PravatiPatrika

Wednesday, May 13, 2020

অনুগল্প ও গল্প


                            স্যাক্রিফাইস
                                      কবিরুল


                 দুর্নিবার সমাপ্তিকে গভীরভাবে  ভালবাসলেও বিদর্ভই শেষে ওকে বিয়ে করে।

                                ওদের তিনজনের একটা কোচিং সেন্টারে পরিচয়। তারপর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। 

                                মাঝে অনেক বছর কেটে গেছে। দুর্নিবারের সাথে যোগাযোগটাও একপ্রকার ছিন্নই বলা চলে।
                                 

                                                 **********
     

             এরপর হঠাৎ একদিন দুর্নিবার জানতে পারে  সমাপ্তির  কিডনি ড্যামেজ হয়ে গেছে ,  সমাপ্তি মা হতে পারবে না।

                দুর্নিবার  শোনামাত্র আর দেরী করেনি ,  কিডনি দান করে সেই সাথে নিজের পালিত সন্তানকেও।

                দুদিন পরেই   দুর্নিবার সেপ্টোসেমিয়াতে আক্রান্ত হয়ে  মারা যায়।

                    দুর্নিবার মারা গেলেও  বেঁচে থাকল ওর অকৃত্রিম পবিত্র  ভালবাসা।

   


                                ক্লেদাক্ত
                                        অগ্নিমিত্র


  রোজকার মতো নিশিগন্ধাকে বাকি সব কর্মচারীর  সামনে অপদস্থ করে তৃপ্তির হাসি হাসলেন কর্নেলবাবু । এই জায়গায় মেয়েরা অনেকেই কাজ করে, তবে তাদের বেশি বাড়াবাড়ি  কর্নেল কমলেন্দ্রের সহ্য হয় না।.. তা সে কাজে বেশি দক্ষ হলেও ..।
  অন্য  মেয়েরা তো এমন না ! কমলেন্দ্র যা খুশি বলেছেন তাদের, মেয়েদের কাঁধ চাপড়েছেন, কই তারা তো এমন উল্টে প্রতিবাদ করেনি! মেয়ে হয়ে অত একরোখা কেন ?!..
 বাড়ি ফিরে মেয়ে শালিনী বলে -' বাবা জানো, পাশের শহরের ঐ সদাগরী অফিসটায় আজ ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলাম ! '
  ' হ্যাঁ, তাই তো রে ! কেমন হলো ?'
 ' আর কী, বিস্তর অপমান করলো । বললো, নাকি মেয়েরা কোন কাজের নয় ।..ওদের নেওয়ার মানেই নেই ।....খুব বাজে ব্যবহার করেছে ।'
  রাগে গা রি রি করে উঠলো কর্নেল কমলেন্দ্রের ।..এত বড় সাহস ওদের ! ওঁর মেয়েকে এ সব বলা ! ...
 হঠাৎ আয়নায় চোখ পড়ে গেল কমলেন্দ্রের ।..আর নিশিগন্ধার মুখটা মনে পড়ে গেল ...!!



                          লকডাউন
                                   প্রশান্ত ভৌমিক

মালতী বিয়ের পর থেকে স্বামীকে নিজের করে খুব একটা পায়নি। বিয়ের পরদিন থেকেই কাজে যোগ দিতে হয়েছে। এবার লকডাউনে মনের সাধ মিটিয়ে সে স্বামীকে কাছে পেয়েছিল কিছুদিন। কিন্তু সাতদিন যেতেই আবার কাজে যোগ দিতে হল স্বামীর। মালতী স্বামীকে বলল- কী এমন চাকরি কর, আমার কাছেই থাকতে পার না?
স্বামী বলল, এই সাতদিন তো চব্বিশ ঘন্টা করেই ছিলাম।
মালতী উত্তরে বলল, সাতদিনে কী হয়!


                        প্রতিবাদী মন
                                বিমান প্রামাণিক

একটা ছোট্ট লাঠি হাতে আমাদের গ্রামের যুবকটি কে? সেই তো মাষ্টারের ছেলে হরি। ভীষন জেদী কিন্তু প্রতিবাদী।
     সনাতন কাকুর মেয়েকে রাস্তার কয়েকটা যুবক আক্রমণ করলে, সেই লাঠি হাতে মোকাবিলা করে। অচেনা হলেও এক বৃদ্ধাকে ব্যঙ্ক ম্যনেজার কটুকথা বললে সেই বাধা দিয়ে প্রতিবাদ করে।
      রাস্তায় কুকুরের মতো ঘুরতে থাকা শয়তানদের এই নবীনটিই সায়েস্তা করে। রাস্তার কলে অযথা জল নষ্টেরও প্রতিবাদ করে। তিনটি কাঠ চোরকেও পাঠায় পুলিশি হেফাজতে।




                      বেরঙিন বসন্ত
                              ----------সৌমেন সরকার

আমার আজকের গল্প প্রেম,রঙ আর বসন্তকে নিয়ে।তাই গল্প শুরু করার আগে ওদের সম্পর্কে কিছু বলে নেওয়া দরকার।
আমার গল্পের এই প্রেম,রঙ আর বসন্ত কিন্তু নাম বা ভালোবাসা বা কালার বা ঋতু নয় একদমই।এরাই আমার আজকের কাহিনীর মূল চরিত্রত্রয়।
রঙ আজকের গল্পের নায়িকা।আর অন্য দুজন হল তার নাশকদ্বয়।কাহিনীর নামভূমিকায় বসন্তের নাম দেখে অনায়াসেই অনুমান করা যাচ্ছে যে আমার এই কাহিনীতে বসন্তের ভূমিকা সর্বাধিক।এক কথায় তার কাহিনীই আমার এই গল্পের মূল উপজীব্য।
               আজ দোল পূর্ণিমা।তবুও চণ্ডীমন্ডপের বটতলায় রঙে ভূত হয়ে যাওয়া মানুষগুলোর মধ্যে বসন্তের দুচোখ খুঁজছে কোন এক বিশেষ ব্যক্তিকে।সে খুঁজছে তার প্রথম ও শেষ ভালোবাসা রঙকে।আবার কখনও তার পাশে তাকিয়ে দেখছে তারই মত ভগ্নহৃদয় প্রেম হৃদয়বিদারক যন্ত্রণা নিয়ে পাগলের মত ঘুরে আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে কি না।না,কাউকেই তার দুচোখ আবিষ্কার করতে পারল না।তবে সত্যিই কি...না...তা হতে পারে না!তা অসম্ভব!রঙ তাকে এভাবে জিল্ট করতে পারেনা।
একে একে মনের আঙিনায় উঁকি দিল তার ঠকে যাওয়া ও ঠেকে যাওয়া তিক্ত অতীত।কিছু টুকরো স্মৃতি,কিছু টুকরো কথা।
মনে পড়ে গেল দু-বছর আগের কথা।
তার প্রথম ও শেষ প্রেমের ইতিহাস।
দু-বছর আগে এখানে,এই চণ্ডীমন্ডপের বটতলাতে এমনই দোলের দিন রঙের সাথে তার আলাপ হয়।সে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা।আর প্রেমের সাথে আলাপের ঘটনাও বেশ রোমাঞ্চকর,তবে সে কথায় একটু পরে আসছি
      সকলে রঙ মেখে ভূত ছিল।বসন্তের একটা রেকর্ড ছিল এই যে,তার নাম বসন্ত হলেও তাকে নাকি কেউই দোলে রঙ মাখাতে পারেনি।আসলে ও অ্যাথলেট,তাই দৌড়ে ধরা কারও পক্ষে সম্ভব নয়।কিন্তু ওর সে রেকর্ড প্রথম ভেঙেছিল রঙ।ওকে আবীরে রাঙিয়ে নাকানিচোবানি খাইয়েছিল প্রচুর।অবশ্য ওর থেকে ওর মন বোদহয় বেশী পরিমাণে বিদ্ধ হয়েছিল।
ঘটনাটা ছিল এরকম।
হাতে মোবাইল নিয়ে বেশ হেলতে দুলতে আসছিল বসন্ত।হঠাৎ পিছনে বেলুন রঙ পটাস্ করে ফাটল।ঠিক এই চণ্ডীমন্ডপের এখানে বট গাছের নীচে।সারা পাড়া অবাক!ভাবল এবার যে রঙ মেরেছে তার চোদ্দ গুষ্টির ষষ্ঠীপূজো করে ছাড়বে বসন্ত।
কিন্তু হল হিতে বিপরীত।পিছনে ফিরে হাত উঁচিয়ে মারতে গিয়ে দেখলে ওকে রঙ বেলুনে বিদ্ধ করেছে একটা মেয়ে।যাকে দেখেই ওর মনের দরজা জানালা সবই গুম হয়ে গেল এক মুহূর্তে।অসম্ভব সুন্দরী সেই মেয়েটা ও কিছু বলার আগেই মেয়েটা ওর হাত ধরে হ্যান্ডশেক করে বলল-
"বুরা মাত মানো হোলি হে আজ।হ্যাপি হোলি।"
বিহ্বল দৃষ্টিতে মেয়েটার দিকে তাকিয়েই রইল বসন্ত।মেয়েটা হাত ধরে বলল-
"হাই,আমি রঙ;রঙিন সেন।"
-"আমি বসন্ত,বসন্ত রায়।"
-"আমি রঙ খেলায় মামাবাড়িতে বেড়াতে এসেছি।এই নাও চকলেট।"
এই বলে সে বসন্তকে সত্যিই একটা চকলেট দিল।

তারপর আর কথা হলনা।
এই ঘটনাটা মেয়েটা হয়ত ভুলে গেল।কিন্তু বসন্তের মনে সে রঙ সারাজীবনের মতই লেগে গেল।
মাস দুই তো বসন্ত সারারাত ঘুমোতেই পারেনি।তখন ঠিক করল মেয়েটাকে প্রপোজ করবে।একদিনেই সে তার প্রেমে পাগল হয়ে গেছে।
                             

ওর কপালটা বোদহয় ভালো।মাস তিনেক পর মেয়েটা আবার মামাবাড়িতে বেড়াতে এল।তখন এই বটতলার নীচে ওর সাথে দেখা করে ওকে একটা গোলাপ আর একটা ঘড়ি গিফট করে প্রপোজ করল।রঙ শুধু একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলল-
"এতদিন সময় লাগল এই কথাটা বলতে।"
এই বলে গিফট গুলো নিল।আর ফোন নম্বর এক্সচেঞ্জ করে চলে গেল।বলে গেল-
"আমার উত্তর পেতে আগামী দোল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।তবে ফোনে যোগাযোগ রেখো।"
ফোনে কথা চলল দুরন্ত গতিতে।বসন্তের মনে আর কোন সন্দেহই নেই যে রঙ তাকে ভালোবাসে।কিন্তু এখনও অনেক কিছুই ওর জন্য অপেক্ষা করছিল।
ক্রমে দোল চলে এল বছর ঘুরে।
তখনই ওর আর রঙের জীবনে আগমন ঘটে প্রেমের।
সে রঙের আর এক প্রণয়ী।ওই এক ফুল অর দো মালী আর কি।
রঙিন বসন্তকে প্রেমের সাথে আলাপ করিয়ে বলল-
"এ প্রেম।আমাকে সেই ক্লাস ফাইভ থেকে ভালোবাসে।এবার বল আমি কি করি?"
সত্যিই কেসটা পুরো জন্ডিস হয়ে গেল।
        কিন্তু চমকানোর এখনও ঢের বাকি ছিল ওদের।তখন রঙ বলল-
"তোমাদের জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে
দাঁড়াও,ওয়েট ফর এ হোয়াইল।"
প্রেম আর বসন্ত-দুজনেরই মুখে কোন কথা নেই।হার্টবিট যেন থেমে গেছে।
একটু পরে একটা ছেলের হাত ধরে ওদের সামনে এসে দাঁড়াল রঙ।বলল-
"মিট মাই ফিয়ানসে,ডঃ আবীর সেনগুপ্ত।"
সারা আকাশ যেন ভেঙে পড়ল ওদের মাথার ওপর।প্রেমের কথা বলতে পারবে না,কিন্তু বসন্তের যেন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল।চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইল ঝরনা অঝোর ধারায়।এ সে কি দেখছে।তবে তার মন নিয়ে এমনভাবে ছিনিমিনি খেলার মানেটা কি?সে তো প্রকৃতই ভালোবাসে রঙকে।সে কি করে তাকে ঘৃণা করবে!কি করে তাকে ছাড়া বাঁচবে?জীবনের বাকি দিনগুজরানো তার পক্ষে নিতান্তই বোঝা হয়ে দাঁড়াবে যে।
      সে প্রায় বছর খানেক আগে ঘটে গেছে।এতদিন হয়ত রঙ আবীরকে বিয়ে করে সুখে সংসার করছে।আর প্রেম মন ভাঙা আয়নার মত বসে নেই,সেও খুঁজের নিয়ে তার প্রেমের আশ্রয় আরশিকে।কিন্তু বসন্ত?না সে ভেঙে পড়েনি বা আত্মহননের পথ বেছে নেয়নি।কারণ,দোষটা তো পুরোটাই তার।রঙ তো তাকে ভালোবাসি বলেনি।সেই তো পুরোটাই অনুমান করে ভুল করেছিল।এখানে রঙকে কোনমতেই দোষী মানতে চায়না সে।
এক দোল তার মনকে গভীরভাবে রাঙিয়ে দিয়েছিল,আর পরের দোলে তার মন ও আশা ভেঙে টুকরাে টুকরাে হয়ে গেল।তবে দোষী শুধুমাত্র বসন্তের পোড়া মন।তার ভগ্ন হৃদয়।সে কত বড় বোকা।
ভবিষ্যতে সে প্রতিষ্ঠিত হবেই।তাছাড়া এখন এটা তার জেদ হয়ে বসেছে।তবে সে আর কখনও কাউকে ভালোবাসতে পারবেনা
যদি আবার তার মনে লাগা রঙকে কোন আবীর এসে নিয়ে চলে যায়।সে আজ বড় ধূসর!বড় বেরঙিন!শুধু নিজের বোকামির জন্য সে আজ বেরঙিন বসন্ত।
 

                   
                          জেনারেলি বেগম
                  রুম্পা দে ও শ‍্যামাপ্রসাদ সরকার


সন ১৭৮১
--------------
স‍হ‍্যাদ্রি পর্বতের কোলে থাকা পুনিকাবিশ্ব নগরী। রাষ্ট্রকূট সাম্রাজ‍্যের সময় সে জেগে উঠেছিল অনেক আগেই। যুগে যুগে তার নবজন্ম হয়েছে। কখনো তার নাম হয়েছে 'পুন‍‍্যাবতী' আবার কখনো বা 'পুনা'!

আপাত তার এই শান্ত জনজীবনে কিন্তু প্রায়শই হায়দ্রাবাদী সেনার অস্ত্র ঝনঝনানি তাল কেটে দেয় ।সহ্যাদ্রি পর্বত সংলগ্ন ঘন সবুজে ঘেরা এই ছোট্ট জনপদটির নাম হল খারাওয়াধি। এটি আসলে চিৎপাবন ব্রাহ্মণ অধ্যুষিত একটি গ্রাম।

******
পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই মুরলীধর আপ্তে আর তার প্রায় অর্ধেক বয়সী ঘরণী পদ্মিনীর সংসারের দিকে তাকানো যাক। সন্তানেচ্ছায় এই প্রৌঢ়ের এই নিয়ে দ্বিতীয় দার পরিগ্ৰহণ। প্রথমপক্ষের পত্নী ঊষাবাঈ এর মৃত্যুর প্রায় দশ বছর বাদে
অপ্সরাসদৃশ না হলেও উদ্ভিন্নযৌবনা পদ্মিনীকে দেখে মুরলীধর অন‍্যমনা হলেন।  প্রথা মোতাবেক সংসারী হলেও স্বাভাবিক কারণেই কখনোই পতিগতপ্রাণ হয়ে ওঠেনি পদ্মিনী। তার যৌবনশ্রী বরং নিজামী সেনার ঋজু গঠনের প্রতি ধাবিত হতে চায়।তার আয়ত দীঘল চোখ আর বুকের মধ‍্যে লুকিয়ে রাখা কস্তুরী আতরের সুগন্ধ তাকে বারবার উন্মনা করে। যৌবন যে বড়ই লজ্জাহীনা।

******
গ্ৰামের পশ্চিম সীমানায় বড়ো জলাশয়ের ধারে মাঝে মাঝেই তার দেখাসাক্ষাৎ ও নিভৃত অভিসার চলে ফৌজদার জাহিরউদ্দিনের সাথে।সময়ের সাথে সাথে কিছু মদির মুহুর্ত সঞ্চয় করে পদ্মিনী আর তার ভ‍্রমরটিও থাকে মধুপানে বিহ্বল। পুরস্কারে অবশ‍্য সে অর্জন করেছে গ্ৰামবাসীর সাথে তার  স্বামীটির নিরন্তর গঞ্জনা।

 এরকম ঘটনা তো ব্রজভূমিতেও আগে হয়েছে বলে পুঁথিতে বলে। কথকঠাকুর গোবিন্দরামের আসরে সবাই গদগদ হয়ে তা শুনেছে। তখন তো কেউ দোষ দেয় না! সে জানে গঞ্জনাই তো অভিসারের অভিজ্ঞান।
তাও একদিন স্মৃতি হয়ে যায় সেসব দিন।মুরলীধর দ্বিতীয় বিবাহের সাত বছর পর কন্যা সন্তানের পিতৃত্ব লাভ করে ভুলে যান পদ্মিনীকে ঘিরে রাখা গল্পগুলি।অবশ্য শিশুকন্যার গাত্রবর্ণ চোখ নাকের তীক্ষ্ণতা গ্ৰামবাসীদের মশলাদার খোরাক জুগিয়েই চলে।

********

বছর পনের কেটে গেছে তার। দেশে এখন ফিরিঙ্গিদের বাড়বাড়ন্ত। কোম্পানির গোরা সিপাইদের জুতোর গটমট শব্দ ওড়ে অধুনা পুনা শহরে।নগর ছাড়িয়ে পাহাড়ের কোলেও তারা ছাউনি ফেলেছে। শিবাজীর সাতারার দূর্গটি ওদের দখলে এখন।

নেটিভ জায়গীরদারদের  মধ‍্যে খাজা আব্বাস আলী সবার কাছে কাছে বেশ আকর্ষণের বস্তু।অনেকেই তাকে উঁকিঝুঁকি মেরে দেখে। তবে মীনাক্ষী নামের মেয়েটি একদম ভিন্নতর। প্রায় স্বর্ণাভ গায়ের রঙ দীর্ঘ বাদামী কেশদাম আর  মরাল গ্ৰীবা এবং শিল্পীসুলভ হাত পা'র সাথে আর আশ্চর্য মোহাবিষ্ট দুটি চোখ। ওদের গোষ্ঠীতে সুরা এবং মাংস দুই নিষিদ্ধ। কিন্তু মীনাক্ষীর বোধ হয় সব নিষিদ্ধ জিনিসেই আকর্ষণ বেশী। শুধু তাই নয় কী করে যেন গোঁড়া ব্রাহ্মণ বাড়ির মেয়ে হয়েও ঠুমরী গজলের সুর বেশ বসে তার চিকন গলায়। পা এর তাল ও নেহাৎ মন্দ নয়।

আব্বাস আলীর চোখে ভাসে  একটি নতুন কিশোরীর মুখ যার শরীরে ভীমা নদীর পাহাড়ী ঝর্নার উচ্ছ্বাস।চোখে ক্ষণপ্রভা বিদ‍্যূৎের ঝলক।
বজ্রমাণিক দিয়ে গাঁথা মালাটি তার নিজের গলায় পরার বড় শখ। আর এই স্বপ্ন সে সত্যি করবেই একদিন যে কোন ভাবেই।

******
বছর ছয়েক হল পদ্মিনী গত হয়েছে। মৃত্যুর আগে কারা যেন প্রায়ই আসতো তার কাছে মীনাক্ষীর দাবী নিয়ে। তারপর একদিন নটরাজ মন্দিরের চত্বরে মিলল তার রক্তমাখা কাপড়ের টুকরো।সবাই বলল পাপের ফল। মুরলীধর পর্যন্ত চোখের জল ফেলল না। সবাই জানে  মীনাক্ষীর আসল বাপ নাকি মুরলী নয়,  কোন এক নিজামী সেনা যে কিনা কেমন করে যেন বাদশা ঔরঙ্গজীবের উত্তরপুরুষ ও বটে। লোকে বিশ্বাস করল মীনাক্ষী মরেছে। মুরলীধর নিজের
মনকেও তাই বুঝিয়েছে।

*******
মুঘল দরবারে ঠাটবাট অবলুপ্ত হওয়ার পথে। তবুও লালকেল্লায় বা দিল্লীর অভিজাত পরিবারগুলির  তেওহারের দিনগুলো  রোশনাই হয় যার নামে বা ঘুঙুরের বোলে তিনি হলেন স্বয়ং মাহারুত্তুন মোবারক উল নিশা বেগম। চলনে বলনে চাহনি বা বাক্যালাপে অন্য নর্তকীদের সাথে তার আলোকবর্ষীয় ফারাক। তার আভিজাত্য আর চোখের ভাষা  দিল্লীর তামাম পুরুষহৃদয়ে একই সাথে বেহস্তের সুর আর দোজখের দুশমন সংসর্গের মতো বাজে।

*****
মুঘল দরবারে আজকাল কোম্পানির রেসিডেন্ট লুনি সাহেবের খুব খাতির। সাদা চামড়া আর নীল চোখের এই ফিরিঙ্গি সেনাপতিটির নাম মেজর ডেভিড অক্টারলোনি। এদেশীয় কালা আদমিরা ডাকে 'লুনি সাহেব' । এই কাঁচা বয়সেই  সে নাকি অনেক জঙ্গ  ফতে করে এসেছে। শিখ  বীর রণজিৎ সিং থেকে নেপালের গোর্খা প্রধান এমন কি ভয়ঙ্কর পিন্ডারীদেরও কোম্পানি বশ করেছে এঁর নেতৃত্বে।

আবার মানুষটাই  কালা আদমি গুলোর আদবকায়দা ভালোবাসে। এদের পোশাক এদের খাবার এদের ভাষা সবই এর খুব পছন্দের।
এমন সাহেব একটু দিলদার না হলে হয় নাকি!স্বভাবটাও তাই তার বাদশাহী দিল্লীর অনুরূপ।রীতিমত এক ডজন বিবির হারেম তার ।কেউ সেখানে হিন্দু কেউ পার্শী কেউ বৌদ্ধ কেউ বা শিখ আবার কেউ বা মুসলমান।

*********
লুনি সাহেবের মজলিসে মোবারকের আজকাল বেশ ঘনঘন ডাক পড়ে।সে ও এখন বেশ এড়িয়ে চলছে চিরায়ত দিল্লীবাসীকে। দিল্লীর বুকে বসে ভাবীকালের নতুন ভাষা বোধহয় মোবারক পড়ে ফেলেছে।প্রাণের গভীরে যে বিষবৃক্ষের স্মৃতি সে বয়ে বেড়ায় সেই বৃক্ষরোপণ হয়েছিল এই বাদশাহী বংশের কারো একজনের হাতেই। সেটা মোবারক কখনো ভোলেনি।শৈশবে শোনা মহাভারতের গল্প তাকে পথ দেখায়।

আত্মমর্যাদায় নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে এবং সেই মুঘল বংশের সমূল উৎপাটন শিশুকাল থেকেই মোবারকের ধ্যানজ্ঞান। তার ষোল বছরের চোখে ঝলসিয়ে ওঠে প্রতিহিংসার আগুন। সে আগুনে এতদিন গা সেঁকেছে আব্বাস আলী, এবার তার লক্ষ‍্য লুনি সাহেব।

********
মীনাক্ষী মরেছিল  ঠিকই। তবে এখন বেঁচে আছে যে তার নাম মোবারক বেগম। কলমা পড়ে কাজীর কাছে সে নতুন করে প্রকাশ পেয়েছে। শুখা গ্রীষ্মে মহাবলেশ্বরের বনে যে আগুন জ্বলে ভগোয়া রঙের। সেই আগুনকে সে এবার পুষেছে তার মাখনের মত নরম শরীরে। বেশরম দেহের খাঁজে খাঁজে তাই ধিকিধিকি জ্বলে দোজখের চিতা।

**********
লুনির কাছে ঘন হয়ে বসে মোবারক বেগম। দামী খস্ ঈত্বরের মাতাল করা সুগন্ধ আসছে তার উপচে পড়া স্তনসন্ধি থেকে। সে আজ সাহেবকে  মদির আহ্বানে ডেকেছে মায়ার খেলায়। লুনিসাহেব এই মেয়েটিতে বেশ মজেছেন। লুনী নিজের দেহের সাথে মোবারকের ডালিমের মত টকটকে লাল রঙের গাল আর ফিনফিনে পাতলা ঠোঁট দুটো আলতো করে চেপে ধরেন। তারপর নিজেই কাঁচুলীর ফাঁস আলগা করে দেন।

*****
ডেভিড অক্টারলোনির মোট তেরো জন উপপত্নীদের  মধ্যে  "জেনারেলি বেগম" এর সান্নিধ‍্যই আজকাল তিনি সবচেয়ে উপভোগ করেন। একবছর হল সে উপহার দিয়েছে অক্টারলোনির কনিষ্ঠতম উত্তরাধিকারটিকে।

 মোবারক ভাবে তার গন্তব‍্যের পথে সে আস্তে আস্তে সাফল‍্যের আলো দেখতে পাচ্ছে। ইংরেজ প্রভুরাই আপাতত অনেকদিন হিন্দুস্থানে রাজ চালাবে। তার সাথে সাথে মুঘল দরবারের শেষ কাঁটাটাও একদিন উপড়ে আসবে অচিরেই।
' আমিও মক্কায় হজ্  করতে যাব' এরকম এক রাতে বিছানায় লুনীর বুকে মাথা রেখে আদুরে বিড়ালের গলায় বায়না ধরল মোবারক বেগম। তার কোলের শিশুটি ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। রাতের মোমদানির গলে যাওয়া আলোয় ডেভিড দেখলেন তার প্রিয়াটি এখনো সমান আকর্ষণীয়া। সন্তানের জন্ম দিয়ে কিঞ্চিৎ মেদবাহুল‍্য ঘটলেও তা তার সৌন্দর্যহানি ঘটাতে পারেনি।

******
কোম্পানীর রেসিডেন্সীতে একজন নতুন চিড়িয়া এসেছে। তার নাম ফেলিক্স হ‍্যামারস্মিথ। দিল্লীর মাটিতে অক্টারলোনির  প্রভাব প্রতিপত্তি আর সাথে মোবারক বেগমও তার জ্বলনের একটা অন‍্যতম কারণ। একটা নাচনেওয়ালীর এত দেমাক!

কমিশনারেটের এক সভায় ছোকরা তো একদিন মন্তব্য করে বসলো যে - "স্যার ডেভিডকে দিল্লির কমিশনার বানানো আর জেনারেলি বেগমকে কমিশনার বানানোটা আসলে একই ব্যাপার। "  খবরটা হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে ডেভিডের কানে এসেও পৌঁছেছে।  শুনতে পেয়ে অপমানিত লুনি সাহেব এর উত্তর দেওয়ার মওকা খুঁজতে লাগলেন। আর মওকা এসেও গেল যথাসময়ে।

ক্রিসমাসের সময় গভর্ণর হাউসের পার্টির নাচঘরে মোবারককে একেবারে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে লাটবাহাদুরের সাথে আলাপ করিয়ে দিয়ে বললেন- " হিজ মেজেস্টি! হিয়ার ইজ মাই ওয়াইফ - অক্টারলোনির এই পত্নীটি এখন তার গৃহ অভ্যন্তরে থাকা প্রত্যেকের গৃহকত্রী!"

ঘটনাটায় সাহেবেরও  নিন্দা হয়েছে বটে, তবে গায়ের জ্বালাও জুড়িয়েছে কতকটা। হ‍্যামারস্মিথ আপাতত কেন্নোর মত গুটিয়ে থাকে তাঁর সামনে। লাটভবন থেকে ফিরে নিজেকে "লেডি অ্যাকটারলনি" বলে ব্রিটিশদের কাছে উপস্থাপন করতে আর বাধা রইল না।মোবারক খুব খুশি। এখন বাকি আছে একটাই কাজ।  নিজেকে  মুঘলদের কাছে "কুদসিয়া বেগম" রূপে তুলে ধরা, যা সম্রাটের মায়ের জন্য সংরক্ষিত উপাধি।

*********
আজকাল মোবারকের নিজের মা'কে মনে পড়ে থেকে থেকেই। তার দুটো মা। সেই সহ‍্যাদ্রির কোল ছোট্ট গ্রাম খারাওয়াধিতে তার জন্মদাত্রী মা পদ্মিনী আর তারপরের সেই দুঃস্বপ্নের দিনগুলোয় তাকে পালন করেছে যে মা সেই মা....ফরজানা বাঈ....এ দুজনকেই সে এক চোখে দেখে।

 সেবার শিবরাত্রির দিন উপোস করেছিল মীনাক্ষী। নটরাজ মন্দিরে পুজো সেরে বেরিয়ে আসতেই দলবল নিয়ে পথ আটকে দাঁড়িয়েছিল পাঠান আব্বাস আলী। তাকে চেপে ধরে ওরা সবাই মিলে একটা পাথরের ওপর ওকে জোর করে শুইয়ে.....মুখে কাপড় গুঁজে পরপর এক এক করে জানোয়ারের মত....

তারপর কিভাবে যে সে ফরজানা বাঈএর কোঠীতে পৌঁছেছিল তা আর  মনে নেই। কেবল মনে আছে তলপেটে খুব ব‍্যথা আর ঊরু থেকে গড়িয়ে নামা চ‍্যাটচ‍্যাটে রক্তের ধারাগুলো। ফরজানা বাঈ নিজের বেটী বলে মেনেছিল ওকে।সারাটা জীবনভর যতদিন বেঁচে ছিল মুবারককেই আঁকড়ে বেঁচেছিল বুঢ়িয়াটা।
সে সব নষ্ট হয়ে যাওয়ার অতীতকাহিনী গুলো মনে পড়লেই  মুবারক বেগমের দুচোখে কেবল ঘৃণা আর ক্রোধ এসে জমে। তখন আর কান্না পায়না তার। প্রত‍্যেকটা রাত তখন মেহফিল আর আমীর ওমরাহ্দের বিকৃত কামনায় ছিঁড়ে ছিঁড়ে টুকরো হয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে তার ষোল সতের বছরের ইচ্ছে মত দিনযাপনের স্বপ্নগুলো। আজ তাই একটাই স্বপ্ন তার। তামাম হিন্দুস্তানের মালিকা -ই- জাঁহা হওয়ার। নিদেনপক্ষে "কুদসিয়া বেগম"ই অন্তত।

******

সন ১৮২৫ ::
------------------
 মির্জা গ্বালিবের ভাগ্নে বলেই শাহ্পুরার হাভেলীতে  আশফাককে  ডেকে পাঠিয়েছিল সেদিন।  ছোকরাকে দেখতে শুনতে ভাল। আর ওর মামাটিও বেশ....আহা! গ্বালিবকে বয়েৎ বলতে তিনি শুনেছিলেন নিজামুদ্দিনের আসরে। বড় মন ছুঁয়ে গেছিল কয়েকটা কথা।

এখনো কানে ভাসে যেন -

"কে মেরে কতল কে বাদ উসনে জফা সে তওবা
হ‍্যায় ঊস যুদ পশেমান কা পশেমান হোনা...."

মোবারক বেগম তার  তৃতীয় মেয়ে পারভিনকে তুলে দিলেন আশফাকের হাতে। দেরী করার মত সময় আর হাতে নেই।আস্তে আস্তে যৌবন চলে যাচ্ছে। প্রতিটি অস্তগামী সূর্য আসলে রাত্রিকেই  যেন নিমন্ত্রণ করে আনে, এটাই অমোঘ সত‍্যি ।  মোবারকের অক্টারলোনি সাহেবও সেই সময়কে ফাঁকি দিতে পারেননি। বছর ঘুরতে যায় সাহেব ঘুমিয়ে পড়েছে কবরের অন্ধকারে। আর  তার মৃত‍্যুর পর থেকেই একদিকে ইংরেজ রেসিডেন্টরা  মুঘলদের ছড়িয়ে থাকা অবশিষ্ট ওয়াকফদের সাথে জোট বেঁধে পাল্লা দিয়ে বেইমানী করেছে তার সঙ্গে। অথচ এই মোবারক বেগম, ওরফে জেনারালি বেগম একদা  ভারতের বিভিন্ন  প্রদেশের স্বাধীন  রাজ্যগুলির রাষ্ট্রদূতগণের সাথে কোম্পানীর হয়ে লেনদেনের সময় নিজার এবং খিলুটস(যৌতুক) প্রদান করেছে কতবার। অবশ‍্য  অক্টারলনির মৃত্যুর পরে, তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে মোবারক বাগ, পুরানো দিল্লির উত্তরে অ্যাংলো-মোগল উদ্যানের সমাধিসৌধটি পেয়েছিলেন।
সেখানে  মুবারক বেগম নিজের তহবিলের সিক্কা দিয়ে একটা মসজিদ বানিয়েছে, সেটির গায়ে মাকরানার পাথরে ফার্সীতে খোদাই করিয়েছে "মসজিদ-ই- মুবারক বেগম"।

 কিন্তু মুঘলদের সাথে  সুসম্পর্ক না থাকার কারণে  সেই খয়রাতের উপযুক্ত সম্মান জোটেনি। উপরন্তু তার পূর্ব জীবনের ইতিহাস তুলে মসজিদটিকে সাধারন মানুষ "রেন্ডির মসজিদ" হিসেবে ডাকা শুরু করেছে এবং তার ওই মসজিদে মুঘল পরিবারে সঙ্গে যুক্ত কেউ নামাজও পড়তে আসেনা।

জেনারেলি বেগমের জীবন ফুরিয়ে আসছে....অস্তবেলার সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়ার আগে মগরীবের নামাজ ফুকরিয়ে ওঠে!

*****

 সন ১৯৪৮ ::
------------------
হজ কাজী চৌক বাজার, লাল কুয়ান বাজার, পুরাতন দিল্লী,  পুলিশ স্টেশন এর কাছেই একটা ভগ্নপ্রায় মসজিদ আছে। এখানে অনেকদিন কেউ নামাজ পড়তে আর আসেনা। যেন জায়গাটাকে আল্লাতালা নিজেই বাতিল করে দিয়েছেন।

মসজিদের একদিকের চাতালে কয়েকঘর লোক ঝুপড়ি বানিয়ে থাকে। এরা সব পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসেছে। রাতারাতি দেশভাগের বিপর্যয় সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে পথের ভিখারী করে দিয়েছে পরিবারগুলোকে।

হামিদ পেশোয়ারের লোক। বৌ আর তিনটে বাচ্চা নিয়ে ওয়াগা বর্ডার পার করে কোনওমতে দিল্লী এসে পৌঁছতে পেরেছে। তার ফুফা করৌলবাগের শাহী মসজিদের মুয়াজ্জিন। তিনি ওকে এই চত্বরটির সন্ধান দিয়েছেন। ঘর বাঁধতে তাই অসুবিধা হয়নি।  হামিদের একটি মেয়ে, নাম রেশমা, অন‍্য দুটি পিঠোপিঠি বয়সের দুটি ছেলে। রেশমা আজকাল গুন গুন করে নিজের মনে। মন্দ লাগেনা শুনতে । হামিদ বিষন্নতা মাখানো এই বিকেল গুলোয় ভাবে তার খানদানী জীবনের কথা । পেশোয়ারের অতবড়ো গায়ক গোলাম খাঁ জাফরের   উত্তর পুরুষ হয়েও আজ নসীবের ফেরে তাদের এই পথের মধ‍্যে বাস।রেশমার মধ্যে থাকা সম্ভাবনার অপমৃত্যু তাকে ব্যথিত করে । রেশমার বয়স এখন এগারো বছর ,  সে এর মধ‍্যে কোত্থেকে একটা ভাঙা স্লেট জুটিয়ে নিয়ে তার ভাইদের নিয়ে বসে আঁকিবুঁকি কেটে কি সব খেলতে ব‍্যস্ত ওই মসজিদের চাতালে বসে।
**********
পড়ন্ত বিকেলে ট‍্যাঁ ট‍্যাঁ করে একঝাঁক টিয়া মসজিদের ফোকর থেকে বেরিয়ে উড়ে গেল।
রোজ এই সময়ে লাঠি হাতে এক বৃদ্ধাকে চত্বরটায় আসতে দেখা যায়। মহিলাটিকে দেখলে খানদানী ঘরের তা বোঝা যায়। যদিও তা কঠিন জীবনসংগ্রামের ছাপ পড়ে মলিন হয়ে গেছে কবেই। নিশ্চুপ হয়ে মহিলাটি খালি মসজিদের গম্বুজটাকে একবার নিরীক্ষণ করেন। কখনো চাতালে একটু বসেন আবার  কখনো রেশমা আর তার ভাইদের ডেকে কিছু হাতে রেউড়ি বা হাওয়া মেঠাই গুঁজে দেন। ইনি যে কে তার পরিচয় কেউ জিজ্ঞাসা করতে সাহস পায়না,  বৃদ্ধার চোখে একটা সম্ভ্রম আদায় করা চাহনি আছে বলেই হয়তো..নিঃসঙ্গ বৃদ্ধাটি কিন্তু কারোর সাথে একটাও কথা বলেন না। চুপ করেই থাকেন যতক্ষণ এ চত্বরে থাকেন। তারপর অন্ধকার নেমে আসতে আসতে কখন যেন সবার অজান্তে চলে যান। রেশমা'র আজকাল খুব চেনা চেনা লাগে মহিলাকে। আসলে বৃদ্ধাটির ঘোলাটে চোখদুটো দেখলে তার  নিজের দাদীজানের কথা মনে পড়ে যায় হয়তো...

         
                                 পাঞ্জাবি
                                     অর্ঘ্যদীপবিষই


আজ শনিবার, অচিনপুরে কাশফুলের মাঠ দেখে মনে হয় শরৎ কালের আগমন ঘটেছে। আর মাত্র দুদিন বাকি মায়ের আগমন হতে, অচিনপুর স্পোর্টিং ক্লাবে এখন থেকেই ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের আনাগোনা দেখতে পাওয়া যায় সামনের রাস্তা থেকে,প্যান্ডেল প্রায় শেষের মুখে ঝাড়বাতি গুলো সাজাতে বাকি রয়েছে। মন্ডপের ভেতর এরমধ্যেই ছেলেপুলেরা প্যান্ডেলের ওপর নানান খেলায় মেতে উঠেছে এবছর নাকি অনেক টাকায় উঠেছে ক্লাবে, সব বছর ক্লাবের ছেলেরাই পুজো করে নিজেদের পুঞ্জি থেকে কিছু দিয়ে। কিন্তু এ বছর নাকি ক্লাবের ছেলেরা গ্রামেও চাঁদা আদায় করেছে।  তাছাড়া চোখের ডাক্তার অরূপ চ্যাটার্জি নাকি দু লাখ টাকা দান করেছেন মুক্তহস্তে ।তার মায়েরে নাকি অনেক দিনের মানদ  ছিল  ঠাকুরের কাছে যে ছেলে বড় চাকরি করলে তিনি টাকা দেবেন। দুদিন পর পুজো তাই সন্ধের সময় রাস্তায় আলোর অভাব নেই।  সেজন্য দীপুর হাট থেকে বাড়ি ফিরতে কোন অসুবিধা হল না , সে হাট গিয়েছিল কিছু পটল ও ঝিঙ্গে বিক্রি করার জন্য কিছুদিন আগে সে তার মাসির বাড়ি গিয়েছিল দিদির জন্মদিনের জন্য ,কাজেই সবজি বিক্রি করা হয়নি  অনেকদিন তাই বিলে সবজি ছিল অনেক। আজ হাটে মানুষজনের ও সমাগম ছিল অনেক বেশি  কারণ সামনে পুজো  গ্রামের মানুষজন ছাড়াও অন্যান্য জায়গা থেকে অনেক মানুষ এসেছিল হাটে  আগের থেকে কিছু বাজার করে নেওয়ার জন্য ।তাই দীপুর হাতে এসেছে মোটা কয়েক টাকা ।দীপুর বয়স সবে মাত্র 15 বছরে পড়েছে তার বাবা বছর দুয়েক হল গত হয়েছেন।তাই তাকেই  বাড়ির সব কিছু দেখতে হয়  তার মায়ের নাম হলো নীলা স্বামী মারা যাবার পর সেও নানান বড়ো বাড়িতে গিয়ে ঝিয়ের কাজ করে। সেখান থেকে যা উপার্জন করে তা দিয়ে টেনেটুনে সংসার টা কোন রকমে চলে যায় ।দিপুর একটা বোন আছে  ওর নাম নিতু  ও দীপুর থেকে চার বছরের ছোট । হাতে টাকা আসার আগের থেকেই দীপু ভেবে রেখেছিল যে মায়ের জন্য একটা শাড়ি কিনবে ও বোনের জন্য একটা লাল ফিতে দেওয়া জামা । মা ওই একটা শাড়ি  কে দিন দিন পরে তা দিপুর ভালো লাগেনা।  কিছুদিন আগে  সে যখন খাবার খেয়ে উঠে মায়ের আঁচলে হাত মুছতে গিয়েছিল তখন সে দেখেছিল আঁচলের অনেকখানি অংশ ছিঁড়ে গিয়েছে তখন থেকেই সে ঠিক করে নিয়েছিল ,যে মায়ের জন্য একটা শাড়ি কিনবে। নিতু কে এর আগের বছর কিছু কিনে দেয়া হয়নি।  তাই সে সমবয়সীদের জামা দেখে বায়না করেছিল খুব    রবিবারের সন্ধের সময় সে তার মায়ের জন্য শাড়ি আর বোনের জন্য লাল ফিতে দেওয়া জামা কিনে নিয়ে আসে একান্তে রামুদার কাপড় দোকান থেকে , কারণ সে  ওই উপহার গুলি দিয়ে তার মা ও বোনকে খুশি করবে বলে ভেবেছিল।  তাছাড়া সামনে অষ্টমী ওই নতুন জামা পড়ে মা ও বোন যাবে মণ্ডপে।  বাড়ি ঢুকতেই  মা ও বোনকে বলল দীপু- তোমরা দুজনেই চোখ বন্ধ করে হাতগুলোকে আগের দিকে নিয়ে এসো তো  মা একথা শোনার পর ফ্যালফ্যাল করে দীপুর দিকে তাঁকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ , কিন্তু নিতু অনেক আগেই হাত বাড়িয়ে চোখ বুজে দাঁড়িয়ে আছে , দীপু ও তার মা নিতুর কান্ড দেখে কিছুক্ষণ হাসলো  দীপু বলল- কেন দেরি করছো.. করো না মা..  তার মা নীলা দেবী নিরুপায় হয়ে চোখ বন্ধ করলো দীপু রামুদার দোকানের কেনা শাড়ি ও জামা  মা ও বোনের হাতে দিলো। তার মা নীলা দেবী চোখ খুলতে বলল -কি এটা..? দীপু  বলতে যাচ্ছিল খুলে দেখবে তো ওর বলার আগেই নিতু  বলে উঠলো, মা দাদা আমার জন্য নতুন লাল ফিতে দেওয়া জামা এনেছে । নীলা দেবী কিছু বলার আগেই নিতু খুলে দিয়ে বলল  মা তোমার জন্য শাড়ি এনেছে দাদা।  এ কথা শোনার পর নীলা দেবীৱ  শরীরজুড়ে স্তব্ধতার একটা হাওয়া বয়ে গেল  কিছুক্ষণ। নির্বাক হয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকলো  নীলা । চোখ থেকে জল আপনাআপনি গাল হয়ে মাটিতে পড়তে লাগলো । দীপুকে জাপটে নীলা দেবী বুকের  মধ্যে টেনে নিল  কিছুক্ষণ পর বললো - দীপু এই টাকায় তো তোর পাঞ্জাবি কিনার কথা ছিল..? তুই ও এই  একখানি জামা  নিয়ে আর কতদিন চালাবি দীপু..? বাবা থাকা অবস্থায় কত বার  জেদ করেছিলি কিন্তু কিনে দেওয়া  হয়নি  তোর এর টাকাটা তুই কেন এইভাবে নষ্ট করলি বাবা..?  হ্যাঁ আজ  থেকে দু বছর আগে তার বাবা যখন জীবিত ছিলেন তখন দীপু পাড়ার ছেলেদের  পাঞ্জাবি পৱতে দেখে  বায়না করত মা-বাবার কাছে। একবার তো রাগে বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিল সে অনেক খোঁজার পর শ্যামপুকুর ঘাটে গিয়ে সন্ধান মেলে তার। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে দীপু বলল -না মা, একে নষ্ট করা বলে না। নীলা দেবী বললো অষ্টমীতে তুই তাহলে কি পৱবি..?  আমার এখন মাস ও শেষ হয়নি যে তোকে কিছু কিনে দেবো বাড়ির কাজের টাকায়। দীপু বলল তুমি চিন্তা করো না তো মা ।আমি ওই মাসিদের বাড়ি গিয়েছিলাম না সেইদিন  দিদির জন্মদিন উপলক্ষে সেখানে মাসির সঙ্গে হাতে হাত লাগিয়ে অনেক কাজ করে দিয়েছি ।ওরা অনেক বড়লোক ওদের ওই  কালো রংয়ের চারচাকা গাড়ি আছে না ,কি যেন নাম গাড়িটার দিদি বলেছিল যেন, মনে পড়ছে না, ওই গাড়িটা যে ধোঁয়া-মোছা করে সে ঐদিন আসেনি আমি আর মেসো মিলে পরিষ্কার করেছি  তাছাড়া ওদের বাগানের গাছেও জল দিয়েছি, এই সবকিছু দেখে মেসো আর মাসি খুব খুশি হয়ে ছিল। আমাকে বলেছিল তুই কি নিবি বল তোর দিদির জন্মদিনে ..?আমি মাসিকে তখন বলেছিলাম আমাকে একটা পাঞ্জাবি কিনে দেবে গো তুমি..? তখন মাসি হ্যাঁ বলেছিল।কিন্তু তখনই হঠাৎ তোমার শরীরটা খারাপ হয়ে পড়ল আমি আর  দিদির জন্মদিনে উপস্থিত থাকতে পারলাম না।আমাকে চলে আসতে হলো কিন্তু জানো মাসি বলেছে পূজোর সময় আসবে আমাদের বাড়ি ওই  কালো গাড়িটা নিয়ে। দীপু আরো বললো -তাই তুমি চিন্তা করো না শুধু অযথাই। কিন্তু তার মা আমতা আমতা করে বলল তোর মাসি তো কোন বছর এই আসেনা, কতবার বলেছি তবুও। কত বড়ো বাড়ি ছেড়ে আসবে কি এই গ্রামেৱ দিকে। দীপু  আত্মবিশ্বাস নিয়ে বললো -অবশ্যই আসবে। অষ্টমীর দিন চলে আসে অচিনপুরে  জুড়ে  নিখুঁত উচ্চারিত মন্ত্র ও ঢাকের শব্দ বইতে শুরু করে বাতাসে ঢাকের শব্দে আত্মহারা হয়ে যায় মন।বাংলার আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হয় তারই আবাহনগীতি।পুরোহিতের মন্ত্র কানে এসে দোলা দিয়ে যায়-
*যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেন সংস্থিতা  নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ*....  মা ও বোনকে পূজামণ্ডপে পাঠিয়ে দিয়ে  দীপু অপেক্ষা করতে থাকে, একান্তে ঘরের ভেতর। কখন তার পাঞ্জাবি নিয়ে তার মাসি আসবে সে পূজামণ্ডপে যেতেও পারছিনা এই পরিতক্ত পোশাক পৱে ।তার সমবয়সীরা বাড়ির সামনে দিয়ে নতুন জামা পরে পূজামণ্ডপে যায়। দীপু তাদের দিকে হাঁ করে চেয়ে থাকে। হঠাৎ সে শুনতে পায় গাড়ির আওয়াজ, সে  হতভম্ব হয়ে ছুটে বাড়ির ভেতর থেকে, বেরিয়ে আসে সেভাবে তার মাসি এসেছে।বাইরে  এসে দেখে এটা তার মাসির গাড়ি নয় এই গাড়িটা চোখের ডাক্তার অরূপ চ্যাটার্জিৱ  তিনি তার মাকে নিয়ে মন্ডপে যাচ্ছেন। দীপু আবার আনমনা হয়ে বাড়ির ভেতরে আসে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে। অপেক্ষা করতে থাকে পাঞ্জাবির, নিজের মুখের ভেতরে  আপন মনে দীপু কি যেন বলে চলছে  অহরহ। তার দুচোখ দিয়ে জল বইছে। অপেক্ষার প্রহর শেষ হয় না।  মন্ডপের থেকেই  এখনো  নিখুঁত মন্ত্র ভেসে আসছে--
 যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেন সংস্থিতা  নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ




No comments:

Post a Comment