PravatiPatrika

Friday, May 8, 2020

গল্প ও অনুগল্প

দুটি পাতা
          সোমনাথ বেনিয়া

প্রেম করে উমাকে বিয়ে করলেও পরবর্তী সময়ে অনিমেষ খুব একাকীত্বে ভুগতো কারণ উমার সঙ্গে তার বয়সের বিস্তর ফারাক এবং স্ট‍্যাটাসগত সমস‍্যা থাকায়। তাই শুধুমাত্র ভালো বন্ধুত্বের খোঁজে সে ডায়াল করে ফেলে ফোনে বিজ্ঞাপিত হ‌ওয়া "বন্ধু চাই" নম্বরে। মেয়েটির নাম অপর্ণা যার সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হলো এবং তার ফ্ল‍্যাটে মেলামেশা, ঘন ঘন যাতায়াত ইত‍্যাদি শুরু করলো। অনিমেষ শুধু বন্ধুত্ব চেয়েছিল কিন্তু অপর্ণা তাকে ভালোবেসে ফেলায় বিয়ের প্রস্তাব দেয় কিন্তু অনিমেষ তাকে তো নিজের পরিবারের কথা জানিয়েছিল। তবে! ভালোবাসা শুধু বন্ধুত্ব নয়, চায় মিলন! তাই অপর্ণা পরিস্থিতি অনুযায়ী অনিমেষকে বলেছিল যে তাকে বিয়ে করতে হবে না কিন্তু সে তো অনিমেষের সন্তানের মা হয়ে সেই স্মৃতি আগলে বাঁচতে পারবে। বিয়ে হলো না তবে অপর্ণা মা হলো। অনিমেষ বলেছিল - কী নাম রাখবে!
- মিতু।
- মিতু! এটা আবার নাম হলো।
- হ‍্যাঁ, মিতু কারণ মিতু উলটে লিখলে তুমি হয়। তাই মিতু বলে ডাকলে তুমি পাশে আছো সেটাই মনে হবে।
       এখন উমা অনিমেষকে তুমি বলে ডাকলে তার চোখের দুটি পাতা বন্ধ হয়ে আসে ...





নির্লিপ্ততা
            প্রশান্ত ভৌমিক

মালতীর একমাত্র কাজ সারাদিনে প্রতিবেশীদের সাথে গল্পগুজব করা। আজ প্রতিবেশী ভদ্রমহিলা জিজ্ঞেস করলেন, আজ তোমার বর কাজে যায়নি?
মালতী বলল, না। সকালে ঘুম থেকে উঠে চা পাইনি সময়মত। তাই ছেলের ক্রিকেট ব্যাট দিয়ে দু ঘা বসিয়ে দিয়েছি। এখন দেখি হাটতে পারছে না। পা ভেঙ্গেছে বোধহয়! আজকের রান্না বান্না যে কে করবে?




প্রতিদান
        শুভঙ্কর রায়

অষ্টাদশী, সুশ্রী মুখমণ্ডল, দেখলে যে কেউ উদাস হয়ে যাবে। শুধু তার একটা চোখে ছানি পড়া।
ইসলামপুরে তার মাসির বাড়ি থেকে পড়াশোনা করে। মা মারা যাবার পর থেকেই তোমার বাবা মাসি বাড়িতে রেখেছে। বাবা ব্যস্ততার কারণে দেখভাল করতে পারেনা, মাসে একবার মেয়েকে শুধু দেখে আসে। সমা মাসির কাছে নিজের মেয়ের মতোই থাকে। চোখের জন্য এদিক ওদিক অনেক ডাক্তার দেখিয়েছে, কিছুটা কম অনুভব করলেও পুরোপুরি ঠিক হয়নি। শেষ পর্যন্ত মাসি তোমাকে নিয়ে নেপালে যান ডাক্তার দেখাতে। নেপালের কিছুই জানা নেই মাসির। শুধু লোকের মুখে গল্প শুনেছে।সাহস করে দিলেও কি করে কি করবেন এ নিয়ে চিন্তা করতে লাগল। এমন সময় এক বাঙালি ছেলেকে দেখতে পান। ওকে জিজ্ঞাসা করেন-'আমরা প্রথম এসেছি, কিছু বুঝে উঠতে পারছিনা'।
-'আমি অনেকবার এসেছি। আমার সাথে চলুন, আমিও মায়ের চোখ দেখাবো।'
হিটলের চোপড়ায় বাড়ি, নেপালে এতবার এসেছে যে ডাক্তারবাবুরা সকলেই হিতেনকে চেনে। সকলের সাথে আলাপ হয়।-যাক ভালই হল, একদিকেরই লোক, একটু ভরসা পাওয়া গেল।
-আপনাদের চিন্তা করতে হবে না। ওর চিকিৎসার সুব্যবস্থা আমি সঙ্গে থেকেই করে দেবো।
সময় এত সুন্দর মেয়ে, কথাবার্তাও বেশ আকর্ষক। কঠিন মনের মানুষ কেউ নরম করে দিতে পারে তার হাসি। শুধু একটা চোখের জন্য মেয়েটি-এ কথা ভেবেই হিতেন চেষ্টাআত্তি করছে সারিয়ে তোলার।বেশ কয়েকদিন ঘোরাঘুরি করে ডাক্তারবাবুদের সঙ্গে কথা বলে সোমার অপারেশনের ব্যবস্থা করে। অপারেশন করলে মাস তিনেকের মধ্যে ভালো হয়ে উঠবে।
হিতেনের ঘোরাঘুরি আর সারিয়ে তোলার কঠোর প্রতিজ্ঞার ফলস্বরূপ সুষ্ঠুভাবে অপারেশন করে বাড়ি চলে আসে। হিতেন বেশ কয়েকবার তোমাকে দেখতে ইসলামপুরে আসে। কথা হয়, দেখে চলে যায়। সোমার সামনেই মাসিকে বলে-মাসি, তোমাকে আমার খুব ভালো লাগে। তুমি যদি সম্মতি দাও, তাহলে আমি ওকে বিয়ে করতে রাজি।
-তোমাকে আমারও পছন্দ। সোমাও় তোমার কথা বলে।
-তাহলে বাবা মা কি তোমার সাথে কথা বলতে পাঠাবো।
-সামনে ফাইনাল পরীক্ষা। তারপর নাহয় কথাবার্তা সেরে নেব।
-ঠিক আছে তাই হবে।
হিতেন স্বপ্নের রঙিন জাল বুনতে থাকে।

সোমার পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে বেশ কদিন হলো। কোন খবর নেই। হিতেনও ফোন করেনি সোমার পরীক্ষার জন্য।এতদিন ফোনের অপেক্ষায় থেকে কোন খবর না পেয়ে মাসির ফোনে কল করলো 'নট রিচেবল' বলছে। থাইল্যান্ড লাইনে কল করতেই ওপাশ থেকে-হ্যালো বৌদি মনি বাড়ি নেই।
-সোমা আছে?
-না, সোমা দিদিমনিও নেই।
-কোথায় গেছে বলতে পারবে?
-বালুরঘাট, ওখানে সোমা দিদিমণির বিয়ে হচ্ছে।
সোমার বিয়ের কথা শুনে হিতেন নির্বাক। কখন হাত থেকে মোবাইলটা মাটিতে পড়ে গেল হিতেন বুঝতেই পারলনা।


   দিদিভাই
          কবিরুল
   

    অফিস থেকেই ফিরেই নীল একটু ফ্রেশ অক্সিজেন পাবার জন্য স্টেশনে এসে বসল। আজ মনটা বিশেষ ভাল নেই। শেডের নীচে একটা রবি ঠাকুরের বেশ বড় ছবি রয়েছে। নীল আপণ মনে ছবির দিকে চেয়ে আছে। কদিন বাদেই কবিগুরুর জন্মদিন।

      হঠাৎ ট্রেন থেকে এক অল্প বয়স্কা মহিলা নেমেই কবিগুরুর ছবির সামনে আপণ খেয়ালে নাচতে শুরু  করল। কি অপূর্ব নৃত্য শৈলী! আজ সত্যিই নীল একটা ফ্রেশ অক্সিজেন পেল বটে।

     মেয়েটার দাদা কখন নীলের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে নীল বুঝতেই পারেনি। দাদাই সব কথা খুলে বলল। বোনটা ভালই নাচ করত। অনেক দামী প্রাইজও আছে ঝুলিতে। বিয়ের পর শ্বাশুড়ির অত্যাচারে সব কিছু ছাড়তে বাধ্য হয়। সেই থেকেই মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে যায়।

     মেয়েটাকে দেখে কেমন মায়া হল নীলের। চোখের কোণ বেয়ে নেমে আসা দু ফোঁটা নোনা জলের ধারা অতীতকে স্মরণ করাল।

     নীলের দিদিভাইও ভাল নাচ করত। বিয়ের পরই দিভাইয়ের সাথে এই নাচ নিয়ে তুষারদার কম অশান্তি হয়নি। যার পরিণাম দিভাইকে সুইসাইড করতে হয়।

      আজ " কবি প্রণাম " এর প্রাক মুহূর্ত্যে ঐ মেয়েটির নাচ দেখে নীলের দিভাইয়ের কথা খুব মনে পড়ছে

               ....  ....   ...  .....
     
    বেশ কিছুদিন কেটে গেছে।
    নীলের পাড়ায় এবার ওর নিজের ক্লাব " স্বপ্ন সন্ধানী " পঁচিশে বৈশাখের দিন বিশাল বড় করে " কবি প্রণাম " এর আয়োজন করছে। নীল তাই ভীষণ ব্যস্ত। পাশের ক্লাব " মিলন বীথী " এর সাথে রেষারেষিও বেশ তুঙ্গে।

       পঁচিশে বৈশাখের দিন বৈকালেই অঘটন টা ঘটল। বনশ্রী ও তার নাচের দল আসতে পারবে না। ওরা অন্য এক ক্লাবে গেছে। সেখানে বেশী টাকা দেবে। বিজনদার কপালে চিন্তার ভাঁজটা দাক্ষিনাত্যের মালভূমির মতন দেখাল।

      সন্ধ্যে আটটায় দাক্ষিনাত্য বদলে গেল ঝরণার বিভঙ্গে।
     একটি মানসিক ভারসাম্যহীন মহিলা কাঁপা , ভীরু পদক্ষেপে মঞ্চে উঠল। পর্দা সরতেই শুরু হল নয়নাভিরাম নৃত্য শৈলী।

     সবাই মণ্ত্রমুগ্ধের মত চেয়ে রইল।

      স্বপ্ন সন্ধানী ক্লাব সত্যিই স্বপ্নের সন্ধান পেয়েছিল।

      যে স্বপ্নের আঁকাবাঁকা সরলরেখা এক মানসিক ভারসাম্যহীন রোগীর মধ্যে থেকে ছিনিয়ে এনেছিল প্রকৃত প্রতিভার বিচ্ছুরণ।

     নীলের বাবা পুরো অনুষ্ঠানই দেখেছেন ভিজে চোখে। কবি প্রণামের দিন উনি নিজের মেয়েকে ফিরে পেলেন।

     নীল পেল তার আদরের দিভাই কে।

      স্বার্থক হল কবি প্রণাম।



শুখনো পাতায় অশ্ৰু 
                     রীতেশ গোস্বামী

একদিন দুপুরে খাওয়া দাওয়া সেরে যীশু বেলকোনিতে দাঁড়িয়ে ছিলো হঠাৎ দেখলো একটা জীর্ণ বয়স্ক লোক রাস্তার ধারে বন্ধ দোকানটার ছাওনি তে শুয়ে আছে | যীশু তা দেখে নীচে গিয়ে লোকটাকে বললো, "এই লকডাউন এ আপনি বাইরে " তা শুনে একটু নড়ে চড়ে লোকটা দুর্বল কণ্ঠে বললো, "বাবা লকডাউন টা বাইরে কিন্তু ভিতরের পেটের খিদাটা তো আর মানেনা, তাই খিদার জ্বালায় বেরোনো, কিন্তু এই লকডাউন এ দু মুঠো ভাত কে দেবে সবাই তো ঘরের ভিতরে" কথাগুলো খুব মনে লাগলো যীশুর | সে তৎক্ষনাৎ ঘরে গিয়ে থালায় ভাত, ডাল আর মাছভাজা নিয়ে এসে আর সাথে পাঁচশো টাকার নোট নিয়ে বুড়োলোকটাকে দিলো..... বুড়োলোকটার মুখের বলিরেখার মধ্যে দিয়ে  চোখের জলটা টপ টপ করে নীচে পড়ছে আর যীশু কে বললো, "ভেবেছিলাম  ভাইরাসটা শেষ হওয়ার আগেই আমি হয়তো মারা যাবো কিন্তু তোমার মতো ছেলে হয়তো এই বুড়োর মতো আরও অনেকের বাঁচার আশাটা হয়তো আবার বাড়িয়ে দেবে, এই ভাবে পাশে থেকো বাবা আমার মতো অনেকেই হয়তো দু মুঠো খাবারের জন্য এই দুর্দিনে পথ চেয়ে আছে "
      কথা গুলো খুব মনে লাগলো যীশুর | আকাশের তীব্র রোদ্রের দিকে তাকিয়ে চোখের জলটা মুছে এক দৃষ্টিতে লোকটার দিকে তাকিয়ে রইলো....... আর ভাবলো ভাইরাসটা হয়তো আবার জানিয়ে দিচ্ছে              "হিংসা,জাতিভেদ আর রাজনীতির উর্ধেও একটা জগৎ আছে একের পাশে একের দাঁড়ানো আর ভালোবাসার হাত সকলের পানে বাড়ানো "




পাঁচ তারিখ
          দিব্যেন্দু চ্যাটার্জি

স্টেশনে পা ফেলতেই ম্যাসেজ টোনটা বেজে উঠে সোহমের মোবাইলে।
‘কি রে কার এস.এম.এস’? অভি জিজ্ঞাসা করল।
-“একটা অচেনা নাম্বার”।

অচেনা নাম্বারের প্রতি অভির আকর্ষণটা বহুদিনের, সেই স্কুলজীবন থেকেই। অচেনা নাম্বার দেখলেই সোজা ঝাঁপ দেয় মোবাইলে। উৎসাহের সাথে বলে ওঠে- “দেখি দেখি”।
ম্যাসেজটা দেখার পর তৃষ্ণা মিটল অভির। উৎসাহের পারদটাকে দ্বিগুণ করে অভি বলল- ‘একবার কল করেই দেখ না...’।
আবার এস.এম.এস। একই নাম্বার থেকে। পুরো এস.এম.এস টা পড়ে সোহম।
-‘প্রিয়াঙ্কার ম্যাসেজ’।
-‘কে প্রিয়াঙ্কা’?
-‘প্রিয়াঙ্কাকে চিনিস না! লম্বা বিনুনি দুলিয়ে দুলিয়ে কলেজে আসত’।
-‘হ্যাঁ, এইবার চিনতে পেরেছি’।
-‘মনে হয় চিরঞ্জিতের থেকে নাম্বারটা নিয়েছে। শুভ পঞ্চমী জানাল’।

এরই মধ্যে ট্রেন প্লাটফর্মে ঢুকলো। ওরা ট্রেনে উঠে পড়ল। দুই জনেই যাবে ধর্মতলা কেনাকাটা করতে। সোহমের সাথে ছিল এ মাসের ‘দেশ’ পত্রিকা। ওর নিঃসঙ্গতা কাটাবার একমাত্র সঙ্গী বই। কিন্তু এখন ট্রেনের মধ্যে শুধুই মোবাইল। চলতে থাকে প্রিয়াঙ্কার সাথে এস.এম.এস-এর বিনিময়। এই ছোট যন্ত্রটার মাধ্যমে হাজার মাইল দূরত্বে থাকা দুটি হৃদয় খুব সহজেই পরস্পরের কাছে চলে আসে নিমেষেই। সোহমের হাত থেকে ‘দেশ’ টা কেড়ে নেয় অভি। বলে ওঠে ‘তুই তো পড়ছিস না আমাকে দে’। বইটা নিয়ে পাতা উল্টাতে থাকে অভি। কিন্তু নজরটা সোহমের ওপর। ওর ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি দেখতে পায় অভি। মনে মনে বলতে থাকে, ‘ডালমে কুছ কালা হে...’। ট্রেনের সাথে কলকাতার দূরত্ব ক্রমশঃ কমতে থাকে। ম্যাসেজ দেয়া-নেয়ার ফলে প্রিয়াঙ্কা জানতে পারে ধর্মতলা যাবার কথা। সোহমের মায়ের মতো বলে উঠে, ‘সাবধানে যেও’...। পুজোতে পকেটমারের সংখ্যা বেড়ে যায় ওখানে।

-‘কি ব্যাপার প্রিয়াঙ্কার সাথে কথা বলার সময় তোর মনে এত ফুর্তি জাগছিল কেন’? অভি জিজ্ঞেস করল।
সোহম মৃদু হেসে পথ চলতে থাকে। সাবওয়েতে জনসমুদ্রের ভিড় ঠেলে ওরা পৌঁছায় বাসস্ট্যান্ডে।

কলেজে স্বর্গের পরীদের দেখতে ভালোই লাগে সবার মতো সোহমেরও। এইসব পরীদের পাশে প্রিয়াঙ্কা ফিকে হয়ে এলেও সোহমের কাছে হয়নি। ভালোই লাগে ওর লম্বা বিনুনির দুলুনি। ধীরে ধীরে প্রিয়াঙ্কার মধ্যেই ডুবে যেতে থাকে সোহম।

ওরা ধর্মতলায় এসে নামে। পুজার শুরুতেই কলকাতায় জমজমাট পরিবেশ। চারিদিকে দোকানীরা নতুন জিনিসের পসরা নিয়ে বসে আছে। ওরা কি কি কিনবে ঠিক করতে পারে না।

ম্যাসেজ এলো, আবার প্রিয়াঙ্কা। -‘কি কি কিনলে’?
সোহমের রিপ্লাই দেয়, ‘ঠিক করতে পারছি না কি কি কিনব...! তোমার কি রঙ পছন্দ গো’?
প্রিয়াঙ্কা- ‘নীল’।
সোহমের মনে হল ভালবাসার সঙ্গে নীল রঙ-টার খুব ভাব। দুটো নীল রঙের টি-শার্ট কিনল সোহম । অভির হাতে দুটো জিনস, দুটো শার্ট।
-‘তুই হঠাৎ নীল রঙ......। তোর তো প্রিয় রঙ কালো’। অভি বলল।
-‘ভালো লাগল, কিনে নিলাম’। সোহম উত্তর দেয়।

বিগবাজার থেকে নিউমার্কেট সবই চষে ফেলল ওরা দুজন। সোহমের পকেট থেকে মোবাইল বার করে স্ক্রিনে চোখ রাখতেই দেখে প্রিয়াঙ্কার দুটো ম্যাসেজ। ভিড়ের কোলাহলে ম্যাসেজ টোনই শুনতে পাইনি সে। ম্যাসেজ দেখার পরই ঝড়ের গতিতে টাইপ করে-‘সরি, দেখতে পায়নি। এতো চেঁচামেচি তে...’।
প্রিয়াঙ্কা রিপ্লাই দেয়-‘সন্ধ্যে হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবে’।
সোহম-‘ঠিক আছে, তুমি চিন্তা করো না’।
ওর প্রতি অহেতুক কৌতূহলের কারণটা বুঝতে পারে সোহম। আরও বুঝতে পারে প্রিয়াঙ্কার মনেও বসন্ত হানা দিয়েছে।

মার্কেটিং শেষ। ট্রেন ধরে বাড়ি ফেরে দুই বন্ধু। একলা ঘরে বসে টি-শার্টের দিকে তাকিয়ে থাকে সোহম। রাত তখন ১২টা। খুঁজতে থাকে প্রিয়াঙ্কার নাম নীল রং-এ। নীলের মত্ততাতে যখন মেতেছে সোহম, তখনই আসে প্রিয়াঙ্কার ম্যাসেজ,-‘তোমার কোনো গার্লফ্রেন্ড আছে...’? “পুজোতে কি করছ?”

অযাচিত এই প্রশ্নে তুবড়ি জ্বলে সোহমের মনে। অল্প সময়ের আলাপ- পরিচয়ের মধ্যে দিয়ে মনের ক্যানভাসে হাজার ছবি এঁকে ফেলে প্রিয়াঙ্কার। রিপ্লাই করে-‘ না, নেই, কেন? আর পুজোতে সেই রকম কোন প্ল্যান নেই”।  প্রিয়াঙ্কার প্রশ্নের কারণটা বুঝে নিতে দেরী করে না সোহম। প্রিয়াঙ্কাকে ওর মনের কথা বলার জন্য একের পর এক কথার মালা গাঁথতে থাকে। রাত বাড়ে...। প্রিয়াঙ্কার এস এম এস-এর অপেক্ষায় থাকে সোহম। রাতের খাবার কথাও ভুলে যায় সে। অপেক্ষার কোন ফল না হওয়ায় বালিশে মাথা গুঁজে শুয়ে থাকে। একের পর এক প্রশ্নের জালে নিজেকে জড়াতে থাকে। মনকে শান্ত করে, কানে হেডফোন গোঁজে।
-‘আমার ও পরাণ যাহা চায়’।

নাইট ল্যাম্পটাও নীল রঙ মেখেছে আজ। সব মিলে মিশে এক মায়াবী পরিবেশ তৈরি হয়, সোহমের মনে ও ঘরে। অজান্তেই দু’চোখের পাতা এক হয় সোহমের।
সকালে ম্যাসেজ টোনেই ঘুম ভাঙে ওর। প্রিয়াঙ্কার ম্যাসেজ, ‘সরি, কালকে ম্যাসেজ ব্যালেন্স শেষ হয়ে গিয়েছিল, তাই তোমাকে......। গার্লফ্রেন্ডের আর পূজোর সময় কি করছো ম্যাসেজটা আমার ভাই পাঠিয়েছিল, ও খুব দুষ্টু। গতকালকে তোমাকে আসল কথাটায় বলা হয়নি’।

সোহম-‘কি কথা? তোমার মনের কথা আমাকে বলতে পারো’।
প্রিয়াঙ্কা- ‘না না, মনের কথা নয়। সামনের মাসের পাঁচ তারিখ আমার বিয়ে। কলেজের সব বন্ধুদের আসতে বলেছি। তুমিও আসবে। ভুলে যেও না যেন, সামনের মাসের পাঁচ তারিখ।আর শুভ ষষ্টি”।

সোহমের মনে বাজতে থাকে- ‘তুমি রবে নিরবে'



   উপহার
         বিউটি কর্মকার

বিছানার এক কোনে দুটো হাঁটুর মাঝে মাথা রেখে চুপ করে বসে আছে সুদীপ। বছর বারোর ছেলেটির মনে আজ ঝড় বয়ে যাচ্ছে। নাম সুদীপ মিত্র, কলকাতার এক নামী ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে। বাবা বেসরকারি চাকুরিজীবী। মা, বাবা, ঠাম্মিকে নিয়ে বেশ ভালোই দিন কাটছিল তার। বাড়িতে সবাই ওর আপনজন হলেও ওকে বোঝার মত মানুষ ছিল কেবল ওর ঠাম্মি। গোপালের নাড়ুর ভাগ পাওয়া, রান্নাঘর থেকে আমুলদুধ চুরি করে খাওয়া-- এসব অন্যায় প্রশ্রয় এই বাড়িতে একমাত্র ঠাকুমাই দিত। ওকে বোঝার মত সময় ওর বাবা মায়ের নেই। তাই স্কুলের সময়টুকু আর টিউশনের সময়টুকু ছাড়া সুদীপের বেশিরভাগ সময়টাই কাটত ঠাম্মির কাছে গল্প শুনে। ঠাম্মির মুখে শোনা রামায়ণের চরিত্রগুলো সত্যি হয়ে যেন সুদীপের চোখের সামনে ভেসে উঠত। আহা, কি সুন্দর ছিল সেইসব দিন! কিন্তু এত আনন্দের মধ্যেও বাড়িতে একদিন অশান্তির কালো মেঘ ঘনিয়ে এলো। মাসছয়েক আগে একদিন সকালে সুদীপের ঠাম্মি ওর বাবার জন্য মুড়িঘন্ট রান্না করছিল। ঠাম্মির এই পুত্রস্নেহ সুদীপের মা সেদিন ভালোভাবে নেয়নি। সেই থেকেই সুদীপের ঠাম্মির উপর সুদীপের মায়ের আচরণ পাল্টে গেল। কিছুদিন পর স্বামীর সঙ্গে বিবাদ করে শাশুড়িকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানোর ব্যবস্থা করল সুদীপের মা। সুদীপের বাবার বারণ, সুদীপের কান্না সেদিন এই ঘটনাকে আটকাতে পারলোনা। এরপর থেকে সুদীপের বাবা নিজের অফিসের কাজে আরো মন দিল, সুদীপের মা দিনরাত ওর দিদুনকে ফোন করতেই ব্যস্ত থাকে। মাঝখান থেকে সুদীপ পড়ল মহা সমস্যায়। হঠাৎ করে বড় একা হয়ে গেল সে। মাকে দুদিন বলেছিল সেই কথা। পরিবর্তে কপালে জুটেছিল মার। সুদীপ বুঝতে পারল ওর কথা কেউ শুনবে না। শেষে নিজেকেই আরো গুটিয়ে নিল সে। ঘরের দরজা তার এখন প্রায় সবসময়ই বন্ধ থাকে। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? সেটা সে নিজেও জানে না। আজ তার উপর ওর জন্মদিন। মা বিকেলে পার্টির ব্যবস্থা করেছে। এতে সুদীপ অবশ্য খুশি নয়। বাবা আজ 'জরুরি কাজ আছে' বলে সকাল সকাল অফিস চলে গেছে। সুদীপ আজ ওর ঠাকুমাকে খুব মিস করছে। মাথায় ধানদূর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করা, নাতির জন্য পায়েস রাঁধা-- এসবই করত ঠাম্মি। কিন্তু আজ সব বন্ধ। মনমরা হয়ে নিজের ঘরে বসে থাকে সুদীপ। সময় চলে যায়, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়। সুদীপের অনুপস্থিতিতেই তার জন্মদিনের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। তখন রাত দশটা। হঠাৎ সুদীপের দরজায় টোকা পড়ে। সুদীপ দরজা খুলে দেখে বাবা দাঁড়িয়ে আছে, পাশে ঠাম্মি। হাতে পায়েসের বাটি। সুদীপের মুখটা আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এটাই ওর বাবার থেকে পাওয়া ওর জন্মদিনের শ্রেষ্ঠ উপহার।


2 comments: