PravatiPatrika

Sunday, June 7, 2020

রবিবারের পাতা

                  সাক্ষাৎকথায় শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
                                প্রশান্ত ভৌমিক  

               কালের নিয়মে সব কিছু পালটে যাবে

(শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, বাংলা শিশু সাহিত্যের মুকুট ছাড়া রাজা। যিনি এক অদ্ভুতুড়ে সিরিজ দিয়ে রঙ্গিন করেছেন বেশ কয়েকটি প্রজন্মের শৈশব। শুধু শিশু-কিশোর কেন! তাবৎ বৃদ্ধরাও তাঁর অদ্ভুতুড়ে পড়ে না হেসে থাকতে পারেন না। শুধু শিশু-কিশোর নয়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় সমানতালে লিখে গেছেন বড়দের জন্যেও। এ পর্যন্ত তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা এক শতাধিক। ডিসেম্বরের এক শীত শীত দুপুরে লেখকের যোধপুর পার্কের বাড়িতে মুখোমুখি হলেন প্রশান্ত  ভৌমিকের।)

প্রশান্ত ভৌমিক: কিশোর উপন্যাস ছাড়াও আপনি বড়দের জন্যেও নানারকম উপন্যাস লিখেছেন, ভালো ভালো উপন্যাস লিখেছেন। লেখাগুলো কালোত্তীর্ণ কিনা সেটা সময়ই বিবেচনা করবে। আপনার মতামত জানতে চাচ্ছি, লেখা গুলো লিখতে লিখতে কী মনে হয়েছে? মানে লিখতে লিখতেই কি কখনো মনে হচ্ছে এই লেখাটা ভালো হচ্ছে? কিংবা এই লেখাটা পাঠক পড়বে?

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়: আমার লেখা সম্পর্কে আমার মতামত জানতে চাওয়ার কোনো মানে হয় না। আমি আমার লেখা নিয়ে খুব একটা ভাবি না। কী হয়েছে লেখাগুলো, কেমন হয়েছে সে সম্পর্কে আমার কোনও ধারণা নেই। কোনো ব্যাখ্যা আমি করতে পারবো না। এইসব ব্যাপারে আমি খুব অসহায়। নিজের লেখা সম্পর্কে কিচ্ছু , কোনো রকমের বিশ্লেষণ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কী হয়েছে না হয়েছে, ভালো কী মন্দ- এসব ব্যাপারে আমার ধারণা খুব ধোঁয়াটে। ফলে এ ব্যাপারে আমি তোমাকে কোনো সহায়তা করতে পারবো না।

প্রশান্ত ভৌমিক: আমি জানতে চেয়েছিলাম লেখাগুলো লেখার পরে আপনার অনুভূতি সম্পর্কে।

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়:  র্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়: অনুভূতি!.... যন্ত্রণারই অনুভূতি। কেননা একটা লেখা শেষ করার পর রিলিফের অনুভূতি হয়তো পাই। কারণ লেখাটা কষ্টকর। শারীরিক কষ্ট, মানসিক কষ্ট। লিখতে গেলে প্রচুর পরিশ্রম হয়। তারপর ধর, ভাবনা- চিন্তা করতে হয়, মাথা খাটাতে হয়। সবকিছু মিলিয়ে যে সুখকর অভিজ্ঞতা তা কিন্তু নয়। এটা খুব যন্ত্রণার অভিজ্ঞতা। তবুও লিখতে হয় বলে লিখি। তাগিদ থেকে লিখি।

প্রশান্ত ভৌমিক: আপনি বললেন- তাগিদ থেকে লিখি। সেই তাগিদ সম্পর্কে যদি বলেন। জানি, আপনার ওপর বিভিন্ন পত্রিকার, বিভিন্ন পুজো সংখ্যায় লেখার অনেক চাপ থাকে। সেসব বাদ দিয়ে নিজের ভেতরের তাগিদের কথা বলুন।

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়: প্রথম যখন লিখতে শুরু করি, তখন নিজের ভেতর খুব তাগিদ ছিলো। আত্মপ্রকাশের একটা বাসনা ছিলো। আস্তে আস্তে সেটা স্তিমিত হয়ে গেছে। এখন কতগুলো আছে কর্তব্য। যেমন- আমরা চাকরি ভালোবেসে করি না, কর্তব্য ভেবে করি। লেখাটা ভালোবাসি না তা নয়, কিন্তু লেখার পরিশ্রমটা এখন সহ্য হয় না। প্রচণ্ড ভাবতে হয় লেখা নয়ে, খাটতে হয়। অশান্তি থাকে, সময়মতো শেষ করতে পারবো কিনা। ফলে নানারকম মিলিয়ে মিশিয়ে অভিজ্ঞতাটা খুব সুখকর হয় না। খুব একটা আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা হয় না। কিন্তু লিখতে হয় বলে লিখি।

প্রশান্ত ভৌমিক: আপনি তো এখনকার কথা বলছেন, লেখাটা অনেক যন্ত্রনার হয়ে গেছে। শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রমের কথা বলছেন। শুরুর দিকটা সম্পর্কে একটু খোলাখুলি বলুন।

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়: উৎসাহ ছিলো, উদ্দীপনা ছিলো। নিজেকে প্রকাশ করার একটা বাসনা ছিলো, তীব্র বাসনা ছিলো। ফলত আমরা নানারকম নীরিক্ষা করতাম। গড়তাম, ভাঙ্গতাম। এখনও যে করিনা এমন নয়, এখনও করি। সবসময় নতুন পথ খুঁজি, অভিব্যক্তি খুঁজি, নতুন ভাষা খুঁজি, শব্দ খুঁজি। নীরিক্ষা আমি এখনো করি। আর করি বলেই পরিশ্রমটা বেশি করতে হয়। পরিশ্রম বেশি করি বলেই আমার ক্লান্তিটা চট করে আসে। এই হচ্ছে ব্যাপার। তবে তাগিদ একটা থাকে। আগের মতো হয়তো নয়, কিন্তু আছে। হয়তো নতুন কিছু একটা ভাবলাম সেটা প্রকাশ করার একটা তাগিদ আসে। সবসময় নতুন ভাবনা আসে এমন নয়। হয়তো নতুন আইডিয়া একটা আসে, সেটাকেই আঁকড়ে ধরে প্রকাশ করার চেষ্টা করি।

প্রশান্ত ভৌমিক: একজন লেখককে অবশ্যই খুব ভালো পাঠক হতে হয়। আপনার কাছে জানতে চাইবো, আপনার প্রিয় লেখক কারা? কাদের বই দিয়ে বই পড়া শুরু করেছিলেন? এক কথায় আপনার অভিজ্ঞতা জানতে চাচ্ছি।

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়: পড়তে তো হবেই। না পড়ে কী করে লেখা যাবে? বঙ্কিম থেকে শুরু করে মাইকেল মধুসূদন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, সতীনাথ ভাদুড়ি, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বাবু, তারাশঙ্কর সহ সবই পড়েছি। কে নয়? অনেক লেখকের লেখাই পড়েছি। আর বিদেশি লেখা তো প্রচুর। দস্তয়ভস্কি আবার সবচেয়ে প্রিয় লেখক। দস্তয়ভস্কি, টলস্টয়, তারপর- কাফকা, কামু, ডিকেন্স। কে নয়!


              ধারাবাহিক নেপোদাদুর গপ্পো
                      রাজকুমার ঘোষ

                            ষষ্ঠ পর্ব

                     নেপোদাদুর বিয়ে


বন্ধু পানুখুড়োর উৎসাহে নেপোদাদুর দিন দিন ঠাঁটবাঁট বেড়ে গেলো। তার সাজের বহর দেখেই পাড়ার সব্বার অজ্ঞান হওয়ার জোগাড়। নেপোদাদুর একসময়ের বন্ধু তিনকড়ি একদিন বলেই ফেললো,

-        নেপো, ভালোই পানুকে পটিয়ে সাবাড় করছিস ভাই। একটু দেখ, আমাদের দিকে, ভুলে যাচ্ছিস যে আমাদের।

-        বেশ করেছি বে, একদম হিংসে করবি ন, বলে দিলাম তিনু… আমাকে দেখে তোর এতো ফাটছে কেন রে? চল, ফোট এখান থেকে… যখন বাংলু পার্টি হবে, ডাকবো… তখন আসবি। 

তিনু ভয়ে পালিয়ে যায়।

এদিকে, নেপোদাদুর স্টাইল বেড়েছে অন্যকারণে, সেটা তো আর জানে না বন্ধুরা। একমাত্র তার পেয়ারের বন্ধু পানুখুড়োই জানতেম। পাশের পাড়ায় ঘুটে বিক্রি করতে গিয়ে এক কাস্টমারের বাড়ির এক অবিবাহিতা মাঝ বয়স্কা মহিলার সাথে নেপোদাদুর মন দেওয়া নেওয়ার ব্যাপার শুরু হয়েছে।

পানুখুড়োই তো নেপোদাদুকে ‘লাগে রহো, আমি আছি দোস্ত” বলে সাহস জুগিয়েছেন। নেপোদাদু টাক মাথার অল্প চুলে শ্যাম্পু করে, গায়ে দামী পারফিউম মেখে, হাতে একটা ঘড়ি লাগিয়েছে, তাও পানুখুড়োকে পটিয়ে পেয়েছে ঘড়িটা। তাছাড়া বাংলাদেশ থেকে আনা রঙ বেরঙের লুঙ্গি, সাথে রঙীন জামা সবই পানুখুড়োর সৌজন্যে পেয়েছেন। এত্তসব স্টাইল করে নেপোদাদু প্রতিদিন যেতেন তার মনের ভেতরে থাকা পাখিকে একটু উড়িয়ে আনতে। সেই দাদু, যে কিনা শুধুমাত্র কিপ্টেমির জন্য আজীবন আইবুড়ো কার্তিক হওয়ার পণ করেছিলেন।

যথারীতি ভ্যালেনটাইনের দিন কাছাকাছি চলে এলো। পানুখুড়ো একদিন, ইংলিশ দারুর পার্টিতে নেপোদাদুকে সুপরামর্শ দিলো,

-        এই নেপো, আমি বলি কি, তোমার মাত্র পঞ্চান্ন বয়স, এখনো তোমার গ্লামার যা আছে, কেউ বলবে না তুমি পঞ্চান্ন। তুমি বিয়ে করে নাও সেই মহিলাকে… বয়স কত হবে তার?

-        এই কিযে বলো, মনে মনে একটু ইয়ে করি, তা বলে বিয়ে? ধ্যাৎ বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে।

-        কিচ্ছু বাড়াবাড়ি না দোস্ত, আমি ভেবে চিন্তেই বলছি। কত বয়স হবে বলো?

-        এই ধরো, ৪৫ থেকে ৫০ এর মধ্যে হবে। 

-        ব্যাস, আর কি? নো চিন্তা। বিয়ে করো, আমি আছি তো।

-        মানে?

-        আরে দাঁড়িয়ে থেকে তোমাদের বিয়ে দেবো।

-        আরে ধুর, কি যে বলো, এই ঘুটে বেচে সংসার। তারপর বাড়ি ঘরের অবস্থাও ভালো নয়। ভঙ্গুর।

-        তাহলে আমি তোমার বন্ধু কেন হলাম নেপো… আমার বাড়ি কি তোমার নয়? আর তোমার বাড়ির মেরামত আমি করিয়ে দিচ্ছি, এতো চিন্তা করো না তো… রাজি হয়ে যাও।

নেপোদাদু দারুর ঘোরে থাকলেও বেশ কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে পানুখুড়োকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে বলে,

-        এই না হলে আমার সাচ্চা দোস্ত। এই তোমার জন্যই আমি এতো কিছু করার সাহস পাচ্ছি, আবার বিয়ে করতে বলছো! চলো আমি রাজি।

-        আরে শোনো, সামনেই ভ্যালেনটাইন দিবস। ঐদিন হাতে একটা ফুলের তোড়া নিয়ে যাবে, ওটা কিনতে পারবে তো নাকি

-        হ্যাঁ হ্যাঁ তা পারবো

-        আমি একটা গিফট  কেনার ব্যবস্থা করছি, ভ্যালেনটাইনের দিন তুমি ফুলের  তোড়া আর গিফটটা নিয়ে ঐ মহিলাকে তোমার মনের কথা বলে ফেলো।

নেপোদাদুর কাছে প্রস্তাবটা মনের মত হয়েছে। সেদিন রাতে তার আর ঘুম হলো না। নেপোদাদু সদ্য তার মনে ঢোকা নেপো ঠাম্মার জন্য বিভোর… দিন রাত সেই ঠাম্মার কথা ভাবতে থাকেন আর ভ্যালেনটাইন দিনের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকেন কি ভাবে ঠাম্মাকে তার মনের কথা বলবে। নেপোদাদু পানুখুড়োকে আবদার করেন যে ঐদিন তার সাথে তাকেও যেতে হবে। পানুখুড়ো নাছোড়বান্দা নেপোদাদুর সাথে যাবেন বলে রাজি হলেন। সবকিছু শিখিয়ে দিলেন নেপোদাদুকে, কিভাবে বিয়ের প্রস্তাব দেবে।

যথারীতি, ১৪ই ফেব্রুয়ারীর দিন চলে এলো, নেপোদাদু দারুণ সাজুগুজু করে পানুখুড়োকে সাথে নিয়ে গেলেন ঠাম্মার বাড়ি। ঠাম্মার বাড়ি গিয়ে নেপোদাদু ঠাম্মার সামনে নত মস্তকে হাঁটু মুড়ে বসে বাড়ির সকলের সামনে বলেই ফেললেন,     

-        আমি আপনার জন্য এইগুলো নিয়ে এসেছি, আজ ভালেনটাইনের দিন, আপনি কি আমার এই উপহার গ্রহণ করবেন। আর আগামীদিন গুলোতে আপনাকে সাথে নিয়ে নতুন করে ঘর বাঁধতে চাই। আমি কি আশা করতে পারি আপনার জন্য

পানুখুড়োর ভীষণ হাসি পেয়ে গেলো, নেপোদাদুকে এই ভঙ্গিমাতে প্রেম নিবেদন করতে দেখে কিন্তু নিজেকে সামলে নিলেন তিনি। বললেন,

-        দেখুন, আমি ওর বন্ধু। আমি জানি আমার বন্ধু নেপোকে… আপনি স্বচ্ছন্দে রাজি হয়ে যান। ওর মত পাত্র হবে না। ও ভীষন সরল মানুষ।

ঠাম্মাতো লজ্জ্বায় মাথা নত করে সেখান থেকে দৌড়ে ঘরে ঢুকে গেলেন। নেপোদাদু হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে রইলেন আর পানুখুড়োর দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন।

ঠাম্মির বাড়ির লোকেরাও এই প্রস্তাব শুনে আশ্চর্য্ হয়ে গেলেন। তারা ভাবতেও পারেনি এইরকম একটা প্রস্তাব দুম করে চলে আসবে।

পানুখুড়ো একটু আস্বস্ত করলেন সকলকে,

-         আপনারা অবশ্যই ভাবুন, সময় নিন।

হঠাৎ ঠাম্মি ঘর থেকে বেড়িয়ে এলেন। লজ্জ্বায় মাথা নত করে জানালেন, “আমি রাজি”। বলেই আবার সেখান থেকে তাড়াতাড়ি চলে গেলেন।

নেপোদাদু পাগলের মত চিৎকার করে পানুখুড়োকে জড়িয়ে ধরে “হুররে” বলে চিৎকার করতে লাগলেন। বাড়ির সবাই এই পাগলামি দেখে এবার হাসতে লাগলো।

এরপর দিন দেখে, সময় দেখে নেপোদাদুর বিয়ে দিলেন পানুখুড়ো। যথারীতি বন্ধু দরদী পানুখুড়োই সবকিছু খসালেন নেপোদাদুর জন্য। নেপোদাদু নতুন ঠাম্মা পেয়ে আহ্লাদে আটখানা। পানুখুড়োকেও নেপোদাদু ভীষন ভালোবাসেন এবং কৃতজ্ঞতা জানাতেও ভোলেন না।

-        বন্ধু পানু, তোমার জন্য আমার এই জীবনটা অন্যরকম হয়ে গেলো। তোমার ঋণ আমি  সারাজীবনেও শোধ করতে পারবো না।

-        নেপো, আমি তো সংসার করতে পারিনি। তোমার সংসার সাজাতে পেরেছি এতেই আমার আনন্দ। তোমরা সুখে থেকো। আমি সর্বদা আছি তোমাদের পাশে। আমাকে একটু ভালোবেসো, সাথে থেকো। আর কিছু চাইনা।

-        বন্ধু পানুর জন্য আমার জান কুরবান

-        থাক, তোমার জান এখন তোমার বৌ… তুমি আগে তাকে সামলাও, তারপর আমি আছি।

নেপোদাদু আবারও আনন্দে ‘হুররে’ বলে পানুখুড়োকে জড়িয়ে ধরলেন।




                              সপ্তম পর্ব
                      নেপোদাদুর শরীরচর্চা

বুড়ো বয়সে নেপোদাদু বিয়ে করলেন। এতো সাংঘাতিক ব্যাপার। নেপোর ছোটবেলার সেই দারু খাওয়া বন্ধুরা নিমন্ত্রিত ছিল বিয়েতে। পানুখুড়োর সৌজন্যে বিরাট আয়োজনে তারা খুবই অবাক। নেপোদাদুকে হিংসে করতে লাগলো। নেপোদাদুর গিন্নী হিসেবে যিনি এসেছেন, তিনিও বেশ বুদ্ধিমতি এবং সেই নেপো ঠাম্মার গ্লামার দেখে সবাই চমকে গেছে বলা যেতে পারে। নেপোদাদুকে টিটকিরি করে তিনকড়ি একদিন বললো,

-        কি নেপো, এই বুড়ো বয়সে তো ভালোই খেল দেখালে। পানুখুড়োকে হাত করলে, তারপর  ভালো দেখে একটা গিন্নীও  জুটিয়ে ফেললে। তা আমার একটু হিল্লে করো। আমার বৌ’টা কবে মারা গেছে। একটা শালী থাকলে তো বলো।

-        এই হতভাগা, একদম ফালতু কথা বলবি না... বেরো এখান থেকে... আমার ভাগ্যে ছিলো তাই জুটেছে। তোর এতো ফাটছে কেন?

তিনকড়ি বেগতিক দেখে সেখান থেকে পালিয়ে গেলো। এদিকে নেপোদাদু’র বাড়ির দশা ভালো না। পানুখুড়ো কথা দিয়েছিল যে বাড়ির মেরামত করবে। একদিন পানুখুড়োকে বললেন নেপোদাদু,

-        তুমি তো বললে, বিয়ে করে নিতে, আমি করে ফেললাম। এরপর? বাড়িতে বৌ’কে নিয়ে থাকবো। ঘরগুলো একটু মেরামত করতে হবে তো! থাকবো কোথায়?

-        আমার সব মনে আছে নেপো, আমি সব ব্যবস্থা করে রেখেছি। এই মিস্ত্রি আসবে সপ্তাহ খানেক বাদে। একটা কাজ করো, তুমি দরকারী কিছু জিনিস নিয়ে আমার বাড়ি চলো, নতুন বৌ’কে নিয়ে কিছুদিন আমার কাছে থাকো। আমার বড় বাড়িতে তোমার থাকা-খাওয়ার অসুবিধা হবে না আশাকরি।

-        কি যে বলো দোস্ত... তুমি থাকতে আমার অসুবিধা ! হাসালে...

নেপোদাদু ভীষণ মাত্রায় খুশি। গিন্নীকে ডাকলেন,

-        কই গো গিন্নী, পানু এসেছে, চা এর ব্যবস্থা করো। আমরা কাল থেকেই ওর বাড়িতে থাকবো।

নেপোদাদু গিন্নীকে নিয়ে পরের দিনেই পানুখুড়োর অট্টালিকায় চলে গেলেন। পানুখুড়ো নেপোগিন্নীকে সংসারের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে বললেন,

-        বৌদি, নিজের মত করে এই বাড়িতে থাকুন। কোনো অসুবিধা হলে বলবেন।

পানুখুড়োর বাড়ির আশেপাশে কিছু প্রতিবেশী ছিল, যারা পানুখুড়োকে ভীষণ হিংসা করতো। প্রায়ই পানুখুড়োকে বিভিন্ন ভাবে বিরক্ত করতো। বাড়িতে এখন নতুন লোক এসেছে, সেই আগ্রহ নিয়ে তারা সবাই দেখে চোখ বড় বড় করে। তাদের বেশ ভয় এই নেপোদাদুকে নিয়ে। আগেই বলেছিলাম, নেপোদাদুর বেশ প্রভাব আছে এই পাড়ায়। নেপোদাদুর বৌ বাড়ির ছাদে যায় জামা কাপড়  শুকোতে। পাশের বাড়ির এক ছোকরা নেপোদাদুর বৌ’কে দেখে। বেশ কিছু শরীর চর্চার সারঞ্জম  নিয়ে ব্যায়াম করে। আর মাঝে মাঝে মুখ দিয়ে আওয়াজ বের করে। ইশারা এবং কু-ইঙ্গিত করে। নেপোদাদু সব খেয়াল রেখেছে। তাকে দেখে নেপোদাদুরও ইচ্ছা হলো, প্রতিদিন শরীর চর্চা করবেন। সেই অনুযায়ী নেপোদাদু দুটো ডাম্বেল জোগাড় করলেন। তারপর একটা গেঞ্জী আর ট্র্যাকস্যুট পটিয়ে আদায় করলেন পানুখুড়োর থেকে। আর ঠিক যখন ঐ ছোকরা ব্যায়াম করতো ছাদে, সেই সময়ই নেপোদাদু ডন-বৈঠক করতেন। ট্র্যাকস্যুট ও গেঞ্জী পরে জগিং করতেন। নেপোদাদুর স্পেশ্যাল ভুড়িও সেই সময় জগিং করতো। নেপোদাদু’র লাফানোর সাথে সাথে ভুড়িও লাফালাফি করতো। আশেপাশের বাড়ির লোকেরা ছাদে উঠে এই সুন্দর দৃশ্য উপভোগ করতো এবং হাসতো। পানুখুড়োকে এই নিয়ে বললেন –

-        ভাই পানু, এই বয়সে যখন বিয়ে করেছি, একটু শরীরচর্চা করতে হয়, কি বলো? নতুন বৌ এর কাছে একটু হিরো হতে হবে তো নাকি?

-        হ্যাঁ, সেতো ঠিকই। তুমি চালিয়ে যাও... অসুবিধা হলে আমাকে বলো।

-        তোমার কোনো অসুবিধা নেই তো?

-        কিসের অসুবিধা আবার, শুনেছি পাশের বাড়ির ছোকরাটা কি যেন নাম

-        রোমি?

-        হ্যাঁ, রোমি কি হোমি যাই হোক, শুনলাম তোমায় নাকি খুব বিরক্ত করে। এছাড়াও আর এক প্রতিবেশী পাবলিক আছে, নাম নরহরি, সেও নাকি তোমাকে ভীষণ জ্বালায়।

-        তুমি কি করে জানলে? তুমি এইসব ভেবো না। নতুন বিয়ে করেছো, বৌদিকে সময় দাও। আমি সব ম্যানেজ করে নেবো।

-        হ্যাঁ, তুমি কত ম্যানেজ করো জানিতো। আমি যতদিন আছি, এইসব নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না। আমি এমনি এমনি শরীর চর্চা করছি না গো পানু। এখনো আমার নামে কাঁপে সারা পাড়া...

-        আরে ঠিক আছে নেপো, মাথা গরম করো না।

নেপোদাদু ঠিক করে নিলেন, এই আশে পাশের এঁটুলি মার্কা পাবলিকগুলোকে শায়েস্তা করবে। 

চলবে...



ভ্রমণ: "বাঁকুড়া ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের কিছু বিখ্যাত স্থান ভ্রমণ"
                   ----টুম্পা মুখার্জী

চতুর্থ দিন

চতুর্থ দিন সকালে উঠে তল্পিতল্পা গুটিয়ে গাড়িতে উঠলাম। আমাদের বিদায় জানাতে গিয়ে আমাদের মাড হাউজের গৃহকর্ত্রীর চোখ দুটো ভিজে উঠল। সাথে আমারও ।

এবার আমাদের গন্তব্য বিষ্ণুপুর। মন্দির নগরী বিষ্ণুপুর।এর প্রতিটি ধুলোমাটি ইতিহাসের সাক্ষী বহন করে চলেছে। প্রথমে আমরা গেলাম রাসমঞ্চে। সেখান থেকে টিকিট কাটলাম এবং গাইডও সঙ্গে নিলাম। আমাদের গাইড এবং গাইড বুকের মাধ্যমে জানতে পারলাম বিষ্ণুপুর আগে 'বনবিষ্ণুপুর ' নামে খ‍্যাত ছিল। এই বনবিষ্ণুপুর ছিল প্রাচীন মল্লভূম রাজ‍্যের রাজধানী । মল্ল রাজারা খ্রিস্টীয় সপ্তম শতক থেকে বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ পর্যন্ত রাজত্ব করে গেছেন। কিংবদন্তী অনুসারে খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে বৃন্দাবনের নিকটবর্তী জয়নগর রাজ‍্যের রাজ‍্যচ‍্যুত রাজা সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে নিয়ে পুরীধামের দিকে যাত্রা করেন। পথে কোতলপুরের কাছে লাউগ্ৰামে রাণী এক পুত্রসন্তান প্রসব করেন। এই অবস্থায় রাজা স্ত্রী ও সন্তানকে পঞ্চানন নামে এক ব্রাহ্মণের বাড়িতে রেখে একাই তীর্থ যাত্রা করেন।এই শিশু গরীব ব্রাহ্মণের বাড়িতে বড় হতে লাগল। একদিন ব্রাহ্মণ এক আশ্চর্য দৃশ্য দেখতে পেলেন, গরু চড়াতে চড়াতে ছেলেটি ক্লান্ত হয়ে মাঠের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে এবং তার মাথার কাছে এক বিরাট সাপ ফণা বিস্তার করে রোদকে আড়াল করে আছে। পঞ্চানন বুঝলেন ছেলেটি রাজ লক্ষণ যুক্ত। তখন তিনি বালকের জন্য অস্ত্রবিদ‍্যা ও শাস্ত্রবিদ‍্যার ব‍্যবস্থা করলেন।মাত্র ১৫ বছর বয়সে সেই বালক এক দক্ষ মল্লবীর হয়ে উঠল। স্থানীয় রাজা তাকে ' মল্ল' উপাধিতে ভূষিত করলেন। কথিত আছে ওই রাজার অনুরোধেই তিনি রাজ সিংহাসনে বসেন। পরবর্তীকালে ওই বালকই 'আদিমল্ল' বা 'রঘুনাথ' নামে বিখ্যাত হয়ে ওঠে। আদিমল্লের রাজধানী ছিল প্রদ‍্যুম্নপুরে ( জয়পুরের কাছাকাছি) । মল্লরাজ জগৎমল্ল পরবর্তীকালে বিষ্ণুপুরে তার রাজধানী স্থানান্তরিত করেন।
আমাদের দেখা বিষ্ণুপুরের অন‍্যতম প্রধান কয়েকটি দর্শনীয় স্থান----

১. রাসমঞ্চ

মল্লরাজ বীরহাম্বি আনুমানিক ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে মঞ্চটি প্রতিষ্ঠা করেন।এর নীচের বেদী 'মাক্ ড়া'
 পাথরের তৈরী আর উপরের স্থাপত্য ইঁটের । এই মঞ্চে ১০৮ টি দ্বার আছে। ১৬০০ খ্রি: থেকে ১৯৩২ খ্রি: পর্যন্ত এখানে নিয়মিত রাস উৎসব হত। মঞ্চের স্থাপত্য শৈলী বিস্ময়ের উদ্রেক করে।

২.শ‍্যামরায় মন্দির ( পাঁচ চূড়া)

১৬৪৩ খ্রিস্টাব্দে মল্লরাজ রঘুনাথ সিংহ এই মন্দিরটি নির্মাণ করেন । ইঁটের তৈরি এই মন্দিরের গায়ে অপূর্ব টেরাকোটার কাজ। পাঁচচূড়া বিশিষ্ট এই মন্দিরের বাইরের ও ভিতরের দেওয়ালে রাসলীলা, ফুলকারি কাজ ও রামায়ণ মহাভারতের দৃশ্য দেখা যায়।

৩.গুমঘর

মল্লরাজ বীরসিংহ সপ্তদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে এটি তৈরি করেছেন। অনেকের ধারণা এখানে অপরাধীদের শাস্তি দেওয়া হত।। কারোর মতে এটি মল্লরাজাদের শস‍্যাগার। তবে ঐতিহাসিকদের মতে এটি ছিল রাজবাড়ীর জলের ট‍্যাঙ্ক । কারণ এটির পাশে পোড়া মাটির পাইপও
পাওয়া গেছে। এই মতটিরই প্রাধান্য বেশি।

৪. মৃন্ময়ী মন্দির

মল্লরাজ জগৎমল্ল ৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে দেবীর আদেশ পেয়ে মন্দির ও মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। মূর্তিটি গঙ্গামাটির তৈরি। দুর্গোৎসবের সময় পনের দিন ধরে পটে পূজা হয়। মল্লরাজাদের সময় থেকে এখনও পর্যন্ত একই মূর্তিতে মৃন্ময়ী মায়ের পূজা করা হয় তোপধ্বনি করে। রাজবাড়ীর একজন সদস্য এবং বাইরের একজন ব‍্যক্তি একই স্বপ্নাদেশ পেলে তবেই মূর্তির অঙ্গরাগ করা হয়। সেটা ১০ বছর বা ২০ বছর পরেও হতে পারে । মন্দিরের পিছনেই রয়েছে রাজবাড়ীর ধ্বংসাবশেষ।

 
           
                           নদী কথায় ভেসে যায় .....
                            তীর্থঙ্কর সুমিত


কথার সাথে সাথে কথারা বদলে যায়।দুপুরের রোদ গায়ে মেখে ভোরের কাকটা
বাড়ি ফেরে ক্লান্ত হয়ে।ঘরের সাথে সাথে  ঘর বদলে যায়।নতুন নতুন মুখ খুঁজে ফেরে চিরনতুনের সন্ধানে।গল্প কথায় সাজিয়ে নেয় তথ্য।আর ফিরে আসে কিছু অবাধ্য যন্ত্রণা।যেখানে জন্ম হয় এক একটা কবির।আবার ফিরে পাওয়া মুহূর্তে নদী কথায় ফিরে আসে প্রতিদিনের বেঁচে থাকার মানে।যে নদী স্রোত হারিয়েছে সে নদীর গভীরে যেওনা ...


                      গ্যাংটক এর দিনগুলো 
                            রাজু মন্ডল

ছয় হাজার তিনশো ফুট উপরে পুরু বরফের আস্তরণে পা ডুবে গেল। চারিদিকে বরফ ধু ধু  করছে । শীত করলেও আমরা তখন বরফের উপর রীতিমত আনন্দ নৃত্য করছি , হঠাৎ কালো মেঘ গুলো এসে থমকে দাঁড়ালো সামনে। দরজা খোলার মত মেঘগুলোকে সরিয়ে দিলাম কখনো বা সেগুলো নিয়ে ছোড়াছুড়ি খেলায় মেতে গেলাম। একটু পরেই এই প্রত্যাশিত আনন্দে তুষারপাত এসে আমাদের ডবল মজা পরার সুযোগ দিয়ে গেল। গুড়ো গুড়ো শুষ্ক বরফে আমাদের শরীর ঢাকতে শুরু করলো- আমরা তখন এক অন্য জগতে।
এই সৌন্দর্য রাজ্যে যেভাবে আমরা পদার্পণ করেছিলাম তার কিছু স্মৃতি কথা ব্যক্ত করছি-
মার্চ মাসের প্রথম দিকে নানা প্লানিং করে বেরিয়ে পড়লাম কাটোয়ার উদ্দেশ্যে । গন্তব্য সিকিমের রাজধানী গ্যাংটক। ৫-৬ দিনের মতো প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ব্যাগে ভরে আমরা হাজির হলাম স্টেশনে।বিকেল ৪ টা ৫০ মিনিটে তিস্তা তোর্সা এক্সপ্রেস, তারই অপেক্ষায় আমরা । এই ভ্রমণের সঙ্গী বলতে রাহুল ,কিশোর, বিজয়, নীলেশ এবং আমি । আমরা সবাই বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় সেমিস্টারের ছাত্র। ট্রেন আসতে ১৫ মিনিট লেট করেছে তাই পাঁচটা -পাঁচ মিনিটে আমরা A-6 কামরাতে স্লিপার এ নিজেদের স্থান দখল করলাম। ব্যাগ পত্র গুলো টেনেহিঁচড়ে সুবিধামতো জায়গায় রেখে শরীরটা এলিয়ে দিলাম ট্রেনের সিটে। ট্রেন চলতে শুরু করল। কিছুক্ষণ পর পেটে টান পড়ল। ট্রেনেই প্রতিদিনের অভ্যাস মত চায়ের আড্ডা জমে উঠলো,তবে আজকের আড্ডার বিষয় গ্যাংটক ঘোরার সময় নির্ণয়। এর মধ্যেই নীলেশ তার ব্যাগ থেকে কেকের প্যাকেটটা খুলে সামনে নিয়ে এসেছে সৌজন্যবশত এক টুকরো তুলে নিলাম এবং গল্পে ডুবে গেলাম । কিছুক্ষন অবাস্তব আলোচনা শেষের পর আমাদের চোখে পড়ল ফারাক্কা ব্যারেজের দিকে। প্রত্যক্ষ ফারাক্কার দৃশ্য কে স্মৃতিতে ধরে রাখা ছাড়াও ক্যামেরাবন্দি করে ফেললাম। সঙ্গে কিছু সেলফি তুলে হোয়াটসঅ্যাপে স্ট্যাটাসের ঝড় বইয়ে দিলাম ।সামান্য কিছু জলযোগ শেষ করে নিজেদের মতো ব্যস্ত হয়ে পড়লাম স্মার্ট ফোনের স্ক্রিনে। সময় তখন ১০:০৫ ,ট্রেন এসে দাঁড়ালো মালদা টাউন স্টেশনে । সেখানে আমরা রাত্রে খাবার খেয়ে ট্রেনের সিটে বিছানা নিলাম। রাহুল এবং বিজয় তাদের প্রিয় গেম সো পাবজি খেলায় ডুবে গেল। আমরাও শুয়ে পড়লাম। রাত ২টা ৪৫মিনিটে মোবাইলে এলাম বেজে উঠলো আর ১৫ মিনিট পর নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে পৌছাবো।অগত্যা আমরা সবাই তৈরি হয়ে নিলাম । মোবাইলের স্ক্রিনে চার্জ সিগনালের শেষ লাল দাগ টুকু জ্বলে উঠলো। দূরপাল্লার ভ্রমণ, সঙ্গে পাওয়ার ব্যাংক থাকলেও শেষ ১৫ মিনিট ট্রেনেই মোবাইল চার্জ করে নিলাম।

রাত ৩:০৫ মিনিট ,স্টেশন বিল্ডিং এর উপর লাল সবুজ আলোয় লেখা নিউ জলপাইগুড়ি জংশন ।ট্রেন যাত্রার অভিযান এখানেই শেষ। স্টেশন থেকে বেরিয়ে কিছুটা গিয়ে ডানদিকে অতিথি নামে একটি রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম ।পূর্ব কথা মত এখানেই আমাদের অপেক্ষা করতে বলেছেন- কিশোরের মামা বিশ্বনাথ বাবু। মামাবাবু অর্থাৎ বিশ্বনাথ রায়, এখানের একটি থানার বড়বাবু। ট্রেনে ওঠার সময় বারবার সতর্ক করে দিয়েছিলেন নিজেদের জিনিসপত্র নজর রাখার ।এত রাতে তিনি আসতে পারবেন না তাই আমাদের রেস্টুরেন্টে সকাল হবার অপেক্ষা করতে হলো ।সকালে জলখাবার এর সব ব্যবস্থা করে দিয়ে তিনি আমাদের তার পরিচিত একটি হোটেলের ঠিকানা দিয়ে, পাহাড়ি গাড়িতে তুলে দিলেন । আমরাও নিশ্চিত। সকাল ৬ টা ৪৫ মিনিটে আমরা পাহাড়ি আঁকা-বাঁকা পথে তিস্তা নদীর সৌন্দর্য দেখতে দেখতে চলেছি গ্যাংটকের উদ্দেশ্যে। পাহাড়ি চড়াই-উৎরাই রাস্তা পার করে প্রায় ১১টার সময় গ্যাংটক এ পৌছায় ।সেখানে মামাবাবুর পূর্ব কথামত  হোটেলে পাইন অ্যাপেল এর একটি রুমে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হল। একটি রুমে দুটো ডাবল বেডে আমরা পাঁচজন মানিয়ে নিলাম ।সেদিন স্নান ও খাওয়া-দাওয়া শেষে গ্যাংটকের পথে নামলাম, উদ্দেশ্য স্থানীয় বাজার পরিদর্শন করা। মোবাইলে মামাবাবু সব সুবিধা-অসুবিধার খবর নিয়েছেন।

গ্যাংটকের প্রথম দিন শুরু হয় বাজার ভ্রমণ দিয়ে । বিকেলের পড়ন্ত আলোয় চকচকে বাজারে নানা প্রদেশের মানুষের আনাগোনা বৌদ্ধ ,চীনা, নেপালি, ভুটানি, তার সঙ্গে দু চারজন আমেরিকাবাসী এবং অনেক বাঙালির মুখ দেখা গেল। কেউ নানা স্টলে শপিং করতে ব্যস্ত কেউ বা রেস্টুরেন্টে বসে সুরাপানের ব্যস্ত ,কেউবা কফি। এরইমধ্যে বাপুজি কে দেখতে পেলাম লাঠি হাতে, যেন পথ হাটতে গিয়ে থমকে পড়েছে ।বাপুজির মূর্তির নিজে বড় বড় করে লেখা- M.G MARG , GANTOK, SIKKIM. । গায়ে শীত শীত বোধ হতেই রুমের দিকে রওনা দিলাম। সঙ্গে নিয়ে এলাম চাওমিন, লাচ্ছা পরোটা, আর চিলি চিকেন সঙ্গে একটা বড় জলের বোতল এবং কিছু চিপস এর প্যাকেট ।প্রত্যেক জিনিসের বাজার মূল্য তুলনামূলক বর্ধমানের থেকে চার ডবল বেশি। প্রথম দিনই বুঝতে পারলাম এখনে লোকেরা খুব সৎ ও কর্মঠ, বিশেষ করে রুটিরুজির জন্য নারীরা নিজের দায়িত্ব নিজেই নিয়েছে

দ্বিতীয় দিন ভোর ৪:৫০মিনিট তখন সারা গ্যাংটক ঘন কুয়াশাচ্ছন্ন । বাইরে ঠান্ডা বাতাস বইছে ।গায়ের সোয়েটার জড়িয়ে জানলা দিয়ে তাকিয়ে আছি একটু আনমনা হয়ে।পরক্ষনেই চোখ ঝলমলিয়ে নজর কেড়ে নিল একটা চেরি গাছ । গাছটিতে প্রচুর গোলাপি রঙের ফুল ফুটেছে ।কুয়াশা এবং রোদের আভাতে মনির মতো জ্বলজ্বল করছে ।হোটেলের আনাচে-কানাচে পাইনাপেল খুঁজে না পাওয়া গেলও দু'চারটে চেরি গাছ পাওয়া যাবে ঠিক। ৬:৩০মিনিটে আমরা তৈরি হয়ে ব্রেকফাস্ট করলাম । গাড়ি এসে দাড়ালো হোটেলের সামনে আজকের ভ্রমণ ছাঙ্গু লেক ও নাথুলা পাস ।অগত্যা বেশ উত্তেজিত হয়ে হাতে ক্যামেরা ও ছোট ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে এলাম।  পরিচয় পত্র স্বরূপ ভোটার কার্ড ,আধার কার্ড এবং কিছু পাসপোর্ট সাইজের ফটো সঙ্গে নিতে হলো ।এগিয়ে চললাম পাহাড়ি পথে ,ধীরে ধীরে উপরে উঠে চলেছি। একটা সময় নিচের দিকে তাকিয়ে দেখলাম গভীর খাত। আবহাওয়া খুবই খারাপ শীতল বাতাস বইছে একটা সময় ডেকে ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম আমরা ছয় হাজার ফুটের বেশি স্থানের দিকে যাচ্ছি । একটা সময় গাড়ি দাঁড়ালো, দেখলাম বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স এর জওয়ানরা পরিচয় পত্র চেক করছেন । একটু পরেই একটা কথা কানে ভেসে এলো- " মৌসুম বহুত খারাব হে, ইসলিয়ে রাস্তা মে বর্ফ জমা হুয়াহে , ভূস্থলনকা ডর ভি হে।" তাই বারবার সাবধান করে দিচ্ছেন বিএসএফ এর জওয়ানরা । ৯:৪৫ মিনিটে ছাঙ্গু লেক যাবার পথে প্রথম বরফের আস্তরণ চোখে পড়ে। রাস্তার দু'ধার দিয়ে স্তরে স্তরে বরফ সজ্জিত ,উঁচু-নিচু ভূমিরূপ যেন রুপোলী মোড়কে ঢাকা ।১০ টার সময় ছাঙ্গু লেক পৌছালাম। এখানেই প্রথম বরফে পা দিলাম এবং দুই হাতে বরফ স্পর্শ করলাম মন ভরে। সিনেমার পর্দার দৃশ্য আজ চোখের সামনে উন্মুক্ত। দুচোখ ভরে দেখলাম তুষারধবল শৃঙ্গ গুলিকে । কিছুক্ষণ পরেই তুষারপাত শুরু হল । কি সুন্দর সেই দৃশ্য যা বলে বোঝানো যায় না ,শুধু উপভোগ করা যায়।
 এরপর আমাদের যাত্রা চীন ও ভারতের বর্ডার নাথুলা পাস এর দিকে ।ঘন্টা দুয়েক পর নাথুলার  দুপাশে বরফের মাঝে উঁচু লম্বা দন্ড গুলি দেখা গেল ,যেগুলি ভারতের থেকে চীনকে আলাদা করেছে ।প্রায় আধ ঘন্টা ছিলাম সেখানে। অনেক ছবি ক্যামেরাবন্দি করলাম ।ছেড়ে আসার পথে চামরী গাই চোখে পড়ল। যখন হোটেলে ফিরলাম তখন প্রায় তিনটা বেজে গেছে। সেদিন আর কোথাও বেরোতে পারলাম না । খাওয়া-দাওয়ার পর ক্লান্তি নিবারণের জন্য শুয়ে পড়লাম।

গ্যাংটকের তৃতীয় দিনে মামাবাবুর তত্ত্বাবধানে বাগডোগরা বিমানবন্দরে কিছুটা সময় কাটালাম । ফিরে আসার পথে রোপওয়েতে গ্যাংটকের বেশ কিছুদিন নতুন দৃশ্য দেখলাম-  ধাপ কেটে চাষ করা, তিস্তার জল এঁকেবেঁকে গড়িয়ে চলেছে নিচের দিকে  ,সেই দৃশ্য । আজ আমাদের সঙ্গে মামাবাবু ও ছিলেন। দুপুরে একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া করে হোটেলে পৌছালাম । বিছানায় শুয়ে শুয়ে পূর্বদিনের তোলা ছবিগুলি দেখতে দেখতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি  বুঝতেই পারেনি। ঘুম যখন ভাঙলো তখন ঘড়িতে চারটে কুড়ি সূর্যালোকের শেষ সৌন্দর্য তখন গ্যাংটক শহর কে ঢেকে দিয়েছে।

চতুর্থ দিন ফিরে আসার দিন সকাল সকাল তৈরি হয়ে নিলাম ফেরার পথে S.M.U (সিকিম মনিপাল ইউনিভার্সিটির )সামনে কিছুটা সময় কাটিয়েছিলাম। গ্যাংটকের কিছু মন্দির ও মঠ পর্যবেক্ষণ করে রওনা দিলাম স্টেশনের দিকে ।আবার সেই পাহাড়ি পথ সঙ্গে আঁকাবাঁকা তিস্তা নদী আমাদের সঙ্গী হল। মনটা একটু ভারী হয়ে উঠল এত সুন্দর পাহাড়ি পথ সবুজে ঘেরা তিস্তা নদী বরফে ঢাকা  শৃঙ্গ সবাই এখন স্মৃতি। রাত আটটার সময় আমরা স্টেশনে পৌছালাম ।ট্রেন 9 টা ৪৫ মিনিটে , মামাবাবু সব ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। রাতের খাবার খেয়ে মামাবাবুকে ধন্যবাদ ও বিদায়ী প্রণাম দিয়ে ট্রেনে উঠে বসলাম । যথাসময়ে মাঠ-ঘাট গাছপালা ছড়িয়ে কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেস চলতে শুরু করল। এবং আমাদের চোখের সামনে মোবাইলের স্ক্রিনের আলো জ্বলে উঠলো।




    -চিরতন্দ্রায়
  রিতেশ গোস্বামী


রাস্তার ধারে কিংবা ট্রেনের লাইনের চত্বরে
আজ যাদের যাচ্ছে প্রাণ,
মৃত্যুটা তাদের আজ হয়নি
বরং, গরিব হয়ে জন্মানোতেই শুরু হয়েছিল তাদের ত্রাণ |
জন্মের পরেই ছুটেছিল এরা অজানা প্রান্তে
ক্ষুদার নেশা মেটানোর খোঁজে,
মৃত্যু তখনই হয়েছিল
আজ কেবল জীবনটা বেড়োলো ক্ষুদার দোহনের তেজে |
পরিবারের রুটির যোগানের ভার
নিয়েছিলো কাঁধে কষ্টপিষ্টে,
আজ সেই রুটির জ্বালায়
মৃত্যুর পথটা  সম্পন্ন হলো তাদের ধৃষ্টে |
দুর্বল নিদ্রার চোখে কাতর প্রাণে
বাড়ির আঙিনায় চুম্বনের আশায়,
পরিযায়ী হয়ে নিস্ফলেই
লুটিয়ে পড়লো চিরনিদ্রার শাখায় |
বাকি রেখে যাচ্ছে কিছু
পরিবারের সাথে ক্ষুদা মেটানোর অসম্পন্ন তৃপ্তি,
আশা মাখানো শুন্য পাত্রেই
অনন্ত গগনের নীচে মৃত্যুতাই অবশেষে হলো তাদের প্রাপ্তি |



             পুরাতত্ত্বের পাতায় “মলহার
                   নির্মাল্য কুমার পান্ডে

                    (শীতের ভ্রমণ)
কি শর্মাজি! মিঠে রোদ-শীতে যাবেন নাকি কোথাও ঘুরতে? কি বলছেন, যাবেন! তবে, চলুন পুরাত ত্বের পাতায় প্রাচীনের নিদর্শন দেখতে।একটি ছোট্ট গ্রাম, অথচ বিখ্যাত প্রাচীনের গন্ধে।খননের চূড়ায় যায়গা করে নিয়েছে ‘ছত্তিসগড়ের এই ছোট্ট গ্রাম”। আপনি তো জানেন, মধ্যপ্রদেশকে ভেঙ্গে দু’ভাগ করা হোয়েছে-১৬টি জেলা নিয়ে ২০০০ সালে ছত্তিসগড়ের জন্ম।এখন সেটি ২৬তম রাজ্য- ছোট হলেও খনিতে, শস্যে ও পুরাতত্ত্বের খ্যাতিতে সমৃদ্ধ।আদর্শ নদী গঙ্গার ন্যায় পবিত্র ‘গোদাবরী নদী’ এই রাজ্যের মধ্যে দিয়ে প্রবাহের ফলে, নদীমাতৃকা দেশের শিরোপা পেয়েছে।তাই, এই নদী যেমন ধর্মে –‘ ওঁ গঙ্গে চ যমুনে চৈব গোদাবরী সরস্বতী’ মন্ত্রে স্থান পেয়েছে, তেমনি ইতিহাসের পাতায় প্রাচীনের গন্ধে নিজেকে মুড়ে নিয়েছে এই ছত্তিসগড়- তারি মাঝে আছে এই গ্রাম-“ মলহার”।
   এই গ্রামে খনন কাজ চালিয়ে যে সব শিলালিপি ও নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে, তার থেকে প্রমাণিত হয় যে, এই অঞ্চল মৌর্য রাজত্বে ও কালচিরি রাজাদের অধীন ছিল- কারণ স্বরূপ সেই সময়ের স্থাপত্য, দেব দেবীর মন্দির ও অন্যান্য সামগ্রী যা মাটী খুঁড়ে পাওয়া গিয়েছে। তিনটি নদী বেষ্টিত এই গ্রাম-পশ্চিমে অরূপ নদী, পূবে লালগড় নদী ও শিবনাথ নদী- এগুলি সবি এ’রাজ্যের প্রধানতম নদী মহানদীর শাখা প্রশখা। এককালে হিন্দু,জৈন, বৌদ্ধ ধর্মের অণুগামীদের তীর্থক্ষেত্র ছিল-এই ‘মলহার’। তবে ট্রেনের টিকিট বুক করা যাক মলহার ভ্রমণে। কোলকাতা/ হাওড়া / শিয়ালদহ থেকে বিলাসপুর যেতে ২১টি মেল,এক্সপ্রেস, দূরান্ত, সুপারফাস্ট ট্রেন যায় এবং ৭১৮ কিমি দুরত্ব প্রায় ৮/৯ ঘণ্টায় চলে যায় বিলাসপুরে। গীতাঞ্জালি, মুম্বাই,সমস্তিপুর, ভুজ ট্রেনগুলো উল্লেখযোগ্য।
    আমরা যথা সময়ে চলে এলাম বিলাসপুরে। বিলাস্পুরে হোটেলে মালপত্র রেখে গাড়ি ভাড়া করে রওনা হলাম ‘মলহারে’। এর আগে এসেছিলাম ন রমদার উৎস সন্ধানে--, ফলে  চেনা গাড়ি পেয়ে গেলাম। বিলাস্পুর থেকে মাত্র ৩৩/৩৫ কিমি। পথের দু’ধারে মিঠে রোডে বনানীর কোলে মনটা চলে যাচ্ছিল পাখির ডানা মেলে দূর দিগন্তে।
 
 যথাসময়ে প্রকৃতি প্রেম ছেড়ে চলে এলাম বাস্তব মিউজিয়ামে, যেখানে রাখা আছে ধরণীতল হোতে উদ্ধারিত প্রাচীন সামগ্রী, চলে এলাম দেবালয়ের ধ্বংস স্তূপে। এবার তার কিছু কিছু নিদর্শন এখানে তুলে ধরছি কবিগুরুর চারটি লাইন-“ সবারে মিলায়ে তুমি জাগিতেছ,দেখা যেন সদা পাই,
                                                                                   দুরকে করিলে নিকট বন্ধু, পরকে করিলে ভাই,”                                 
       

 আমরা একে একে এই সব দুষ্প্রাপ্য প্রাচীন রত্নের খোঁজ পেলাম, মুগ্ধ হলাম শিল্প নিদর্শন দেখে- আপনারাও যান না! দেখে আসুন, প্রাচীনকে, মেলবন্ধন স্থাপন করুন প্রবিণে- নবীনে।
 পথ নির্দেশ=  আগেই বলেছি, কিভাবে যেতে হবে। তারি পুনরাবৃত্তি করছি- ৭১৮ কিমি হাওড়া থেকে বিলাস্পুর ট্রেনে- ২১ জোড়া ট্রেন আছে। বিলাস্পুরেই  হোটেলে আশ্রয় নিয়ে গাড়িতে শুধু ঘোরা। যাতায়াত ও থাকা খাওয়ার কোন অভাব নেই বিলাসপুরে। যদি কেউ উড়তে চান, চলে আসুন রায়পুরের বিবেকানন্দ বিমান বন্দরে- সেখান থেকে বিলাস্পুর প্রায় ১৪৮ কিমি- গাড়ি,বাসে, ট্যাক্সিতে। ভাড়ার রদব্দল হয়, তাই তার উল্লেখ অপ্রয়োজনীয়। অক্টোবার – মার্চ ভ্রমণে আছে আনন্দ।


            প্রাচীনে মোড়া মুর্শিদাবাদের বেরা উৎসব 
             (আগামী ২৫শে ভাদ্র, ১২ই সেপ্টম্বার,২০১৯ উৎসব উপলক্ষে প্রতিবেদন)

পলাশী যুদ্ধে বাংলার রাজধানীর পতনের পর মুর্শিদাবাদে পা রেখেই লর্ড ক্লাইভ মন্তব্য করেছিলেন-“The city of Murshidabad is as extensive, populous and rich, as the city of London”- সেই লন্ডনের সম সৌন্দর্য আজ আর নেই-,আছে শুধু প্রাচীনে মোড়া বৈভব, কাঠামো, স্মৃতি। তারই নিদর্শন স্বরুপ ‘প্যালেস’ বা ‘হাজাদুয়ারি’, ‘ইমামবাড়া’ ভাগীরথীর তীরে মাথা উঁচূ করে নবাবী আমলের কীর্তির জানান দিচ্ছে। বলতে বাধ্য হচ্ছি, আমরা এখন যা দেখি, তা, কিন্তু বিশুদ্ধ নবাবী নয়-ব্রিটিশ রাজত্বের কীর্তির সঙ্গে মিশ্র নিদর্শন। এই যে হাজারদুয়ারি, এটার নক্সা প্রস্তুত করেছিলেন-‘বেঙ্গল কর্পোরেশন অব ইঞ্জিনিয়ার্সের জেনারেল-ডানকান ম্যাক্লিওড’-ইটালিয়ন ধাঁচে এবং এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন মাসহারা প্রাপ্ত নবাব হুমায়ূন জ্যা- ১৮২৯ সালে এবং শেষ ১৮৩৭ সালে।তখন কিন্তু ব্রিটিশরাজের অধীন উপনিবেশ শাসন। আবার, ভাগীরথীর উত্তর পাড়ে অবস্থিত বর্তমান ইমামবাড়া কিন্তু নবাব সিরাজের তৈরী নয়-সেই ভারত বিখ্যাত ইমামবাড়ার ঘটেছে অবলুপ্তি, পরিবর্তে দেখছি, ১৮৪৭ সালে পুনরগঠিত ইমামবাড়া, যা আবার আতশবাজির আগুনে ক্ষতিগ্রস্থ হয়-বেরা উৎসবকালে-। এখন এই ইমামবাড়ায় আছে কিছু মামুলী দ্রব্য-বেলজিয়াম কাঁচের আয়না, সিরাজের ব্যবহৃত তরবারি, অস্ত্র ও বাঁশের তৈরি দ্রব্য রঙ্গিন কাগজে মোড়া--। অতি প্রাচীন “বেরা বা ব্যারা” উৎসবের সময় সেই সব সামগ্রি সাজান হয়। আমাদের প্রতিবেদন ‘বেরা’ উৎসব নিয়ে—
  বেরা- এই উৎসবের সূচনা হয় নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর আমলে- (১৭১৭-১৭২৭ সাল)।তারপর থেকে ধারাবাহিক ভাবে এখনও চলে আসচ্ছে, কাজেই এই উৎসবকে নির্ভেজাল উৎসব বলা যেতে পারে। এটি জাতি, ধর্ম, দেশি-বিদেশি সকলকে নিয়ে ‘অসাম্প্রদায়িক’ উৎসব- আগেও ছিল, এখনও আছে- তফাৎ, প্রাচীনে উৎসব পালিত হত নবাবের দ্বারা, জাঁকজমক সহকারে, এখন হয় প্রতীকী হিসেবে, যেমন, আগে জ্বালান হত ‘সোনার/রূপোর প্রদীপ, ভাসমান বেরার সঙ্গে নদী বরাবর জাফ্রাগঞ্জের দিকে চলত হাতি,ঘোড়া, আলোর জৌলুষ, বিচিন্ন বাজনা- এখন তার বিকল্প ব্যবস্থা- সরকারী তদারকে।অবশ্য নবাবের বংশধররা উৎসবের সুচনা করেন। আগে কামান দাগা হত, এখন হয় বাজী বোমা--।
  কেন এই উৎসব-নবাব মুর্শিদকুলই খাঁ এই উৎসবকে উৎসর্গ করেছিলেন- ‘খাজা খিজিরের’ উদ্দেশ্যে। সকলের প্রেম, ভালবাসা নিতে ও দিতে। তিনি যদিও ছিলেন ইতিহাসবিদদের মতে বীর ও ইসলামধর্ম- গোঁড়া বিশ্বাসী, তথাপি তিনি ছিলেন,- মনে হয়-মানব প্রেমী। তাই, এই সকলকে নিয়ে বেরা উৎসব। বেরার গঠণ- কলাগাছের কান্ডকে পরপর সাজিয়ে ভেলা তৈরি করে পাতলা কাঠের তক্তা ইত্যাদি দিয়ে বজরা তৈরি করা হয়- গঠনটা অনেকটা দুর্গের মত। তাতে থাকে প্রদীপ, আতশবাজি, নানা ধরণের আলোর ঝর্না-।সেই দুর্গের মত কাঠের নৌকা বা বজরাকে ঐ কলাগাছের ভেলাতে চাপান হয়। মাঝরাতে নানা ধরণের জৌলুশ সহকারে কামান দেগে ভেলাকে নদীর বুকে ভাসান হয় ও সব আলো প্রজ্জ্বলিত করে আতশবাজি ফাটিয়ে উৎসবের সুচনা হয়। এই নদীবক্ষে ভাসমান আলোর ঝর্না দেখার জন্য প্রচুর লোকের সমাগম ঘটে। পূর্বে একমাস ধরে মেলা বসত- খানাপিনা চলত- তা অবশ্য আর হয় না, তবে প্রাচীনের কৌলীন্য এখনও অনেকটা বজায় আছে।গান বাজান হয়- ‘দেশাত্মক বোধের’। এই বেরা উৎসব বঙ্গের গর্ব বলা যেতে পারে- প্রাচীনে মোড়া সাম্প্রদায়িক প্রীতি। প্রতি বছর ভাদ্রমাসের শেস বৃহস্পতিবার এই অনুষ্ঠান হয়ে থাকে।       
                 
                                                     

 পথ নির্দেশ- হাজারদুয়ারি এক্সপ্রেস সকাল ৬টার পর কলকাতা ষ্টেশন থেকে ছাড়ে। এছাড়াও- শিয়ালদহ থেকে অনেক কটা ট্রেন, লালগোলা প্যাসেঞ্জার, ভাগীরথী এক্সপ্রেস--ছাড়ে- মুর্শিদাবাদ রেল ষ্টেশনে নেমে টোটো বা অন্য ঘণ্টা লাগে। বাসও যায়।



ক্ষুধার জ্বালা
সৌমিত্র ভান্ডারী

আমাদের দাবি খুব ছোট
শুধু ভাত চাই
আমরা যে গরিব খুব
আমাদের বিলাসিতা নাই।

স্বপ্ন শুধু দু-মুঠো ভাত
তাও জোটে না কপালে
হায়রে ক্ষুধার জ্বালা
মিটবে না কোনো কালে।




" জেগে ওঠো....."
             ...শ্রী শতানীক ভট্টাচার্য

 যদি আর ফেরা না হয়,
তবে পরের জন্মে দেখা হবে
এক বৃষ্টিমুখর দিনে!
সুবর্ণরেখার বালুতটে,
স্বর্ণ ভূমির মেঘে ভেজা সিক্তদুপুরে ভেসে বেড়াবো
মহুয়া ফলের উদ্বায়ী গন্ধে,
লালমাটির মাতাল পথ বয়ে ছুটে বেড়াবো
শাল-শিমুল আর পলাশের জঙ্গলে!
ঝলসানো সূর্যের গলন কিংবা শীতের হিমেল কাঁপুনি উপেক্ষা করে নেমে যাব ডুলুং এর বুকে,
ধুয়ে যাবে দেহের সকল গরলগরিমা,
ঝকঝকে পাথরজলে পরিশ্রুত মন
শিশির হয়ে ঝরে পড়বে হেমন্তের শীততাপ জারিত ঘাসে -ঘাসে,
ভরদুপুরে বিন্দু বিন্দু হয়ে তলিয়ে যাব সূর্যের কবোষ্ণ আলোর বিছানায়!
প্রজাপতির রঙিন ডানা হয়ে জুড়ে যাব রেনুর গভীরে,
ভাঙ্গাব অলস ঘুম!
অভিমানী কুসুম-মন মুক্তহাসি হাসবে,
সাদা মেঘের দুরন্তযানে পাড়ি দেব নদী আকাশ পেরিয়ে,
তপবনের গভীর অরণ্যে !
হারিয়ে যাবে বেসুরো মন
              সুস্থির ধ্যানমগ্নতায়!
শঙ্খচিল হয়ে আকাশের বুকে এঁকে দেবো শূন্যতার মানে,
লক্ষ লক্ষ সূর্য হয়ে আশার আলো ছড়িয়ে দেবো গভীর শূন্যে -
বহুদূরে -আলোকবর্ষের অসীম বৃত্তে!
 রক্তাক্ত মন গুলোকে মুছে দেবো ভালোবাসার তুলো-স্পর্শে!
মরার আগে সকল যন্ত্রণা ধৈর্য ধরে সহ্য করবো,
শুনবো বিশ্বের সমস্ত অভিমান!
ক্লান্ত পৃথিবী আবার  হাঁটো-
 মন্থর গতিতে,
                 জেগে ওঠো--
                                 হে ঈশ্বর!




কিছু দৃশ্য বাকি ছিল
                  অমিত দত্ত

সন্ধ্যা ঘনায় ক্রমে পদ্মপাতার বুকে
এক বিন্দু জল যা জীবন ধরে রাখে
গড়িয়ে পড়ে অলক্ষ্যে, চাঁদ ওঠার বহু আগে
রেখে যায় শুধু অভিনয়-
পরিবর্তন হয় বহু পট নট জীবনে
ক্যানভাসে আসল ছবি হারিয়ে গেছে বহুদিন
বহু অপটু হাত তাতে রঙ চাপিয়েছে একের পর এক
পরতে পরতে জ'মে যা চেনা মানুষকে
করেছে অচেনা অজানা কিম্ভূত;
সে শুধু অভিনয় করে যায়
সে এক, হয় বহু, নিজ তাগিদে
বাকিরা চোখ কচলায় অবিশ্বাস বিভঙ্গে
' আরে এ তো আমার গল্প বলে !'
সন্ধ্যা ঘনায় ক্রমে কচুরিপাতার দঙ্গলে
জোনাকি সাজিয়ে তোলে মঞ্চ-
অদৃশ্য সীমারেখার ওপারে
যখন তোমরা ফুল দিয়ে শয্যা সাজিয়ে তোল
এখানে লোকচক্ষুর আড়ালে তখন অভিনয়ের তোড়জোড় হয়
অভিনেতা চলে যায়... অভিনয় নয়...




                                স্মৃতি কথা 
                        সত্যব্রত দাস অধিকারী

তারিকটা ঠিক মনে নেই , কিন্তু মনে আছে ওই দিন পূর্ণিমা ছিলো। আমরা বিয়ে বাড়ি গিয়েছিলাম, সুবর্ণরেখা নদীর তীরে এক বহু কাল পুরোনো মন্দিরে বিয়ে হয়। তার কিছু দিন আগে তোমার সঙ্গে আমার মনোমালিন্য হয় তাই কয়েকদিন ধরে আমাদের মধ্যে কথাবার্তা বন্ধ ছিলো । তুমি আর আমি একই জায়গায় থেকেও অভিমান করে কেউ কারোর সঙ্গে কথা বলছিলাম না। যার বিয়ে করতে গিয়েছিলাম সেই আমাদের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি করে দিয়েছিলো। আজ তার বিয়ে কিন্তু সে আমাদের দুজনকে বার বার লক্ষ্য করছিলো। আমাদের দুজনের মাঝে বসে সে পুরো ব্যাপারটা দেখছিলো। তার পর হঠাৎ একটা প্রশ্ন করে, কী রে? কী হয়েছে তোদের? ততক্ষণ থেকে চুপচাপ বসে আছিস কোনো কথাবার্তা নেই। আমার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে এর পর তোদের মধ্যে সমস্যা হলে আমি আর সমাধান করতে আসব না। আমি যাওয়ার আগে তোদের দুজনের মুখে হাসি দেখতে চাই, তোরা কোনো এক ফাঁকা জায়গায় বসে নিজেদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি গুলো দূর করে নে। যা তাড়াতাড়ি যা, আর হ্যাঁ বিয়ে শুরু হওয়ার আগে তোরা ফিরে আসিস যেনো। তার কথা শুনে দুজন উঠে গেলাম। আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করলাম ওই নদীর ধারে যাবে নাকি? তুমি বললে চলো, কিন্তু আমাকে খুব ভয় লাগে। আমি বললাম আরে আমি আছি তো কিসের ভয়? চলো যাই। নদীর ঘাটটি খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এবং ঢাকাই করা (বলি সিমেন্ট দিয়ে কাজ করা)। তুমি আমার হাত ধরে ঘাটের দিকে এগিয়ে গেলে, সেখানে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আমাদের মধ্যে কথাবার্তা হলো, নিজেদের ভুল গুলো মেনে নিলাম আমরা। আমি তোমাকে বললাম চলো ওই ধারে গিয়ে বসি।তুমি জলের ধারে যেতে ভয় পাচ্ছিলে তাই আমার হাত শক্ত করে ধরে ছিলে তুমি, ভয়ে চোখ বন্ধ করে দিয়েছিলে, বার বার বলছিলে খুব ভয় করছে, আমি তোমাকে বলছিলাম আরে ভয় করার কি আছে আমি আছি তো। তোমাকে একেবারে জলের ধারে নিয়ে গেলাম। আমরা ওই ধাপ গুলোতে বসলাম আর পা দুইখানি নদীর স্রোতে ভাসিয়ে রেখেছিলাম ।তুমি তখনও আমাকে ছাড়োনি শক্ত করে ধরে রেখেছিলে, এই ভাবে কিছুক্ষণ বসার পর তোমার ভয় আস্তে কম হলো ।চাঁদের আলোয় মেতে ছিলাম আমরা ।তুমি আর আমি পাশাপাশি বসে কত কথা বলে ছিলাম।তুমি আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলে, তুমি আমাকে ছেড়ে কোনোদিন চলে যাবে না তো? আমি যে তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারবো না। তুমি তাড়াতাড়ি কিছু একটা করো। আমাকে ভীষণ ভয় লাগে আমাদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে। কী যে হবে কিছু বুঝতে পারছি না। আমি বলেছিলাম ভয় করার কি আছে? আমি তো বাড়িতে বলে রেখেছি আর তোমার বাড়িতেও ব্যাপারটা জানে, আর ভয় কিসের? তুমি চিন্তা করোনা কিছু হবে না, আমি কিছু হতে দেবো না। তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ছিলে আর বলেছিলে সত্যি তো কোনোদিন ছেড়ে যাবে না। আমি বলেছিলাম বিশ্বাস রাখো আমার উপর। তার পর আমার ঠোঁটে তোমার ওই উষ্ণ ছোঁয়া আমাকে যেনো কোনো এক স্বপ্নের দেশে নিয়ে গিয়েছিলো। হঠাৎ আমি বলে উঠেছিলাম চলো বিয়ে শুরু হয়ে গেছে দেরি হয়ে যাবে। সেদিন তুমি আমাকে আর আমি তোমাকে অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। আজ ওই প্রতিশ্রুতি গুলো সব ভেঙে গেছে, মূল্যহীন হয়ে গেছে। আমি এখনও কিছু ভুলিনি মনে আছে সব প্রতিশ্রুতি। তুমি ভুলে গেছো সব আমাকে আর আমাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি গুলোকে।অনেক দিন হয়ে গেলেও এখনও মনে পড়ে ওই সোনালী সন্ধ্যার কথা, সেদিনের কাটানো মুহূর্ত গুলোর কথা। তাই তো এখনো তোমার অপেক্ষায় বসে আছি।




               পাপী
         বিশ্বজিত মুখার্জ্জী

গভীন হস্তিনি ক্ষুধার জ্বালায় কাতর,
ক্ষুধা নির্বৃত্তে প্রবেশিল বাগানের ভিতর।
বিস্ফোরক যুক্ত সুস্বাদু আনারস,
সম্মুখে আহার তুলেদিল বাগানের বস।
আহারে ক্ষণিকে চিত্ত অস্থির,
মস্তিষ্কে বিকার চাপে শরীর থাকেনি স্থির।
আহারে ক্ষণকাল পরে যন্ত্রনা জঠোরে,
যন্ত্রনায় কাতরাতে কাতরাতে পরে নদী গহ্বরে।
অসহ্য যন্ত্রনা নদী গহ্বরে হয়না উপশম,
নিয়তির করাল আঘাতে শেষ হয় দম।
বাহাদুরী কেরামতি প্রতাপের বিক্রম,
মনুষ্য কলঙ্ক তুই,ডোবালি মানবজাতির সম্ভ্রম।
ওরে মানবের নির্বোধ  পাষন্ড সন্তান,
হস্তিনিরে নাশিতে বিস্ফোরণ দান।
দিনু অভিশাপ তোরে বুদ্ধিভ্রষ্ট দুষ্ট মহামতি,
নরকে হবেনা ঠাঁই দিনেদিনে বাড়িবে দুগর্তি।


                                      মধু
                               গোপালচন্দ্র দাস

অনুপ দাস উত্তর ত্রিপুরা জেলার দেওছড়া স্কুলের চালের খোপে একটি কুলি মৌ'র মধু'র চাক কাপড়ের সলতে জ্বালিয়ে অল্প ধোঁয়ায় ভেঙ্গে মধু সংগ্রহ করতে উপড়ে উঠল। কিন্তু সঠিকভাবে মধুর চাক নাগাল পাচ্ছে না। মধুলোভী প্রবীণ রঞ্জিত চক্রবর্তী কানে কম শুনেন,তিনি অনুপকে কাঁধে নিয়ে উপরে উঠাচ্ছেন আর সাবাসী দিচ্ছেন। উদ্দেশ্য  কিছুটা মধু যদি মাগ্‌না পাওয়া যায়। কিন্তু তারপর‌ও অনুপ নাগাল পাচ্ছে না। রঞ্জিত বাবু এবার অনুপের পাছার নীচে মাথা লাগিয়ে উপর দিকে ধাক্কা দিচ্ছেন। অনুপ মধুর চাকে হাত দিতেই মৌমাছি অনুপকে চারদিকে ঘিরে কামড়ে ধরল। অনুপ অসহ্য যন্ত্রনায় চিৎকার করে বলছে, কাকু এগুলো কুলি মৌ নয়,এগুলো রাজ মৌ,আমাকে কামড়ে দিচ্ছে সহ্য হচ্ছে না। নামাও আমাকে মাথা থেকে নামাও। অনুপ রাজমৌ'র কামড় সহ্য ক‍রতে না পেরে পেচ্ছাব করে দিল। রঞ্জিত বাবু বলছেন,সব মধু আমার মাথা মুখ বেয়ে নীচে পড়ে যাচ্ছে ভাতিজা। তুই কিভাবে মধুর চাক ভাঙছিস? আজকাল কি যে হল,সব কিছুতেই ভেজাল!মধুতেও মিষ্টি নেই!


 
                                            উত্তর সুরী 
                                             কবিরুল


               "   কৃষ্ণকলি আমি যা রে বলি
                     কালো .....  বলে গাঁয়ের লোক
                    মেঘলা দিনে দেখেছিলেম
                       কালো হরিণ চোখ ...... "

              " এবার ঠিক আছে তো নাচের স্টেপিং ? "  

              " একদম ঠিক নেই। বার বার বলছি আরো ভাল করে প্র্যাকটিস করতে হবে। কোন কথায় তুমি শুনছ। বাঁ পায়ের সাথে ডান পা গুলিয়ে ফেলছ। এই রকম করলে হবে বল ? মন দিয়ে নাচটা করতে হবে। "
   
   " দিদি , গানের এক জায়গাতে সুরটা ঠিক  মত ধরতে পারছি না। আর সেই জায়গাতে কেমন বেখাপ্পা শোনাচ্ছে। "

     " বার বার ভিডিওটা দেখ। তাহলে আইডিয়া ক্লিয়ার হবে। গানটা মন দিয়ে অ্যাটেনটিভলি শুনতে হবে। বার বার নয় , একশো বার হাজার বার  শুনতে হবে। এটা যার তার গান নয়। এ হল কবিগুরুর গান। গানের মধ্যে অনেক ভাব , আবেগ লুকিয়ে আছে। অনেক দর্শন আছে। গানের গভীরে ঢুকতে হবে। তাহলেই সুরের সন্ধান পাওয়া যাবে। "

       " মিনতি , বাহ্ বেশ দারুণ হয়েছে। আগের থেকে অনেক ইমপ্রুভমেন্ট করেছ। আর একটু পারফেকশান চাইছি তোমার কাছ থেকে। "

        " ম্যাম , আজকে একটা নাচের নতুন ভিডিও নেব। আগের দিন যেটা নিয়ে গিয়েছছিলাম গিয়েছিলাম সেই নাচটা তোলা হয়ে গেছে। আগের নাচের ভিডিওটা দারুণ ছিল। " 

          " বেশ তো , প্র্যাকটিস শেষ হবার পর নিয়ে যেও। তবে আর একটু ভাল করে করতে হবে। "

             মানসী  সবাইকে নাচ গানের তালিম দিচ্ছে।
 আর বারান্দায় বসে আশাবরী দেখছে। বিকেলের  পড়ন্ত রোদ্দুরটা একটু একটু করে তার সারা শরীরে আদর বোলাচ্ছে। সামনেই রবি ঠাকুরের জন্মদিন। তাই আশাবরীর ছড়ানো চাতালে ছেলে মেয়েরা রোজ প্র্যাকটিস করছে। ছেলে মেয়েদের এই প্র্যাকটিস দেখতে আশাবরীর ভীষণ ভাল লাগে। 

              নিজেও একটা সময়ে নাচ গানের মধ্যে ছিল। তখন এ বাড়িতে প্রায় নাচ গানের প্রায়  আসর বসত। বাড়ি গম গম করত তবলা হারমোনিয়াম বাঁশি ,  গিটার ,  পিয়ানো আর নানা স্বাদের বাদ্য যণ্ত্রের শব্দে। ঘুঙুরের শব্দে ঘুম ভাঙ্গত সকলের। বাড়ির সকল সদস্য সদস্যা কোন না কোন ভাবে সংগীত চর্চার সাথে যুক্ত ছিল। ভোর হতেই দরাজ কণ্ঠের গান ভেসে আসত বিশাল বপুর ছাদ থেকে। বিভিন্ন রাগ রাগিনীর শব্দে এই জমিদার বাড়ি ঝলমল করত।

              বৈশাখ মাস আসলেই কবিগুরুর জন্মদিনের জন্যে তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। তখন মনে হয় যেন বাড়িটা পুরো উৎসবের বাড়ি। গানের রেওয়াজ , নাচের তালিম , কবিতার ছন্দে ,   নাটকের সংলাপে সারা বাড়ি মুখরিত হয়ে ওঠে। পঁচিশে বৈশাখ চলে গেলেও বেশ কিছুদিন তার রেশ থেকে যেত। 

              অনেক রকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হত। বাড়ির সকল সদস্যের অংশগ্রহণ সেখানে ছিল বাধ্যতামূলক। আর  এই সমস্ত কাজের একমাত্র পুরোহিত ছিল বাড়ির মেজ বৌ। সামনে থেকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করত। সেই সব দিন কখনো ভোলার নয়। সব ধরণের সম্প্রদায়ের মানুষের সাথে মেজ বৌয়ের ছিল দারুণ সখ্যতা। অনুষ্ঠানেও সব ধরণের মানুষকে সামিলকে করত।

               "  হে নূতন দেখা দিক ....
                   জন্মেরও প্রথম শুভক্ষণ তোমার প্রকাশ হোক
             " কুহেলিকা করি ......মতন..... "    

               "  বড় বৌমা  , দোতলার ছাদ থেকে মেজ বৌমার  গলা ভেসে আসছে। বেলের সরবৎটা উনার কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা কর। " আশাবরী ফুল তুলতে এসে এক হাঁক পাড়ল।

             "  মা , এবারে পঁচিশে বৈশাখে শুনছি সান্যাল বাড়িতে বাইরে থেকে শিল্পী আসছে। গতবার আমরা অনেক সুন্দর অনুষ্ঠান করলেও সান্যাল বাড়ির প্রশংসাই লোকের মুখে বেশী শোনা  গিয়েছিল।এবার কিন্তু সান্যাল বাড়িকে টেক্কা দিতেই হবে। " বড় বৌমা বেলের সরবৎটা চামচ দিয়ে নাড়তে নাড়তে বলল।


            " মেজকামণি , আমি এবারে কবি প্রণামের দিন একটা কবিতা আবৃত্তি করব। আমার কবিতা পাঠের ধরণ ঠিক মতন হচ্ছে কি না একটু দেখে দেবে ? " ছোট্ট তিতলি ছুটতে ছুটতে এসে বলল।

            " কেন দেব না সোনা , আমি গানটা শেষ করে  উঠি , তারপরে না হয় দুজনে একসাথে বসে আবৃত্তি করব। " ঝরণা তিতলির গাল টিপে দেয়।

            " কি মজা ! কি মজা ! " 

             "  কি গো , বাসির চাচা ,  তোমার মেয়ের প্রস্তুতি কেমন চলছে ? রবি ঠাকুরের জন্মদিন তো এলো বলে ? "

              " মেজ বৌদিমণি , তুমি থাকতে আর ভয় কিসের। এবারে তাঞ্জিলা কবিগুরুর একটা কবিতা পাঠ করবে। ও সারা দিন খুব খটছে ওটার পেছনে। " 

            " বাহ্ বেশ তো। গতবারের মতন এবারেও প্রথম প্রাইজ নিতে হবে। "

               চৌধুরী বাড়ির কবি প্রণামকে ঘিরে টুকরো টুকরো কথা ঘটনা আশাবরীকে আজও আবেগপ্রবণ , অস্থির করে তোলে। বুকের অলিন্দে তোলপাড় শুরু হয়।
               সন্ধ্যে হয়ে আসছে। মানসীদের গান ,  নাচের মহড়া সমানে চলছে।

              " মনে আছে তো শোভন , তুমি আর বাগদি পাড়ার মিলি দুজনে "  বীর পুরুষ " কবিতাটি পাঠ করছ। " আরো একবার কবিতাটা পড়ে দেখে নিও। "

              "   ......... ..........

 হা রে রে রে রে রে আমায় রাখবে কে যে ধরে 
            " যেমন ছাড়া বনের পাখি ....   "

            " কি রে তোদের অনুশীলন শেষ হল ? "

            " হ্যাঁ দিদা , আবার কালকে। আজকের মতন ছুটি । দিদা , মেজ জ্যেঠিমণির পুরাণো গানের খাতাটা একবার একটু দেখতাম। গানের কিছু নোটেশানে ভুল থেকে যাচ্ছে। তাই .....   "

           "  ওটা তো তোদেরই সম্পত্তি। আশাবরীর মুখে হাসি ফুটে উঠল।

                   সন্ধ্যে হলেই আশাবরী প্রতিদিন মেজ বৌমার ঘরে প্রদীপ হাতে একবার করে ঢোকে। ফটোর সামন দাঁড়িয়ে বিড় বিড় করে। ঝরণা মারা যাবার পর থেকে এই রুটিনের কোন ব্যতিক্রম হয়নি।

               আজ একটু দেরী করে ঢুকল। প্রদীপটা রেখেই একবার স্থির হয়ে দাঁড়াল ছবির সামনে। ছবির নীচে রবি ঠাকুরের বাণীটি বড় বড় অক্ষরে লেখা আছে  " যে মাঌনুষ প্রেম দান করিতে পারে ক্ষমতা তাহারই , যে মানুষ প্রেম লাভ করে তাহাল কেবল সৌভাগ্য।" ঝরণার ক্ষেত্রে কথাটি একেবারে খাটে।

                 ঝরণা বহু বছর আগে সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেছে। তারপর থেকে ও চলে  যাবার পর সেইভাবে আর কবি প্রণাম এই বাড়িতে প্রাণ ফিরে পায়নি। ঝরণার  মেয়ে এখন কলকাতায় চাকরি ,  পড়াশোনা করে। ও কালে ভদ্রে একবার করে আসে এখানে।  তাও প্রতি বছর না।ও কি পারবে এই বংশের পুরানো ধ্যান ধারণা বজায় রেখে সার্থক কবি প্রণামের আয়োজন করতে ।

           " কি গো মেজ বৌমা , পারবে তোমার মেয়ে তোমার জায়গা নিতে ? ও তো গ্রামেই আসতে চাই না। " আশাবরীর চোখে বাষ্প। অনেক্ষণ নীরবতার পর একটা টিকটিকি ডেকে উঠল - " টক্ টক্ টক্ । "

             একটা সময় ঝরণা সব নিজে হাতে করত। ও  চলে যাবার পর তানপুরাটায় অনেক ধুলো জমেছে। চৌধুরী বাড়িও তার পুরানো গৌরব হারিয়েছে। এখন শুধূ যোগ্য উত্তরসুরীর অপেক্ষা।  পুরানো অতীতটা যে মুছে ফেলার নয়।

              " মেজ , এবার তো কবিগুরুর জন্ম মাসেই রমজান মাস শুরু হয়েছে। ওদিকে মসজিদের ভিতর গতকালের বৃষ্টির জল ঢুকেছে। নামাজ পড়াও বন্ধ। দূদিন পরেই তো পঁচিশে বৈশাখ। আবার ঈদও এগিয়ে এল। " 

             " তুই একদম ভাবিস না বড় , আমাদের যে  দুর্গা দালনটা আছে ,  ওখানেই এবার " রবি প্রণাম " করব। জায়গাটা একটু ঝাড় পোছ করলেই হবে।  আর দালানের সামনে চাতালেই ইফতারও  চলবে আর সেখানে তারাবি নামাজও পড়া হবে । কি বলিস ? "
            " আইডিয়াটা মন্দ বলিস নি। " 

               পঁচিশে বৈশাখের দিন দুপুরেই  আকাশ কালো করে মেঘ করল। আঁধার ঘনিয়ে আসল। চারিদিকে অন্ধকারে।  একটু পরেই শুরু হল প্রলয়। সান্যাল বাড়িতে অনুষ্ঠানে পড়ল ভাঁটা। ওদের  কলকাতার নাচ আর গানের টিম ফিরে  গেছে। মসজিদে জল থৈ থৈ করছে। 

               সন্ধ্যের একটু পরেই আকাশে চাঁদটা উঠল। 
              সবাই ভাবল এবারে " কবি প্রণামের " অনুষ্ঠান বুঝি ডুবল। আশাবরীর কপালে চিন্তার ভাঁজ। ঝড়ে সব লণ্ড ভণ্ড করে দিয়েছে। কি করে কি হবে।

             কিছুক্ষণ পরেই দুর্গা দালানে উঠে ঝরণা গলা ছেড়ে গান ধরল ,

               " মেঘের কোলে রোদ হেসেছে 
                  বাদল গেছে টুটি 
                    ......... ........
                     কি করি আজ ভেবে না  পায় 
                      পথ হারিয়ে    .......... "

                   ঝরণার গান শুনেই একটু একটু করেই ভিড় জমতে শুরু করল। সার্থক হল কবি প্রণাম। এদিকে দালানের একপাশে ইফতার শেষে চলছে তারাবি নামাজ।

                রমজানি চাঁদের আলোতে ঝলমল করে উঠল " রবি প্রণাম। "

                  পঁচিশে বৈশাখ যত এগিয়ে আসছে আশাবরীর কপালে চিন্তার ভাঁজ তত বাড়ছে।

                প্রায় ত্রিশ বছর হয়ে গেল। চৌধুরী পরিবার আর সেই ভাবে কবি প্রণাম করতে পারেনি। কারণ ঝরণার বিকল্প কেউ আসেনি। সেটাই আশাবরীর একমাত্র  কষ্টের কারণ।

             তবে এবার মনে হল সেই যন্ত্রণার যবনিকা পাত হল। মানসীর  সাথে ঝরণার  মেয়ে সোমাশ্রীর ট্রেনেই আলাপ। মানসীর মুখে চৌধুরী পরিবারের প্রশংসা শুনে সোমা বেশ আবেগ বিহ্বল হয়ে পড়ে। মানসী জানত না ও ঐ পরিবারের আদরের মেজ জ্যেঠিমণির মেয়ে।

                 মানসী ওকে কবি প্রণামের বিষয়টা খুলে বলে। তাতেই সোমা চনমনে করে ওঠে।

                 " পঁচিশে বৈশাখের আগের দিন থেকেই আশাবরীর শরীর খারাপ। পরের  দিন সকালেই ঘুম ভাঙ্গল এক মিষ্টি সুরে।

             "  রাখ রাখ রে জীবনে
                  ........
                   জীবন বল্লভে প্রাণ মনে 
                     ধ্বনি রাখ
                    নিবিড় আনন্দ বন্ধনে 
                     .......   ....... " 

                 সুরটা শুনেই চমকে উঠল। শরীরে শিহরণ জাগল। বহুকালের চেনা এ সুর।ঝরণার সাথে অনেক মিল।
                   সন্ধ্যেতে " রবি প্রণাম " শুরু হতেই মানসীর নাচের সাথে পা মেলাল সোমাশ্রী। একটু পরেই শুরু করল নিজের একক যন্ত্র সহযোগে সংগীতানুষ্ঠান।

                     " গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙা মাটির পথ
                         আমার   ....... " 

                       যে মেয়ে গ্রামকে পচ্ছন্দ করত না তার মুখেই আজ গ্রামের প্রতি প্রাণ ঢালা আবেগ।  ভালবাসা উপচে পড়ছে।

                    অনুষ্ঠান শেষ হলে সোমা ঠাম্মির ঘরে ঢুকল। আশাবরী শুয়ে আছে।

                " কে ? " 

                " ঠাম্মি , আমি সমু , তোমার আদরের সোমাশ্রী , ঝরণার মেয়ে। চৌধুরী বাড়ির ঝরণার উত্তরসুরী।  "

                 আশাবরী তড়াক করে লাফিয়ে উঠল।

                    ঝরণার ফটোর সামনে দাঁড়িয়ে বলল , " মেজ বৌমা , তোমার উত্তরসুরী চলে এসেছে। আমি এখন চাপ মুক্ত। কি গো কিছু বলছ না যে ? বুঝেছি রাগ হয়েছে ? "
                  অনেক্ষণ চুপ থাকার পর টিকটিকিটা সেদিনের মতন ডেকে উঠল।
                   " টক্ টক্ টক্ "

                টিকটিকির শব্দ শুনে সোমাশ্রী আর আশাবরী দুজনেই হো হো করে হেসে উঠল।
                ঐ হাসির অনুরণন , কম্পাঙ্ক একটু একটু করে রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে ছুটে চলল দূরে , অনেক দূরে। চৌধুরীবাড়ির উত্তরসুরীর আগাম পূর্বাভাস দিতে।


No comments:

Post a Comment