PravatiPatrika

Thursday, June 4, 2020

পার্থসারথি র ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস সোহান ও তার বন্ধুরা


ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস

 সোহান ও তার বন্ধুরা 
পার্থসারথি

পর্ব-৪

ক্লাশ শেষে টিফিন পিরিয়ডে সবাই মাঠে গিয়ে জড়ো হল।পেছনের বড় মাঠে গেল যা'তে স্যাররা দেখতে না পায়। পুরো ক্লাশের বেশির ভাগ ছাত্রই দুটো ভাগে ভাগ হয়ে গল। এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে সবাই কথা বলছে। কেউ কেউ একবার কাহারদের দিকে আসছে তো আবার আসফিদের দিকে যাচ্ছে। তবে বেশির ভাগ দৃষ্টি সোহানের দিকে। আলাপ আলোচনা করে বিভিন্ন ফন্দি আঁটানো হল কে কার সাথে কীভাবে লড়বে এবং কেমন কেমন কৌশল ব্যবহার করবে। চিনুদার অনুপস্থিততে নাউড়াই এখন বুদ্ধি বাতলে দিচ্ছে। ওর দেয়া পরামর্শ কাহরসহ সবাই পছন্দ করেছে। আসফিরাও পরামর্শ করছে দল বেঁধে। এখানে কেমন যেন একটা উৎসব উৎসব ভাব চলে এসেছে। দু'পক্ষই প্রস্তুত।
ঠিক হল কাহার এবং শিবলীর মধ্যে কুস্তিটা শুরু হবে।অন্য কেউ কাউকে সাহায্য করতে পারবে না। আরও পরামর্শ করার জন্য উভয় পক্ষই পাঁচ মিনিট সময় নিল। পায়ে পায়ে প্যাঁচ দেয়ার কৌশলগুলো প্যাঁচ দিয়ে দিয়ে নাউড়া দেখিয়ে দিল। নাউড়া যখন কৌশলগুলো দেখাচ্ছে তখন সবাই ঘিরে রেখেছিল যা'তে আসফিদের গ্রুপের কেউ আবার দেখে-না-ফেলে।কারণ যদি দেখে ফেলে তাহলে উল্টো ঘায়েল করে ফেলবে। এর মধ্যে নাউড়া একজনকে দায়িত্ব দিয়েছে, পারলে লুকিয়ে-চুকিয়ে ওদের কিছু কৌশল যেন দেখে আসে। হাতের প্যাচঁগুলোও দেখিয়ে দিল। তারপর শরীরটা সময়ে সময়ে কীভাবে বাঁচিয়ে চলবে সেগুলোও দেখিয়ে দিল। নাউড়া কুস্তিগীরের মত দেখাচ্ছে আর সবাই পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে। সবশেষে নাউড়া কাহারের কানে কানে বলল- ‰শিবলীর কাঁতুকুঁতু আছে। যখন দেখবি হেরে যাচ্ছিস তখন খুব সাবধানে ওর বগল তলায় অথবা কোমরের বিশেষ স্থানে চেপে ধরবি।'
কথাটা কাহারের বেশ পছন্দ হয়েছে। খুশীতে গদগদ হয়ে নাউড়াকে জড়িয়ে ধরে ধন্যবাদ জানাল। সুজনসহ আরও কয়েকজন আপত্তি জানাল, বলল- ‰এভাবে তোরা একা একা কানাকানি করছিস কেন। আমাদেরও বলতে হবে।'
সুজন রীতিমত অভিমান করে বসে আছে। নাউড়া বুঝাতে চেষ্টা করল যে, ব্যাপরটা তেমন গোপনীয় নয় তবে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সুজনের এক কথা, সবাইকে জানাতে হবে।
কথাটা জানার পর হাসতে হাসতে একজন আরেকজনের ওপর গড়িয়ে পড়ল। হাসি থামিয়ে নাউড়া কাহারকে বলল- ‰আমার কোমরে ধর তো দেখি, জায়গাটা চিনেছিস কি না।'
কাহার এগিয়ে এসে নাউড়ার কোমরে ধরল। কাহার এক চান্সেই মোক্ষম জায়গায় ধরল। নাউড়ার কাঁতুকঁতু লেগে গেল। হাসতে হাসতে ছাড়িয়ে নাউড়া বলল- ‰বাবারে, একেবারে টার্গেট শ্যুট।' নাউড়ার যে কাঁতুকুঁতু আছে কেউ জানত না। নাউড়ার দিকে তাকিয়ে মিটমিট হাসল।
নির্ধারিত সময় শেষ হতেই দু'পক্ষ এগিয়ে এল। কাউকে বলতে হল না, সবাই গোল হয়ে দাঁড়াল। দু'জন মাঝখানে দু'হাত দূরত্ব রেখে দাঁড়াল। নাউড়া দু'জনের উদ্দ্যেশে বলল- ‰চিমটি দেয়া আর ঘুষি মারা নিষেধ।
দু'জন ঘাড় কা'ত করে সম্মতি জানাল। আসফি রেফারির মত বলল- ‰ওয়ান, টু, থ্রি...স্টার্ট ।' বলার সাথে সাথেই কুস্তি শুরু হয়ে গেল।
সবার দৃষ্টি এখন কুস্তিরত কাহার ও শিবলীর ওপর। সবার মাঝে কেমন একটা টান টান উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। কেউ কেউ মনের অজান্তে ওদের সাথে সাথে নিজেরাও অঙ্গভঙ্গী করছে। ফাঁকে ফাঁকে হাততালি দিয়ে উৎসাহ দিচ্ছে। আবার কেউ কেউ ‰চালিয়ে যা চালিয়ে যা' বলে সাহস দিচ্ছে। কাহার হঠাৎ করে এক ঝাঁকুনি দিয়ে পায়ের প্যাঁচ কষে দিল। শিবলী ধপাস করে মাটিতে পড়ে গেল।সাথে সাথে নাউড়া, সুজন ওদের দলের সবাই হাততালি দিয়ে নেচে ওঠল। কিন্তু শিবলীকে বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারে নি। শিবলী এবার কাহারের বুকে চেপে বসল। কাহার নড়াচড়া করারও শক্তি পাচ্ছে না।
এবার আসফিরা আনন্দে নেচে ওঠল। অনেক ধরণের টিটকারিও মেরে যাচ্ছে। হাসির মহড়া বইয়ে দিচ্ছে। নাউড়া, সুজন ওরা চুপচাপ তবে ভেতরে ভেতরে ওদের ভীষণ রাগ হচ্ছে।কাহার আর উঠতে পারে নি। হার মেনে চুপচাপ চলে এল। কাহারকে সান্ত্বনা দিয়ে নাউড়া বলল- ‰মন খারাপ করিস না। এর বদলা নিয়ে তবে ছাড়ব।'
কাহার কোন কথা বলছে না। লজ্জায় ওর চোখ-মুখ লাল হয়ে আছে। হার মেনে চলে এসেছে ওরা।
সারাটি দিনই নাউড়ার মনটা খারাপ গিয়েছে। পড়ায় মন বসাতে পারছে না। ঘুরে ফিরে শুধু দুপুরের হারের ঘটনাটা চোখে ভেসে ওঠছে। ভাবতে গেলেও নাউড়ার মনটা বারবার খারাপ হয়ে যায়। মনটা কেমন যেন ক্লান্ত হয়ে আসে লজ্জায় আর ক্ষোভে।আগামীকালের কথা ভাবছে নাউড়া। আসফির যন্ত্রণায় ক্লাশে টেকাই যাবে না। যদি  চিনুদা চলে আসে তবে রক্ষা পাওয়া যাবে। এ মুহূর্তে চিনুদার ওপর ভীষণ রাগ হচ্ছে নাউড়ার। না বলে-কয়ে হঠাৎ উধাও। আগের দিন পর্যন্তও কারও কাছে কিছুই বলে নি। হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেল। এ এক বিরাট যন্ত্রণা। সন্ধ্যার পরই বিদ্যুৎটা বেশি যায়। ঠিক সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় পড়ার টেবিলে পড়তে বসেছে। কিন্তু পড়ার পড়া কিছুই হয় নি। বারবার ঐ চিন্তাটা এসে মাথায় চেপে বসে। সেই তখন থেকেই পড়া পড়ছে অথচ কিছুই এগোচ্ছে না। ক্লাশের পড়া যেভাবেই হোক শেষ করতে হবে।স্যারের হাতে মার খাওয়া বা কোনরকম তিরস্কার শোনা নাউড়া একদম সহ্য করতে পারে না। মিনিট পাঁচেক যেতে না-যেতেই মা হারিকেন বাতি জ্বালিয়ে দিয়ে গেলেন। কপালে হাত রেখে মা জিজ্ঞাসা করলেন- ‰কিরে বাবা...তোর শরীর আবার খারাপ-টারাপ হলো নাকি?'
না মা, শরীর আমার ভালো আছে। কিছু হয় নি।
তাহলে অন্ধকারে চুপচাপ বসে আছিস যে?
এমনি মা।উঠতে মন চাচ্ছিল না, তাই।
ঠিক আছে, মনোযোগ দিয়ে পড়।
মা চলে গেলেন। নাউড়া এখন পড়ায় মনোযোগ দিল। মনটা কেমন যেন উড়ুউড়ু করছে। মনটাকে পড়ায় স্থির করার জন্য প্রথমে অংক নিয়ে বসল। দ্বিতীয় অংকটা করতে যাবে এমন সময় চিনুদার সিগনাল কানে এল। ঘড়ির দিকে তাকাল নাউড়া। আটটা বেজে চল্লিশ। বাইরে বেরিয়ে এল। নাউড়াকে দেখে চিনুদা এগিয়ে এল।
চিনুদার গায়ে নতুন শার্ট। চাঁদের আলোয় আলোয় শার্টটা ঝিলিক দিয়ে ওঠল। বেশ লাগছে চিনুদাকে।নাউড়ার হাত চিনুদার শার্টের উপর।হাত বুলাতে বুলাতে বলল- ‰কীরে চিনুদা, নতুন শার্ট মনে হচ্ছে?'
‰হ্যাঁ, নতুন শার্ট।ওসব বাদ দে।তুই আগে ক্লাশের খবরসহ সব খবরাখবর কী বল?'- বেশ উৎসুক হয়ে জানতে চায় চিনুদা।
নাউড়া প্রসঙ্গটা আপাতত আনতে চাচ্ছে না।কারণ চিনুদা ভীষণ রেগে যাবে। তাই প্রসঙ্গ পাল্টে বলল- ‰তুই কখন এলি বল?'
মাত্রই এসেছি। ওসবের কোন দরকার নেই।আগে আসল কথা তাড়াতাড়ি বল।
নাউড়া ঢোক গিলল। না, চিনুদাকে না বলে উপায় নেই। কয়েকবার আমতা আমতা করে তারপর শুরু করল- ‰খবর খুব একটা ভালো না।তোর সাথে কথা বলতে একদম ভালো লাগছে না।'- এই বলে নাউড়া বিরক্তি প্রকাশ করল।
জোছনা রাত। চারদিক একেবারে সবকিছু পরিষ্কার এবং স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মাথার ওপর দিয়ে কয়েকটা চামচিকা উড়াউড়ি করছে।দূর থেকে প্যাঁচার ডাক ভেসে আসছে। আকাশের শাদা মেঘরাশি মৃদু বাতাসের বুকে পা রেখে হেলে দুলে ছুটছে। স্বচ্ছ চাঁদ মাঝে মধ্যে শাদা মেঘরাশির আড়ালে ডুবছে আবার ভাসছে। যেদিকেই তাকানো যায় মনটা উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। কিন্তু নাউড়ার মুখটা কেমন যেন গুমড়া করে আছে। চিনুদা বুঝতে পারে যে, কাউকে না বলে চলে যাওয়াতে এ অভিমান।
নাউড়ার কাঁধের উপর হাত রেখে অতি বিনীত কন্ঠে দুঃখ প্রকাশ করে চিনুদা বলল- ‰সত্যি তোদের না-বলে যাওয়ার জন্য দুঃখিত। আমি নিজেও জানতাম না যে, এভাবে কোথাও যেতে হবে। খুব জরুরী কাজে যেতে হয়েছিল।দেখা করে যে যাব সে সময়টুকু পর্যন্ত পাইনি। খুব সকালে রওনা হয়েছিলাম।'
নাউড়া কোন কথা বলছে না দেখে চিনুদাই আবার শুরু করল- ‰তাই তো এসেই তোর কাছে ছুটে এলাম। এবারের মত ক্ষমা করে দে।'- এই বলে চিনুদা হাত জোড় করে আসামীর মত নাউড়ার সামনে দাঁড়িয়ে রইল। চিনুদার এ অবস্থা দেখে নাউড়ার মায়া লেগে গল। কারণ চিনুদার এমন কিছু নেই যা নাউড়া জানে না। সবাই জানে যে, কাউকে না জানিয়ে সে কখনও কোথাও যায় না। তবুও আহত মনের আহবানে এই অভিমানটুকু প্রকাশ করল নাউড়া। এবার আর চুপ করে থাকতে পারল না নাউড়া। সব ঘটনা খুলে বলল চিনুদাকে। চলবে...



No comments:

Post a Comment