PravatiPatrika

Sunday, May 24, 2020

কবিতা, গল্প ও সাক্ষাৎকার


সাক্ষাৎকথায় রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রশান্ত ভৌমিক

আমি বাংলাদেশে যাই রবীন্দ্রনাথের গান শোনার জন্য   

(রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়- উপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক। সহ- সম্পাদক হিসেবে কাজ করছেন 'সংবাদ প্রতিদিন' পত্রিকায়। নিজের ভাষায় তিনি নন্দিত ও নিন্দিত উভয়ই। বানানো কাহিনী লেখা বাদ দিয়ে লিখছেন বাস্তবকে উপজীব্য করে। রবীন্দ্রনাথকে নায়ক করে একাধিক গ্রন্থে তুলে ধরেছেন কবিগুরুর জীবনের অন্ধকার দিকটিকে। বিপুল মানুষের ভালোবাসা কুড়িয়েছেন। পাশাপাশি নিন্দা কুড়িয়েছেন রবীন্দ্র প্রেমীদের। ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশোনা করা লেখকের বহুমুখী জ্ঞান ছড়িয়ে দিয়েছেন বিভিন্ন লেখায়। তাঁরই এক সহকর্মীর বইয়ের প্রকাশনা উৎসবে এসেছিলেন কলকাতার বিখ্যাত বইয়ের দোকান 'অক্সফোর্ড বুক শপ'-এ। সেখানেই (১৩-১২-২০১৮) মুখোমুখি হলাম।)

প্রশান্ত ভৌমিক: কেমন আছেন?

রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়: ভালো। তুমি ভালো তো?

প্রশান্ত ভৌমিক: হ্যাঁ স্যার। আমিও ভালো আছি। ধন্যবাদ আপনাকে।

রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়: বলো কী জানতে চাও।

প্রশান্ত ভৌমিক: আমরা জানি আপনি অনেক লিখেছেন, অনেক ধরনের লেখা লিখেছেন। সব মিলিয়ে সংক্ষেপে বলুন।

রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়: আমি তো অনেক রকম লেখা লিখেছি। কবিতা বিশেষ নয়। প্রবন্ধ লিখেছি এবং উপন্যাস লিখেছি। আমার যেটা বৈশিষ্ট্য সেটা হল, আমি বানানো গল্প লিখি না। বানানো গল্প একসময় লিখতাম। এবং অনেক বানানো গল্প আমার আনন্দবাজার পত্রিকায় বেরিয়েছে। যেমন- উত্তরণ, তুমি আছো, আলোকবর্ষ দূরে, অমৃতের সন্তান। কিন্তু এগুলোর পরে আমার মনে হল আমার চোখের সামনে এত বড় বড় নায়কেরা রয়েছেন যেমন- রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ। কাদম্বরী দেবী, সরলা দেবীর মতন নায়িকারা রয়েছেন এঁদের নিয়ে কেন উপন্যাস হবে না? আমি এদের নিয়েই উপন্যাস লিখি এবং অনেক দ্বিমত তৈরি হয়। আমার জনপ্রিয়তাও তৈরি হয়। আবার আমার নিন্দাও তৈরি হয় একই সঙ্গে। আমি একই সঙ্গে নিন্দিত ও বন্দিত। কিন্তু এটাই হচ্ছে আমার বৈশিষ্ট্য। আমার পরে অনেকেই এই ধারায় লিখছেন। কিন্তু আমার আগে কেউ নয়। এদিক থেকে আমি বলতে পারি পথিকৃতের ভূমিকা আমি নিয়েছি। যেটা করেছি- বানানো কোনো চরিত্র নয়, ইতিহাসের চরিত্র নিয়ে আমি লিখেছি।

প্রশান্ত ভৌমিক: বাস্তবের চরিত্র নিয়ে লিখতে গিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তো অবশ্যই পেয়েছেন। আপনি নিজেই বলেন আপনি নিন্দিত ও বন্দিত। ওঁদের পরিবারের কাছ থেকে কোন বাঁধা কি পেয়েছেন?

রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়: না, কারো পরিবারের কাছ থেকে কোনো বাধা পাইনি। পেলে বোঝা যাবে। তবে যারা রবীন্দ্র ভক্ত, তারা অনেকেই মনে করেছেন আমি বোধহয় রবীন্দ্রনাথকে ছোট করেছি, রবীন্দ্রনাথকে নিন্দার জায়গায় নিয়ে গেছি। আমি বললাম- আমি তো তা করিনি। আমি বাস্তব মানুষটাকে দেখবার চেষ্টা করেছি। বুদ্ধদেব বসু একটি অসামান্য কথা বলেছিলেন, সেটা রবীন্দ্রনাথের যে প্রামাণ্য জীবনী, প্রশান্ত পালের লেখা রবিজীবনী - তার ব্যাকপেজে এই কোটেশান ছিল। বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন- আমরা রবীন্দ্রনাথকে তো বেদির উপরে প্রতিষ্ঠা করেছি এবং দেবতা হিসেবেই তাকে পুজো করেছি। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একদিন ঐ মূর্তি থেকে প্রলেপগুলো খসে পড়বে। এবং ভেতর থেকে আসল মানুষটি বেরিয়ে আসবে। তখনই রবীন্দ্রনাথকে আমরা চিনতে পারব এবং জীবনী লেখা সম্ভব। আমার মনে হয় যে আমার লেখায় সে প্রলেপগুলো খসে পড়েছে। এবং আসল রবীন্দ্রনাথ বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু নিন্দার্থে নয়। এই রবীন্দ্রনাথকেই আমরা চাই। আমার মনে হয়েছে রবীন্দ্র সাহিত্যকে বুঝতে হলেও এই প্রলেপহীন মানুষটিকে বুঝতে হবে।

প্রশান্ত ভৌমিক: আমার পাঠ্যাভ্যাস সম্পর্কে বলুন। ছোটবেলায় কী পড়েছেন? এখন কী পড়ছেন?

রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়: আমি সব পড়তাম ছোটবেলা থেকেই। যেগুলো নিষিদ্ধ বই সেগুলো আগে পড়তাম। বাবা- মা আমাকে কখনো বাধা দেন নি। আর আমি ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়ালেখা করি স্কটিশ চার্চ কলেজে। তখনকার দিনে সেটি ইংরেজের কলেজ ছিল। খুব ভালো কলেজ। এটা আমি পঞ্চাশ দশকের শেষ দিক এবং ষাট দশকের শুরুর দিকের কথা বলছি। তাছাড়া আমার বাড়ির পরিবেশটা মুক্ত পরিবেশ ছিল। আমি মুক্ত পরিবেশের মধ্যে মানুষ হয়েছি। আর আমি মুক্ত চিন্তার মানুষ। সুতরাং বাধা যে পাইনি তা নয়। কিন্তু বাধা আমি গ্রাহ্য করিনি। আমার জীবনেও করিনি, আমার লেখাপড়াতেও করিনি। আমার যা ভালো লাগে তাই পড়েছি। এবং এখনো তাই পড়ি। আমি খুব আধুনিক বই পড়তে ভালোবাসি।

প্রশান্ত ভৌমিক: বাংলাদেশের সাহিত্য নিয়ে আপনার ধারণা কি? পড়েছেন কেমন?

রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়: বাংলাদেশের সাহিত্যের মধ্যে কবিতা আমি অনেক পড়েছি। প্রবন্ধ বেশি পড়েছি। উপন্যাস কম পড়েছি। আমার উপন্যাসগুলোর ভাষা এবং সম্পর্কগুলোর নাম- টাম নিয়ে একটু অসুবিধে হয়। কিন্তু বাংলাদেশের রবীন্দ্রচর্চা আমাকে খুব সন্তুষ্ট করেছে। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের গান। বাংলাদেশের গায়করা খুব ভালো রবীন্দ্রনাথের গান করেন। আমি বাংলাদেশে যাই রবীন্দ্রনাথের গান শোনার জন্য অনেকটা। আমার ভালো লাগে বাংলাদেশ, পদ্মা পাড়। আমি দু'টো বই লিখলাম। একটা হল রবীন্দ্রনাথ ও ইন্দিরা- দিবা রাত্রির কাব্য। সেটা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ দশ বছর ছিলেন বাংলায় পদ্মার ওপারে। সেটা নিয়ে একটা উপন্যাস। আরেকটা উপন্যাস লিখেছি পদ্মাপাড়ে রবীন্দ্রনাথ। সেটা এই বই মেলায় বেরোবে। দু'টো বই-ই আমি লিখলাম বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথের থাকা নিয়ে। বাংলাদেশের কাছে রবীন্দ্র ঋণ নিয়ে। আজকের মতো এখানেই শেষ কর। আমাকে উঠতে হবে এখন।

প্রশান্ত ভৌমিক: ঠিক আছে স্যার। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।

রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়: তোমাকেও ধন্যবাদ। ভালো থেকো।

         অনুরাগে বৈশাখ
                ঈশিতা চৌধুরী


দীর্ঘশ্বাসের নিয়মিত ছন্দমালিকায়
আনাগোনা অস্তমিত গোধূলি তরবারির,
 আকাশ ভেজা চোখে নিয়ত,
   দীর্ঘায়িত বসন্ত রাগের অনুসূক্ষ্ম  কলমকারি.....

দীর্ঘশ্বাস দীর্ঘ যত, নিরবচ্ছিন্ন মধুমাস ক্ষয়িষ্ণু তত, অবিরত,
  দিন রজনী বৈশাখী উত্তাপে ক্রমে ধীর, সমাদৃত,

    ভেজা ভেজা মন, আগামীর বারিধারায় অঘোষিত,                            প্রজ্জ্বলিত ।




                        তিলোত্তমা
                   জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়

আমাদের মফসসলি অহংকার তাকে ছেড়ে যেতে দুবার ভাবেনি
নবীন শ্বাসের ঘাতে নগরীর কালিমাবর্জ্য অন্তরীণ সবুজেসবুজ।
উপন্যাসের সূচনাবাক্যে ঘুম যায় ফেলে আসা রাজপথ।
প্রাণের সড়কে আজ ঘুঙুরের নাচ গ্রন্থিময় ঠিকানাগুলি হাতে ধরা যায়।
ভাগাড় শব্দটি অভিধানে ঢাকা গেছে।

এখানে খুব বেশি চাওয়া নেই। কিছু করার ইচ্ছা জাগিয়ে রাখে।
অথবা খুব বেশি পাওয়ার স্বপ্ন থাকেনা। বিমল অস্তিত্ব নিয়ে
ভালো থাকে পালানোমানুষ। জলপরির হাসির মুক্তাস্নান মরানালার খেয়ালি প্লাবনে
কখনও কখনও সব ভেসে যায়।

এই নিয়ে বেশ কাটে গ্রামীণ বেলা।
ক্বচিৎ জরুরি কাজে তিলোত্তমা ছুঁই। এখনও হাঁপিয়ে উঠি আগের মতই।


বিবর্ণ  ভাষা
বটু কৃষ্ণ হালদার

সব কিছু মুখে বলতে হয় না
মায়াবী চোখের বাঁকা ইশারায়  লুকিয়ে থাকে ভাবের  বহি:প্রকাশ.....
হৃদয়ের বন্ধন আলগা হয়ে যায়, নূন্যতম ভাষার অস্বচ্ছতার অলক্ষে
বলতে গিয়েও কত বিবর্ণ হৃদয়ের ব্যাপ্তি, মিশে যায় চোরা স্রোতের গহীন বাঁকে
জোর করে সুন্দর গোলাপকে পদদলিত করা যায়, কিন্তু আপন করা যায় না
বৃন্ততে ফুল কেই বা ফোটাতে পারে
মিথ্যা অভিনয়ে সত্যি ভালোবাসা প্রকট হয় না.
আবার কিছু ভালোবাসা বিকিয়ে যায় সস্তা দরের ফুটপাথের বদ্ধ হোটেলের কামরায়
একটু পা ভিজিয়ে মাপা যায় না সমুদ্রের গভীরতা
অবলেশহীন স্রোতের বিবর্ণ ভাষা
কিছু ভাষা মৌন হয়ে রয়ে যায় পাষান হৃদয়ের আড়ালে




         অবস্থা আশঙ্কাজনক
               প্রাপ্তি  মুখোপাধ্যায়

শুকিয়ে যাচ্ছে সমস্ত জল
ভিজছে না আর পায়ের আঙুলগুলো
গা ছুঁয়ে তাপ পোড়াচ্ছে হাত
দুই মুঠোতে কালবৈশাখি ধুলো...


রোজ আঁচলে গোঙাচ্ছে ঝড়
শব্দদূষণ লিখছে স্বরলিপি-
চাঁদ জড়িয়ে কাঁদছে মমি
দুই পেয়ালায় স্তব্ধ মিসিসিপি...


কালপুরুষের তীরধনুকেই
লক্ষ তারায় লক্ষ্য অরূন্ধতী,
অশ্রুকণায় মুক্তো ভ্রূণে
হায় কমলা বাণিজ্যে বসতি...


পা মেলানো শক্ত খেলা
রং মেলে না মুখোশ এবং মুখে,
চারদেয়ালে তিক্ত শ্লোগান
স্নানঘরে ঘাম জমছে এসে বুকে...!


সব সিঁড়িময় লতাচ্ছে সাপ
খোলস ছাড়ছে লম্বা হয়ে আরো--
সামনে চলায় পিছোচ্ছে পা
রিভার্স গ্রাফটা ফ্ল্যাটেণ্ড, অন্ধকারও...!



                    নিস্তব্ধ
                 সৌমেন সরকার

যখন বলেছিলে 'না'-
দ্বিতীয় মৃত্যু ঘটেছিল আমার!
হৃদস্পন্দন হয়েছিল স্তব্ধ!
শিরা-উপশিরায় জমাট বেঁধেছিল-
                থান থান রক্ত!
মুখ হয়েছিল বিকৃত...ব্যথাতুর...ক্লিষ্ট...জর্জরিত...
পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গিয়েছিল সেদিন।
নুইয়ে পড়েছিল রক্তগোলাপ-
         বর্ষার অঝোর ধারায়।

সত্যিই স্তব্ধ হয়েছিলাম সেদিন-
          নিস্তব্ধ তোমায় দেখে!




আজকে আমরা
তীর্থঙ্কর সুমিত


মেঘে ঢাকা সেই আকাশটার কথা
আজকে আবার মনে পরে
অবশ্য আজকে চড়া রোদ
তবুও কোথায় যেনো একটা বিষাদ
লুকিয়ে আছে
হিসেবের খেলায় আজ
সবাই গোলকিপার
তবুও কেউ বল সামলাতে পারছিনা
গোল গোল গোল
আজ আর কোনো উচ্ছ্বাস নেই
শুধুই ঢেউ
হেলে দুলে

আর ...

সবাই ঘর দখল করছি।



      ওইভাবে কী দেখছ
                         অমিত দত্ত

আমি কেন নেশা করি?
কেউ একজন আমায় প্রশ্ন করেছিল।
উত্তরটা খুব সহজভাবে দিতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়েছিলাম।
উত্তর তো এক নয় বহু -
এ যেন একটি ঘরের চতুর্দিকের আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখা, একটার ভিতরে একটা,
তার ভিতরে আরও একটা, এত ছবি তো আমি দেখতে চাইনি-
নিজেকে লুকাতেই তো চেয়েছি- চেয়েছি লুকাতে
আমার একিলিসের গোড়ালির নমনীয়তা,
ঢাকতে চেয়েছি তাকে দ্রৌপদীর কেশরাশি দিয়ে,
আমি তো কৃষ্ণর কাছে ' সখা রক্ষা করো' বলেও
আর্তনাদ জানাইনি ।
নিজের অক্ষমতাকে শক্তিতে পরিণত করেছি মেডুসার চোখ দিয়ে;
ঘোরানো, পেঁচানো সিঁড়ি দিয়ে নেমেছি,  নেমেছি, নেমেছি, নামছি -
আমি শেষ ধাপের লক্ষ্যে যেখানে হাত বাড়িয়ে আছে-
হেডিস!
স্বর্গে গোলামী করার চেয়ে নরকে রাজত্ব করা ঢের ভালো
নেশা... নেশা...নেশা...নেশা
তোমরা সবাই কি আমার দিকে চেয়ে আছ...


         রবীন্দ্রনাথ
     বাপন দেব লাড়ু

চেনা শহর
    জানালা খুলে দেখি,
    এ এক অচেনা অবয়ব।
কংক্রিট দেওয়াল থেকে,
ঠিকরে পড়ছে আলো।
স্ট্রিট লাইটে ঝুলে আছে
গোটা একটা বিকেল---

অনুভবে আসছে রবীন্দ্রনাথ,
আষাঢ়ে-শ্রাবনে সুরের তীব্র ধারা
ছুটেচলে বিরাম হীন---
    কত কী জানার বাকি
    কত কি বোঝার বাকি
তবুও শুনি; আসে গুনগুনিয়ে
অন্তহীন আকাশ আঁতুড়ঘরে
জন্ম নেয় আজও কত রবীন্দ্রনাথ।।


                       অভিজ্ঞতা
             যশ ( ডঃ সায়ন ভট্টাচার্য)

 বিশ্বজিৎদা নেশাটেশা করে ফিরল । হস্টেলে আমরা তখন খাওয়া দাওয়া করছি ।..
 এটা নতুন কিছু নয়; এরকম হামেশাই ঘটত  । বিশ্বজিৎদা একটু খ্যাপাটে প্রকৃতির, ও তার অভিন্নহৃদয় বন্ধু নকুলদা সাহিত্যিক হবে বলে কোমর বেঁধেছে  । কোনো একজন বিখ্যাত সাহিত্যিকের সাথে দেখা করার জন্য, ও কারণবারির স্বাদ পেতে খালাসিটোলায় যাতায়াত করত ওরা ।
 আমি লিখতাম আমার মতো করে; গল্প, কবিতা সবই লিখতাম । আমার লেখা নকুলদা বিশেষ পছন্দ করতো না । কারণ সেটা ছিল নাকি বর্ণনামূলক ।
 " সাহিত্য অনুভূতিমূলক হওয়া উচিত ।" নকুলদা উষ্মার স্বরে বলতো । আর বিশ্বজিৎদা একটু স্বাধীনচেতা ধরনের লোক ; রাস্তায় মেয়েদের সাথে কেউ অভব্যতা করলে নাকি সোজা প্রতিবাদ করতো !
 যাক, সেদিন নেশা করে ফিরে বিশ্বজিৎদা টলতে টলতে ঘুমিয়ে পড়লো ।  ..তার পরদিন শুরু হলো তার শরীর খারাপ । পেট ব্যথা, অজীর্ণ ..। তার বান্ধবীর সেবাযত্নে একটু সুস্থও হলো ।
 তবে আবার যেদিন বিশ্বজিৎদা নেশা করে ফিরল, সেদিন কেউ অবাক হইনি । অবাক হলাম , যখন শুনলাম যে সেদিন সে আরো একটা কান্ড করেছে । কাছাকাছি  খারাপ পাড়া থেকে ঘুরে এসেছে । বিস্রস্ত বেশে মাঝরাতে ফিরেছে হস্টেলে  ..।
 তার সেই বান্ধবীর সাথে ঝগড়া করেই নাকি সে এসব করেছে ।..
   আমরা নাকি 'বোকাই থেকে গেলাম'। মেয়েদের মনটাই খুঁজে গেলাম শুধু ! আর বর্ণনাকারী সাহিত্যিক হয়েই থেকে গেলাম ! এসব একটু না করলে কি আর বড় হওয়া যায়?!...
  কোনো কিছুই আর আমার দ্বারা হলো না !!



                          মোহিনী
                      রাজশ্রী সেন


সকলের বিরুদ্ধে ভালবাসাটাকে মোহিনী চ্যালেঞ্জ রূপে নিয়েছিল। এটা তার স্বভাবের একটা অঙ্গ। যদি সে মনে করে তার বিবেচনা যথার্থ, তবে তার জন্য লড়াই করার প্রবণতা তার মজ্জাগত,সে যে কোন বিষয়েই হোক। জীবনে প্রথম ভালোবাসাকে হারিয়ে নতুন ভাবে ভাবতে গিয়ে একটু আলো দেখার প্রচেষ্টা। কিন্তু এটাই তার একমাত্র লড়াই যেখানে সে এমনভাবে পরাজিত হলো যে তার স্বকীয়তা হারিয়ে ফেললো।
মোহিনীর অনেক স্বপ্ন ছিল নিজের পায়ে দাঁড়াবার। একদিকে বাড়ির বড় মেয়ে, আবার অন্যদিকে ভুল নির্বাচন বেকার প্রেমিক, তাই বাড়ি থেকে সম্বন্ধ দেখে চটজলদি বিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা।
জীবনের পরিসরে ভালোবাসাকে জেতাতে গিয়ে নিজেই হেরে বসল মোহিনী নিয়তির আয়ূরেখা  ধরে হাঁটতে হাঁটতে। বিয়ে করল দোটানা থেকে বাঁচতে মোহিনী বিস্ময় আর উচ্ছ্বাসের মধ্যবর্তী কোনো জীবনধারাকে বুকে আঁকড়ে ধরে। এক উচ্ছল হাসিখুশি উন্মুক্ত আকাশ মুঠোয়বন্দী হলো। শ্বশুর বাড়ির চৌকাঠে পা রাখলো। কিন্তু মোহিনীর হাত ধরে রইল আলোড়িত ব্যঙ্গাত্মক শব্দের নিবন্ধ। যতই হোক বেকার স্বামীর স্ত্রী। টুকরো টুকরো হয়ে গেল সাজানো কাঁচের ঝকঝকে স্বপ্ন গুলো জোড়াতালির সংসারে।
এখন স্মৃতি হাতড়ে জীবন প্রাঙ্গণে যেটুকু অঙ্কুর সুপ্ত ছিল, সেটুকু হলো অবসর সময়ে তার কবিতার ডালপালা, শাখা প্রশাখা,যার মধ্যে ফুলে ফলে ভরিয়ে দিয়েছে তার সকল অনুভবকে উন্মোচন করে।
শ্বশুরবাড়িতে প্রবেশ থেকে আজ অবধি মোহিনী তার জীবন একটি সরু সুতোর সাঁকো তৈরি করে মুহূর্ত গুলোকে প্রতিনিয়ত পার করে চলেছে মানস ভ্রমণে ।।



                  আমার ছেলে কিচ্ছু খায় না 
                          সিদ্ধার্থ সিংহ

ডাক্তারের উল্টো দিকের চেয়ারে বসে মুখ কাঁচুমাচু করে কাজরী বললেন, ডাক্তারবাবু, আমার ছেলে কিচ্ছু খায় না। এর আগেও দু’জন চাইল্ড স্পেশালিস্টকে দেখিয়েছিলাম। এই যে তাঁদের প্রেসক্রিপশন... বলেই, আগে থেকে বের করে রাখা তিন-চারটে কাগজ উনি এগিয়ে দিলেন ডাক্তারবাবুর দিকে। ডাক্তারবাবু সেগুলিতে চোখ বোলাতে লাগলেন।
কাজরী আবার বললেন, ও কিচ্ছু খাচ্ছে না, কী করা যায় বলুন তো?
ডাক্তারবাবু প্রেসক্রিপশনগুলোয় চোখ বোলাচ্ছেন। বিশাল চেম্বার। দারুণ সাজানো-গোছানো। এ সি চলছে। সাত দিন আগে নাম লেখাতে হয়েছে। এর আগে যে দু’জন ডাক্তারকে দেখিয়েছিলেন, তাঁদের একজন পাড়ার ডাক্তারখানায় বসেন। অন্য জন একটু দূরে।
ওর ছেলে কিচ্ছু খাচ্ছে না শুনে সহেলীর মা বলেছিলেন, কোন ডাক্তার দেখাচ্ছিস? সুনীল ডাক্তার? কত টাকা ভিজিট? চল্লিশ টাকা?
কাজরী বলেছিলেন, সুনীল ডাক্তারকে দেখিয়ে কোনও কাজ না হওয়ায় লেক মার্কেটের কাছে একজন খুব বড় ডাক্তার বসেন, তাঁকে দেখিয়েছিলাম। তাঁর ভিজিট দুশো টাকা। শুনে সহেলীর মা বলেছিলেন, ধুর, এ সব রোগের ক্ষেত্রে একদম লোকাল ডাক্তার দেখাবি না। বাচ্চার ব্যাপার তো, একটু ভাল ডাক্তার দেখা। তাতে যদি দু’পয়সা বেশি লাগে তো, লাগুক, বুঝেছিস?
সহেলী ওর ছেলের সঙ্গে একই ক্লাসে পড়ে। বাচ্চাদের স্কুলে ঢুকিয়ে দিয়ে ওঁরা মায়েরা স্কুলের কাছেই একটা ঘর ভাড়া নিয়ে বসেন। সেখানে নানা কথা হয়। আর সব কথাতেই সহেলীর মায়ের কথা বলা চাই। যেই শুনেছেন ওঁর ছেলের কথা, অমনি আগ বাড়িয়ে বলতে শুরু করলেন, সহেলীকে যিনি দেখেন, তার তো ডেটই পাওয়া যায় না। ভীষণ ব্যস্ত। একেবারে সাক্ষাৎ ধন্বন্তরী। এক ওষুধেই কাজ হয়ে যায়। তবে ভিজিট একটু বেশি। আটশো টাকা।
— আটশো টাকা! আঁতকে উঠেছিলেন কাজরী।
— হ্যাঁ, আটশো টাকা। সুনীল ডাক্তারের চল্লিশ আর এর আটশো। তফাত তো হবেই, না?
— ডাক্তারের নাম কী?
— নাম? নামটা কী যেন বেশ। ওর বাবা জানে। দাঁড়া। জি়জ্ঞেস করি... বলেই, টপাটপ বোতাম টিপে মোবাইলে ধরলেন স্বামীকে। এই, আমরা সহেলীকে যে ডাক্তার দেখাই, তাঁর নামটা কী গো? ও, আচ্ছা আচ্ছা। না, কাজরী আছে না, ওর ছেলেও তো কিছু খেতে চায় না, তাই। আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক আছে, রাখছি।
স্বামীর সঙ্গে কথা বলেই আফসোস করেছিলেন সহেলীর মা, না রে, ও-ও নামটা জানে না। আসলে ওর অফিসের এক বন্ধুর স্ত্রী ওই ডাক্তারের খোঁজ দিয়েছিলেন। উনি হয়তো জানতে পারেন। কিন্তু ওঁর নম্বরটা আমার কাছে নেই।
— তা হলে ওই ডাক্তারকে তোরা কী বলে ডাকিস?
— ডাক্তারবাবু বলে।
— না না, তা বলছি না। বলছি, তোরা যখন নিজেদের মধ্যে কথা বলিস, তখন ওই ডাক্তারের কথা বলার সময় তোরা কী বলিস?
— বলি, আটশো টাকার ডাক্তার।
— আটশো টাকার ডাক্তার? ও, তা আমাকে দে না ওই ডাক্তারের ঠিকানাটা।
— ওর চেম্বার তো গড়িয়াহাটায়।
— গড়িয়াহাটায়? রোজ বসেন?
— ধুর, অত বড় একজন ডাক্তার রোজ রোজ বসবেন? উনি বহু জায়গায় বসেন। বড় বড় সব নার্সিংহোমে। তবে আমাদের কাছাকাছি হল গড়িয়াহাট।
— ওখানে কবে কবে বসেন?
— সপ্তাহে দু’দিন। মঙ্গল আর শনি, সন্ধে ছ’টা থেকে রাত আটটা।
— ভালই হল। আজ তো বৃহস্পতিবার। তার মানে কাল শুক্র, পরশু শনি। তাই তো? তা হলে এই শনিবারই ওকে নিয়ে যাব।
— আরে, ও ভাবে গেলে কি উনি দেখবেন নাকি? আটশো টাকার ডাক্তার বলে কথা। প্রচুর ভিড় হয়। এক মাস আগে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে হয়।
— এক মাসে আগে!
— তা হলে আর বলছি কি? দাঁড়া, তোকে একটা নম্বর দিচ্ছি, এখানে ফোন করে কথা বলবি। আমার কথা বলতে পারিস। আসলে যে ছেলেটা নাম লেখে, সে আমাকে খুব ইয়ে করে... মানে, ওকে বলবি, তুই আমার বন্ধু। একটু রিকোয়েস্ট করবি, ডেডটা যাতে একটু আগে করে দেয়। দেখবি, ও ঠিক করে দেবে।
স্বামী বাড়ি ফেরার পর পরই কাজরী বায়না ধরেছিলেন, তিনি তাঁর ছেলেকে নতুন ডাক্তার দেখাবেন। স্বামী গাঁইগুঁই করতেই তাঁর মুখের উপরে বলে দিয়েছিলেন, তুমি যদি টাকা দিতে না চাও, দিয়ো না। আমি আমার বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে আসব। সহেলীর মা সহেলীকে ওখানেই দেখায়। এটা একটা প্রেস্টিজ ইস্যু!
অগত্যা ডাক্তারের জন্য আটশো এবং যাতায়াত বাবদ আরও পঞ্চাশ টাকা দিয়ে দিয়েছিলেন ওঁর স্বামী। অবশ্য টাকা হাতে পাওয়ার সাত দিন আগেই ফোন করে চেম্বার থেকে উনি ডেট নিয়ে নিয়েছিলেন।

কাজরীর মুখের দিকে তাকালেন ডাক্তার, তা হলে ও কী খায়?
— কিচ্ছু না।
— কিচ্ছু না মানে?
— সেটাই তো বলছি, ও না কিচ্ছু মুখে তোলে না।
— কিচ্ছু না?
— না।
ডাক্তার ভ্রু কুঁচকে তাকালেন।
ঠিক এ ভাবেই মাঝেমাঝে ভ্রু কুঁচকে যায় কাজরীর। যখন তাঁর ছেলে হঠাৎ হঠাৎ জানতে চায়, এটা কী, ওটা কী? উনি যে জানেন না, তা নয়। জানেন বাংলাটা। ইংরেজির জন্য তখন তার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করে। এই তো সে দিন, বিকেলবেলায় মুড়ি মেখে ছেলেকে দিতে গিয়ে বললেন, নে, মুড়িটা খেয়ে নে। বলতে গিয়েই মনে পড়ে গেল, তাঁর ছেলেকে যে মেয়েটি পড়ায়, সে বারবার করে বলে দিয়েছে, বউদি, ও কিন্তু ইংরেজিতে খুব কাঁচা। ওর সঙ্গে যতটা সম্ভব ইংরেজিতে কথা বলবেন। পুরো না হলেও ইংরেজি বাংলা মিশিয়ে। তাতে ওর অন্তত স্টক অব ওয়ার্ড বাড়বে। অথচ কাজরী ইংরেজি জানেন না। ছোটবেলায় পড়তেন পাড়ার একটা পাতি বাংলা মিডিয়াম স্কুলে। এখনও ঠিক করে স্কুল বলতে পারেন না। বলেন ইস্কুল। মার্ডারকে মাডার। ফাস্ট ফুডকে ফাস ফুড। এমন বিদ্যে নিয়ে মাধ্যমিকে ব্যাক পাওয়ার পরে পড়াশুনো ছেড়ে দিয়েছিলেন। সেই থেকে বইয়ের সঙ্গে তাঁর কোনও সম্পর্ক নেই। তার পরে ছেলের জন্য আবার এই বই নিয়ে বসা। শ্বশুর-শাশুড়ি, এমনকী ওঁর  স্বামীও বলেছিলেন, ইংরেজি মিডিয়ামে ভর্তি করাতে হলে বাবা-মাকেও একটু ইংরেজি জানতে হয়। না হলে নার্সারি থেকেই দু’জন মাস্টার রাখতে হবে। তার চেয়ে ভাল দেখে কোনও একটা বাংলা মিডিয়ামে ছেলেকে ভর্তি করে দিই। কাজরী রাজি হননি। তিনি বলেছিলেন, যত দিন পারবেন, তিনি নিজেই ছেলেকে পড়াবেন। আর সে জন্যই আবার নতুন করে পড়া শুরু করেছিলেন তিনি। যতটা পারতেন, ছেলের সঙ্গে ইংরেজিতেই কথা বলতেন।
ইংরেজিতে কথা মানে, ছেলেকে নিয়ে পার্কে ঘুরতে ঘুরতে হয়তো কোনও গাছে একটা প্রজাপতিকে বসতে দেখলেন, অমনি ছেলেকে তিনি বলতে লাগলেন, ওই দ্যাখ, ওই দ্যাখ, কী সুন্দর একটা বাটারফ্লাই। বা টাপুরটুপুর বৃষ্টি দেখিয়ে বলতে লাগলেন, দেখছিস, কী রকম রেইন হচ্ছে। কিংবা ছেলের খাবার বাড়তে বাড়তে ক’হাত দূরে থাকা চামচটা দেখিয়ে বললেন, যা তো বাবা, ওই স্পুনটা নিয়ে আয় তো। এই রকম। এতে ছেলেকে দারুণ ইংরেজি শেখাচ্ছি ভেবে মনে মনে খুব গর্ববোধ করতেন তিনি। এই তো সে দিন ছেলেকে নিয়ে বাপের বাড়ি থেকে ফেরার সময় কেকার সঙ্গে তাঁর দেখা। কেকা যেই জিজ্ঞেস করল, কোথায় গিয়েছিলি? ও অমনি দুম করে বলে ফেলল, শ্রেয়াদের বাড়ি গিয়েছিলাম। ওর মেয়েকে যে বাংলা পড়ায় তার ঠিকানাটা নিতে...
— বাংলা টিচার! কেন?
— আর বলিস না। আমার ছেলেটা না একদম বাংলা জানে না।
— সে কী রে? তুই তো বাংলা স্কুলেই পড়তিস। আর তোর ছেলে কিনা বাংলা জানে না?
— কী করব বল? ওর আর সব বিষয়ে ঠিক আছে। কোনও প্রবলেম নেই। কিন্তু বাংলা পড়তে গেলেই ওর গায়ে জ্বর আসে।
— সে জন্য বাংলা মাস্টার খুঁজতে বেরিয়েছিস?
— আর বলিস কেন?
— কোন ক্লাস হল ওর?
— এই তো সবে টুয়ে উঠল।
— কত পেয়েছে বাংলায়?
— একচল্লিশ।
— একচল্লিশ? কতয় পাশ?
— চল্লিশে।
— চল্লিশে পাশ, একচিল্লশ? না না, পড়াশোনার ব্যাপারে একদম অবহেলা করবি না। প্রথম থেকেই নজর দে। না হলে পরে কিন্তু পস্তাতে হবে। আমার মেয়েও তো একদম বাংলা জানত না। তার পর মাস্টার রাখার পরে এখন খানিকটা ঠিক হয়েছে। এখন থেকেই ওর জন্য একটা ভাল মাস্টার রাখ। বুঝেছিস?
ও বুঝেছিল। কিন্তু ওর ছেলে বুঝতে পারছিল না ব্যাপারটা। তাই কেকা চলে যেতেই ও মাকে বলেছিল, আচ্ছা মাম্মি, আমি বাংলায় কত পেয়েছি, সেটা তো তুমি আন্টিটাকে বললে, লেকিন বাকিগুলোতে কত পেয়েছি, তা তো বললে না!
— বললে থুতু দিত। তোমার মনে নেই, কত পেয়েছ? অঙ্কে গায়ে-গায়ে, আর ইংরেজিতে তো এক্কেবারে এই এত্ত বড় একটা গোল্লা। মনে আছে, দু’-দুটো বিষয়ে ফেল। ক্লাস টুতেই গার্জিয়ান টু সি... আবার কথা বলছ?
— লেকিন, আমি তো পড়ি মাম্মি।
— ছাই পড়ো। সারাক্ষণ খালি টিভি, টিভি আর টিভি।
— হ্যাঁ, টিভি দেখি। লেকিন, প্রোগ্রামের মাঝে মাঝেই যে অ্যাড হয়, তখন তো পড়ি।
— ও ভাবে পড়া হয় না, বুঝলে?
— তুমিই তো সবাইকে বলো, আমি খুব পড়ি।
— কেন বলি, তুমি যখন বাচ্চাকাচ্চার বাবা হবে, তখন বুঝবে।
— লেকিন মাম্মি, আমরা তো দিদুনের বাড়ি গিয়েছিলাম। তুমি যে আন্টিটাকে বললে, শ্রেয়া আন্টির মেয়েকে যে বাংলা পড়ায়, তাঁর ঠিকানা আনতে গিয়েছিলে...
— চুপ। একটাও কথা বলবি না। খালি বকবক বকবক। একটু চুপ করে থাকতে পারিস না? ছেলে কী বলতে যাচ্ছিল, উনি ফের ধমকে উঠলেন, চুপ। বলেই, মনে পড়ে গেল ছেলেকে উনি বাংলায় বকছেন। অমনি বললেন, স্যরি। সাট আপ। রেগে গেলে মানুষ কেন যে মাতৃভাষায় কথা বলে, বুঝি না! বাঙালি বাচ্চাদের বাংলা না জানাটা যে কত গর্বের, সেটা অন্যান্য মায়েদের সঙ্গে দু’মিনিট কথা বললেই টের পাওয়া যায়। সবারই এক কথা, আমার বাচ্চার ইংরেজিতে কোনও অসুবিধে হয় না। কিন্তু বাংলাটায় ভীষণ কাঁচা। থার্টি নাইনের বাংলা কী? জিজ্ঞেস করো, বলতে পারবে না। কী যে করি! এই ‘কী যে করি!’ বলাটা আসলে কিন্তু গর্ব করে বলা।
তাই বাংলা নয়, উনি জোর দিয়েছিলেন ইংরেজিতে। কিন্তু তাঁর ছেলেকে যে তিনি কিছুই শেখাতে পারেননি, সেটা উনি বুঝতে পেরেছিলেন, সি বি এস সি বোর্ডের একটা স্কুলে ওকে নার্সারিতে ভর্তি করাতে গিয়ে। রেজাল্টের দিন দেখলেন, তাঁর ছেলের নামই ওঠেনি। তাই উনি ঠিক করলেন, যে করেই হোক, দরকার হলে ডোনেশন দিয়ে ছেলেকে ভর্তি করাবেন।
স্বামী একদম রাজি নন। তাই বাবাকে গিয়ে ধরলেন। তোমার নাতিকে সামনের সপ্তাহেই স্কুলে ভর্তি করতে হবে। কিন্তু তোমার জামাইয়ের হাতে এখন, এই মুহূর্তে একদম কোনও টাকাপয়সা নেই। তুমি যদি ডোনেশনের টাকাটা এখন দিয়ে দাও, তা হলে খুব ভাল হয়। ও পরে তোমাকে দিয়ে দেবে, বলে বাবার কাছ থেকে কায়দা করে টাকাটা ম্যানেজ করে নিয়ে এসেছিলেন। সেটা আর দেওয়া হয়নি। সেটা যে কত টাকা, তাও মনে করতে চান না তিনি। এবং তিনি যে ভাবে চান, ছেলেকে সে ভাবে পড়াতে পারছেন না বলে, নার্সারি ওয়ানেই রাখতে হয়েছে একটা মেয়েকে। সেই মেয়েটিই সে দিন বলে গিয়েছে, যতটা পারবেন, ওর সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলবেন।
সেটা বলার জন্যই বিকেলবেলায় ছেলের দিকে মুড়ি-মাখা বাটিটা এগিয়ে দিয়ে, নে, মুড়িটা খেয়ে নে, বলেও, থমকে গিয়েছিলেন। ক’দিন আগেই বাসে করে ফেরার সময় একটা হকারের কাছ থেকে তিন টাকা দিয়ে একটা বই কিনেছিলেন তিনি। বেঙ্গলি টু ইংলিশ। কয়েক পাতার পাতলা একটা চটি বই। সেই বইটা উল্টেপাল্টে মুড়ির ইংরেজিটা দেখে নিজেই হেসে ফেললেন! ফ্রাইডরাইস! মুড়ি ইংরাজি ফ্রাইডরাইস! তা হলে আমরা যাকে ফ্রাইডরাইস বলি, সেটার ইংরেজি কী?

— ও কবে থেকে খাচ্ছে না? ডাক্তার প্রশ্ন করতেই কাজরী সচকিত হলেন। নড়েচড়ে বসতে বসতে বললেন, প্রথম থেকেই। তবে সেটা আরও বেড়েছে, ওই গানের ক্লাসে গিয়ে।
গানের কথা বলে ফেলার পরেই নিজেকে একটু সামলে নিলেন কাজরী। কিছু দিন আগে একটা বিয়ে বাড়িতে গিয়ে তাঁর এক পুরনো বান্ধবীর সঙ্গে দেখা। দেখা আরও অনেকের সঙ্গেই। সেখানে সবাই সবার খোঁজখবর নিচ্ছিল। কে কী করছে, কার বর কী করে, কার বাচ্চা কোন ক্লাসে পড়ে। কথায় কথায় কাজরী বলেছিলেন, তাঁর ছেলের গান শেখার কথা। বলতে বলতে তাতে রং চড়ছিল। এক সময় বলে ফেললেন, নিজের ছেলে বলে বলছি না, এই বয়সেই ও যা গায়, কী বলব... ও যেখানে যায়, সেখানেই, সবাই ওকে গান করার জন্য ধরে। পাড়ায় কোনও ফাংশন হলেই হল, ওকে চাই। পাড়ার সবাই তো বলেই, ও আপনাদের ছেলে না, ও আমাদের ছেলে। শুধু গানের জন্য। স্কুলে যাবে, সেখানেও। এমনকী টিফিন পিরিয়ডে ওর আন্টিরা পর্যন্ত ওকে ডেকে নিয়ে যান। ও যার কাছে গান শেখে, তিনিও তো বলেন, ওর মধ্যে পার্স আছে, ও যদি গানটাকে ধরে রাখতে পারে, ও একদিন...
আশপাশের লোকেরা যত মাথা নাড়ছেন, উনিও তত বলে যাচ্ছেন— এই তো তোন একটা চ্যানেলে ছোটদের গানের কমপিটিশন হচ্ছে না? ওর মাস্টার তো ওর নাম দিয়েই দিচ্ছিল। আণি বলে দিয়েছি, না। একদম না। এক্ষুনি না। আগে লেখাপড়াটা করুক। তার পর এ সব। কারণ, ও যদি ফার্স্ট হয়ে যায়, তা হলে তো আর নিস্তার নেই। মুম্বই যেতেই হবে। একের পর এক গানের রেকর্ড করতে হবে। সিনেমার জন্য গান গাইতে হবে। তোরাই বল, এতে পড়াশোনার ক্ষতি হবে না? ওদের স্কুল আবার প্রচণ্ড স্ট্রিক্ট। নাইন্টি এইট পারসেন্ট না থাকলে... সবাই ভিড় করে শুনছিলেন। হঠাৎ পাশ থেকে সেই বন্ধু বলে উঠলেন, ঠিক বলেছিস, এখন গান করলেও তো কত নাম। দেখিস না, লতা মঙ্গেশকর, মান্না দে, শান। এঁরা গান করেই যা রোজগার করেন, তাতেই তাঁদের সংসার চলে যায়। আর চাকরি বাকরি করতে হয় না।
প্রথমটা চট করে বুঝতে না পারলেও, কাজরী যখন দেখলেন, মুখ টিপে টিপে সবাই হাসছেন, তখন বুঝতে পারলেন, ওই বন্ধুটা তাঁর কথা নিয়ে ব্যাঙ্গ করছেন।
এর পরেই ওঁদের জমাটি আসর ভেঙে যায়। যে যার মতো এ দিক ও দিক ছড়িয়ে পড়েন। সে দিন ওঁর কাছ থেকে ফোন নম্বর নিয়ে রাখলেও তিনি আর কোনও দিনই ওঁকে ফোন করেননি। তার পর থেকে ছেলের গানের কথা কাউকে বলতে গেলেই ওঁর মনে পড়ে যায়, ওই বন্ধুর কথা। তাই ডাক্তারবাবুকে ছেলের গানের কথা বলে ফেলেও কথা ঘোরালেন কাজরী আসলে এমনিতেই ও কিছু খেতে যায় না।
— সকালে কী খায়?
— কিচ্ছু না।
— জলও না?
— না, জল খায়।
— দুধ?
— হ্যাঁ, দুধ খায়। আধ গ্লাস।
— দুধের সঙ্গে?
— কিচ্ছু না, ওই একটু কর্নেফ্লক্স।
— তার পর?
— তার পর আর কিচ্ছু না। সামান্য লবণ দিয়ে একটা দেশি ডিম, ব্যস...
— দুপুরে?
— দুপুরেও তাই। কিচ্ছু খায় না। শুধু একটু স্টু, ছোট্ট এইটুকুনি এক পিস মাছ আর একটু ভাত, ব্যস।
— তার পরে?
— তার পরে আর কিচ্ছু না। সেই বেলা চারটে নাগাদ একটা আপেল আর একটু সিজিন ফল।
— সন্ধেবেলা?
— কিচ্ছু না। ঘরে যা হয়, তাই। কোনও দিন ম্যাগি করে দিলাম, কি কোনও দিন একটা এগরোল কিনে দিলাম...
— আর কিছু?
— না না, আর কিচ্ছু না। ওই কখনও সখনও একটু চিপস্‌ বা এটা ওটা সেটা, ব্যস।
— রাতে?
— রাতে খেলে তো ধন্য হয়ে যেতাম। কিচ্ছু খায় না। ওই একটু ভাত, একটু তরকারি, কখনও দু’-চার পিস চিকেন বা একটু মাছ কিংবা একটা ডিম। ডিমটা ও খুব ভাল খায়।
— আর কিছু খায় না?
— না। সে জন্যই তো আপনার কাছে এসেছি। না খেয়ে খেয়ে আমার ছেলেটা, কি বলব ডাক্তারবাবু, একেবারে ঝেঁটার কাঠি হয়ে গেছে।
— ও কোথায়?
— গানের ক্লাসে। আসলে সপ্তাহে একটা দিন ক্লাস তো। তাই ভাবলাম, আপনি যদি এই প্রেসক্রিপশনগুলো দেখে আর আমার মুখের কথা শুনে কোনও ওষুধ-টসুধ দিয়ে দেন, তা হলে... এর পর যে দিন আসব, সে দিন না হয়...
— না, ওকে আনতে হবে না।
— ও! আপনি বুঝে গেছেন, ওর কী হয়েছে?
— হ্যাঁ।
— কী হয়েছে ডাক্তারবাবু?
— কিছু না।
— কিন্তু ও যে একদম খেতে চায় না... জানেন? আমাদের পাড়ায় একটা ছেলে আছে। সবাই ওকে ভয় পায়। বড়রা পর্যন্ত  সমঝে চলে। সে দিন তাকে সামনে দাঁড় করিয়েও ওকে এতটুকু খাওয়াতে পারিনি।
— শুধু ওই ছেলেটা কেন? ওর সামনে যদি একটা বাঘ এনেও দাঁড় করিয়ে দেন, ও আর খাবে না।
— কেন ডাক্তারবাবু? খাবার দেখলেই ও পালায় কেন?
— ও কেন? ও ভাবে যদি আমাকেও আপনি খাওয়ান, দেখবেন, পরের দিন থেকে আমিও খাবার দেখলে পালাচ্ছি। আর ওর বয়স তো সবে সাত বছর...
— কেন? আমি কি ওকে বেশি খাওয়াচ্ছি?
— বেশি না। খুব বেশি। হিসেব করে দেখবেন, ও যা খায়, আপনিও তা খান না। সুতরাং এ সব নিয়ে একদম ভাববেন না। পারলে এক-আধ বেলা ওকে না খাইয়ে রাখুন। খেতে না চাওয়া পর্যন্ত ওকে কোনও খাবার দেবেন না। দেখবেন, খিদে পেলে ও নিজেই আপনার কাছে এসে খাবার চাইবে। জোর করে কখনও খাওয়াতে যাবেন না। জানবেন, না খেলে কেউ মরে না, খেয়েই মরে।
ডাক্তারের কথা শুনে কাজরী হাঁ হয়ে গেলেন। তিনি কত আশা করে এসেছিলেন, ডাক্তারবাবু তাঁকে এই পরীক্ষা করাতে বলবেন, সেই পরীক্ষা করাতে বলবেন, এত এত ওষুধ দেবেন, তা নয়, উেল্ট বলছেন কি না, যা খায়, সেটাও কমাতে! পারলে দু’-এক বেলা না খাইয়ে রাখতে! এ কেমন ডাক্তার রে বাবা! এর ভিজিট আটশো টাকা! যাক বাবা, আর কিছু না হোক, একটা কাজ তো হল, এ বার থেকে সহেলীর মায়ের মতো তিনিও বড় মুখ করে বলতে পারবেন, আমি আমার ছেলেকে আটশো টাকার ডাক্তার দেখাই। সেটাই বা কম কী!


                      মেঘলা কথা
                    সোমনাথ মুখার্জী

সকাল থেকেই আজ খুব মেঘলা দিন। বৈশাখের প্রথম। থাকার কথা নয়,কিন্তু ছিল। সৌমেন এভাবে ভাবল। বিছানায় শুয়ে। বাইরের আকাশ ভাবনা উপহার দিল ওকে। ভাবান্বিত হল। মনে মনে হাসল খুব। অনেকেই ওকে নিয়ে আড়ালে হাসে। সেটা বোঝে সৌমেন। রাস্তায় চলাফেরার সময় আকাশের দিকে, বড় বড় বাড়ি গুলোর দিকে, পথ চলতি পথচারীদের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। তাকাতে ভালবাসে। তবে কি ও আধুনিক অপু!! দেখবার এত কি সত‍্যিই আছে!! যন্ত্র সভ‍্যতায় সবই প্রায় ভঙ্গুর। আসলে, একাকীত্ব ওর জন্মগত  অভিশাপ। মেঘলা দিনে সৌমেন ভাবুক হয়ে ওঠে। কবিতা লিখতে পারে না। কষ্ট মোচড় দেয় বুকে। চোখে মুখে ছাপ পরে। চোখের কোলে কালি। ভালবাসতে চায়, কিন্তু  ভালবাসা ওকে মেঘলায় ঢেকে রাখে। ওর শরীরে, মনে, চোখে, কোষে কোষে মেঘ জমে আছে। জমছে আর জমছে। কোনো একদিন বৃষ্টি হয়ে ঝরবে সেই আশায়।
           

1 comment:

  1. আমার "মোহিনী" অণু গল্পটি প্রকাশ করার জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞ জানাই 🙏🙏

    ReplyDelete