ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস
সোহান ও তার বন্ধুরা
পার্থসারথি
পর্ব-৩
পরের দিন চিনুদার গ্রুপের সবাই ক্লাসে। কেবল চিনুদাই এল না। সোহানও এদের সাথে মিলে গেল। ওরা সবাই একসাথে পাশাপাশি বসেছে।
আসফি, শিবলী ওরা এখনও আসেনি। বইখাতা ক্লাশ রুমে রেখে সোহান ওরা বাইরে এল। ক্লাশ শুরু হতে কম হলেও আরও আধ ঘন্টা বাকি । তারপর ওরা বের হলো স্কুল ঘুরতে।কাহার বিজ্ঞের মতো সোহানকে চারপাশটা দেখাচ্ছে এবং বর্ণনাও দিচ্ছে। বড় মাঠ, পুকুরপাড়, গাছপালা দেখে সোহান বেশ খুশি হলো। স্কুলের উত্তর দিকের বাগান বাড়িটা দেখেতো সোহান অবাক। অবশ্য বাড়িটা স্কুলের অংশ নয়।
গতকালের ঘটনায় মন খারাপ হলেও আজ সোহানের মন বেশ ফুরফুরে। তার কারণ, কাহারদের বন্ধুসুলভ আচরণ।এই কথাটা নিজের মুখ দিয়ে বলেই ফেলল সে।কাহার সান্ত্বনার সুরে বলল- দুটো দিন অপেক্ষা করো। চিনুদা আসলে ওই ছাগলটাকে উচিত শিক্ষা দিয়ে তবে ছাড়বো । একেবারে কড়ায়গণ্ডায় হিসাব তুলে নিবো।'
নাউড়া বলল- ছাগল না, শব্দটা পাগল হবে।'
আরে তুই থামতো! যা স্বভাব ওর। পাগল না, ওটা ছাগলই হবে।' –বেশ জোর গলায় বলল কাহার।
এরমধ্যেই ক্লাসের ঘণ্টা বাজল। ওরা তাড়াতাড়ি করে ক্লাশরুমে ঢুকল। ততক্ষণে আসফিরা চলে এসেছিল ।ওরা রুমেই বসে ছিল।সোহানকে কাহারদের সাথে দেখে আসফি একটু নড়েচড়ে বসল।
সোহানকে শুনিয়ে শুনিয়ে আসফি শিবলীকে বলল- শিবলী শুনেছিস?'
শিবলী আবার গলার জোর একধাপ বাড়িয়ে সবাইকে শুনিয়ে বলল-কি কথা রে?'
কাহার ফিরে তাকায় আসফি ও শিবলীর দিকে। কথাতো নয় যেন ঠোঁটের ওপর হাসির প্রলেপ ঝিকমিকিয়ে ওঠছে প্রতিক্ষণে।
কি বলিস! এখনও জানিস না?' – আশ্চর্য হবার ভান করল আসফি। আর দৃষ্টিটা ফেলল কাহারদের দিকে। নাউড়াও একবার তাকাল।আসফি চোখ ঘুরিয়ে নিল।
শিবলীসহ আরও দু'তিনজন একসঙ্গে চেঁচিয়ে ওঠল- কী খবররে আসফি?'
হঠাৎ করে বাজারে আলুর দাম বেড়ে গেছে। কী হবেরে এখন?'- আসফি নকল দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কাহারদের দিকে তাকাল। কয়েকজনের দৃষ্টি নতুন বন্ধু সোহানের দিকে। বুঝতে বাকী রইল না যে ওরা সোহানকে নিয়ে মশকরা করছে।
শিবলী গলার স্বর এক ডিগ্রী চড়িয়ে বলল- আলুর দাম বেড়ে গেছে? বলিস কী! তা' আলুর দাম বাড়ল কেন?'
আসফি কন্ঠস্বর আরও চড়া করে বলে- ঐ যে দেখছিস না, আলুর গুদাম এসেছে আমাদের এখানে !'
কথাটা শুনে সবাই হো হো শব্দ করে হাসির ঝর্ণা বইয়ে দিল ক্লাশে। হাসতে হাসতে একজন আরেকজনর ওপর গড়িয়ে পড়ছে।থেকে থেকে আবার কাহারদের দিকে তাকাচ্ছে, বিশেষ করে সোহানের দিকে। সোহানের মনটা দুঃখে ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। কান্না কান্না ভাব সারা মুখমণ্ডলে লেপটে আছে। সোহানের ওপর দৃষ্টি পড়তেই নাউড়ার মনটা খারাপ হয়ে গেল। সোহানের ছলছল চোখে তাকিয়েই নাউড়া দৃষ্টি সরিয়ে নিল।
নাউড়া, কাহার, সুজন চোখ গরম করে আসফিদের দিকে তাকাল। কিন্তু ওরা এদিকে আর তাকাচ্ছে না।এ মুহূর্তে ওরা কিছুই বলতে পারছে না। কারণ আসফিরা সরাসরি কিছুই বলছে না। তবুও সুযোগের অপেক্ষায় আছে। কিছুক্ষণ থেমে থেমে আসফিরা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে।
কাহার বিড়বিড় করে বলল- আমি আসফিকে এমন প্যাঁদানি দিমু! সারাজীন মনে রাখবে।' তারপর সোহানকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল- কিছু মনে করো না। ধৈর্য্য ধর। এর প্রতিশোধ আমরা নেব। কত ধানে কত চল ঠিক ঠিক বুঝিয়ে দেব।'
আসফিরা ছড়া কেটে বলতে লাগল-
আলুর বস্তা যায় গুদামে
গুদাম এখন ক্লাশ রুমে।'
একটানা সুরে সুরে ছড়া কেটে যাচ্ছে ওরা। আর একজন অন্যজনের ওপর হেলে-দোলে গড়িয়ে পড়ছে। আবার মাঝে-মধ্যে হাততালি দিচ্ছে। কন্ঠস্বর কেমন যেন বিশ্রী ধরণের করছে। সুরও কতক্ষণ পরপর পরিবর্তন করছে।অঙ্গভঙ্গীর বাহার দেখলে যে কারও গা জ্বালা করবে। যেন যাত্রাপালা চলছে। ভীষণ অসহ্য রকমের যন্ত্রণা। সোহানের চোখ যেন আগুনের মত লাল হয়ে আছে। ঠোঁট জোড়া কাঁপছে। একবার নাউড়ার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকাল। নাউড়া লজ্জায় দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল।
কাহার রাগ সামলে রাখতে পারল না। এক চিৎকারে পুরো ক্লাশ রুম কাঁপিয়ে তুলল- আসফি! বেশি বাড়াবাড়ি হচ্ছে কিন্তু।'
কাহারের এক চিৎকারে ক্লাশ রুমটা অসম্ভব রকমের নীরব হয়ে গেল হঠাৎ করে। কানটা কেমন যেন ঝিনঝিন করে ধরে আছে। সবার দৃষ্টি এখন কাহারের দিকে।কাহার আসফির উদ্দ্যেশে বলল- আবার যদি এই বাজে গানটা গাইবি অসুবিধা হবে।'
আসফি উল্টো চোখ রাঙিয়ে বলল- আমরা গান গাইছি তাতে তোর কী ?'
যদি বাপের বেটা হয়ে থাকিস, আবার গানটা গেয়ে দেখা ! মজা বোঝাচ্ছি।'- এই বলে কাহার বুক টান টান করে দাঁড়ায়।
এবার আসফি সত্যি সত্যি যেন একটু ভয় পেয়ে গেল। কিন্তু পরক্ষণেই আবার গান জুড়ে দিল। কাহার এক লাফে বেঞ্চ ছেড়ে ওদের দিকে তেড়ে যাচ্ছিল এমন সময় নাউড়া দেখতে পেল ক্লাশ টিচার আসছে। কাহারকে টেনে ধরল। তারপর সবাই যার যার জায়গায় চুপচাপ বসে পড়ল।
ক্লাশ শেষেও একই অবস্থা। এবার কাহাররা সবাই একসাথে দলবেঁধে আসফিদের দিকে এগিয়ে যেতেই ওরা গান গাওয়া বন্ধ করে দিল। সোহান ওর নিজের জায়গাতেই চুপচাপ বসে আছে। শুধু অসহায় ও হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
প্রথমে কাহার কথা বলল- এসব কী শুরু করেছিস ?'
আসফি গলা ফুলিয়ে বলল- তাতে তোর কী সমস্যা হয়েছে ? তোকে তো কিছু বলছি না।'
কাহার এবার ক্ষিপ্র কন্ঠে বলল- ওকেও কিছু বলতে পারবি না।'
একশ' বার বলব, হাজার বার বলব তাতে তোর কী ?
ও আমাদের বন্ধু।
শিবলী টিটকিরির সুরে বলে- মাল-পানি পেটে পড়েছে মনে হয়।'
কথাটা শুনে কাহার আর নিজেকে সামলাতে পারল না।শিবলীর শার্টের কলার চেপে ধরল। শিবলীও কাহারের শার্টের কলার চেপে ধরল। আসফিও কাহারকে ধরতে যাচ্ছিল এমন সময় নাউড়া ও সুজন টেনে ধরে বলল- তুই আবার ধরছিস কেন? একজন একজন করে চলুক। একেবারে মজা দেখিয়ে দেব।'
আসফি গলা চড়িয়ে বলল- তাহলে চল মাঠে গিয়ে লাগি।'
প্রতি উত্তরে সুজন বলে- চল, এখনই চল।'
কাহার এবং শিবলীকে সবাই মিলে ছাড়াল। কাহার এখনও রাগে ফোঁস ফোঁস করছে। কারণ বাগে পেয়েও শিবলীকে কিছুই করতে পারল না।
চল, মাঠে চল।'- এই বলে আসফি যেতে উদ্যত হল।
নাউড়া স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলল- এখনতো ক্লাশ আছে। টিফিন পিরিয়ডে হবে।'
সবার মাথা এখন গরম। তাই ক্লাশের কথা কারও খেয়াল ছিল না। নাউড়া বলার পর সবাই একটু শান্ত হল। চলবে...
No comments:
Post a Comment