তারপর দিন টানা দশদিন দিনের বৃষ্টিতে আমাদের গ্রামের অধিকাংশ স্থান জলের তলায় কিন্তু মজার ব্যাপার হলো মানিকগঞ্জ জলের তলায় যায়নি আমরা তো আশ্চর্য হলাম। তারপর থেকেই বাবা মারা যাওয়ার পর সেই দিকে আর যাওয়া হয়নি অনেকদিন পর শুনলাম গ্রামের লোক সেই গাছকে বিশ্বাস করতে লাগলো তারপর থেকে আজ পর্যন্ত সবাই গাছকে কে খুব ভালোবাসে। আমরা তখন সবাই প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছি একসময় সরকারের লোক এসে গাছকে কাটার জন্য সিদ্ধান্ত নিলেন তখন গ্রামের লোক বিক্ষোভে ফেটে পড়লো। সব বাধাকে অতিক্রম করে যখন সরকারি লোকেরা কুঠার দিয়ে গাছের গায়ে মারলো তখন গাছের ছাল উঠলেও পরক্ষণেই অদ্ভুতভাবে ছল করে উঠলো যারা কুঠার চালাচ্ছিল তাদের হাত-পা অবশ হয়ে যাচ্ছিল তা দেখে সবাই অবাক ব্যবস্থা থেকে সরকারি কর্মীরা ভয়ে পালালো। দুই মাস পরে জায়গাটিকে নির্দিষ্ট স্থান হিসেবে স্বীকৃতি দিল সেই গাছের চারপাশে গড়ে তুলল পাচিল তারপর থেকে স্থানটির নাম মানিকতলা নামে চেনা পরিচিত হল সবার কাছে এইভাবে মানিক গাছ আজ পর্যন্ত আমার তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার প্রতিটি পাতা ঝুড়ি শেকর যেন জাদুময় গ্রামের মোড়ল প্রাচীন মানিক গাছের জন্ম বৃত্তান্ত শুরু করে তার আশ্চর্য ক্ষমতা নামকরণ গ্রামের লোকেদের শোনালেন শুনতে শুনতে সকাল হয়ে গেল। এইভাবে গ্রামের প্রাচীন গাছের সম্বন্ধে সবাই জানল। একদিন গ্রামের যুবকরা মিলে এই প্রাচীন গাছকে নিয়ে এক সপ্তাহ ব্যাপী মেলা আয়োজন করেছিল গ্রামের লোক আসত মেলায় আর জেনে যেত গাছের ইতিহাস এইভাবে বছরের পর বছর মেলার মাধ্যমে এই গাছের কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পরল এরপর বহু পালাবদল পরিবর্তনের পর বর্তমান সময়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছে। ঝুড়ি কে দেখলে মনে হয় গাছটির বয়স অতিপ্রাচীন কিন্তু সে যেন জীবনের মত দাঁড়িয়ে আছে আর সেখানকার মানুষের কাছে মানিকতলা নামে খ্যাত আছে যা গ্রামবাসীর কাছে বড় পাওনা। এভাবেই মানিক গাছ প্রকৃতি ও সবার মনের মাঝে বিরাজমান।
আত্মবিশ্বাস
তৃণা মুখার্জী
ওরাও স্বপ্ন দেখে, রোদে, জলে পুরে বাড়ির সব কাজ সেরে মাঠে ছাগল চরাতে গিয়ে একটু শান্তিতে পড়বে। সারাদিন ছোট ছোট হাত-পাগুলো কত কাজ করে।সকালে উঠে ছেঁড়া জুতো-জামা পড়ে, মাঠে যায় ফুটবল খেলতে।কি যে আনন্দ। তারপর গরু ছাগল চরানো। বাড়ির কাজ করে নিজেদের জন্য সময় বের করতে পারেনা ওরা।ওদের কাছে রবি ,নজরুল কি ? নিজের জন্মদিন পালন করাটা স্বপ্নের। আধুনিক উন্নত সমাজে সত্যিই ওরা বেমানান। মোবাইলে গেম নয় ,ওরা মাঠে কাদায় খেলে। সারাদিনের পর বাড়ি থেকে পালিয়ে কোনো এক গাছের তলায় বসে "বল বীর,বল উন্নত মম শির" আওড়ায় ।
রিকি ঘোষ
ওরা যে গরীব ভীষণ
ভাতের খোঁজ চারিদিকে আজ,
পঞ্চপদ আর জোটে না কপালে
একমুঠো ভাতেই আনন্দের সাজ।
দুঃখ তবুও যায় না চলে
বেঁধে আছে গাট ঘরের কোণে,
সামান্য একটু ভাতের জন্যে
হাসি ফুটিয়েছে তারা দুঃখের মনে।
ওরা যে গরীব ভীষণ
দিতে চায় সুখের দেশে পাড়ি,
তবুও দুঃখ, অভাব করেছে তাড়া
চড়েনা হেন সুখের হাড়ি।
প্রভাবশালীর প্রভাব আজ
কেরেছে গরীবের মুখের ভাত,
দেখছে সমাজ বেজায় হাস্যে
বাড়ায়নি কেহ সাহায্যের হাত।
আঁধার যে করেছে গ্রাস
সুখ ও হাসির চলন্ত রথ,
চোখের ওই নোনা জলের তরেও
পেয়েও পেলনা ভাতের পথ।
বলছে সকলে, "হে ঈশ্বর;
আমরা বড়োই অসহায়",
কি করিলে পাব বলো
ভাতের সন্ধান হেন আশায়।
হবে একদিন ঠিকই তাদের
সমস্ত দুঃখের সর্বশেষ,
প্রভাবশালী দেখবে সেদিন
কাটাবে বসে ভ্রান্তির রেশ।
অশরীরী ঈশ্বরী
রুপম
কাল রাতে আমি এক স্বপ্ন দেখেছি
স্বপ্নে শুনেছি তোমার নূপুরের ছম ছম ।
তুমি ঈশ্বরের বেদী হতে নেমে ধেয়ে আসছো মানব সভ্যতার তীরে ,
তোমার হাতে ছিল অমরত্বের সুধা পূর্ণ মঙ্গল ঘট ,
তোমার গায়ে ছিল সূর্য সম আভা ,
কেমন যেনো সে ঈশ্বর হতে মানসী হচ্ছিল মনের দেওয়াল ঘড়িতে ,
যেমন করে রূপকথার নায়ক থাকে ছোট্ট বাচ্চার চোখের ঠুলিতে ।
আমি কাল রাতে এক স্বপ্ন দেখেছি
স্বপ্নে আমি ঈশ্বর পেয়েছি যেমন করে সাধক পায় আরাধ্যাকে ,
আমি ছুয়ে দেখেছি তোমার হাতের রেখা গুলো
যেমন করে ছুয়ে থাকে ছোট্ট শিশু আবিষ্কারের নেশাতে।
আমি কাল রাতে এক স্বপ্নে বেঁচেছি মরেছি ,
জীবনচক্র পূরণ করেছি এক রাতে
আমরা কাল রাতে ছিলাম তারকাটা ফেলা একই বিছানাতে ।
আমি সকালের আলোয় এক ছায়া দেখেছি ,
আমার ক্ষত বিক্ষত কায়া দেখেছি মন আয়নার প্রতিবিম্বে ।
আমি একযুগ বেঁচে মরেছি কাল রাতে ,
উরে বেড়িয়েছি কাল রাতে
যেমন করে পিপীলিকা ওরে পাখা গজানোর সুখে
মৃত্যু ক্ষণ ভুলে ।
বিচ্ছেদ
শিবপ্রসাদ গরাই
বিচ্ছেদ তো হয়েই গেছে অনেকদিন
এখন শুধু স্মৃতি গুলো খুলে খুলে রাখা
মৃতদেহ চিতায় উঠলে, যেমন পরনের বস্ত্র গুলোকে এক এক করে খুলে রাখে ;
তেমনই
নগ্ন শরীরটা যেমন নিমেষেই পুড়ে খাক হয়ে যায় ,
তেমন স্মৃতি-শূন্য হয়েই বাঁচতে চাই আমি।
এরকমভাবে বাঁচা আসলে মরতে চাওয়া ,
একটু একটু করে জলের অতল গভীরে ডুবে যাওয়া।
ডুবতে না চাওয়া বা মরতে না চাওয়া যেখানে অর্থহীন ।
স্মৃতিমেদুরতা মানুষের বাঁচার জন্য ভালো না,
ভুলে যাওয়া বা মনে করতে না চাওয়া
দুটোই তো আর এক নয় ।
প্রতিটা বিচ্ছেদ আসলে এক-একটা মিলন
ওই যে কবিগুরু বলেছেন -
'লিখি দিল বিশ্বনিখিল দু বিঘার পরিবর্তে'
তেমনই আর কি!
শঙ্কা
বিশ্বজিত মুখার্জ্জী
নগরেরপ্রান্তরে,বাজারেরঅন্দরে,ওরা ঘোরে দলেদলে প্রতি পলেপলে,
জানে নাকো কাল,কি হবে হাল,ওদের কপালে?
চোখেমুখে আতঙ্কের ছবি,তবুও বেঁচে থাকার স্বপন,
কার অপেক্ষায় কাদের যেন মন ভীষণ উচাটন।
যদি ধরে ছোঁয়াচে কঠিন জ্বরে,জীবন সঙ্গিন,
হবেই যেতে ঘরের বাহিরে যতই হোক দুর্দিন।
মানেনা কোন বাধা,উপেক্ষিত সরকারি পরোয়ানা,
নাস্তানাবুদ হয়েও,ওরা রাজি দিতে জরিমানা।
গৃহবন্দি মানুষ আজ মনরোগী,মনেতে ভীষন চাপ,
সমাজ রোগেতে তফাৎ গড়েছে,বেড়েছে মনস্তাপ।
তন্দ্রাহীন নিকশকালো রাত্রি,ব্যারিকেডে মৌনি শহর,
ঝড়েরবেগে আসছে ধেয়ে,প্রতিক্ষিত মৃত্যুর লহর।
ক্রমশ গিলোটিন
হীরক বন্দ্যোপাধ্যায়
ছুরির ফলা এগিয়ে আসছে
তিন দুই এক শূন্য...
বিস্ফোরণ, নিরীহ বুর্জোয়া শব্দটির পাশে
এখন আর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই
লড়াই মিছিলের মতো শুধু এক ধূসর পৃথিবী
একে একে ফিরে গেছে অক্ষৌহিনী সেনা
এখন কেউ তার কোনও হিসেব ও রাখেনা
বিমূঢ় বিক্ষোভে কান্নারত শৈশব
ঘন কুয়াশার ভিতর
ডুবে যাচ্ছে গাছের মর্মরধ্বনি
তুমি দেখেও দ্যাখো না
এখন আমাদের সব ই নিয়ন্ত্রিত
সত্য উচ্চারণে সহস্র গিলোটিন নেমে আসে
তুমুল বৃষ্টিপাতের ঘটনা আজ আর মনে পড়ে না
নি:শ্বাসের বায়ু ,উদ্ধারের আঙুল
বৌদ্ধযুগের ভাঙামূর্তির মতো
দমিত,স্বাধীনতাহীন...
বিষয় হারানোর মতো একটি অশেষ ধন্যবাদ ছাড়া এখন আর আমাদের কোনো গত্যন্তর নেই...
কাউকে কি চেনা যায়?
পাখী
হারিকেনের টিমটিমে আলোয় যেদিন প্রথম আমাকে দেখেছিলে বলেছিলে চিনতে পেরেছ...
বকুলের ডালে দোলনায় ঝুলতে ঝুলতে তোমাকে যেদিন দেখেছিলাম
মনে হয়েছিল চিনতে পেরেছি...
তার পর যেখানে যেখানে দেখেছি চিনেছি তোমাকে...
সন্ধ্যার শেষ ম্লান আলো মিলিয়ে যেতে যেতে শেষবারের মতো বলে গেল
সে তোকে ভালোবাসে
আনন্দে পাখি গাইল গান
নেচে উঠল দখিনা বাতাস
শিস দিয়ে উঠল বাঁশপাতারা...
অন্ধকার সরিয়ে সরিয়ে পরম যত্নে দুহাতে তুলে নিলে আমার মুখ জোছনায় চোখ রেখে পাগল হলে মুগ্ধ হলে
ভুলে গেলে স্বপ্ন দেখা...
ফিসফিসিয়ে শুধু একবার বললে
চিনতে পেরেছি
যুগ যুগ ধরে এই দুটি চোখইতো খুঁজছি
যার অতলান্ত গভীরতায় ডুবে থাকা যায় হাজার হাজার বছর...
তার পর কেটে গেছে অনেক আলোকবর্ষ
পুরোনো হয়েছে অনেক কিছু
সারা বসন্ত ঢেকে থাকে এখন বিবর্ণ ঝরা পাতায়...!
মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে মনে
তুমি বা আমি বা আমরা দুজনেই সত্যিই কি চিনতে পেরেছি একে অপরকে...?
সত্যিই কি কাউকে চেনা যায়????
চলো ঘুরে দাঁড়াই
শুভঙ্কর দাস
হারিয়ে যাবো এক দূরদুরান্তের হিমের দেশে
ভোরের শীতল শুভ্র কুয়াশায় ধূসর চিলের ভেসে ভেসে।
শিশির হয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় পড়বো ঝরে মৃতুল ঘাসে,,,
বাঁধবো ঘর, বাঁধবো সোনার সংসার.....এই সবুজ বন ও সবুজ পৃথিবীকে ঘিরে;
দেখবো হাজারো স্বপ্ন, লড়বো দৃঢ়তার সাথে বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে।
আসবে হাজারো প্রতিবন্ধকতা.........
করবো জয় নিজের বাহুবলের জোরে।
রাখবো শত-শত ঈর্ষা ও ক্ষোভকে ভূলুন্ঠিত করে,
বিশ্ববিজেতা আলেকজান্ডারের মতন হেসে-খেলে করবো সমগ্র বিশ্বজয়।
ক্ষোভে ফেটে পড়বে গর্জন, জ্বলে উঠবে পৃথিবী,,,,,,,,
আত্মবিশ্বাসের অগ্নিতে সমগ্র প্রতিবন্ধকতা, হিংসা, গর্জন ভস্মীভূত হবে।
ভালোবাসি
ফিরদৌসী বেগম
প্রকৃতি তোমায় ভালোবাসি
আজও বাসি !
তোমার তীক্ষ্ণ অনুভূতি আজও শরীরে ছোঁয়াই !
তোমার ওঠা নামা আজও আমার রাজ্যেজুড়ে আঁকড়ে ধরে !
যেখানে ভোর হয় মেঘেদের ভীরে ,
তরুণী হাসে পদ্মার দেখা !
শঙ্কচিল উড়ে তৃণ রাশে ,
গঙ্গার দুকূল এপার ওপার সাজে !
প্রকৃতি সবুজ লতা
আজও তোমার রঙ ধরে !
তোমার রাতের রহস্য শত নক্ষত্র রুপ ধরা দেয় জীবন্ত জোৎস্নায় !
আঁধারের দেখা হয় স্বপ্নের ঘোরে !
প্রকৃতি তোমার অস্তবেলা
আজও ফেরায় ঘরের ঠিকানায় !
ভালোবাসি আজও বাসি !
ভালোবাসা
মিত্রা ঘোষ
অনীশ সমস্ত টেষ্ট রিপোর্টগুলো ফাইল বন্দি করে বেড়িয়ে এলো ডাক্তারের চেম্বার থেকে।
পৃথিবীটা যেন দুলতে লাগলো ওর চোখের সামনে,
মনের ভেতর ভেসে যাচ্ছে জীবন স্মৃতির এপিসোডের পর এপিসোড।
বি.কম. ফাইনালের মাঝে বাবার চলে যাওয়া,
প্রথম কর্পোরেট অফিসে চাকরি পাওয়া. মধুমিতার সাথে, প্রেম, বিয়ে, আট বছরের ছেলে অম্বরকে নিয়ে ওর ঘর এখন আলো ঝলমলে, তবে এত গাঢ় অন্ধকার কেন নেমে এল তার জীবনে ?
ক'দিন হল ছোট ছোট ফোসকায় ভরে যাচ্ছে ওর সারা শরীর,
ডাক্তারবাবু রিপোর্ট দেখে বললেন ক্যান্সারের থার্ড স্টেজ।
খবরটা শুনেই মিতা কেমন রুক্ষ হয়ে উঠলো, ক'দিন ধরে ও লক্ষ্য করছে মিতা কেমন বদলে গেছে , অফিস থেকে রোজ অনেক রাত করে বাড়ি ফেরে, সাথে এক ভদ্রলোক থাকেন ।
অনীশ একদিন ওনার পরিচয় জানতে চাওয়াতে মিতা খরখরে গলায় বলেছিল,
" তুমি অসুস্থ হয়ে শুয়ে আছো, শুয়েই থাক না ! এসব জেনে তুমি কি করবে ? "
অনীশ নিশ্চল।
অনীশের ফোস্কাগুলো আরও বেশী করে মাথা, মুখ, সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো , রাতদিন যন্ত্রণায় ছটফট করে সে।
এদিকে মিতার বয় ফ্রেণ্ড রবীনবাবু অনীশের বাড়িতেই থাকেন আজকাল।
মিতার কাছে অনীশ ওনার থাকার কারণ
জানতে চাওয়াতে মিতা হিংস্র বাঘিনীর মতো গর্জন করে রবীন রবীন বলে চেঁচাতে শুরু করলো, রবীনবাবু ঘরে ঢুকতেই মিতা ওকে জড়িয়ে ধরে চুমু দিতে লাগলো পাগলের মতো,ওই অবস্থাতেই অনীশের সামনের বিছানায় বসে ওরা লিপ্ত হল আরও গভীর আলিঙ্গনে।
তখন অনীশের লজ্জায়, অপমানে চেতনা লুপ্ত হয়ে এল।
যখন অনীশের জ্ঞান ফিরলো মাঝরাত পেরিয়ে গেছে, ঘরের ভেতর ঘুটঘুটে অন্ধকার কেউ তার ঘরে আলো জ্বালায়নি।
ওর বালিশের পাশে মোমবাতি আর দেশলাই রাখা থাকে তাই জ্বালিয়ে ও দেখলো রাত আড়াইটে পেরিয়ে গেছে,
ও দেশলাই কাটিগুলো জ্বালিয়ে জ্বালিয়ে বিছানার চারিদিকে ছড়িয়ে দিল , আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে যেতে লাগল ওর খাট বিছানা, তার মাঝে ও।
দান সৌমেন সরকার
একমুঠো ভাতের জন্য মানুষকে কি কি কাজই না করতে হয়!দিনমজুরি,যুদ্ধ,অসামাজিক কাজকর্ম এমনকি নিষিদ্ধপল্লীরও সঙ্গী হতে হয়।আর এসবের মূলে আছে ওই একমুঠো ভাত।
নীহারিকা সেনগুপ্তের বাড়ীর বিশাল অবস্থা!আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে দারুণ পসার জমিয়ে বসেছেন মেমসাহেব।তাঁর স্বামী মারা গেছেন বছর দশেক হল।চার ছেলে-নবীন,শ্রীবাস,বুদ্ধদেব ও ভবেশ।প্রথম দুজন বিবাহিত।নবীনের এক ছেলে রাহুল,মাত্র সাত বছর বয়স।আর শ্রীবাসের একমাত্র কন্যা মণিমালা,মাত্র বছর চারেক বয়স।আদরকরে সবাই ডাকে রাই বলে।এই দুই ভাইই বাবার ব্যবসা সামলাচ্ছে মায়ের সাথে কাঁধে কাঁধ আর হাতে হাত মিলিয়ে।বুদ্ধদেব সবেমাত্র ডাক্তারি পাশ করে প্র্যাকটিস শুরু করেছে দিল্লীতে।নীহারিকা দেবী এখন তার বিয়ের কথা ভাবছেন।আর বাড়ীর সবথেকে আদরের ছোটকর্তা ভবেশ কলেজে পড়ে।ইচ্ছা আচ্ছে অঙ্কের প্রফেসর হবেন।তবে তিনি সাহিত্যিক আর একটু ভবঘুরে প্রকৃতির।সবমিলিয়ে বেশ হাসিখুশী-জমজমাট পরিবার নীহারিকা দেবীর।
একান্নবর্তী এমন পরিবার খুঁজে পাওয়া দুষ্কর,যেখানে বড় বৌমা শিউলি ঠিক যেন লক্ষ্মী আর মেজ বৌমা প্রিয়াঙ্কা যেন স্বয়ং সরস্বতী।
তাদের বাড়ীতে কাজ করে কালু আর তার বড় মেয়ে পুঁটি।ছোট মেয়ে ডলি সবে ক্লাস টু-তে উঠেছে।বাবা আর বড় মেয়ে সেনগুপ্ত বাড়ীতে কাজ করে সংসার ও ছোট মেয়ে ডলির লেখাপড়া চালায়।
পুঁটির বয়স বার হলেও সংসারের সকল কাজে এক্কেবারে পটুঁ।সকালে রান্নাবান্না করে সকলকে খাইয়ে ও নিজে খেয়ে সেনগুপ্ত বাড়ীতে কাজে বেরিয়ে পড়ে বাবার সাথে।দুপুরে এসে স্নানাহার সেরে আবার কাজে চলে যায়।রাতে ফেরে দশটা নাগাদ।ওদের বাড়ী থেকে নীহারিকা দেবীর বাড়ী মাত্র দশ মিনিটের হাঁটা পথ।পুঁটির সাথে রাহুল আর রাই-এর দারুণ ভাব।পুঁটির প্রধান কাজ মূলতঃ ওদেরকেই দেখাশোনা করা। বাপ বেটিতে যা মাইনে পায় তাতে হাসতে খেলতে তিনজনের সংসার চলে যায়।
ঘটনাটা ঘটল শ্রীবাসের একমাত্র শ্যালক কাঞ্চনের আসার ঠিক পরদিন।
কাঞ্চন প্রিয়াঙ্কার ছোট ভাই।সে একটু নষ্ট প্রকৃতির বাউন্ডুলে বকাটে ছেলে।বড়লোক বাপের বিগড়ে যাওয়া কুলাঙ্গার আর কি!
পুঁটিকে আজ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে কাঞ্চনের গেস্টরুম পরিষ্কার করার।মেজ বৌমা প্রিয়াঙ্কা বলল-
"এই পুঁটি!কাঁচু মামা এসেছে জানিস তো।আজ ওর ঘরটা একটু সাফাই করে রাখিস।তেমন পরিষ্কার নয় ঘরটা।"
ভাই কাঞ্চনকে সে আদরকরে কাঁচু বলে ডাকে।মানে বাবার লাই এর সাথে সাথে দিদির আদরেরও তার বকাটে হবার পশ্চাতে যথেষ্ট অবদান আছে।পু্ঁটি মাথা নীচু করে বলল-
"আচ্ছা ঠিক আছে মেজ কাকিমা।আমি এখনই করছি।"
-"হ্যাঁ,তাই কর।হয়ে গেলে বলিস আমায়।"
পুঁটির মিষ্টি ও শান্ত স্বভাবের জন্য তাঁকে বাড়ীর সকলে খুব ভালোবাসে।কারও কোন প্রয়োজন হলে পুঁটির ডাক অবসম্ভাবী।
পুঁটি ঘর মুছতে ব্যস্ত এমন সময় কাঞ্চন নিঃশব্দে পুঁটির পিছনে এসে দাঁড়ায়।কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে যখন দেখল কেউ আসছে না তখন সে পুঁটির হাত টেনে ধরে।পুঁটি থতমত খেয়ে উঠতেই পিছনদিক থেকে পেটের ওপর দুহাত দিয়ে চেপে ধরে।তারপর পুঁটি সামনে ঘুরতেই কাঞ্চন ওকে সামনের দিক থেকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করে।পুঁটি তৎক্ষণাৎ কোনরকমে সেঘর থেকে পালিয়ে আসে।
(১)
তার সারা শরীর কাঁপতে থাকে থরথর করে।কিন্তু কাউকে কিছু বলার সাহস পায় না সে।কারণ,গরীবদের জন্য কোন আদালত যে নেই।তাদের কান্না চাপা পড়ে ধনীদের সম্পদের তলায়।
তবে এথেকে কাঞ্চনের সাহস দিন দিন বাড়তে থাকে।কেউ জানত না বলে তার স্পর্ধা আরও বেড়ে গিয়েছিল।
এই ঘটনার দিন সাতেক পরে যে মারাত্মক ঘটনাটা ঘটিয়ে বসে কাঞ্চন,তা ভাবলেই শরীরের রক্ত গরম হয়ে ওঠে!
ঘটনাটা বলি।
সবাই গেছে পিকনিকে।কিন্তু কাঞ্চন পেট খারাপের ভান করে থেকে গেছে বাড়ীতে।আর কাজ করতে রয়ে গেছে কালু আর পুঁটি।অবশ্য ওদের বলা হয়েছিল,কিন্তু ওরা যায়নি।
কালু আগের ব্যাপারটা কিছুই জানত না।তাই পুঁটিকে বাড়ীতে রেখে সে দুপুরবেলা চলে গেল বাজার করতে।
কাঞ্চন হাঁক দিল-
"এই পুঁটি!একটু চা দিয়ে যাস তো।"
পুঁটির হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল কাঞ্চনের কথা শুনে।সারাবাড়ী খুঁজেও বাবাকে পেলনা সে।তখন নিতান্ত নিরুপায় হয়েই চা নিয়ে গেল পু্টি।ঘরে ঢুকে দেখে ঘরে কেউ নেই।হঠাৎ খুট্ করে শব্দ হতেই দেখল দরজার কপাট বন্ধ করে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে কাঞ্চন!সে হাসিতে যেন লালা মেশানো।চোখের চাহনিতে শ্বাপদের উষ্নতা বিচ্ছুরিত হচ্ছে।তখন হাত থেকে চায়ের কাপ সশব্দে পড়ে গেল মেঝতে।কিছুক্ষণ খাটের চারপাশে বেড়াল-ইঁদুরের খেলা হল যেন।তারপর ক্লান্ত হয়ে পড়লে কাঞ্চনের বাহুডোরে বদ্ধ হয়ে পড়ে সে।খাটের ওপর প্রবল ধস্তাধস্তিতে জর্জরিত হয়ে পড়ে।পুঁটি অনুভব করে কাঞ্চনের শরীরে যেন অসুরের শক্তি ভর করেছে।কোনভাবেই তার নাগপাশ থেকে নিজেকে বন্ধনমুক্ত করতে পারছেনা।সে নওতান্তই নিরুপায়।ওদিকে কাঞ্চনের উত্তপ্ত নিঃশ্বাসে তখন প্রথম রিপুর বিষম উত্তাপ!কাঞ্চনের ঠোট নিমেষে শুষে নিচ্ছে পুঁটির কচি ঠোঁটের শেস রসবিন্দু।শেষে রক্তক্ষরণ শুরু হল পুঁটির ঠোঁট থেকে।তার শরীরও ধীরে ধীরে অবশ হয়ে পড়ছে যেন।তবুও শেষ চেষ্টা করতেই হবে।ও বারে বারে অনুনয়ের সুরে বলছে-
"আমার এমন সর্বনাশ করবেন না মামাবাবু।আপনি সম্পর্কে মামা হন,আর মামা তো বাবারই সমান।"
সে টোটকাতেও চিড়ে ভিজল না।কাঞ্চন কামের নেশায় জর্জরিত-চরম উত্তপ্ত হয়ে লালামিশ্রিত গলায় বলল-
"কিছু হবেনা পুঁটি...আমার পুঁটি...আয়...আরও কাছে...আজ মনের সব জ্বালা জুড়িয়ে দে!" আরও বেশী জোরে জড়িয়ে ধরে সে পুঁটিকে।
মুহূর্ত যখন চরম বিপদের তখন খাটের পাশে থাকা টেবিলের ওপর থেকে কি একট শক্ত বস্তু যেন পুঁটির হাতে ঠেকল।শরীরের সব শক্তি একত্রিত করে সেই বস্তুটা দিয়ে চরম আঘাত হানে কাঞ্চনের মাথায়।সে খাট থেকে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ক্রমশ।
ভয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেল সে।বেচারি জানতেও পারলনা যে তার ফুলদানির আঘাতে তৎক্ষণাৎ মৃত্যু ঘটেছে কাঞ্চনের।
পুলিশ এসে তদন্ত শুরু করে ও পুঁটির ওপরেই সবার আগে সকলের সন্দেহ যায়।কারণ,ঘটনার পর থেকে সে নিরুদ্দেশ।পরে তদন্তে জানা যায় যে পুঁটিদের বাড়ীর সামনের রেল লাইনে রেলে কেটে মারা গেছে সে!মুণ্ডুহীন দেহের পোশাক দেখে কালুই তাকে সনাক্ত করে।তার অবস্থা শোচনীয়।কেঁদেকেটে একাকার করছে শুধু।
কিন্তু এর পিছনে থাকা প্রকৃত কারণটা ধামাচাপা পড়ে যায় সকলের অগোচরে।সকলে জানে কাঞ্চনকে খুন করে পুঁটি আত্মহত্যা করেছে।এমনকি আসল কারণটা পর্যন্ত খোঁজার দিকে কোন ভ্রূক্ষেপ নেই কারও।
(২)
এরপর সেনগুপ্ত বাড়ী থেকে কালুকে ছাড়িয়ে দিয়ে অন্য কাজের লোক রাখা হয়।কালু হাতে-পায়ে ধরে অনেক কাকুতিমিনতি করে,তবুও মন গলেনি সেনগুপ্ত পরিবারের কোন সদস্যের।যদিও সকলে কাঞ্চনকে হাড়ে হাড়ে চেনে।আসল ঘটনাটা যে কি তা আন্দাজ হয়ত সক্কলেই করতে পারছে।তবুও বাড়ীর সম্মান বাঁচাতে মৌন ব্রতই সঠিক মনে করেছেন তারা।কেবল রাহুল আর রাই কেঁদে বলেছে-
"পু্টি দিদি ভালো...ওকে এনে দাও..."
ভাগ্য ভালো এক বন্ধুরর সহযোগিতায় একটা ভ্যান ভাড়াতে পায় কালু।তাই দিয়েই কোন মতে চলে তাদের দুজনের সংসার।
হঠাৎ একদিন ডলি খুব অসুস্থ্য হয়ে পড়ে।ধুম জ্বর আর জ্বরের ঘোরে প্রায় বেহুঁশ হয়ে বারে বারে বলছে "দিদি!দিদি! বাবা,দিদি আমায় ডাকছে!আমি দিদির কাছে যাব..."
ডাক্তার ডেকে আনা হল।তিনি ওষুধ দিলেন।তবে কিছু খাবার পর তা খাওয়াতে হবে।খালিপেটে একদম নয়।ওর বয়স মাত্র আট বছর।ঘরে দাদাপানি বলতে কিছুই নেই।দোকানে আর বাজারে এত দেনা যে এমন চরম সঙ্কটজনক অবস্থাতেও কেউ সাহায্য করতে রাজী হবে না।
তখন কালু ছুটে গেল মনিব বাড়ীতে।সেনগুপ্ত বাড়ীর বাইরে দাঁড়িয়েই চেঁচাতে লাগল-
"দিদিমণি!একটিবার দয়া করুণ।মেয়েটা আমার না খেতে পেয়ে মরে যাবে!কিছু খাবার দিন..." বলে অঝোরে কাঁদতে থাকে।কিন্তু সেপরিবারের সকলের যেন পাষাণ হৃদয়।মুখের ওপরেই বলে দিল শিউলী-
"তোদের মত ভিখিরিদের এমন হওয়াই উচিৎ!যা,না খেতে পেয়ে মরুক মাগী!বর রস,তাই না!"
এত অপমান সত্ত্বেও বাড়ীত গিয়ে হাতে-পায়ে ধরে কেঁদেছে,তবুও পাথর গলাতে পারেনি এক হতভাগ্য পিতার করুন আর্তনাদ আর অশ্রু।ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিল এবং মুখের ওপর দরজা সপাটে বন্ধ করেদিল তখনই।
এবার বাড়ীর পিছনদিকে রান্না ঘরের পাশে গিয়ে জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে বলল-
"কিছু অন্তত দিন মা ঠাকরুণ।মেয়েটা আমার না খেতে পেয়ে মরে যাবে!"
তখনই একটা হাঁড়ি জানালা দিয়ে বাইরে চলে এল।শোনা গেল-
"এই নাই কালুকাকা,ডলি দিকে খাওয়াও।রাত হয়েছে তো,তাই ভাতে জল দেওয়া হয়ে গেছে।পান্তা করে রেখেছে!"
চমকে উঠল কালু!এতো ছোট দিদিমণি রাই-এর গলা।-"একশ বছর বাঁচুন ছোট দিদিমণি" এই আশীর্বাদ করে কালু হাঁড়িটা নিয়ে বেরিয়ে আসে।কিন্তু গেটের কাছে এসে হোঁচট খেয়ে পড়তেই হাতের অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়িটাও সশব্দে মাটিতে আছাড় খায়।ওদিকে এই আওয়াজে সবাই "চোর! চোর!" করে সেনগুপ্ত বাড়ী থেকে বেরিয়ে পড়েছে ততক্ষণে।
ওদিকে কালু হাঁড়িটাকে কোনমতে তুলে ছুটছে বাড়ীর দিকে।বাড়ী আগে রেললাইন।ওখানে এসে চেঁচাতে লাগল-
"ওরে ডলি মা!এই দ্যাখ্!রাই দিদিমণি তোর জন্য পান্তা পাঠিয়েছে।এবার তুই ওষুধ খেয়ে ঠিক সেরে উঠবি দেখিস!"
(৩)
কালুর কথা শেষ হতে না হতেই রেললাইনের ওপর আবার হোঁচট খেয়ে পড়েছে সে।এবার কিন্তু ও ওঠার আগেই সেনগুপ্ত বাড়ীর লোকজন তাকে ধরে ঘিরে ফেলেছে।মিনিট পনের পর দেখা গেল সাদা পান্তা লাল হয়ে গেছে আর হাত-পা ছড়িয়ে উপুর হয়ে পড়ে আছে কালুর স্পন্দনহীন নিথর রক্তাক্ত দেহটা।কিছু দূরে পড়ে আছে অ্যালুমিনিয়ামের একটা হাঁড়ি।সবাই সরে যেতেই একটা প্যাসেঞ্জার ট্রেন চলে গেল কালুর দেহের ওপর দিয়ে।আর চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে লাল লাল পান্তাভাত!
পরদিন সকালে ডলির মৃতদেহ বের হল কালুর ঘর থেকে।ডাক্তার বললেন,দিন তিনেক কিছু খাওয়া হয়নি বাচ্চাটার...আর পেটে একফোঁটা ওষুধও পড়েনি...
স্বপ্ন
কবিরুল
" শোন সরমা , তোমার এই মেয়ে বংশের কলংক। ও আর পাঁচটা মেয়ের মতন স্বাভাবিক নয়। গুরুজী ঠিকই বলেছিলেন তোমার ছেলে না হয়ে মেয়েই হবে। তখন তোমার এই অলুক্ষণে মেয়েকে আমাদের গর্ভেই বিনাশ করা উচিৎ ছিল। "
একুশ বছর আগে শ্বাশুড়ির ঝাঁঝালো বাক্যবাণ গুলো আজও সরমার মনে আছে। সেদিন থেকেই ঠিক করেছিল নিজের কন্যা সন্তানকে এমনভাবে তৈরী করবে যাতে সে আর পাঁচটা পুরুষের সাথে টেক্কা দিতে পারে।
সরমার জেদের কাছে ওর স্বামী প্রলয় অবশেষে হার মেনেছিল। অত্যাচারও কম করেনি সরমার উপর। সরমাকে প্রতিদিন রাতে মারধোর করত। গালাগাল দিত। সরমা মেয়ের ক্যারিয়ার তার লেখাপড়ার কথা ভেবে মুখ বুজে সব সহ্য করেছে।
যদিও স্বামী অন্য মেয়ের সাথে পরে ঘর সংসার পেতেছিল। সরমা তখন রিম্পাকে নিয়ে অথৈ জলে। একবারে জীবনযুদ্ধে হেরে না গিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই শুরূ করেছিল। মেয়েকে জুগিয়েছিল স্বাধীনভাবে বাঁচার সাহস।
শ্বাশুড়ি বেঁচে নেই। স্বামী অনেক দূরে সরে গেছে। তবে শরীরের কালো দাগগুলো সরমার লড়াইকে আজও কুর্নিশকে করে। মেয়ের ইচ্ছে ছিল বড় আইপিএস অফিসার হবে। সমস্ত অপরাধের মোকাবিলা করবে। উইম্যান ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করবে। কিরণ বেদী ওর আদর্শ। কিন্তু সরমা সব সময় চাইত মেয়ে ডাক্তার হয়ে রুগীদের সেবা করূক। বিনা পয়সাতে গরীব মানুষদের চিকিৎসা করুক।
রিম্পা মায়ের কথা রেখেছে। মেডিসিন নিয়ে পড়াশোনার পরে আইপিএস পরীক্ষায় পাশ করেছে।বিশাল বড় পুলিশ অফিসার হয়ে অনেক নির্যাতিতার পাশে দাঁড়িয়েছে। মেয়েদের নিয়ে কন্যা ভ্রূণ হত্যার বিরুদ্ধে লড়াই করেছে।
এ বছর ওর কাজে খুশী হয়ে নারী দিবসের দিনে কেন্দ্রীয় সরকার রিম্পা ও তার টিম মেম্বারদের পুরষ্কৃত করেছে। সরমা পুরো অনুষ্ঠানটাই টিভিতে দেখেছে। আবেগে চোখ ছলছল করে উঠেছিল। শ্বাশুড়ির কথা মনে পড়ছিল সেদিন। উনি ঐ ভাবে সেদিন তিরষ্কার না করলে রিম্পা এতটা এগোতে পারত না।
করোনা ভাইরাসের তাণ্ডব বাড়তেই রিম্পার বিভিন্ন হসপিটালে দায়িত্ব পড়েছে। ও তো নিজেই একজন ভাক্তার।
একদিন ওর হসপিটালেই এক রোগী করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হল। ভদ্রলোককে খুব যত্ন সহকারে সেবা করেছে রিম্পা ও তার সকল স্টাফ আর নার্সরা। উনি সুস্থ হতেই রিম্পার নাম ঠিকানা , বাবার নাম জানতে চাইলেন। সব শুনে উনার চোখে জল।
প্রলয়বাবু ভাবতেই পারেনি সেদিনের ছোট্ট রিম্পার এত নামডাক হবে।
সামনে বছর হয়ত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ডাকে বিদেশ যাবে। সেমিনারে যোগ দিতে।
একটা লড়াই , একটা কন্যা , একটা নারীর স্বপ্ন যেন পূর্ণতা পেল।
সরমা যেন দেখতে পাচ্ছে একটা প্লেন স্বপ্নের ডানায় ভেসে নীল মেঘের দিকে ছুটে চলেছে।
মানিকতলা (ছোট গল্প)
আব্দুল রাহাজ
গ্রামটির নাম ছিল শালপুর। গ্রামটি ছিল আশেপাশের এলাকা থেকে খুব বড়ো। গ্রামটিতে বসবাস করতেন হিন্দু মুসলিম ধর্মের মানুষ দেখলে মনে হয় সবাই যেন ভাই ভাই এতটাই মেলবন্ধন তাদের মধ্যে আবদ্ধ আছে। গ্রামের ভিতরে এক জায়গায় একটি বড়ো গাছ ছিল গ্রামের লোকেরা সেই গাছের বয়স আজ জানতে পারেনি তবে গ্রামের প্রবীণদের কাছ থেকে শোনা যায় এই গাছটি রাতারাতি জন্মেছিল এটাই ছিল এই গাছের জন্ম বৃত্তান্ত। গ্রামের লোকেরা নাম দিয়েছেন মানিকতলা। বর্তমানে কাজটি বিশাল আকারে অবস্থান করছে। গাছটির ঝুড়ি নেমেছে দেখলে মনে হয় বটগাছটি বছরের পর বছর সেখানে প্রোথিত হয়ে আছে। এই গাছটির পশ্চিম দিকে মাছ চাষ করা বড় বড় পুকুর আর পূর্ব দিকে রাস্তা যেখানে মানুষ প্রতিনিয়ত চলাচল করে রাস্তার পাশে মানুষের জনবসতি মনে হয় সম্প্রীতির বার্তা মেলবন্ধন সবসময় বহন করে আসছে। মানিক গাছের আশেপাশে গাছপালা সারিসারি অবস্থান সবুজায়ন সৃষ্টি করেছেন। গাড়ির আওয়াজ মানুষের দৈনন্দিন কাজকর্ম সব জেনে কাজ প্রতিনিয়ত প্রত্যক্ষ করে যাচ্ছে। কিভাবে রাস্তা দিয়ে হাজার হাজার মানুষের আনাগোনা উৎসব অনুষ্ঠান দেখে গাছ আজ বর্তমান সময়ে এসে প্রবীণ অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু তাকে দেখলে মনে হয় কিন্তু তাকে দেখলে মনে হয় ভরা যৌবন নিয়ে আজীবন কাল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। এখানকার ছোট ছেলেরা যখন তার নিচে খেলা করে তখন সেই ছেলেরা কাজ থেকে দেখেই প্রথমে কি সব ভাবতে থাকে। শতাধিক বর্ষের এই গাছ আজ সবার মনে বিরাজ করে আছে। গ্রামের বৃদ্ধরা গাছের সম্বন্ধে নানা গল্প অপরাহ্ণে নিস্তেজ সূর্যের ছায়ায় ছোট্ট ছেলেদের গল্প শোনাতো এভাবেই মানিক গাছের গল্প ছোট ছেলেরা শান্তভাবে শুনে সন্ধ্যার প্রাক্কালে বাড়ির উদ্দেশ্যে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিতো। একবার একদিন বর্ষা শুধু হল সারাদিন বৃষ্টি তখন গ্রামের মোড়ল খুবই বৃদ্ধ গ্রামের সবাইকে এক ঘরে ডেকে নিয়ে গল্প করতে লাগলেন তার মতে ফকিরচাঁদ বলে উঠলেন দাদু আমাদের মানিকতলা নিয়ে কিছু বলুন তখন শিমুরালি বললেন তবে শোনো তার গল্প। আমরা তখন খুব ছোট আমার বাবা তখন মাঠে কাজ সেরে বাড়ি ফিরেছে আমি তখন খেলা করছি সেই সময় আমাদের গ্রামের একজন বলল ও নদের চাঁদ জানো কাল রাতে গ্রামের পশ্চিম দিকে ওই পুকুর পাড়ে রাতারাতি গাছ জন্মেছে আমার বাবা তাহলে চলো দেখে আসি তারপর সেখানে নিয়ে উপস্থিত হলে দেখা যায় সত্যিই বড় গাছ। তখন গ্রামের লোক বেশি ছিল না সবাই দেখলাম সেখানে উপস্থিত। তারপর থেকে কেউ যেন বলল একটা মানিকজোড় গাছ পেলাম সেখান থেকেই না হল মানিকতলা। এইভাবে দিন যায় দিন আসে বউ পরিবর্তন পালাবদলের পর গাছটি বড় হতে থাকে তারপর দিন টানা দশদিন দিনের বৃষ্টিতে আমাদের গ্রামের অধিকাংশ স্থান জলের তলায় কিন্তু মজার ব্যাপার হলো মানিকগঞ্জ জলের তলায় যায়নি আমরা তো আশ্চর্য হলাম। তারপর থেকেই বাবা মারা যাওয়ার পর সেই দিকে আর যাওয়া হয়নি অনেকদিন পর শুনলাম গ্রামের লোক সেই গাছকে বিশ্বাস করতে লাগলো তারপর থেকে আজ পর্যন্ত সবাই গাছকে কে খুব ভালোবাসে। আমরা তখন সবাই প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছি একসময় সরকারের লোক এসে গাছকে কাটার জন্য সিদ্ধান্ত নিলেন তখন গ্রামের লোক বিক্ষোভে ফেটে পড়লো। সব বাধাকে অতিক্রম করে যখন সরকারি লোকেরা কুঠার দিয়ে গাছের গায়ে মারলো তখন গাছের ছাল উঠলেও পরক্ষণেই অদ্ভুতভাবে ছল করে উঠলো যারা কুঠার চালাচ্ছিল তাদের হাত-পা অবশ হয়ে যাচ্ছিল তা দেখে সবাই অবাক ব্যবস্থা থেকে সরকারি কর্মীরা ভয়ে পালালো। দুই মাস পরে জায়গাটিকে নির্দিষ্ট স্থান হিসেবে স্বীকৃতি দিল সেই গাছের চারপাশে গড়ে তুলল পাচিল তারপর থেকে স্থানটির নাম মানিকতলা নামে চেনা পরিচিত হল সবার কাছে এইভাবে মানিক গাছ আজ পর্যন্ত আমার তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার প্রতিটি পাতা ঝুড়ি শেকর যেন জাদুময় গ্রামের মোড়ল প্রাচীন মানিক গাছের জন্ম বৃত্তান্ত শুরু করে তার আশ্চর্য ক্ষমতা নামকরণ গ্রামের লোকেদের শোনালেন শুনতে শুনতে সকাল হয়ে গেল। এইভাবে গ্রামের প্রাচীন গাছের সম্বন্ধে সবাই জানল। একদিন গ্রামের যুবকরা মিলে এই প্রাচীন গাছকে নিয়ে এক সপ্তাহ ব্যাপী মেলা আয়োজন করেছিল গ্রামের লোক আসত মেলায় আর জেনে যেত গাছের ইতিহাস এইভাবে বছরের পর বছর মেলার মাধ্যমে এই গাছের কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পরল এরপর বহু পালাবদল পরিবর্তনের পর বর্তমান সময়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছে। ঝুড়ি কে দেখলে মনে হয় গাছটির বয়স অতিপ্রাচীন কিন্তু সে যেন জীবনের মত দাঁড়িয়ে আছে আর সেখানকার মানুষের কাছে মানিকতলা নামে খ্যাত আছে যা গ্রামবাসীর কাছে বড় পাওনা। এভাবেই মানিক গাছ প্রকৃতি ও সবার মনের মাঝে বিরাজমান।
আত্মবিশ্বাস
তৃণা মুখার্জী
ওরাও স্বপ্ন দেখে, রোদে, জলে পুরে বাড়ির সব কাজ সেরে মাঠে ছাগল চরাতে গিয়ে একটু শান্তিতে পড়বে। সারাদিন ছোট ছোট হাত-পাগুলো কত কাজ করে।সকালে উঠে ছেঁড়া জুতো-জামা পড়ে, মাঠে যায় ফুটবল খেলতে।কি যে আনন্দ। তারপর গরু ছাগল চরানো। বাড়ির কাজ করে নিজেদের জন্য সময় বের করতে পারেনা ওরা।ওদের কাছে রবি ,নজরুল কি ? নিজের জন্মদিন পালন করাটা স্বপ্নের। আধুনিক উন্নত সমাজে সত্যিই ওরা বেমানান। মোবাইলে গেম নয় ,ওরা মাঠে কাদায় খেলে। সারাদিনের পর বাড়ি থেকে পালিয়ে কোনো এক গাছের তলায় বসে "বল বীর,বল উন্নত মম শির" আওড়ায় ।
Darun...
ReplyDelete