মায়ের দুধ
শাশ্বত ভট্টাচার্য্য
নাহ্ , আর পারছেনা হৈমন্তী, চোখটা ক্রমশ বন্ধ হয়ে আসছে, শরীরে আর বল নাই, অবশ্য শরীরেরই বা কী দোষ, প্রায় তিন-চারদিন যাবদ পেটে একটা দানাও পড়েনি, তবুও চোখ খুলে থাকা খালি রিভু টার জন্য, একেবারেই যে দুধের শিশু, বুকের দুধ খেয়েই থাকে, কিন্তু এই অনাহারের দিনে নিজেই খেতে পায়নি তো, বুকেই বা দুধ আসবে কোত্থেকে, আর দুধ না পেয়ে পেয়ে তার চেহারাটাও একেবারে কঙ্কালসার হয়ে গিয়েছে, হাড়গোড় যেন বেরিয়ে আসছে, খিদের জ্বালায় খালি কাঁদছে, তার অসহায় মুখটা দেখে হৈমন্তীর চোখেও বারবার জল আসে , বুকটা হু হু করে ওঠে, বাপটা তো সেই কবেই মরে গেছে, এমনকি অভাবের তাড়নায় বেচে দিলে তার সাধের রিমিকেও ওই দানবদের কাছে, কিন্তু... আকাশের দিকে তাকিয়ে তার চিৎকার করে বলে উঠতে ইচ্ছে করে, 'হে ঈশ্বর, আমরা কী অপরাধ করেছিলাম , তুমি কেনো এত বড়ো শাস্তি দিলে?' কিন্তু সে বলার মতোও যে আর গলার জোর নাই, তাছাড়া বললেই বা শুনছে কে!হৈমন্তীর মনে পড়ে যায়, তাদের গ্ৰামের কথা, গ্ৰামের বাড়ির কথা, অভাবের সংসার হলেও কতোই না আনন্দে ছিলো তাদের, বিঘে দুই জমি ছিলো, আর ছিলো যজমানি, তাতে হেলায়ফেলায় না হলেও খেয়েপড়ে বাঁচা যেতো অন্তত, ইচ্ছে ছিলো আর বছর দুয়েক পর রিমিটার একটা ভালো বিয়ে দিয়ে দেবার, এইবারো মাঠে সোনার ফসল ফললো, মাঠ একেবারে সোনার মতো চকচক করছিলো, ভাবছিলো এইবার একটা ঘটা করে নবান্ন দেবে, কিন্তু সেসব হায়… গরিব মানুষের অত সুখ বোধহয় ঈশ্বরের সয়েনা, হঠাৎ নেমে এলো বন্যা, ফসল মাঠ থেকে তোলার আগেই সব শেষ, যাও বা উঁচু দু'একটা জমিতে ছিলো কিছু, তাও কেড়ে নিয়ে গেলো ওই পাজি গোড়া সাহেবের পেয়াদারা যুদ্ধের জন্য, যেটুকু টাকা ছিলো, তাও খাবারের খরচ জোগাতে গিয়ে ফুরিয়ে গেলো কিছুদিনের মধ্যেই , পেটের জ্বালা মেটাতে চলে আসতে হলো শহরে , কিন্তু এমন মন্দার দিনে শহরেই বা কাজ দেয় কে? অগত্যা ফুটপাতে থাকা, রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষে করে যা জোটে, তাই খেয়েই বাঁচা, অভাবের চোটে বাপ বেচে দিলো মেয়েকেও, সেদিনও সে খুব কান্নাকাটি করেছিলো, কিন্তু শোনে কে....বাপের হৃদয় পাষাণ নাহয়, সে যে মা, দশ মাস দশ দিন পেটে ধরেছে, তার কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেলো তার ওই প্রাণের মেয়েটাকে, কিছুদিনের মধ্যে মরলে নিজেও, আর আজ তার একমাত্র সম্বল বলতে আছে এই দুধের শিশুটা...সে চলে গেলে যে শিশুটার আর কেউ নাই, মরে যাবে। মন যাই বলুক, শরীর যে আর পারছেনা, হাত-পা অবশ হয়ে আসছে, শরীরটা মিশে যেতে চাইছে মাটিতে, চোখটা ক্রমশ ভারী হয়ে আসছে , চোখের সামনে আস্তে আস্তে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে সবকিছু। হৈমন্তী প্রাণপণ চেষ্টা করে চোখটা খুলে রাখার, যতবার বন্ধ হয়ে আসে, ততবার ঝেড়েমেরে ওঠে, কিন্তু নাহ্ , শেষে আর পারলোনা, আস্তে আস্তে বুঁজে গেলো চোখটা, হয়তো চিরদিনের মতো, নিভে গেলো সব স্বপ্নের প্রদীপ, দেহখানিও আস্তে আস্তে অসার হয়ে গেলো, ছোট্টো অবুঝ শিশুটা তখনও বুকটা জাপটে ধরে কামড়ে চলেছে।
যোগাযোগ
লেখশ্রী
মানসিক ভাবে ক্লান্ত শরীরটাকে বিছানায় এলিয়ে দিয়ে নীরা ভাবল,যোগাযোগটা আজ সত্যি নিভে গেলো।টানা তিন মাস ধরে নিজের মধ্যে বহন করা ওই ছোট্ট প্রাণ টাকে পরিবারের চাপে আজ সে মুক্তি দিল।কিন্তু প্রথম মাতৃত্বের অনুভব - আদৌ কি তা মুক্তি পেল!!!!!
ওরা কাজ করে
পাঁচ বছরের মিঠির প্রশ্নবাণে সারা বাড়ি জেরবার। লকডাউন এ বাবাকে বাড়িতে পেয়ে দিনগুলো তার বেশ কাটছে।আজ সকালে কাগজ টা দরজা থেকে নিয়ে দৌড়ে এসে অমলবাবু কে বললো -"বাবান,বাবান এই বাচ্চাটাকে দেখো রেল লাইন এ ঘুমাচ্ছে,মনে হয় ওর মা খুব বকেছে,তাই না?...."। অস্ফুট স্বরে অমলবাবু শুধু বললেন ," তিন্নি, ওরা কাজ করে"।
আ-মরি বাংলা
ইন্দ্রাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
সকাল থেকে ব্যস্ততা মণির।ভোর থেকে উঠে ঘরের সব কাজ গুছিয়ে, রান্না প্রায় অর্ধেক সেরে টুবাইকে নিয়ে ছুটতে হয় স্কুলে। টুবাই মণির একমাত্র ছেলে। মণির স্বপ্ন জীবনে ও নিজে যা পায় নি,টুবাইকে দিয়ে তা পূরণ করবে,তাই এই কৃচ্ছসাধন।
টুবাই একটা নামকরা ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে পড়ে।এরজন্য মণি কে অনেক কষ্ট করতে হয়।তবুও টুবাইয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে ও তা মেনে নেয়।আজকাল ইংরেজি ভালোভাবে না জানলে,ছাপোষা মধ্যবিত্ত ছাপ নিয়ে কোথাও ভালো কিছু কাজ পাওয়া যায় না।
রোজ অন্ধকার থাকতে উঠে সব কাজ সেরে প্রায় ২০ মাইল দূরের স্কুলে নিয়ে গিয়ে বসে থাকে মণি। ছুটি হলে নিয়ে আসে একেবারে।
এমনই একদিন স্কুলে বসে আছে স্কুলের মাঠে, সঙ্গে আরও দু একজন অভিভাবক। হঠাৎই স্কুলের ভেতরে চিৎকার শুনে ওরা স্কুলের ভেতরে আসে।সেখানে একজন অভিভাবকের সাথে স্কুল কতৃপক্ষের গন্ডগোল হচ্ছে। ওরা দাঁড়িয়ে শুনে যা বুঝতে পারে যে একজন শিক্ষক ওই ভদ্রলোকের ছেলে কে অন্যায় ভাবে শাসন করেছেন।ওরা দাঁড়িয়ে দুপক্ষকেই বোঝানোর চেষ্টা করে। তর্কাতর্কির মধ্যে স্কুল কতৃপক্ষের একটি মেয়ে বলে ওঠে "বাঙালী লোগ এয়সাহি হোতা হ্যয়". মণি সাথে সাথে প্রতিবাদ করে জানায়।মেয়েটির যুক্তি যেহেতু ওরা বাংলায় কথা বলে তাই ওরা এভাবে উদ্ধ্যত ব্যবহার করছে। মণি মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করে সে কোথায় থাকে? মেয়েটি গর্বের সঙ্গে জানায়,ও বাংলা ভাষী নয়।মণি ওকে পাল্টা প্রশ্ন করে, তাহলে ও এখানে কি করছে? মেয়েটি জানায় শুধুই জীবিকার প্রয়োজনে তার বাংলা শেখা।মণি হেসে উঠে বলে তাহলে যে ভাষার মানুষ আপনাকে অন্ন দিচ্ছে আপনি তাকেই আক্রমণ করছেন, ধন্য আপনার সভ্যতা।আর আমার গর্ব যে আমি একজন বাংলা ভাষী যে আপনাদের মতো মানুষদের আপন করে অতিথি হিসেবে রাখতে পারি, সন্মান করি সব ভাষার মানুষদের।মণির কথার কোনো প্রতিউত্তর দিতে পারে না মেয়েটা।
মণিরা সবাই ওখান থেকে চলে আসে তখনকার মতো।পরের দিন স্কুলে গিয়ে জানা যায় স্কুল চত্বরে বসা যাবে না। মণিরা বুঝতে পারে আবারও সেই অন্যায় ভাষা বিদ্বেষের শিকার ওরা,শিকার বাংলাভাষার হয়ে কথা বলার..মনে মনে বলে " মোদের গরব মোদের আশা আ-মরি বাংলা ভাষা"
বন্ধন
নন্দিতা মিশ্র
প্রতীক বলেছিল সকাল দশটায় ফোন করবে।
সাড়ে ন'টা থেকে প্রতীতি ফোনের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। দশটা...দশটা পাঁচ...দশটা কুড়ি...
ফোনটা বেজে উঠলো! স্ক্রীনে লেখা "Head Master".
ফোনটা ধরে প্রতীতির তড়িঘড়ি জবাব, "আজ শরীরটা ভীষণ খারাপ, স্যার! বিছানা থেকে উঠতে পারছি না। এখন রাখি স্যার। ডাক্তারকে ফোন করতে হবে।"
দশটা ত্রিশ...সাড়ে এগারোটা...দুপুর দু'টো...
প্রতীককে ফোন করাও ঠিক নয়। কী অবস্থায় আছে কে জানে! দুপুরের খাওয়াও মাটি।
সন্ধ্যে সাতটা...রাত ন'টা। ফোনটা আবার বাজল।
প্রতীতি তখন বাথরুমে। এসে দেখে একটা মিসড্ কল্ "From PRATIK". সাথে সাথে একটা মেসেজ, "জানতাম ফোন ধরবে না। ভালোই করেছো।"
কেঁদে ফেলে প্রতীতি।
সেই এক অমলতাসের গন্ধ মাখা বিকেলে প্রিন্সেফ ঘাটের রাস্তায় হঠাতই ধাক্কা লাগে প্রতীতির সাথে প্রতীকের। দুজনেই মোবাইলে চোখ রেখে হাঁটছিল আর কানে গোঁজা ছিল হেডফোন।
এক ধাক্কায় নীচে দুজনেরই ফোনটা। প্রটেক্টর থাকায় প্রতীকেরটা বেঁচে গেলেও, সদ্য কেনা প্রতীতিরটা খান খান হয়ে যায়। প্রথম মাসের বেতন থেকে ফোনটা কিনেছিল সে।
'সরি!'
'আর সরি বলে কী লাভ? আর দোষটা দুজনেরই ছিল!'
'তবে নতুন ফোন কেনার টাকাটাও দুজনেরই লাগা দরকার!'
'কেন নেব, আমি আপনার টাকা?'
'কেন নয়...'
এভাবেই এক অনাবিল স্রোতে পার হচ্ছিল দিন। হঠাতই লকডাউনে পুরো গৃহবন্দি প্রতীতি। আর প্রতীক নিজের সর্বস্ব দিয়ে সেবায় বিলীন করেছে নিজেকে... বেলেঘাটা আই ডিতে তার ডিউটি।
দেখা নেই প্রায় দুইমাস। কথাও হয়না সব সময়। প্রতীতি বড্ড ভালোবাসে প্রতীককে।
কিন্তু জানি না কেন কিছুদিন থেকে সচেতন ভাবে প্রতীক অবহেলা করছে তাকে।
সকাল থেকে যার একটা ফোনের অপেক্ষায় দিনটা পার হয়ে গেল প্রতীতির, তার কাছে এমন ম্যাসেজে প্রচণ্ড অভিমানে আর ফোনও করল না।
প্রতীক ভেন্টিলেশনে। প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট। কোনোরকমে ম্যাসেজটা টাইপ করতে বলে বন্ধু সুজয়কে। তার আগে ঠিক একটা রিং হওয়া মিসড কল।
প্রতীক জানে, এ সময় প্রতীতি সান্ধ্যস্নানে যায়। জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে সে ভাবে, এই কষ্টের চেয়েও বড় কষ্ট হয়তো প্রতীতির ভাগ্যে আছে। আর যদি সে বেঁচে ফেরে, বুঝিয়ে বলে দেবে তখন।
অকালে শ্রাবণধারা প্রতীতির চোখে।
বিষাদ বর্ষা
বসন্ত কুমার প্রামাণিক
আজ প্রবল বর্ষণ হচ্ছে।মিনুর মা আর কাজে বেরোতে পারল না,প্রচণ্ড জ্বর এসেছে।মিনু ভাইকে মায়ের কাছে বসিয়ে ঝুড়িতে ফুল সাজিয়ে গেল জহরাতলার মেলায় বিক্রি করতে।যা অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে,মনে হয় না মেলায় লোকের সমাগম হবে।তবুও মিনু গেছে ফুল বেচে যা দু-চার পয়সা হবে তা দিয়ে মায়ের জন্য ওষুধ কিনে নিয়ে আসবে।প্রবল বর্ষণে সেরকম লোকজনের সমাগম হয় নি।মিনু বৃষ্টিতে ভিজে সব লোকের কাছে ফুল কেনার জন্য আবেদন করতে লাগল, কিন্তু কেউ আর মিনুর দিকে ভ্রূক্ষেপ করল না।দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে আসল,মেলা প্রায় শেষের দিকে।মিনুর ফুল ভর্তি ঝুড়ি থেকে একটি ফুলও বিক্রি হল না।অবশেষে দুঃখে ঝুড়ি ভর্তি ফুল নিয়ে মিনু বাড়ি ফিরে এল।দরজার ফাঁক দিয়ে মিনু দেখে ভাই মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর সান্ত্বনা দিয়ে বলছে-"একটু অপেক্ষা কর,দিদি এখনই ওষুধ নিয়ে আসছে"।এসব দেখে মিনু আর নিজেকে ঠিক রাখতে না পেরে ফুলের ঝুড়ি ফেলে দৌড়ে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদতে লাগলো, আর বলল,"মা আমি তোমার জন্য ওষুধ আনতে পারলাম না,আমাকে ক্ষমা করে দিও"।মা এদিকে বলতে লাগল,"এই দেখ কাঁদে না,আমার কিছু হয়নি,সব ঠিক হয়ে যাবে।চুপ কর মিনু, চুপ কর"।এইভাবে মা ও মেয়ে একে অপরকে সান্ত্বনা দিতে লাগল।এদিকে ভাই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে মা ও মেয়ের ছলনার অভিনয় দেখতে লাগল।
আজও বলা হয়নি
সুব্রত সামন্ত
সেই যে একবার বললে ইনস্টাগ্রামে আমায় ফলো করবে আমি কেবল আজও ফলো করি আর কাউকে নয়। বিশ্বাস কর তোমার পছন্দের ছবিটা প্রথম থেকেই প্রোফাইল করে রেখেছি। কতবার ম্যাসেজ করেছি ইনস্টাগ্রাম এর ইনবক্সে তার কোনো উত্তর দাওনি আজও....। জানি আজ অনেকটাই ব্যাস্ত সদ্য চাকুরি জীবন সব মিলিয়ে বিন্দাস। আচ্ছা ঠিক আছে অন্তত একবার এসো অনলাইনে; জানি আসবে না এই বহুমুখী কাজে সোস্যাল মিডিয়ায় এক্টিভ থাকার সময় কোথায়? যাক এসব কথা এখন বলো দৌড়াতে গিয়ে যে ব্যাথা পেয়েছিলে সেটা এখন ভালো হয়েছে তো? কদিন আগে দেখলাম কাকদ্বীপ বাজারে দাঁড়িয়ে আছো একটা ব্যাগ হাতে নিয়ে, ভীড় ঠেলে গিয়ে দেখি তুমি নেই! বলছি একবার অন্তত দেখা হোক একটাই কথা তো... ব্যাস্ তারপর সব শেষ। পল্টু কাকু বলছিল কদিন আগে নাকি বাসের কন্ট্রাক্টর এর সাথে ভাড়া নিয়ে ঝামেলা করেছিলে? সত্যি তোমার ঝামেলা করার স্বভাবটা যাবে না কোনও দিন আমি জানি। দ্যাখো এত প্রতিবাদী হতে নেই কখনও কখনও নিজেকেও মাথা নীচু করতে হয়। আচ্ছা রাত জেগে অফিসের জমানো কাজ করছ না তো আজকাল? দরকার হলে এই অফিসটা ছেড়ে দাও। শোনোনা এবার একটা বিয়ে করে নাও বয়স অনেক হল আর তারপর মা তোমায় কদিন নিজের হাত পুড়িয়ে রান্না করে দেবে বলোতো? আচ্ছা থাক এসব কথা... জানি তুমি রেগে যাচ্ছো হয়তো এই কথা গুলো বলি বলে তুমি আমার কথার কোনও উত্তর দাওনা, আর আমি বুঝতেও পারি না যে তুমি আমার ম্যাসেজ গুলো দেখছো কিনা।তোমার ইনস্টাগ্রামে শেষ আপলোড করা ফটোটার ক্যাপশন খুব সুন্দর দিয়েছো। জানো তোমার ঐ ক্যাপশন সহ ফটোটার স্ক্রীনশর্ট আমার গুগল ড্রাইভে সেভ করা আছে। তবে আমার ঐ কথাটার কোনও উত্তর আজও পেলাম না, আর পেলামনা তোমার বেশ কয়েকটি কথার সঠিক দিশা। জীবনের ভেঙে যাওয়া পেনসিলটা আজ একদন্ড গ্রাফাইট খোঁজার আশায়... আবছা ছবিগুলোর স্কেচ করবে বলে। তুমি তো আছো আমার কল্পনায় ওয়াটার কালারের মতো ভিন্ন রঙিন স্কেচের ধাঁচে! যে স্কেচের ক্যাপশনের মানেটা আজও বুঝিনি আমি।
হঠাৎ
সত্য সুন্দর (অনুপম)
সাত সকালে সৈকতের মোবাইলটা কেঁপে ওঠে বার দুয়েক। ঘুম জড়ানো চোখে সে দেখে অহনার ম্যাসেজ।
পাগলী একটা! গত রাতে দুটো পর্যন্ত কথা বলার পরও এখন কি বলছে? নিশ্চয়ই সুপ্রভাত।
কি মনে করে ম্যাসেজটা খুলতেই তার মাথাটা ঘুরে ওঠে।
"সোনা যা ভয় করছিলাম তাই, অমি প্রেগন্যান্ট।"
কয়েক দিন ধরেই শারীরিক অসুবিধার কথা বলছিলো
অহনা।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই রিং ব্যাক করে সে। কিন্তু ফোনটা সুইচড অফ বলছে।
সেই মার্চের শুরুতে কলেজের ক্লাস কেটে বেড়াতে গিয়ে ছিলো ওরা। অহনা বার বার নিষেধ করে ছিলো বাড়াবাড়ি করতে।
এখন তো সবাই গৃহ বন্দি, ডাক্তার ও বসছে না এখন। রাগে, ক্ষোভে নিজের মাথা খুঁড়তে ইচ্ছা করে।
তার শারীরিক ও মানসিক অবস্থা দেখে তার বাবা-মায়ের মনে প্রবল সন্দেহের উদ্রেক হয়, জেরায় জেরায় জেরবার করে তোলে।
সে কিছুক্ষন পর পর ফোনে অহনাকে ধরতে চেষ্টা করে। সেই এক কথা "সুইচড অফ"....
একে বেকারত্বের জ্বালা, তার উপর এমন বিনা মেঘে বজ্রপাত। রাতে শুয়ে শুয়ে অহনাকে ধরার চেষ্টা করতে থাকে আর ভাবতে থাকে কি করা যায়। এমনি বাবা-মাকে বললে হয়তো খুব একটা আপত্তি করতেন না কিন্তু এঅবস্থায়? অসম্ভব। শেষে কি তাকে সুইসাইড করতে হবে! তাহলে অহনার কি হবে? এ সব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে রাত তখন গভীর। মরার প্ল্যানটা জানিয়ে অহনা কে একটা ম্যাসেজও করলো। ডেলিভারি পেন্ডিং দেখাচ্ছে। কিভাবে মরা যায় তার ছকটা সবে কষতে শুরু করেছে.......
ফোনটা হঠাৎ করে আবার কেঁপে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে ফোনটা তুলে দেখে একটা ম্যাসেজ ডেলিভার্ড, একটা রিসিভ্ড।
ম্যাসেজটা তাড়াতাড়ি খুলতেই দেখলো:
"শুভ প্রথম এপ্রিলের শুভেচ্ছা বুদ্ধুরাম!"
করোনা
প্রশান্ত ভৌমিক
মালতীর স্বামীর গতকাল থেকে জ্বর, কাশি। মালতী তাই সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে স্বামীকে বলল, কয়েকদিনের জন্য গ্রামের বাড়ি চলে যেতে। কারণ জানতে চাইলে মালতী জানাল, তোমার করোনা হলে তুমি মর, আমাকে সাথে টান কেন?
বিকল্প
নয়নের বউ প্রেগন্যান্ট। কিন্তু তার কোন হেলদোল নেই। না কোন স্বাস্থ্যসম্মত খাবার, না কোন চিকিৎসা! বউ একদিন তাকে বলল, আমাকে যে এই অবস্থায় কোন যত্ন নিচ্ছ না, যদি আমি মারা যাই, তুমি কী করবে?
নয়নের নির্লিপ্ত জবাব, কী আর করব? আরেকটা বিয়ে করে নেব। পুরুষ মানুষের জন্য বউয়ের অভাব হয় নাকি?
চোরাটান
শ্রীরণজিৎ
বন্দী পাখির মত যখন কারো বাসনায় লাগাম দেওয়ার চেষ্টা হয় তখন যেন তার বেঁচে থাকার স্বাদটাই নোনাক্ত হয়ে পড়ে...... আমাদের অতীন স্যারেরও যেন আজকাল একই অবস্থা..... আর্থিকভাবে তিনি ধনী না হলেও চলনসই জীবনের মধ্যে দিয়ে তিনি তার স্ত্রীকে নিতাদের এযাবৎ সুখীই ছিলেন। তাদের এত বছরের নিঃসন্তান-দাম্পত্য জীবন ছিল একে অপরের ভালোবাসায় পরিপূর্ণ, কোনোদিন একাকীত্ব বোধ করেননি।
দীর্ঘদিন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকতা করার পর অবসর জীবনে রিটায়ার করে পাওয়া এককালীন টাকাটা ব্যাঙ্কে খাঁটিয়ে যা আয় হত তাতে করে দুজনের অনায়াসে চলে যেত। বাহুল্যময় জীবনের বাড়তি খরচে তিনি কোনোদিন ধার ধারেননি। তবে স্যারের বই কেনাটা ছিল এক প্রকার বাঁধাধরা হবি। প্রায়শই বাজারের সঙ্গে চলে আসতো কোনো একটা বই। শহর লাগোয়া ছায়ানিবিড় শান্ত পরিবেশে গড়ে ওঠা ওনার ছোট্টো বাড়িটির প্রতিটা রুমেই কোনায় কোনায় বইয়ে ঠাসা। দেশ বিদেশের বিখ্যাত সব লেখকদের বিখ্যাত সব বই। বই রাখার আলমারিগুলো তো আগেই বইয়ে টইটুম্বুর। এরপর দিনকে দিন বইয়ের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে এখন বিছানা সহ ঘরের ছোটোখাটো আসবাবপত্র থেকে শুরু করে প্রায় সমস্ত মেঝেটাও এখন দখল হয়ে গেছে। বাড়িতে কেউ এলে যে একটু বসতে দেবে তারও কোনো জো নেই। যদিও উনার স্ত্রীর এতে কোনোদিন গাঢ় অভিযোগ ছিল না, সয়ে গিয়েছিলেন। মাঝে মধ্যে শুধু বলতেন, "তুমি একটা লোক বটে, যেখানেই যাওনা কেন তোমাকে একটা না একটা বই কিনতেই হয়!....." "কী আর করবো বলো? তার প্রেমে যে আমি হইনু পাগল।"
"কিন্তু সব বই তো আর তোমার পড়া হয়ে উঠে না! তাহলে শুধু শুধু কেনো অতগুলি টাকা ব্যায় করে বই কিনে ফেলো রাখো?"
--"Its my only hobby, my dear গিন্নি, কতসব বিখ্যাত বইয়ের নাম..... ওহ! একঝলক দেখলেই আমার মনটা একেবারে জুড়িয়ে যায়।"
ফুলের পাপড়ি মেলার মত যেন তার মনের ভাঁজ খুলে শিহরন জাগতে শুরু করে। আর 'dear গিন্নি' উতলা শিহরণে জল ঢেলে দেওয়ার জন্য যেন বলে উঠে, "অনেক হয়েছে....এযাবৎ নিজের বহু ইচ্ছাকে অপূর্ণ রেখে তোমাকে বই কিনতে দিয়েছি। এবার এক কাজ করো, পড়া হয়ে গেছে এমন বইগুলো বিক্রি করে দাও।"
নিজের প্রাণটা যদি কেউ কেড়ে নিতে চায় তাতেও যেন তিনি রাজি কিন্তু একটা বইও তিনি হাতছাড়া করতে রাজি নন! স্ত্রীর কথাগুলি যেন স্যারের মনে আৎকা ঘা লাগার মত শোনায় তবে প্রতিবাদের কোনো ভাষা খুঁজে পান না। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর নিজের পাঁকা দাড়ির ছোপে হাত বুলিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, "তুমি আর এই বইগুলি ছাড়া আমার আপন বলতে আর কে'ই বা আছে বলো?....." কিন্তু সময় তো গড়িয়ে চলে সময়েরই স্রোতে আর জীবনটাকে রেখে যায় যুদ্ধের ময়দানে দাঁড় করিয়ে রেখে....... অগ্নিমূল্য আর্থিক-পরিস্থিতিতে সীমিত আয় আর কতটুকই বা প্রয়োজন মেটাতে পাড়ে? অতৃপ্ত বাসনা জমে টিলা হয় মন। মাসের শেষ প্রান্তে এসে ছাপোষা লোকেদের কী একটা অবস্থা হয় সেটা কেবল তারাই জানে যারা ঐ জীবনটা বিলং করে; অর্থের ভাড়ার প্রায় শূন্য হয়ে পড়ে । সুগার কন্ট্রোলে রাখতে গিয়ে স্যারের মাসে এমনিতেই বেরিয়ে যায় কতগুলি টাকা তার উপর সঙ্গে আছেন "dear গিন্নি", যিনি বারো মাসের রুগি। এদিকে আকাশ ছোঁয়া জিনিশের দাম, খরচের হিসেব মেলাতে গিয়ে "dear গিন্নি" প্রতিমাসেই খেই হারিয়ে ফেলেন..... ক্লান্ত হয়ে পড়েন বইগুলো আলমারি থেকে নামিয়ে ধুলো ঝেরে আবার গুছিয়ে রাখতে গিয়ে। ভুলে যান কোন তাক থেকে কোন বইটি নামিয়েছেন...... স্বামীর আবার বদভ্যাস, জায়গামত প্রয়োজনীয় বইটি খুঁজে না পেলে চেঁচিয়ে সারা বাড়ি মাথায় তোলেন। মাঝেমধ্যে এই নিয়ে কথাকাটি হলেও নিজেদের মনের পরিবেশ কখনো বিপর্যয়পূর্ণ হয়ে উঠত না। এভাবে চলার মধ্য দিয়ে ম্যা'ম পড়ে যান সমস্যায়। নিত্যদিনের বাজার তো আছেই সঙ্গে আছে ওষুধপত্র। কতসব বিলের মধ্যে হয়তো দুধের বিল কিংবা ইলেকট্রিক বিলটা দেওয়া হয়নি। কিন্তু স্যার তার পুরনো অভ্যাসটা পাল্টাতে পারেননা।
কিন্তু একদিন এই নিয়ে ওদের স্বামী-স্ত্রীতে এমন তুমুল ঝগড়া বেঁধে গেল যে তাতে অতীনবাবুর জীবনের ছন্দটাই যেন এলোমেলো হয়ে যায়! "....যদি আর একটি বই এই বাড়িতে কিনে আনা হয়েছে তো আমি আর এই বাড়িতেই থাকবো না,এই বলে রাখলুম।" dear গিন্নি একেবারে কড়া ডোজে হুমকি দিয়ে রাখেন।
অতীনবাবুর মনটা এতে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে। সপ্তাখানেক ধরে মনমরা ভাবে বাজার করে বাড়ি ফিরে আসেন। বইয়ের দোকানগুলির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় নিজেকে অপরাধী মনে হয়, ঢুকতে সাহস পান না। বাড়িতে আগের মতই সচরাচর লোকজন আসেন, দেখেন কিন্তু আগের অতীনবাবুকে খুঁজে পাননা। কাজে ভুল করেন, বেরসিক কথা বলেন। বাগানের ফুলগুলির সঙ্গে পর্যন্ত কথা বলেন না। পুরনো ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে গড়ে তোলা স্বেচ্ছাসেবক দলটির সঙ্গেও যোগাযোগ বন্ধ। যে তারটিতে হৃদয়ের সুর উঠে সেই তারটিতে যেন জং পড়েছে। সুর উঠছে না.....
একদিন তিনি শহরের একটি বড় রাস্তার পাশ দিয়ে একান্ত মনে হেঁটে যাচ্ছেন, পাশেই শহরের বড় নামকরা একটি বইয়ের দোকান, হঠাৎ শুরু হয় মুষলধারে বৃষ্টি। সঙ্গে ছাতা না থাকায় তিনি প্রায় ভিজে উঠছিলেন, উপায় না পেয়ে বইয়ের দোকানটিতে ঢুকে পড়েন। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর তার চোখ গড়ায় কাউন্টারের এক কোনায় পড়ে থাকা ছোট্ট বাদামী রঙের চামড়ার কভার দেওয়া একটি বইয়ের উপর। সোনালী অক্ষরে লেখা রয়েছে, "The River Amazon"। দেখা মাত্রই উনার মনটা একেবারে আনন্দে উবছে উঠে। এর আগে তিনি বহুবার এই বইটির সন্ধান করেছিলেন কিন্তু কোত্থাও খুঁজে পাননি। উনার কাছে যেন এই বইটি একটি স্বপ্নের বই। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি স্ত্রীর হুমকি ভুলে গিয়ে ৫০০টাকার বিনিময়ে বইটি কিনে নিলেন। আর আনন্দে আত্মহারা হয়ে বাড়ি ফিরে আসেন । তারপর বাজারের ব্যাগটা খালি করতে গিয়ে dear গিন্নি যখন দেখলেন তার নিষেধ থাকা সত্ত্বেও আবার বই কিনে আনা হয়েছে তখন তিনি একেবারে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন, "তোমাকে বলিনি, বাড়িতে আর একটা বই কিনে এনেছো তো.....।"
বইটি তুলে নিয়ে dear গিন্নি জানলা দিয়ে বাইরে ছুড়ে মারলেন আর রাগে গজগজ করতে করতে পাশের ঘরে চলে গেলেন। এরপর মনটা ভার করে অতীনবাবু বাগানের দিকে তাকিয়ে রইলেন আর ঘাসের উপর পড়ে থাকা সুন্দর সেই বইটির গায়ে আছাড় খেয়ে পড়তে থাকে এক এক ফোটা বৃষ্টির জল....
একটি মা ও শিশু
আব্দুল রাহাজ
সময়টা ছিল বড়ই দুর্ভিক্ষের হতাশার। সেই সময় দারিদ্র্যের মাধ্যমে বয়ে চলে ছিল সাধারণ মানুষের জীবন। একটি গ্রাম ছিল নামটি তার রহমতপুর। গ্রাম কি খুব বেশী বড় ছিলো না গোটা ত্রিশ জনের বাস সবাই মুসলিম পরিবার। দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে সবাই একে একে গ্রাম ছাড়তে আরম্ভ করতে লাগলো শেষে একটি জনম দুঃখিনী মা আর তার শিশুর হয়ে গেল। স্বামী ও আরও দুই ছেলে খেতে না পেয়ে ক্ষুধার জ্বালায় চিরঘুমের দেশে পাড়ি দিয়েছেন বেশ কয়েকদিন আগে। এরপর সেই জনম দুঃখিনী মা আর সেই শিশুটি মনের দুঃখে হতাশায় চেয়ে থাকেন পথে দিকে তারা মনে করতো মনে হয় তাদের কেও সাহায্য করবে কিন্তু সেই আশা তাদের আর পূরণ হয় না। এর এর কয়েকদিন পর তারা চলে গেছে গ্রামের পাশে একটি নদী আর তার মাঝখানে আছে ছোট্ট দ্বীপ সবুজে ঘেরা আর বনের আধিক্য থাকায় কেউ বসবাস করে না সেখানে এসেই মা-ও-শিশু বসবাস করতে লাগল তারপর আস্তে আস্তে বনের পশু পাখির সঙ্গে ভাব হয়ে গেল। আর এদিকে রহমতপুর আস্তে আস্তে যোনির আকার ধারণ করল নদীর বুকে যেন আরো আরো এক সবুজ সমাধি বন তৈরি হলো। এরপর সেই জনমদুঃখিনী মা আর শিশু বনের পশু পাখিদের নিয়ে সুখে শান্তিতে বসবাস করতে লাগলো। নদীর মাছ ফলমূল খেয়ে তাদের দিন কাটতো। একবার এক সন্ধ্যায় বনের পশুপাখি ও তার ছোট্ট শিশুকে নিয়ে রহমতপুর গ্রামের কথা বলতে লাগলো একদিন রহমত পুর গ্রামের অবস্থান ছিল জলা জমি ভরা নদী একসময় বাইরে থেকে লোক এসে এখানে প্রচুর মাছ ধরতো তারপর তারা আস্তে আস্তে লাভবান হতে থাকে এরপর কিছু মানুষের বসবাস করার ইচ্ছা প্রকাশ করে তারপর থেকে তারা যেমন তেমন করে একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই করলেন তারপর আস্তে আস্তে তারাও সুন্দরভাবে ভাঁজযোগ্য করে তুললেন তারপর থেকে তারা নাম দেন রহমত পুর এভাবেই এই গ্রামের নামকরণ করেছিলেন তারা। তারপর আমরা আসি খুব সুখে শান্তিতে একসাথে থাকতাম দেখতে দেখতে আমাদের গ্রামে গোটা ত্রিশ পরিবার একসাথে থাকতে আরম্ভ করলাম। তার বেশ কিছুদিন পর আমাদের ঘরে আলো করে আসলেন আমার পাশে বসে থাকা এই ছোট্ট সোনা টি। এইভাবে আমাদের এবং গ্রামের সবারই ভালোই দিন কাটছিল। হঠাৎ একদিন দেখা দিল আশে পাশের গ্রামে মহামারী তারপর উদার হতে থাকলো গ্রামের পর গ্রামের মানুষ তখন আমরা ভাবতে শুরু করলাম যে আমরা অতি সুন্দর পৃথিবীর মায়া জালে আর বেশি দিন থাকবো না কিন্তু প্রভুর কৃপায় আমাদের গ্রামে মহামারী ঢুকলো না সবাই আনন্দে আত্মহারা সত্যি সেদিন সবাই আনন্দ বোধ করেছিল তারপর গ্রামের পূর্ব পাশে চাষের ক্ষেত তৈরি করা হলো গ্রামের সবাই সেখানে চাষ করতো যখন ফসল ঘরে উঠতো তখন গ্রামের প্রতিটি মানুষের চোখে মুখে আনন্দের ফুলঝুড়ি উঠতো। আর মাঠে ফসল থাকলে প্রকৃতির সবুজের সঙ্গে মাঠের ফসলের যে মিল তা তৈরি করত এক মায়াবী মনোরম দৃশ্যে যা দেখে আপ্লুত আপামর গ্রামবাসী। যখন নিশ্চিত সূর্যের আলো পশ্চিমাকাশে অস্তমান সেই সময় তার হলুদ আভায় মনে করে দিত রহমতপুর তথা প্রকৃতি নিজে মেলবন্ধন তা সজ্জল ভাবে ফুটে উঠত। এইভাবে চলতে থাকলেও দিনের পর দিন বহু সময় বয়ে গেল পরিবর্তন হলো প্রকৃতির বহু পালাবদল হল একদিন হঠাৎ রহমতপুরে নেমে এলো সত্যি সত্যি মহামারী দুর্ভিক্ষ প্রথমেই চলে গেল জনম দুখিনী মায়ের স্বামী ও তার দুটো সন্তান তারপর আস্তে আস্তে রহমতপুর গ্রাম ছেড়ে সবাই চলে গেল আর সেই জনমদুখিনী মা ও তার শিশু তাদের সেই জন্মভিটা ধরে আঁকড়ে বসেছিল। এরপর থেকে আমরা এই বনে চলে এলাম আর তোমাদের সাথে বন্ধুত্ব হল এভাবেই চলছে আমাদের বর্তমান জীবনযাত্রা আর তাদের রহমতপুর হল এক সবুজায়নের মনের অধিকারী যেখানে প্রকৃতি রহমত পুর কে আগলে ধরে রেখেছে এক অনন্য সম্পদ হিসেবে। এইভাবে এসেই মা ও শিশু আদি কাল ধরে বনের মধ্যে বসবাস করতে লাগল সেই সঙ্গে বনের পশুপাখি নিয়ে তাদের এক সুন্দর পরিবারের মতো বসবাস করতে লাগল। এইভাবে দিনের-পর-দিন বনের মধ্যে রয়ে গেল ওই দুজন মানুষ এদিকে সেই শিশুটি বড় হলো আর সেই মায়ের বয়স হলো। একদিন হঠাৎ এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল তার সেই মা তখন সেই শিশুটি মাকে হারিয়ে মায়ের জন্য কাঁদতে কাঁদতে সেই বনে হাতি চিরকাল ধরে রয়ে গেল। তারপর বনের মধ্যে মা ও শিশু র এইযে বসবাস প্রকৃতি ও তাদের সাথে মিলেমিশে থাকতো থাকতো । সেই প্রকৃতি শকে আত্ম বিলীন হয়ে পড়েছিল।এর ফলে একটি মা ও শিশুর যে সম্পর্ক তা প্রকৃতির বুকে সলিল সমাধি রূপে প্রতীক্ষিত হয়ে রইল।
শাশ্বত ভট্টাচার্য্য
নাহ্ , আর পারছেনা হৈমন্তী, চোখটা ক্রমশ বন্ধ হয়ে আসছে, শরীরে আর বল নাই, অবশ্য শরীরেরই বা কী দোষ, প্রায় তিন-চারদিন যাবদ পেটে একটা দানাও পড়েনি, তবুও চোখ খুলে থাকা খালি রিভু টার জন্য, একেবারেই যে দুধের শিশু, বুকের দুধ খেয়েই থাকে, কিন্তু এই অনাহারের দিনে নিজেই খেতে পায়নি তো, বুকেই বা দুধ আসবে কোত্থেকে, আর দুধ না পেয়ে পেয়ে তার চেহারাটাও একেবারে কঙ্কালসার হয়ে গিয়েছে, হাড়গোড় যেন বেরিয়ে আসছে, খিদের জ্বালায় খালি কাঁদছে, তার অসহায় মুখটা দেখে হৈমন্তীর চোখেও বারবার জল আসে , বুকটা হু হু করে ওঠে, বাপটা তো সেই কবেই মরে গেছে, এমনকি অভাবের তাড়নায় বেচে দিলে তার সাধের রিমিকেও ওই দানবদের কাছে, কিন্তু... আকাশের দিকে তাকিয়ে তার চিৎকার করে বলে উঠতে ইচ্ছে করে, 'হে ঈশ্বর, আমরা কী অপরাধ করেছিলাম , তুমি কেনো এত বড়ো শাস্তি দিলে?' কিন্তু সে বলার মতোও যে আর গলার জোর নাই, তাছাড়া বললেই বা শুনছে কে!হৈমন্তীর মনে পড়ে যায়, তাদের গ্ৰামের কথা, গ্ৰামের বাড়ির কথা, অভাবের সংসার হলেও কতোই না আনন্দে ছিলো তাদের, বিঘে দুই জমি ছিলো, আর ছিলো যজমানি, তাতে হেলায়ফেলায় না হলেও খেয়েপড়ে বাঁচা যেতো অন্তত, ইচ্ছে ছিলো আর বছর দুয়েক পর রিমিটার একটা ভালো বিয়ে দিয়ে দেবার, এইবারো মাঠে সোনার ফসল ফললো, মাঠ একেবারে সোনার মতো চকচক করছিলো, ভাবছিলো এইবার একটা ঘটা করে নবান্ন দেবে, কিন্তু সেসব হায়… গরিব মানুষের অত সুখ বোধহয় ঈশ্বরের সয়েনা, হঠাৎ নেমে এলো বন্যা, ফসল মাঠ থেকে তোলার আগেই সব শেষ, যাও বা উঁচু দু'একটা জমিতে ছিলো কিছু, তাও কেড়ে নিয়ে গেলো ওই পাজি গোড়া সাহেবের পেয়াদারা যুদ্ধের জন্য, যেটুকু টাকা ছিলো, তাও খাবারের খরচ জোগাতে গিয়ে ফুরিয়ে গেলো কিছুদিনের মধ্যেই , পেটের জ্বালা মেটাতে চলে আসতে হলো শহরে , কিন্তু এমন মন্দার দিনে শহরেই বা কাজ দেয় কে? অগত্যা ফুটপাতে থাকা, রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষে করে যা জোটে, তাই খেয়েই বাঁচা, অভাবের চোটে বাপ বেচে দিলো মেয়েকেও, সেদিনও সে খুব কান্নাকাটি করেছিলো, কিন্তু শোনে কে....বাপের হৃদয় পাষাণ নাহয়, সে যে মা, দশ মাস দশ দিন পেটে ধরেছে, তার কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেলো তার ওই প্রাণের মেয়েটাকে, কিছুদিনের মধ্যে মরলে নিজেও, আর আজ তার একমাত্র সম্বল বলতে আছে এই দুধের শিশুটা...সে চলে গেলে যে শিশুটার আর কেউ নাই, মরে যাবে। মন যাই বলুক, শরীর যে আর পারছেনা, হাত-পা অবশ হয়ে আসছে, শরীরটা মিশে যেতে চাইছে মাটিতে, চোখটা ক্রমশ ভারী হয়ে আসছে , চোখের সামনে আস্তে আস্তে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে সবকিছু। হৈমন্তী প্রাণপণ চেষ্টা করে চোখটা খুলে রাখার, যতবার বন্ধ হয়ে আসে, ততবার ঝেড়েমেরে ওঠে, কিন্তু নাহ্ , শেষে আর পারলোনা, আস্তে আস্তে বুঁজে গেলো চোখটা, হয়তো চিরদিনের মতো, নিভে গেলো সব স্বপ্নের প্রদীপ, দেহখানিও আস্তে আস্তে অসার হয়ে গেলো, ছোট্টো অবুঝ শিশুটা তখনও বুকটা জাপটে ধরে কামড়ে চলেছে।
যোগাযোগ
লেখশ্রী
মানসিক ভাবে ক্লান্ত শরীরটাকে বিছানায় এলিয়ে দিয়ে নীরা ভাবল,যোগাযোগটা আজ সত্যি নিভে গেলো।টানা তিন মাস ধরে নিজের মধ্যে বহন করা ওই ছোট্ট প্রাণ টাকে পরিবারের চাপে আজ সে মুক্তি দিল।কিন্তু প্রথম মাতৃত্বের অনুভব - আদৌ কি তা মুক্তি পেল!!!!!
ওরা কাজ করে
পাঁচ বছরের মিঠির প্রশ্নবাণে সারা বাড়ি জেরবার। লকডাউন এ বাবাকে বাড়িতে পেয়ে দিনগুলো তার বেশ কাটছে।আজ সকালে কাগজ টা দরজা থেকে নিয়ে দৌড়ে এসে অমলবাবু কে বললো -"বাবান,বাবান এই বাচ্চাটাকে দেখো রেল লাইন এ ঘুমাচ্ছে,মনে হয় ওর মা খুব বকেছে,তাই না?...."। অস্ফুট স্বরে অমলবাবু শুধু বললেন ," তিন্নি, ওরা কাজ করে"।
আ-মরি বাংলা
ইন্দ্রাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
সকাল থেকে ব্যস্ততা মণির।ভোর থেকে উঠে ঘরের সব কাজ গুছিয়ে, রান্না প্রায় অর্ধেক সেরে টুবাইকে নিয়ে ছুটতে হয় স্কুলে। টুবাই মণির একমাত্র ছেলে। মণির স্বপ্ন জীবনে ও নিজে যা পায় নি,টুবাইকে দিয়ে তা পূরণ করবে,তাই এই কৃচ্ছসাধন।
টুবাই একটা নামকরা ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে পড়ে।এরজন্য মণি কে অনেক কষ্ট করতে হয়।তবুও টুবাইয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে ও তা মেনে নেয়।আজকাল ইংরেজি ভালোভাবে না জানলে,ছাপোষা মধ্যবিত্ত ছাপ নিয়ে কোথাও ভালো কিছু কাজ পাওয়া যায় না।
রোজ অন্ধকার থাকতে উঠে সব কাজ সেরে প্রায় ২০ মাইল দূরের স্কুলে নিয়ে গিয়ে বসে থাকে মণি। ছুটি হলে নিয়ে আসে একেবারে।
এমনই একদিন স্কুলে বসে আছে স্কুলের মাঠে, সঙ্গে আরও দু একজন অভিভাবক। হঠাৎই স্কুলের ভেতরে চিৎকার শুনে ওরা স্কুলের ভেতরে আসে।সেখানে একজন অভিভাবকের সাথে স্কুল কতৃপক্ষের গন্ডগোল হচ্ছে। ওরা দাঁড়িয়ে শুনে যা বুঝতে পারে যে একজন শিক্ষক ওই ভদ্রলোকের ছেলে কে অন্যায় ভাবে শাসন করেছেন।ওরা দাঁড়িয়ে দুপক্ষকেই বোঝানোর চেষ্টা করে। তর্কাতর্কির মধ্যে স্কুল কতৃপক্ষের একটি মেয়ে বলে ওঠে "বাঙালী লোগ এয়সাহি হোতা হ্যয়". মণি সাথে সাথে প্রতিবাদ করে জানায়।মেয়েটির যুক্তি যেহেতু ওরা বাংলায় কথা বলে তাই ওরা এভাবে উদ্ধ্যত ব্যবহার করছে। মণি মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করে সে কোথায় থাকে? মেয়েটি গর্বের সঙ্গে জানায়,ও বাংলা ভাষী নয়।মণি ওকে পাল্টা প্রশ্ন করে, তাহলে ও এখানে কি করছে? মেয়েটি জানায় শুধুই জীবিকার প্রয়োজনে তার বাংলা শেখা।মণি হেসে উঠে বলে তাহলে যে ভাষার মানুষ আপনাকে অন্ন দিচ্ছে আপনি তাকেই আক্রমণ করছেন, ধন্য আপনার সভ্যতা।আর আমার গর্ব যে আমি একজন বাংলা ভাষী যে আপনাদের মতো মানুষদের আপন করে অতিথি হিসেবে রাখতে পারি, সন্মান করি সব ভাষার মানুষদের।মণির কথার কোনো প্রতিউত্তর দিতে পারে না মেয়েটা।
মণিরা সবাই ওখান থেকে চলে আসে তখনকার মতো।পরের দিন স্কুলে গিয়ে জানা যায় স্কুল চত্বরে বসা যাবে না। মণিরা বুঝতে পারে আবারও সেই অন্যায় ভাষা বিদ্বেষের শিকার ওরা,শিকার বাংলাভাষার হয়ে কথা বলার..মনে মনে বলে " মোদের গরব মোদের আশা আ-মরি বাংলা ভাষা"
বন্ধন
নন্দিতা মিশ্র
প্রতীক বলেছিল সকাল দশটায় ফোন করবে।
সাড়ে ন'টা থেকে প্রতীতি ফোনের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। দশটা...দশটা পাঁচ...দশটা কুড়ি...
ফোনটা বেজে উঠলো! স্ক্রীনে লেখা "Head Master".
ফোনটা ধরে প্রতীতির তড়িঘড়ি জবাব, "আজ শরীরটা ভীষণ খারাপ, স্যার! বিছানা থেকে উঠতে পারছি না। এখন রাখি স্যার। ডাক্তারকে ফোন করতে হবে।"
দশটা ত্রিশ...সাড়ে এগারোটা...দুপুর দু'টো...
প্রতীককে ফোন করাও ঠিক নয়। কী অবস্থায় আছে কে জানে! দুপুরের খাওয়াও মাটি।
সন্ধ্যে সাতটা...রাত ন'টা। ফোনটা আবার বাজল।
প্রতীতি তখন বাথরুমে। এসে দেখে একটা মিসড্ কল্ "From PRATIK". সাথে সাথে একটা মেসেজ, "জানতাম ফোন ধরবে না। ভালোই করেছো।"
কেঁদে ফেলে প্রতীতি।
সেই এক অমলতাসের গন্ধ মাখা বিকেলে প্রিন্সেফ ঘাটের রাস্তায় হঠাতই ধাক্কা লাগে প্রতীতির সাথে প্রতীকের। দুজনেই মোবাইলে চোখ রেখে হাঁটছিল আর কানে গোঁজা ছিল হেডফোন।
এক ধাক্কায় নীচে দুজনেরই ফোনটা। প্রটেক্টর থাকায় প্রতীকেরটা বেঁচে গেলেও, সদ্য কেনা প্রতীতিরটা খান খান হয়ে যায়। প্রথম মাসের বেতন থেকে ফোনটা কিনেছিল সে।
'সরি!'
'আর সরি বলে কী লাভ? আর দোষটা দুজনেরই ছিল!'
'তবে নতুন ফোন কেনার টাকাটাও দুজনেরই লাগা দরকার!'
'কেন নেব, আমি আপনার টাকা?'
'কেন নয়...'
এভাবেই এক অনাবিল স্রোতে পার হচ্ছিল দিন। হঠাতই লকডাউনে পুরো গৃহবন্দি প্রতীতি। আর প্রতীক নিজের সর্বস্ব দিয়ে সেবায় বিলীন করেছে নিজেকে... বেলেঘাটা আই ডিতে তার ডিউটি।
দেখা নেই প্রায় দুইমাস। কথাও হয়না সব সময়। প্রতীতি বড্ড ভালোবাসে প্রতীককে।
কিন্তু জানি না কেন কিছুদিন থেকে সচেতন ভাবে প্রতীক অবহেলা করছে তাকে।
সকাল থেকে যার একটা ফোনের অপেক্ষায় দিনটা পার হয়ে গেল প্রতীতির, তার কাছে এমন ম্যাসেজে প্রচণ্ড অভিমানে আর ফোনও করল না।
প্রতীক ভেন্টিলেশনে। প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট। কোনোরকমে ম্যাসেজটা টাইপ করতে বলে বন্ধু সুজয়কে। তার আগে ঠিক একটা রিং হওয়া মিসড কল।
প্রতীক জানে, এ সময় প্রতীতি সান্ধ্যস্নানে যায়। জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে সে ভাবে, এই কষ্টের চেয়েও বড় কষ্ট হয়তো প্রতীতির ভাগ্যে আছে। আর যদি সে বেঁচে ফেরে, বুঝিয়ে বলে দেবে তখন।
অকালে শ্রাবণধারা প্রতীতির চোখে।
বিষাদ বর্ষা
বসন্ত কুমার প্রামাণিক
আজ প্রবল বর্ষণ হচ্ছে।মিনুর মা আর কাজে বেরোতে পারল না,প্রচণ্ড জ্বর এসেছে।মিনু ভাইকে মায়ের কাছে বসিয়ে ঝুড়িতে ফুল সাজিয়ে গেল জহরাতলার মেলায় বিক্রি করতে।যা অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে,মনে হয় না মেলায় লোকের সমাগম হবে।তবুও মিনু গেছে ফুল বেচে যা দু-চার পয়সা হবে তা দিয়ে মায়ের জন্য ওষুধ কিনে নিয়ে আসবে।প্রবল বর্ষণে সেরকম লোকজনের সমাগম হয় নি।মিনু বৃষ্টিতে ভিজে সব লোকের কাছে ফুল কেনার জন্য আবেদন করতে লাগল, কিন্তু কেউ আর মিনুর দিকে ভ্রূক্ষেপ করল না।দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে আসল,মেলা প্রায় শেষের দিকে।মিনুর ফুল ভর্তি ঝুড়ি থেকে একটি ফুলও বিক্রি হল না।অবশেষে দুঃখে ঝুড়ি ভর্তি ফুল নিয়ে মিনু বাড়ি ফিরে এল।দরজার ফাঁক দিয়ে মিনু দেখে ভাই মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর সান্ত্বনা দিয়ে বলছে-"একটু অপেক্ষা কর,দিদি এখনই ওষুধ নিয়ে আসছে"।এসব দেখে মিনু আর নিজেকে ঠিক রাখতে না পেরে ফুলের ঝুড়ি ফেলে দৌড়ে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদতে লাগলো, আর বলল,"মা আমি তোমার জন্য ওষুধ আনতে পারলাম না,আমাকে ক্ষমা করে দিও"।মা এদিকে বলতে লাগল,"এই দেখ কাঁদে না,আমার কিছু হয়নি,সব ঠিক হয়ে যাবে।চুপ কর মিনু, চুপ কর"।এইভাবে মা ও মেয়ে একে অপরকে সান্ত্বনা দিতে লাগল।এদিকে ভাই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে মা ও মেয়ের ছলনার অভিনয় দেখতে লাগল।
আজও বলা হয়নি
সুব্রত সামন্ত
সেই যে একবার বললে ইনস্টাগ্রামে আমায় ফলো করবে আমি কেবল আজও ফলো করি আর কাউকে নয়। বিশ্বাস কর তোমার পছন্দের ছবিটা প্রথম থেকেই প্রোফাইল করে রেখেছি। কতবার ম্যাসেজ করেছি ইনস্টাগ্রাম এর ইনবক্সে তার কোনো উত্তর দাওনি আজও....। জানি আজ অনেকটাই ব্যাস্ত সদ্য চাকুরি জীবন সব মিলিয়ে বিন্দাস। আচ্ছা ঠিক আছে অন্তত একবার এসো অনলাইনে; জানি আসবে না এই বহুমুখী কাজে সোস্যাল মিডিয়ায় এক্টিভ থাকার সময় কোথায়? যাক এসব কথা এখন বলো দৌড়াতে গিয়ে যে ব্যাথা পেয়েছিলে সেটা এখন ভালো হয়েছে তো? কদিন আগে দেখলাম কাকদ্বীপ বাজারে দাঁড়িয়ে আছো একটা ব্যাগ হাতে নিয়ে, ভীড় ঠেলে গিয়ে দেখি তুমি নেই! বলছি একবার অন্তত দেখা হোক একটাই কথা তো... ব্যাস্ তারপর সব শেষ। পল্টু কাকু বলছিল কদিন আগে নাকি বাসের কন্ট্রাক্টর এর সাথে ভাড়া নিয়ে ঝামেলা করেছিলে? সত্যি তোমার ঝামেলা করার স্বভাবটা যাবে না কোনও দিন আমি জানি। দ্যাখো এত প্রতিবাদী হতে নেই কখনও কখনও নিজেকেও মাথা নীচু করতে হয়। আচ্ছা রাত জেগে অফিসের জমানো কাজ করছ না তো আজকাল? দরকার হলে এই অফিসটা ছেড়ে দাও। শোনোনা এবার একটা বিয়ে করে নাও বয়স অনেক হল আর তারপর মা তোমায় কদিন নিজের হাত পুড়িয়ে রান্না করে দেবে বলোতো? আচ্ছা থাক এসব কথা... জানি তুমি রেগে যাচ্ছো হয়তো এই কথা গুলো বলি বলে তুমি আমার কথার কোনও উত্তর দাওনা, আর আমি বুঝতেও পারি না যে তুমি আমার ম্যাসেজ গুলো দেখছো কিনা।তোমার ইনস্টাগ্রামে শেষ আপলোড করা ফটোটার ক্যাপশন খুব সুন্দর দিয়েছো। জানো তোমার ঐ ক্যাপশন সহ ফটোটার স্ক্রীনশর্ট আমার গুগল ড্রাইভে সেভ করা আছে। তবে আমার ঐ কথাটার কোনও উত্তর আজও পেলাম না, আর পেলামনা তোমার বেশ কয়েকটি কথার সঠিক দিশা। জীবনের ভেঙে যাওয়া পেনসিলটা আজ একদন্ড গ্রাফাইট খোঁজার আশায়... আবছা ছবিগুলোর স্কেচ করবে বলে। তুমি তো আছো আমার কল্পনায় ওয়াটার কালারের মতো ভিন্ন রঙিন স্কেচের ধাঁচে! যে স্কেচের ক্যাপশনের মানেটা আজও বুঝিনি আমি।
হঠাৎ
সত্য সুন্দর (অনুপম)
সাত সকালে সৈকতের মোবাইলটা কেঁপে ওঠে বার দুয়েক। ঘুম জড়ানো চোখে সে দেখে অহনার ম্যাসেজ।
পাগলী একটা! গত রাতে দুটো পর্যন্ত কথা বলার পরও এখন কি বলছে? নিশ্চয়ই সুপ্রভাত।
কি মনে করে ম্যাসেজটা খুলতেই তার মাথাটা ঘুরে ওঠে।
"সোনা যা ভয় করছিলাম তাই, অমি প্রেগন্যান্ট।"
কয়েক দিন ধরেই শারীরিক অসুবিধার কথা বলছিলো
অহনা।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই রিং ব্যাক করে সে। কিন্তু ফোনটা সুইচড অফ বলছে।
সেই মার্চের শুরুতে কলেজের ক্লাস কেটে বেড়াতে গিয়ে ছিলো ওরা। অহনা বার বার নিষেধ করে ছিলো বাড়াবাড়ি করতে।
এখন তো সবাই গৃহ বন্দি, ডাক্তার ও বসছে না এখন। রাগে, ক্ষোভে নিজের মাথা খুঁড়তে ইচ্ছা করে।
তার শারীরিক ও মানসিক অবস্থা দেখে তার বাবা-মায়ের মনে প্রবল সন্দেহের উদ্রেক হয়, জেরায় জেরায় জেরবার করে তোলে।
সে কিছুক্ষন পর পর ফোনে অহনাকে ধরতে চেষ্টা করে। সেই এক কথা "সুইচড অফ"....
একে বেকারত্বের জ্বালা, তার উপর এমন বিনা মেঘে বজ্রপাত। রাতে শুয়ে শুয়ে অহনাকে ধরার চেষ্টা করতে থাকে আর ভাবতে থাকে কি করা যায়। এমনি বাবা-মাকে বললে হয়তো খুব একটা আপত্তি করতেন না কিন্তু এঅবস্থায়? অসম্ভব। শেষে কি তাকে সুইসাইড করতে হবে! তাহলে অহনার কি হবে? এ সব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে রাত তখন গভীর। মরার প্ল্যানটা জানিয়ে অহনা কে একটা ম্যাসেজও করলো। ডেলিভারি পেন্ডিং দেখাচ্ছে। কিভাবে মরা যায় তার ছকটা সবে কষতে শুরু করেছে.......
ফোনটা হঠাৎ করে আবার কেঁপে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে ফোনটা তুলে দেখে একটা ম্যাসেজ ডেলিভার্ড, একটা রিসিভ্ড।
ম্যাসেজটা তাড়াতাড়ি খুলতেই দেখলো:
"শুভ প্রথম এপ্রিলের শুভেচ্ছা বুদ্ধুরাম!"
করোনা
প্রশান্ত ভৌমিক
মালতীর স্বামীর গতকাল থেকে জ্বর, কাশি। মালতী তাই সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে স্বামীকে বলল, কয়েকদিনের জন্য গ্রামের বাড়ি চলে যেতে। কারণ জানতে চাইলে মালতী জানাল, তোমার করোনা হলে তুমি মর, আমাকে সাথে টান কেন?
বিকল্প
নয়নের বউ প্রেগন্যান্ট। কিন্তু তার কোন হেলদোল নেই। না কোন স্বাস্থ্যসম্মত খাবার, না কোন চিকিৎসা! বউ একদিন তাকে বলল, আমাকে যে এই অবস্থায় কোন যত্ন নিচ্ছ না, যদি আমি মারা যাই, তুমি কী করবে?
নয়নের নির্লিপ্ত জবাব, কী আর করব? আরেকটা বিয়ে করে নেব। পুরুষ মানুষের জন্য বউয়ের অভাব হয় নাকি?
চোরাটান
শ্রীরণজিৎ
বন্দী পাখির মত যখন কারো বাসনায় লাগাম দেওয়ার চেষ্টা হয় তখন যেন তার বেঁচে থাকার স্বাদটাই নোনাক্ত হয়ে পড়ে...... আমাদের অতীন স্যারেরও যেন আজকাল একই অবস্থা..... আর্থিকভাবে তিনি ধনী না হলেও চলনসই জীবনের মধ্যে দিয়ে তিনি তার স্ত্রীকে নিতাদের এযাবৎ সুখীই ছিলেন। তাদের এত বছরের নিঃসন্তান-দাম্পত্য জীবন ছিল একে অপরের ভালোবাসায় পরিপূর্ণ, কোনোদিন একাকীত্ব বোধ করেননি।
দীর্ঘদিন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকতা করার পর অবসর জীবনে রিটায়ার করে পাওয়া এককালীন টাকাটা ব্যাঙ্কে খাঁটিয়ে যা আয় হত তাতে করে দুজনের অনায়াসে চলে যেত। বাহুল্যময় জীবনের বাড়তি খরচে তিনি কোনোদিন ধার ধারেননি। তবে স্যারের বই কেনাটা ছিল এক প্রকার বাঁধাধরা হবি। প্রায়শই বাজারের সঙ্গে চলে আসতো কোনো একটা বই। শহর লাগোয়া ছায়ানিবিড় শান্ত পরিবেশে গড়ে ওঠা ওনার ছোট্টো বাড়িটির প্রতিটা রুমেই কোনায় কোনায় বইয়ে ঠাসা। দেশ বিদেশের বিখ্যাত সব লেখকদের বিখ্যাত সব বই। বই রাখার আলমারিগুলো তো আগেই বইয়ে টইটুম্বুর। এরপর দিনকে দিন বইয়ের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে এখন বিছানা সহ ঘরের ছোটোখাটো আসবাবপত্র থেকে শুরু করে প্রায় সমস্ত মেঝেটাও এখন দখল হয়ে গেছে। বাড়িতে কেউ এলে যে একটু বসতে দেবে তারও কোনো জো নেই। যদিও উনার স্ত্রীর এতে কোনোদিন গাঢ় অভিযোগ ছিল না, সয়ে গিয়েছিলেন। মাঝে মধ্যে শুধু বলতেন, "তুমি একটা লোক বটে, যেখানেই যাওনা কেন তোমাকে একটা না একটা বই কিনতেই হয়!....." "কী আর করবো বলো? তার প্রেমে যে আমি হইনু পাগল।"
"কিন্তু সব বই তো আর তোমার পড়া হয়ে উঠে না! তাহলে শুধু শুধু কেনো অতগুলি টাকা ব্যায় করে বই কিনে ফেলো রাখো?"
--"Its my only hobby, my dear গিন্নি, কতসব বিখ্যাত বইয়ের নাম..... ওহ! একঝলক দেখলেই আমার মনটা একেবারে জুড়িয়ে যায়।"
ফুলের পাপড়ি মেলার মত যেন তার মনের ভাঁজ খুলে শিহরন জাগতে শুরু করে। আর 'dear গিন্নি' উতলা শিহরণে জল ঢেলে দেওয়ার জন্য যেন বলে উঠে, "অনেক হয়েছে....এযাবৎ নিজের বহু ইচ্ছাকে অপূর্ণ রেখে তোমাকে বই কিনতে দিয়েছি। এবার এক কাজ করো, পড়া হয়ে গেছে এমন বইগুলো বিক্রি করে দাও।"
নিজের প্রাণটা যদি কেউ কেড়ে নিতে চায় তাতেও যেন তিনি রাজি কিন্তু একটা বইও তিনি হাতছাড়া করতে রাজি নন! স্ত্রীর কথাগুলি যেন স্যারের মনে আৎকা ঘা লাগার মত শোনায় তবে প্রতিবাদের কোনো ভাষা খুঁজে পান না। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর নিজের পাঁকা দাড়ির ছোপে হাত বুলিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, "তুমি আর এই বইগুলি ছাড়া আমার আপন বলতে আর কে'ই বা আছে বলো?....." কিন্তু সময় তো গড়িয়ে চলে সময়েরই স্রোতে আর জীবনটাকে রেখে যায় যুদ্ধের ময়দানে দাঁড় করিয়ে রেখে....... অগ্নিমূল্য আর্থিক-পরিস্থিতিতে সীমিত আয় আর কতটুকই বা প্রয়োজন মেটাতে পাড়ে? অতৃপ্ত বাসনা জমে টিলা হয় মন। মাসের শেষ প্রান্তে এসে ছাপোষা লোকেদের কী একটা অবস্থা হয় সেটা কেবল তারাই জানে যারা ঐ জীবনটা বিলং করে; অর্থের ভাড়ার প্রায় শূন্য হয়ে পড়ে । সুগার কন্ট্রোলে রাখতে গিয়ে স্যারের মাসে এমনিতেই বেরিয়ে যায় কতগুলি টাকা তার উপর সঙ্গে আছেন "dear গিন্নি", যিনি বারো মাসের রুগি। এদিকে আকাশ ছোঁয়া জিনিশের দাম, খরচের হিসেব মেলাতে গিয়ে "dear গিন্নি" প্রতিমাসেই খেই হারিয়ে ফেলেন..... ক্লান্ত হয়ে পড়েন বইগুলো আলমারি থেকে নামিয়ে ধুলো ঝেরে আবার গুছিয়ে রাখতে গিয়ে। ভুলে যান কোন তাক থেকে কোন বইটি নামিয়েছেন...... স্বামীর আবার বদভ্যাস, জায়গামত প্রয়োজনীয় বইটি খুঁজে না পেলে চেঁচিয়ে সারা বাড়ি মাথায় তোলেন। মাঝেমধ্যে এই নিয়ে কথাকাটি হলেও নিজেদের মনের পরিবেশ কখনো বিপর্যয়পূর্ণ হয়ে উঠত না। এভাবে চলার মধ্য দিয়ে ম্যা'ম পড়ে যান সমস্যায়। নিত্যদিনের বাজার তো আছেই সঙ্গে আছে ওষুধপত্র। কতসব বিলের মধ্যে হয়তো দুধের বিল কিংবা ইলেকট্রিক বিলটা দেওয়া হয়নি। কিন্তু স্যার তার পুরনো অভ্যাসটা পাল্টাতে পারেননা।
কিন্তু একদিন এই নিয়ে ওদের স্বামী-স্ত্রীতে এমন তুমুল ঝগড়া বেঁধে গেল যে তাতে অতীনবাবুর জীবনের ছন্দটাই যেন এলোমেলো হয়ে যায়! "....যদি আর একটি বই এই বাড়িতে কিনে আনা হয়েছে তো আমি আর এই বাড়িতেই থাকবো না,এই বলে রাখলুম।" dear গিন্নি একেবারে কড়া ডোজে হুমকি দিয়ে রাখেন।
অতীনবাবুর মনটা এতে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে। সপ্তাখানেক ধরে মনমরা ভাবে বাজার করে বাড়ি ফিরে আসেন। বইয়ের দোকানগুলির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় নিজেকে অপরাধী মনে হয়, ঢুকতে সাহস পান না। বাড়িতে আগের মতই সচরাচর লোকজন আসেন, দেখেন কিন্তু আগের অতীনবাবুকে খুঁজে পাননা। কাজে ভুল করেন, বেরসিক কথা বলেন। বাগানের ফুলগুলির সঙ্গে পর্যন্ত কথা বলেন না। পুরনো ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে গড়ে তোলা স্বেচ্ছাসেবক দলটির সঙ্গেও যোগাযোগ বন্ধ। যে তারটিতে হৃদয়ের সুর উঠে সেই তারটিতে যেন জং পড়েছে। সুর উঠছে না.....
একদিন তিনি শহরের একটি বড় রাস্তার পাশ দিয়ে একান্ত মনে হেঁটে যাচ্ছেন, পাশেই শহরের বড় নামকরা একটি বইয়ের দোকান, হঠাৎ শুরু হয় মুষলধারে বৃষ্টি। সঙ্গে ছাতা না থাকায় তিনি প্রায় ভিজে উঠছিলেন, উপায় না পেয়ে বইয়ের দোকানটিতে ঢুকে পড়েন। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর তার চোখ গড়ায় কাউন্টারের এক কোনায় পড়ে থাকা ছোট্ট বাদামী রঙের চামড়ার কভার দেওয়া একটি বইয়ের উপর। সোনালী অক্ষরে লেখা রয়েছে, "The River Amazon"। দেখা মাত্রই উনার মনটা একেবারে আনন্দে উবছে উঠে। এর আগে তিনি বহুবার এই বইটির সন্ধান করেছিলেন কিন্তু কোত্থাও খুঁজে পাননি। উনার কাছে যেন এই বইটি একটি স্বপ্নের বই। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি স্ত্রীর হুমকি ভুলে গিয়ে ৫০০টাকার বিনিময়ে বইটি কিনে নিলেন। আর আনন্দে আত্মহারা হয়ে বাড়ি ফিরে আসেন । তারপর বাজারের ব্যাগটা খালি করতে গিয়ে dear গিন্নি যখন দেখলেন তার নিষেধ থাকা সত্ত্বেও আবার বই কিনে আনা হয়েছে তখন তিনি একেবারে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন, "তোমাকে বলিনি, বাড়িতে আর একটা বই কিনে এনেছো তো.....।"
বইটি তুলে নিয়ে dear গিন্নি জানলা দিয়ে বাইরে ছুড়ে মারলেন আর রাগে গজগজ করতে করতে পাশের ঘরে চলে গেলেন। এরপর মনটা ভার করে অতীনবাবু বাগানের দিকে তাকিয়ে রইলেন আর ঘাসের উপর পড়ে থাকা সুন্দর সেই বইটির গায়ে আছাড় খেয়ে পড়তে থাকে এক এক ফোটা বৃষ্টির জল....
একটি মা ও শিশু
আব্দুল রাহাজ
সময়টা ছিল বড়ই দুর্ভিক্ষের হতাশার। সেই সময় দারিদ্র্যের মাধ্যমে বয়ে চলে ছিল সাধারণ মানুষের জীবন। একটি গ্রাম ছিল নামটি তার রহমতপুর। গ্রাম কি খুব বেশী বড় ছিলো না গোটা ত্রিশ জনের বাস সবাই মুসলিম পরিবার। দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে সবাই একে একে গ্রাম ছাড়তে আরম্ভ করতে লাগলো শেষে একটি জনম দুঃখিনী মা আর তার শিশুর হয়ে গেল। স্বামী ও আরও দুই ছেলে খেতে না পেয়ে ক্ষুধার জ্বালায় চিরঘুমের দেশে পাড়ি দিয়েছেন বেশ কয়েকদিন আগে। এরপর সেই জনম দুঃখিনী মা আর সেই শিশুটি মনের দুঃখে হতাশায় চেয়ে থাকেন পথে দিকে তারা মনে করতো মনে হয় তাদের কেও সাহায্য করবে কিন্তু সেই আশা তাদের আর পূরণ হয় না। এর এর কয়েকদিন পর তারা চলে গেছে গ্রামের পাশে একটি নদী আর তার মাঝখানে আছে ছোট্ট দ্বীপ সবুজে ঘেরা আর বনের আধিক্য থাকায় কেউ বসবাস করে না সেখানে এসেই মা-ও-শিশু বসবাস করতে লাগল তারপর আস্তে আস্তে বনের পশু পাখির সঙ্গে ভাব হয়ে গেল। আর এদিকে রহমতপুর আস্তে আস্তে যোনির আকার ধারণ করল নদীর বুকে যেন আরো আরো এক সবুজ সমাধি বন তৈরি হলো। এরপর সেই জনমদুঃখিনী মা আর শিশু বনের পশু পাখিদের নিয়ে সুখে শান্তিতে বসবাস করতে লাগলো। নদীর মাছ ফলমূল খেয়ে তাদের দিন কাটতো। একবার এক সন্ধ্যায় বনের পশুপাখি ও তার ছোট্ট শিশুকে নিয়ে রহমতপুর গ্রামের কথা বলতে লাগলো একদিন রহমত পুর গ্রামের অবস্থান ছিল জলা জমি ভরা নদী একসময় বাইরে থেকে লোক এসে এখানে প্রচুর মাছ ধরতো তারপর তারা আস্তে আস্তে লাভবান হতে থাকে এরপর কিছু মানুষের বসবাস করার ইচ্ছা প্রকাশ করে তারপর থেকে তারা যেমন তেমন করে একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই করলেন তারপর আস্তে আস্তে তারাও সুন্দরভাবে ভাঁজযোগ্য করে তুললেন তারপর থেকে তারা নাম দেন রহমত পুর এভাবেই এই গ্রামের নামকরণ করেছিলেন তারা। তারপর আমরা আসি খুব সুখে শান্তিতে একসাথে থাকতাম দেখতে দেখতে আমাদের গ্রামে গোটা ত্রিশ পরিবার একসাথে থাকতে আরম্ভ করলাম। তার বেশ কিছুদিন পর আমাদের ঘরে আলো করে আসলেন আমার পাশে বসে থাকা এই ছোট্ট সোনা টি। এইভাবে আমাদের এবং গ্রামের সবারই ভালোই দিন কাটছিল। হঠাৎ একদিন দেখা দিল আশে পাশের গ্রামে মহামারী তারপর উদার হতে থাকলো গ্রামের পর গ্রামের মানুষ তখন আমরা ভাবতে শুরু করলাম যে আমরা অতি সুন্দর পৃথিবীর মায়া জালে আর বেশি দিন থাকবো না কিন্তু প্রভুর কৃপায় আমাদের গ্রামে মহামারী ঢুকলো না সবাই আনন্দে আত্মহারা সত্যি সেদিন সবাই আনন্দ বোধ করেছিল তারপর গ্রামের পূর্ব পাশে চাষের ক্ষেত তৈরি করা হলো গ্রামের সবাই সেখানে চাষ করতো যখন ফসল ঘরে উঠতো তখন গ্রামের প্রতিটি মানুষের চোখে মুখে আনন্দের ফুলঝুড়ি উঠতো। আর মাঠে ফসল থাকলে প্রকৃতির সবুজের সঙ্গে মাঠের ফসলের যে মিল তা তৈরি করত এক মায়াবী মনোরম দৃশ্যে যা দেখে আপ্লুত আপামর গ্রামবাসী। যখন নিশ্চিত সূর্যের আলো পশ্চিমাকাশে অস্তমান সেই সময় তার হলুদ আভায় মনে করে দিত রহমতপুর তথা প্রকৃতি নিজে মেলবন্ধন তা সজ্জল ভাবে ফুটে উঠত। এইভাবে চলতে থাকলেও দিনের পর দিন বহু সময় বয়ে গেল পরিবর্তন হলো প্রকৃতির বহু পালাবদল হল একদিন হঠাৎ রহমতপুরে নেমে এলো সত্যি সত্যি মহামারী দুর্ভিক্ষ প্রথমেই চলে গেল জনম দুখিনী মায়ের স্বামী ও তার দুটো সন্তান তারপর আস্তে আস্তে রহমতপুর গ্রাম ছেড়ে সবাই চলে গেল আর সেই জনমদুখিনী মা ও তার শিশু তাদের সেই জন্মভিটা ধরে আঁকড়ে বসেছিল। এরপর থেকে আমরা এই বনে চলে এলাম আর তোমাদের সাথে বন্ধুত্ব হল এভাবেই চলছে আমাদের বর্তমান জীবনযাত্রা আর তাদের রহমতপুর হল এক সবুজায়নের মনের অধিকারী যেখানে প্রকৃতি রহমত পুর কে আগলে ধরে রেখেছে এক অনন্য সম্পদ হিসেবে। এইভাবে এসেই মা ও শিশু আদি কাল ধরে বনের মধ্যে বসবাস করতে লাগল সেই সঙ্গে বনের পশুপাখি নিয়ে তাদের এক সুন্দর পরিবারের মতো বসবাস করতে লাগল। এইভাবে দিনের-পর-দিন বনের মধ্যে রয়ে গেল ওই দুজন মানুষ এদিকে সেই শিশুটি বড় হলো আর সেই মায়ের বয়স হলো। একদিন হঠাৎ এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল তার সেই মা তখন সেই শিশুটি মাকে হারিয়ে মায়ের জন্য কাঁদতে কাঁদতে সেই বনে হাতি চিরকাল ধরে রয়ে গেল। তারপর বনের মধ্যে মা ও শিশু র এইযে বসবাস প্রকৃতি ও তাদের সাথে মিলেমিশে থাকতো থাকতো । সেই প্রকৃতি শকে আত্ম বিলীন হয়ে পড়েছিল।এর ফলে একটি মা ও শিশুর যে সম্পর্ক তা প্রকৃতির বুকে সলিল সমাধি রূপে প্রতীক্ষিত হয়ে রইল।
সব গল্পগুলিই বেশ।
ReplyDelete