PravatiPatrika

Friday, May 22, 2020

গল্প ও কবিতা

মোটকথা আকাল
প্রাপ্তি  মুখোপাধ্যায়

জিরোই এমন ছায়া নেই আর কোত্থাও
বস্তা বস্তা বিকেল জমছে রাস্তায়
গা -বাঁচায় ভীড়ে প্লাটফর্মের রোদটাও
কাঁধে ঝোলা-ব্যাগ হাসি-হাসি মুখ সস্তায়।

চিটচিটে আলো ল্যাম্পপোস্ট আর চা-দোকান
চাকাগুলো সব চলে যায় কেউ খোঁজ-খোঁজ
ধোঁয়াটে চুমুক অনিয়ম কোনো মধুপান
আলগোছে পিঠে ঠান্ডা নামতো রোজ রোজ।

মুখোশ আড়াল হাতে হাত নয়,নিরুপায়
আতঙ্ক গিলে আশঙ্কা বাঁচে সঞ্চয়,
যুক্তির মুঠো আঙুল খুলছে ভীরুতায়
ঝোড়ো উল্লাস  বসবাস ঘুম নয়-ছয়।

বিভোর হাঁটছি মনে নেই আর কতকাল
মুঠোর মধ্যে শিলালিপি হল পথটাও
তোমারই দু-হাতে জমা হল প্রেম কঙ্কাল
কবর দেবারও অবকাশ নেই কোত্থাও।




 
রাত
নির্মলেন্দু কুণ্ডু

রাত নামলে মুখোশটা খুলে যায় !
দিনভর করে যাওয়া অভিনয় যত
যবনিকা নেমে আসে তাতে ৷
শেষ হয় যতসব মেকি দেঁতো হাসি,
মনের পশুকে মেরে জোর করে মানবিক সাজ !
নিজের স্বরূপ চিনি
আয়নাও করে না আর কোন ধোকাদারি
দিন হলে শেষ ৷

তারপরও
দুই চোখে বুনে চলি নকশীকাঁথা,
দিবালোকে ফুটে ওঠে তাবত ভালো-বাঁচা,
দিন হলে যেগুলোতে জমে থাকে আঁধারের কালো...

রাত হলে খুঁজে পাই ভেতর-মানুষ...




পলাশ
হীরক বন্দ্যোপাধ্যায়

তুমি নীরব জলের সংশয়
তুমি আত্মঘাতী ফাঁস
চিত্ত নয়,বিত্ত নয় তুমি ছায়াকে সত্য ভেবে
ডুবেছো একদিন আজ শেষের তর্পণে এসে দেখি তুমি ই  মহৎ...
প্রজ্ঞায় ভরপুর শুদ্ধ প্রাণ তুমি বসন্তের বজ্রনাদ
জন্মজন্মান্তরের কমলেকামিনী
বিশুদ্ধ পঞ্জিকা মতে কড়িকাঠজুড়ে নামাও লাশ
বলো,ন ইলে  কিকরেইবা ফুটবে পলাশ  ?





   কৃষ্ণচূড়ার  নিচে
           প্রশান্ত  মাইতি


মন শূন্য ঘরে শরীর
ছুঁয়ে দিয়ে গেলে সাপের মতো
হৃদয় ঘন হয়ে এলো ভালোবাসায়
           
নতুন প্রভাতের আলোয় দরজার ছিটকিনি
খুলে এলো প্রথম গোলাপ সুবাস
নদীর কলতান,পাখিদের ঘুম ভাঙ্গার
শব্দ,গাছেদের মৃদু মন্দ বাতাস,
আর তোমার আলমুড়ি দেওয়া সবই
যেন ফুটে উঠলো ভোরের ক্যানভাসে
আমি দেখছি বসে উঠোন দরজায়
         
শূন্য মনের ঘরে তোমার হাসি
মুখ ভেসে ওঠে প্রত্যহ ভোরে
ঝাপসা চোখ কৃষ্ণগহ্বর ভুলে
     
হাসিমুখে দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় কৃষ্ণচূড়ার নিচে ।।
       




অপ্রত্যাশিত ছুটি
রাজশ্রী সেন


এ কেমন ছুটি?
যে ছুটির অবসরে নেই খোলা আকাশের নিঃসীম আহ্বান,
যে ছুটিতে নেই প্রাণের দেওয়া নেওয়ার সবুজ হুল্লোড়,
শুধু আছে নিরন্তর আতঙ্কের প্রগাঢ় প্রচ্ছায়ার নীরবতা।
যে ছুটি বন্দী হয়েছে আজ গৃহে সঙ্গরোধের নিয়মনীতিতে,
যে ছুটিতে প্রেম ছুঁতে পারে না দূরদেশের বাউলমনের অস্তিত্বকে,
যে ছুটির সুপ্রভাতের প্রাককালে সংবাদপত্র জুড়ে মৃত্যুলীলার তাণ্ডব,
যে ছুটি ঘিরে বিবর্ণতার অসহায় কোলাহল,
যে ছুটিতে নেই বসন্তের আবেগী উচ্ছ্বাস,
নেই বৈশাখের নব আগমনের নবীন জয়গান,
সে ছুটির কান্না ভেজা চোখে রিক্ততার হাহাকার।
এ ছুটি কাম্য নয়,
যেখানে নেই শান্তিসুখের  স্বস্তিসুধা,
আছে শুধু জীবন যুদ্ধের দুশ্চিন্তার সংযোজন।
পৃথিবীর দেহের সুস্হতার পরিণামে হোক্ ,
এই দুঃসহ অবসরকামী যন্ত্রণার বিলুপ্তি।
ইতিহাসের পাতায় আক্ষরিক চুম্বনে ছুঁয়ে থাকুক,
এই অপ্রত্যাশিত শঙ্কিত অবসরের দহনশ্বাসের পূর্ব অভিজ্ঞতা।।




ব্যর্থতা
শঙ্খ রঞ্জন পাত্র

আমি বারে বারে হেরে যাই
তবু ঘুরে দাঁড়াই।
কখন যে আসবে সাফল্য ?
চেয়ে থাকি এক দৃষ্টিতে
কখনো দুঃখে মুষড়ে পড়ি ।
ঘুমানোর ভান করে শুয়ে থাকি ,
চোখ বুজে অন্ধকারে ,
পৌঁছাই এক নিস্তেজ দেশে ।
তবু একটু আলোর কিরণ
জাগিয়ে তোলে আমাই
মনটা ভরে তোলে
ঘুরে দাঁড়াবার মন্ত্রে
অচেতন মনটা ধীরে ধীরে
ফিরে পাই চেতনা ।
আমি ব্যাস্ত হয়ে
ব্যর্থতা ঢাকার কারণ খুঁজি ।
যখন দেখি কত পথ পেরিয়ে
কেউ সফল হয়,
আমি বলে উঠি - পথ দেখাও
ওহে পথ প্রদর্শক।




        নিশানা
              -চিরশ্রী কুণ্ডু ( অবন্তিকা)


প্রিয় দিন চলে যায় নিঃশব্দের কোলাহলে,
আজও পরে রয়েছে স্মৃতি মাখা পরন্ত বিকেলে।

স্তব্ধ চারিদিকে লেগেছে বসন্তের ছোয়া,
ঝড়া পাতার মরসুমে সুখের স্বপ্ন বোনা ।

বইছে হিমেল হাওয়া ফাল্গুনের আকাশে,
কোকিলের কুহু সুর বসন্তের আঙিনা জুড়ে।

মনের কোণে দাঁড়িয়ে আছে বসন্তের পরশ
চোরাবালিতে হারিয়ে গেছে একরাশ আবেগ।




               নববর্ষ
       বসন্ত কুমার প্রামাণিক


ঝরাপাতাগুলি হওয়ায় উড়তে উড়তে
নবকিশলয়ের জন্য বার্তা দিয়ে গেল-
তাদের স্বচ্ছন্দে রেখো।
পুরানো জমে থাকা বিষাদগুলো
দূর করে যেন জীবন হর্ষিত হয়ে ওঠে।
নববর্ষে পৃথিবীব্যাপী অবসান হোক-
যুদ্ধ-হিংসা ও মহামারীর।
সুপ্ত স্বপ্নগুলো সার্থক হোক।
সকলে শত্রুতা ভুলে বন্ধুত্বের হাত বাড়াও,
নতুন সূর্য উঠবে নতুন প্রাণ নিয়ে।




এবেলাতেই শিখিয়ে নিয়ো
                   লিলি সেন


ছেলে জন্ম দিয়েছ?বেশ বেশ বেশ।
তবে ছেলেবেলাতেই শিখিয়ে নিয়ো নীতিবোধ,
নচেৎ বৃদ্ধ বয়সে পস্তাতে হবে শেষ-মেশ।
দুমুঠো ভাতের জন্য হয়তো বা সকালেই দেখবে
কলিকালের ঘোর অমাবস্যার রাত!
তোমার সম্পত্তি সম্পদ হবে,আর খুরধার
তুমি নিছক জঞ্জাল হয়ে এক্কেবারে কাত।

কি যে বলো, এখনো তো ওকে খাইয়ে দিতে হয়,
জানোতো মাছের মাথাটা খেতে বড্ডো ভালোবাসে।
তাড়াতাড়ি বদ - অভ্যেসগুলো পাল্টে ফেলো—
নচেৎ হয়তো তোমার মাথার মুড়িঘন্টটা
খুব প্রিয় হয়ে যাবে, বেশ আরো ভালো খাবে।
আর তোমার খালি থালাটা হাপিত্যেশ করবে
কিম্বা ঠন ঠন শব্দে গড়াগড়ি খাবে!

না না না না, অমন করে বলো না,
ওতো এখনো ছোট নিষ্পাপ একটি ফুল।
ঠিক ঠিক ঠিক এবেলাতেই কর্তব্য শিখিয়ে নিও,
নচেৎ মাথা চাপ্ রে একদিন বলবে—
ইস্ বড্ডো হয়েছে ভুল!

কি যে বলো,
এখনো তো ও একলা চলতে পারে না—
ওর হাত ধরে রাস্তা পার করে দিই
মাঝে মাঝে কাঁধে নিই।
শিখিয়েছো তো গাছে তুলে কিভাবে
টান দিতে হবে মই?
বালাই - সাট্ ; তোমার জন্য স্বর্গরথই সই।।
       

       পরচিতি
              আব্দুর রহমান

পড়ন্ত বিকেলে সূর্যের আলোর নরম  ছোঁয়া ছোটো ছোটো ভুট্টা গাছগুলোর ওপর পড়ছে । সবুজ পাতাগুলি এই আলোতে আরও গভীর জীবন্ত  মনে হচ্ছে । গাছগুলোর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে সাদেকের জমিতে আসা । গত বছর ভুট্টা চাষ ভালো হয়েছিল । কোনো কোনো গাছের পাতাগুলো উল্টে  দেখছে । কোনো পোকা বা অসুখ করেছে কিনা । চাষের জমিতে এলে একটা সুন্দর খুশির অনুভূতি হয় । প্রকৃতির সঙ্গে একাত্মতার আত্মোপলব্ধি । কোনো বাধা নেই । নেই কোনো নিয়ম ।আছে শুধুমাত্র জমির সঙ্গে আত্মীয়তা ।সাদেক দিগন্তের দিকে ভাবে ।কত বৈচিত্র্যময় জীবনের গভীরে রয়েছে শক্তি । পৃথিবীর মানুষ এগিয়ে চলেছে নতুন নতুন চিন্তা তথ্য প্রযুক্তি তে ।অন্য দিকে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের মানুষ , ভাষার মানুষ , রাজনৈতিক মা্নুষরা নিজ নিজ মতে  আনার টানাটানি করছে । মানুষের ইচ্ছা স্বপ্ন অভিরুচি কারোর অমঙ্গল না হলে কেন আমরা নাক গলাব । কালকের রাতের শালিশে ম‌ওলানার কথায় প্রায় সবাই মত দিলে ।মরিয়ম আর সায়েমের জীবন কে অভিশপ্ত করে তুলল । সাদেক বলেছিল ,” মরিয়ম -সায়েমের মধ্যে কোনো সমস্যা নাহলে আমরা উচিত অনুচিতের বোঝা তাদের ওপর চাপাচ্ছি কেন ? “
       ম‌ওলানা জোরের সঙ্গে দৃড় আত্মবিশ্বাসী হয়ে বলল,  “ ইসলাম কুনো বেদাত নাপাক পছন্দ করেনা ।এটা আমাদের মর্জির ওপর নির্ভর করে না ।সব কিছু হাদিস কু্র‌আন অনুযায়ী চলতে হবে ।নাপাক কাজ বরদাস্ত নয় । জাহান্নামের আগুনের ভয় মুসলিম উম্মাহর কে করতে হবে । মরিয়ম যে  কাজ করেছে তার কুনো নজির নাই। এ সন্তান অবৈধ । সায়েম পিতৃত্বের দাবি করতে পারে না।“
    শালিসের মধ্যে থেকে কে একজন বলল, ব‌উ কার ?
লোকজন যেন তেলে ভাজা মুখরোচক খাবার পেল । গুঞ্জন উঠল । চারিদিকে 'কার ব‌উ ?’ আওয়াজ উঠল । শালিশী সভা গম গম করে উঠলো । কার ব‌উ ,কার ব‌উ !
    মরিয়মের মনে হলো সে যেন বাজারি মেয়ে।   বাজারি মেয়ে কেও তো এভাবে তরিয়ে তরিয়ে মানুষ উপভোগ করে না । এতগুলো পুরুষ তাকে এক সঙ্গে লাঞ্ছনা করতে  উন্মুখ । সবাই যেন একসঙ্গে ধর্ষণের জন্য হামলে পড়ছে । মানসিক যন্ত্রণায় সে ছটফট করতে থাকে । তার বলার কিছু নেই ।
   সভায় নারায়ন মেম্বার ছিলেন । তিনি মুখ খুললেন । সবাইকে চুপ করিয়ে বললেন, “মরিয়ম সায়েম সুশিক্ষিত ও ভদ্র সন্তান । ঘটনাটির  দু রকম  অভিমুখ আছে । একটি সরকারি আইনি দিক । তারা একাজ টি করেছে সম্পূর্ণ সচেতন ভাবে । তোমরা যে কেউ জন স্বার্থের মামলা করতে পার । আর একটি মুসলিম সমাজের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার । ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কিত ।এ ব্যাপারে আমার কিছু বলার নেই। আর আমার ব্যক্তিগত অভিমত হলো , এটা নিয়ে যেন বাড়াবাড়ি না করি । মহাভারতে এ ঘটনা অনেক আছে । “
   সভায় কেহ মন্তব্য করল , “আমরা মানব কেন ? “
নারায়ণ বললেন , “আমি তো আগেই বলেছি । এসব তোমাদের ব্যাপার । আমরা যদি বাড়াবাড়ি না করি অর্থাৎ ওরা ওদের মতো থাক ।ওরা আমাদের পাড়ায় থাকে না । কোনো সমস্যা নেই ।“
  ম‌ওলানার ভালো লাগলো না এ সব কথা । উনি রাগ করে চলে গেলেন । যাওয়ার সময় ক্ষুন্ন হয়ে বললেন , “ তোমরা ঠিক কর ,হারাম হালাল মেনে চলবে কিনা ।“
    সভা এলোমেলো হয়ে গেল । যারা ভেবেছিল এতদিন সায়েমের বাবা কত জন কে গ্রাম্য শালিশে শাস্তি দিয়েছে ।আজ তার প্রতিশোধ নেবে ।এই দলের একজন বলল, “সায়েমের বাবার মত স্পষ্ট করে শুনতে চাই ।“
   অনেকে একসঙ্গে সমর্থন জানালো ।
   সায়েমের বাবা লিয়াকত সাহেব বললেন , “শোনো ভাই , ছেলের সঙ্গে আমি সম্পর্ক রাখব না । আমার সম্পত্তি বাইরের কেউ পাবে ,এ হতে পারে না ।“

     ঘটনাটি কেউ জানতে পারত না । গত সপ্তাহে মরিয়মের ছেলের বার্থ সার্টিফিকেট নিতে পঞ্চায়েত অফিসে সে নিজেই গিয়েছিল । ছেলের বাবার নামের জায়গায় লিখতে চায় , সোহান । সবাই মরিয়ম কে চেনে লিয়াকত সাহেবের ব‌উমা হিসেবে । প্রধান সাহেব থেমে যান। বলেন, “সায়েমের নাম তো সোহান নয় ,মা । কী ব্যাপার ? “
 মরিয়ম বলল, “ আমি যা বলেছি তাই লিখুন ।“
 মরিয়ম অফিস থেকে ফিরে আসার পর কথাটা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে । সোহান তো মরিয়মের আগের স্বামী নয় । এখনো সে সায়েমের স্ত্রী । তাহলে সোহান কীভাবে ছেলের পিতা হতে পারে ? এই প্রশ্ন সবার । লিয়াকত সাহেব ছেলের কাছে জানতে চাইল । সায়েম কে বলল, “পাড়ায় আমার মুখ দেখানো কঠিন হয়ে পড়ছে । তুমি আমার কাছে বিষয়টি পরিষ্কার কর ।“
 সায়েম ভালভাবে জানে এ বিষয়টি ঘরে বাইরে জটিল হয়ে উঠবে । কিন্তু এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা যৌথভাবে ।
এ সিদ্ধান্তে আসার আগে অনেক ঝড় ঝাপ্টা গেছে । গেছে মনের সঙ্গে লড়াই তাদের ।
    সায়েমের বিয়ে হয়েছে বছর পাঁচেক আগে । ভালবেসে বিয়ে । বাড়িতে জানিয়ে ছিল সায়েম ।ওর বাবা মা মেয়ের পরিচয় নিয়ে যোগাযোগ করেন । শেষে বড়ো অনুষ্ঠান করে বিয়ে দেন লিয়াকত হোসেন। বিয়ের আড়ম্বর ছিল দেখার মতো।এখন  বিয়েতে  চার চার চাকার গাড়ি আকছার ব্যবহার হচ্ছে ।বরের জন্য  নামি কোম্পানির ছোটো লাক্সারি গাড়ি আর বরং যাত্রীর জন্য টাটা সুমো কিংবা বোলোরো । কিন্তু সায়েম বাবার একমাত্র ছেলে । ভালো অবস্থা । এলাকায় নাম ডাক আছে । ভালো চাকরি করে । লিয়াকত  সাহেবের ইচ্ছা বর যাবে  নবাবি পালকিতে । খোঁজ খবর নিয়ে তিনি জোগাড় করেন পালকি । সাজু গুজু বৌভাত সব কিছু চোখ ধাঁধানো  । এলাকাবাসী বাসী মনে রেখেছে সে সব । দেখতে দেখতে সায়েম মরিয়ম পঞ্চম বিবাহ বার্ষিকী উদযাপন করল শেষ মার্চে ।
   মা ব‌উমাকে বলে, আমি তোমাদের ছেলে মেয়ের মুখ দেখতে চাই । তোমরা সন্তান নাও । 
  মরিয়ম রাত্রে সায়েম কে মায়ের কথাটা তুলল ।সেও চায় তাদের কোলে একটা সুন্দর শিশু আসুক । তারা সন্তানের আসা বিলম্বিত করেছে তা  নয় । স্বাভাবিক ভাবেই ছলছে তাদের দাম্পত্য । সন্তান লাভের ইচ্ছার প্রকাশ সায়েম আগেই জানতে পেরেছে । তাই বলল, আমাদের গাইনিক দেখাতে হবে । এবার বাঙালুর গিয়ে দেখিয়ে নেব । সে মতো বিখ্যাত স্ত্রী বিশেষজ্ঞ ডাঃ সুধা রমেশের চেম্বারে যায় তারা । কতকগুলো পরীক্ষা নিরীক্ষার পর কয়েক বার চেম্বারে যাওয়ার পর ডাক্তার বাবু বললেন , “ very sorry .Frankly speaking  you have lacking to produce sperm .”
   মরিয়ম উদ্বিগ্ন হয়ে বলেছিল, “স্যার কোনো উপায় নেই ?।
“ কোনো উপায় নেই ।তা বলতে পারি না। তোমরা যদি IVF কর তাহলে , A donor sperm can then be obtained from semen banks .”
      মরিয়ম সায়েম ভাঙা মন নিয়ে ডাক্তারের চেম্বার থেকে বাসায় ফিরল ।পথে কোনো কথা নেই । মরিয়ম ওর হাত ছুঁয়ে বলেছিল , “ আমরা লড়াই করব । ভেঙে পড়ব না ।“ সায়েম যেন আরও বরফের মত শীতল হয়ে গেল । 
     ভেঙে পড়ল রাত্রে ঘুমানোর সময়ে । তার পৌরুষের পরাজয় । দাম্পত্য জীবনের গভীরে অন্তর্লীন অসহায়তা তাকে হতাশায় ডুবিয়ে দেয়। মরিয়ম তাকে টেনে নেয় কাছে ।বুকে জড়িয়ে ধরে বলে,  “না ,তুমি এসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল । কত মানুষ আছে , ভেবে দেখেছ ? কোনো ছেলে মেয়ে নেই । তারা তো বেঁচে আছে । “
   “ তুমি মাতৃত্বের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হচ্ছ ,এর জন্য আমি দায়ী । “
 “ এভাবে ব্যাপারটা দেখছ কেন ? উল্টোটা  হতে পারত , তাই না ? আমাদের কোনো হাত নেই । মেনে নাওয়া ছাড়া কী করতে পারি !”
  এভাবে সান্ত্বনা দেয়ার পরেও  সকাল থেকেই সে চুপ চাপ হয়ে গেল ।কথা প্রায় বলে না । হাসি খুশি ভাব নেই । নিরুত্তাপ ভাবে কাজ কর্ম করতে থাকে । আগের মতো লিভিং স্পিরিট পায়না ।  একদিন তারা এক সাইকাটিস্টের কাছে গেল । সব শুনে উনি বললেন , “ এটা কে তোমরা সমস্যা মনে করছ কেন ? পিতৃত্ব মাতৃত্ব আমাদের হাতে নেই । পৃথিবীতে ভুরি ভুরি নিঃসন্তান মানুষ আছেন। তাঁরা স্বাভাবিক জীবন যাপন করছেন । জীবন যেমন তেমন ভাবে উপভোগ কর । এক‌ই কথা ভাবতে থাকলে অবসেসন হবে । শান্তি নষ্ট হবে ।“
  মরিয়ম বলল, “ ওকে কিছুতেই বোঝাতে পারছি না । ও শুধু বলছে ,  আমাকে ডিপ্রাইভ করছে । আমার মাতৃত্বের যোগ্যতা আছে । পুরুষ হিসেবে সে ব্যর্থ । “
 ডাক্তার বাবু বললেন, “ কে কবে বিয়ের আগে যোগ্যতার পরীক্ষা করে বলো ? তোমাদের মধ্যে ভাব ভালোবাসা আছে , পারস্পরিক দায়িত্বশীলতা আছে । স্বামী স্ত্রীর এটা বড় সম্পদ । জানো , আমাদের কোনো সন্তান নেই । মনে করো , যে আসবে তাকে এ পৃথিবীতে কষ্ট দেবে না , দেখবে ধীরে ধীরে কষ্ট কেটে যাবে । আর তা না হলে সিমেন ব্যাঙ্ক থেকে সিমেন নিয় আই, ভি এফ করতে হবে ।“
 সেদিন সিনিয়ার ডাক্তারের চেম্বার থেকে ফিরে এলো । তারপর সায়েম এ নিয়ে কথা বলেনি ।
    কিছু দিন পর মরিয়মের খালা শাশুড়ি এলো । শাশুড়ির মুখে সব শুনল । মরিয়ম কে শুনিয়ে বলল, “ব্যাটা ছেলের বাঁঝা হ‌ওয়ার কথা তো শুনিনি । তোর ব‌উ-ই বাঁঝা ।“ সেদিন সায়েম ঘরে ছিল ।তার খালার কথা তার বুকে আঘাত করল । আর তার দুর্বলতার জন্য তার ব‌উ কে অপমানিত হতে হবে । সে অপমান তার নিজের । সংগোপনে পৌরুষের অকারণ বড়াই চলতে থাকবে ।তা তার অসহনীয় হয়ে উঠল । স রাত্রে মরিয়ম কে শান্ত ও স্থির ভাবে  বলল , “ তুমি আমাকে ত্যাগ কর । নতুন করে সংসার পেতে মা হ‌ও ।“
 মরিয়ম সন্তান কন্দ্রিক কথা বার্তায় ধৈর্য্য শৌর্য দেখিয়ে এসেছে কিন্তু আজ রুষ্ট হল ; কষ্ট পেল । তার ভালবাসার মানুষের মুখে আজ কী কথা শুনছে ? সে কী বলছে ? মরিয়ম বলল, “ তুমি কী এসব বলছ ? আমি মা হতে চাই না । বেশ আছি । তুমি যদি আমাকে আর না ভালবাস, সহ্য করতে না পার ,ত্যাগ করতে পার ।মা হ‌ওয়ার জন্য আবার বিয়ে করার দরকার আমার নেই । “
সায়েম এ ব্যাপারে অস্থিরতার পরিচয় অনেক বার দিয়েছে । তার অক্ষমতার কারণে তার স্ত্রী  মা হতে পারে নি । অথচ পরিবারের  সমাজের মানুষ মরিয়ম কে আড় চোখে দেখে । শুধু মেয়ে হ‌ওয়ার জন্য তাকে দোষারোপ করা হচ্ছে । সে বলল, “ শোনো মরিয়ম , আমি চাই তুমি মা হ‌ও । সিমেন ব্যাঙ্ক থেকে নয় , আমাদের পরিচিত কারো থেকে সিমেন নিয়ে আই. ভি . এফ.  করি । পিতৃ পরিচয় আমার থাকবে না ।“
“এর পরিণাম কী হতে পারে ভেবে বলছ ?  আমি মেনে নব ,না  ; মানব না , তা নির্বাচনের অধিকার আমার তারকবে না ? “
 “ মা হ‌ওয়ার অধিকার তোমার জন্মগত ।বরং আমি তোমাকে বঞ্চিত করছি “
 “সিমেন ব্যাঙ্ক থেকে নয় কেন ? নিলে আমরা সেফ থাকব ।“
 “সত্য সত্য থাক । আমি মিথ্যা পিতৃত্বের পরিচয় চাই না । আশা করব , আমাকে ভালবেসে তুমি মেনে নেবে ।“
  সায়েম বলল, “ বাবা, এটা আমার সিদ্ধান্ত ।“
    বাবার মুখ থেকে একটা কথা বেরুলো না । বলতে গিয়ে ঠোঁট নড়ে উঠলো কিন্তু মুখটা হা হয়ে গেল ।




                  রক্ষা
                  দীপক বিশ্বাস


ছেলের চাকুরি পাওয়ার আনন্দে ভুরিভোজ করিয়ে সুষেন বন্ধুর হাতে একটা সিগারেট ধরিয়ে দিয়েছে। সেটাই টানতে টানতে শম্বুকগতিতে ধীরাজ আড়াআড়ি মাঠের পথ ধরল। ত্রয়োদশীর চাঁদ চরাচরে মাধুর্যের বন্যা বইয়ে দিয়েছে। হাঁটতে হাটঁতে ধীরাজ হঠাৎ থমকে যায়। তার পটলক্ষেতের আলে কে বসে আছে পিছন ফিরে। পটলচোর ? সতর্ক হয়ে এগোয় ধীরাজ, চোর যাতে টের না পায়! কিন্তু চোর চুপচাপ বসে কেন? আরো একটু এগোতেই কানে আসে,-
" কিছুই বাঁচাতে পারলাম না রে মা, না ছেলেটাকে, না তোকে। তিনপুরুষকে বাঁচিয়ে রেখেছিস তুই--- আর আজ এই অধমের হাতে তোর রক্ষা হল না! "

বুকে হাতুড়ি পড়ে ধীরাজের!এ তো কাঞ্চনের কণ্ঠ! একমাত্র ছেলের ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়ায় ধীরাজের কাছে ছুটে এসেছিল কিছু টাকার জন্য। দিয়েছিল দু'বার এই জমির দলিল নিয়ে। পরের বার চাইতে এলে দলিল পাকাপোক্ত করে নিয়েই টাকা দিয়েছিল ধীরাজ। একথা হঠাৎ মাথায় আসায় কাঞ্চনের কান্নার শব্দে বিভোর হয়ে গিয়েছিল। হাতে আগুনের ছ্যাঁকা লাগে। মেকুরের মতো নিঃশব্দে ফিরে গেল ধীরাজ।

সকালে ধীরাজের ডাকে কাঞ্চন ঘর থেকে বেরিয়ে এলে তার হাত দুটো ধরে বলল-" ভাই, তোমার হাতের জমি, অন্যের হাতে বশ মানবে কেন? আমি চেষ্টা করেও তোমার মতো ফসল ফলাতে পারলাম না। নিজের ভেবেই চাষ করো আজীবন ;আমায় শুধু খাওয়ার সবজি দিও,তাহলেই হবে। "
কাঞ্চন অবাক চোখে তাকায় --- হাতটা ছেড়ে দিয়ে ধীরাজ দ্রুত চলে যায়।




পেটমোটা ও মাথামোটা
 - অগ্নিমিত্র ( ডঃ সায়ন ভট্টাচার্য)


 অনেক কিছু নিয়েই তো গল্প লেখা যায়  ; আমি আজ সবাইকে দুই সান্ত্রীর গল্প বলবো ।
 আমাদের কোয়ার্টারে দুজন সিকিউরিটি গার্ড ছিল, অমল ও কমল ।..দুজনে আলসেমি ও গল্প করতে খুব ভালোবাসতো ।
 কেউ গেটে এলে নিজেই খুলে ঢুকত, কারণ অমল ও কমল ' তুই যা, তুই যা' করতে থাকতো ও আগন্তুকের ধৈর্য থাকতো না ।..
  এর মধ্যে অমল রোগা কিন্তু বোকাটে ধরনের; কমল স্থূলকায় ও ভুঁড়িদার ।..তাই ওদের নাম হয়ে গেল যথাক্রমে  মাথামোটা ও পেটমোটা ।..
 একবার এক বিখ্যাত লোক গেটে অপেক্ষা করে করে বিরক্ত হয়ে গিয়েছেন; পেটমোটা কোনরকমে গেট খুলে দিল। ভদ্রলোক বিরক্ত হয়ে ঢুকলেন; মাথামোটা বললে:" আরে অমল, গেটটা খোলাই রাখ না; বারবার কে উঠবে?!"
 গেট খোলা ও বন্ধ করার থেকে বসে গল্প করা ও খবরের কাগজ পড়াই ওরা শ্রেয়তর কাজ বলে মনে করতো ।
 তবে ওদের মাইনে মাঝেমধ্যেই ঠিক সময়ে আসতো না । সেই নিয়ে পেটমোটা ও মাথামোটা প্রায়শই আন্দোলন করতো !..
 কমল একটু শিক্ষিত মানুষ ছিল; উল্টোবাবুর, মানে উমাচরণবাবুর ছেলের ইংরেজি বোলচালের ভুল ধরিয়ে দিত ।
 আমার মাঝেমাঝে ওদের জন্য কষ্ট হতো । আবার ওদের কীর্তিকলাপ দেখে রাগও হতো ..।
 আর একজন গার্ড ছিল , তারানাথ । অতিরিক্ত মাত্রায় মহুয়া খাওয়ায় তার চাকরি যায় ।..আমরা ওকে ' ট্যারানাথ ' বলে চিনতাম, কারণ সে ছিল ভালো লক্ষ্মীট্যারা ।..
 বাজারে ট্যারানাথের সঙ্গে দেখা । ..মহুয়ার গন্ধ পেলাম না !..  সেই জানালো, যে অমল- কমলের অটুট বন্ধুত্বে সম্প্রতি  চিড় ধরেছে!..কারণ কাজের মেয়ে উর্মিলা । অমল- কমল দুজনেই তার ভক্ত; ওকে দেখলেই দুজনে প্রতিযোগিতা করে গেট খুলে দেয় ..।
 উর্মিলা সুন্দরী, তরুণী ;  ওদের যেন দেখেও দেখতো না ।
 পেটমোটা ও মাথামোটাকে দেখে আমার আরো দুঃখ হতো ।
 সেটা অবিশ্বাসে পরিণত হলো, যেদিন আমার লেটার বক্সে একটা  বিয়ের কার্ড রাখা দেখলাম ।..
 দেখি, উর্মিলা এবং তারানাথের শুভ পরিণয়ের নেমন্তন্ন!!...
 সত্যিই কত কিছুই না হয় দুনিয়ায়  ।
 খেতে গিয়েছিলাম ওদের বিয়েতে ।...আশীর্বাদও করলাম।
 তারানাথ সুখে আছে; ইদানিং মুদির দোকান দিয়েছে ।
 অমল ও কমল আবার জয়- বীরু  হয়ে উঠেছে !!....
       

3 comments:

  1. আমার "অপ্রত্যাশিত ছুটি" কবিতাটি প্রকাশ করার জন্য অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ ... সকলেই সুস্থ থাকুন আর ভালো থাকুন।

    ReplyDelete
  2. বেশ সুন্দর ব্যবস্থা। ভালো লাগলো।

    ReplyDelete