PravatiPatrika

Wednesday, June 10, 2020

ধারাবাহিক উপন্যাস, কবিতা ও গল্প

                           
               পাখির ডানার উড়ান
                                    প্রশান্ত ভৌমিক
                                      ৩)
ঘরে ঢুকেই দেখলাম মদন স্যার বসে আছেন। আমাকে দেখেই মুখ বিকৃত করে জিজ্ঞেস করলেন, এত দেরি কেন?

আমি আসছি বলে ভেতরে চলে এলাম। ভাবছি আজ কপালে না জানি কী আছে! ঘড়িতে ২টা বেজে ২০। মানে স্কুল ছুটি হয়েছে ২০ মিনিট আগে। তাহলে আমার আসতে মোটেও কিছু দেরি হয়নি। কিন্তু মদন স্যারকে গিয়ে সে কথা বলার সাহস আমার নেই। বাথরুমে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে জামা-কাপড় পাল্টে বেরোলাম। বেরুতেই বড়দি বলল ভাত খেয়ে নিতে। আমি বলে দিলাম এখন নয়। বড়দি বলল ও খাইয়ে দেবে। ছোটবেলা থেকেই বড়দি একদম মায়ের মত আদর করে আমাকে। আর তাই না খাইয়ে ছাড়বে না সেয়া বেশ ভালই বুঝতে পারছিলাম। চুপচাপ খেতে গেলাম।
দু’মিনিটেই খাবার শেষ করলাম। জানি আরামে খাবার খাওয়াই শেষ কথা নয়। এরপরে বাঘের মুখে পড়তে হবে। বিনা কারণে অত্যাচারিত হতে হবে। মাঝে মাঝে মদন স্যারের অত্যাচারের কথা মনে পড়লে ইচ্ছে করে ঘর-বাড়ি সব ছেড়ে বেরিয়ে পড়ি। কিন্তু বাবা-মা আর দিদিদের ছাড়া থাকার কথা ভাবতে পারি না বলে সেটাও করা হয় না। এর ফলাফল বিনা অপরাধে শাস্তি ভোগ। আমি গণিত পরীক্ষায় ইচ্ছে করে অংক ভুল করি, জ্যামিতি আঁকি ভুল, ইচ্ছে করে পরীক্ষায় শূন্য পাওয়ার চেষ্টা করি। ভাবি, এতে বাবা মদন স্যারকে বদলে অন্য স্যার রাখবেন। কিন্তু পরীক্ষায় খারাপ করলে মোজাম্মেল স্যার বাবাকে স্কুলে ডেকে রিপোর্ট করবেন। তাই সেটাও করা হয়ে ওঠে না। বুঝে গেছি, আমার মত যারা ভীতু তাদের পড়ে পড়ে মার খাওয়া ছাড়া গতি নেই।

ভাত খেয়ে বই-খাতা নিয়ে পড়ার ঘরে গিয়ে টেবিলে বসলাম। টেবিলে বসতে না বসতেই কিছু বুঝে ওঠার আগেই সপাটে এক চড় অনুভব করলাম বাঁ-গালে। ব্যথায় চিনচিন করে উঠল। চোখে জল চলে এল। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করলাম। চোখের জল দেখলে মদন স্যার আরো বেশি আগ্রহী হয়ে উঠবেন মারামারির ব্যাপারে। আমি মুখ বুজে রইলাম। অন্যদিন মারামারির কিংবা শাস্তির ব্যাপারটা এত আগে শুরু হয়না। আজ শুরুতেই থাপ্পড়। আমি যত ঠাকুর-দেবতার নাম জানি, সবাইকে মনে মনে ডাকা শুরু করলাম। প্রশ্ন ধেয়ে এল- স্কুলের পর কোথায় গিয়েছিলি?
আমি- কোথাও যাইনি। স্কুল থেকে রিক্সায় করে কলেজ রোড। সেখান থেকে হেঁটে বাসায়।
মদন স্যার- তুই বললেই হল? আমি বসে আছি একটা থেকে। তোর স্কুল ছুটি হয় কয়টায়?
আমি বললাম, স্কুল ছুটি হয় দুইটায়। আর আমি দুইটা কুড়িতে ঘরে ঢুকেছি।
ভয় পাচ্ছি কখন আরো চর-থাপ্পর এসে পড়ে।
মদন স্যার- স্কুল দুইটায় ছুটি হয়! কে বলল? অর্ণব তো বলল স্কুল একটায় ছুটি হয়। তাহলে বল স্কুলের পর এই এক ঘণ্টা কুড়ি মিনিট তুই কোথায় ছিলি?
আমি অবাক হলাম। বললাম, অর্ণব বলেছে একটায় ছুটি হয়? আজকেও তো স্কুল ছুটির পর পাশাপাশি রিক্সায় এলাম। আমি এসেছি আমাদের ক্লাসের দু’জনের সাথে। অর্ণব আর ত্রয়ী একসাথে এসেছিল।
মদন স্যারের থামার লক্ষনই নেই। বলেই চলেছেন, ওরা ভাই-বোন ঠিকই আছে। ওরা ক্লাস শেষ করেই বাসায় চলে আসে। তুই বদমাস ক্লাস শেষে ছেলেদের সাথে এদিক-সেদিক ঘুরতে চলে যাস। বেয়াদব কোথাকার!
বলেই বাঁহাতে আমার চুলের মুঠি ধরে ডান হাত আমার বাঁ-গালে পরপর দুটি চড় কষালেন। আমি আর চোখের জল ধরে রাখতে পারলাম না। স্যার বলেই যাচ্ছেন, তোর মত অপদার্থকে পড়াশোনা কেন করায় তোর বাবা আমি ভেবেই পাই না। তোর বাবার উচিত ছিল তোকে জমিতে কাজ করতে পাঠানো। তা না করে তোকে স্কুলে পাঠাচ্ছে। আবার রিক্সায় করে আসার ভাড়াও দিচ্ছে। বেয়াদব কোথাকার! রিক্সায় যে চড়িস বাবার টাকায়, তোর কোন লজ্জা আছে? কাল থেকে রিক্সা চালাতে যাস, তাও কিছু রোজগার  করতে পারবি। এখন বল, স্কুল শেষে কোথায় গিয়েছিলি আজ? না হলে ৫০০ বার কান ধরে দাড় করিয়ে রাখব।
আমি স্যারের কথার কোন উত্তর না দিয়ে কান ধরে উঠা বসা শুরু করলাম। কারণ, তিনি ধরে বসে আছেন আমার স্কুল একটায় ছুটি হয়েছে। আর আমি এক ঘণ্টা কুড়ি মিনিট কোথাও কাটিয়ে এসেছি। অথচ আমি জানি আমি এক মিনিট সময়ও কোথাও বাড়তি কাটাইনি। কিন্তু ওনাকে এখন এই কথা বোঝানো সম্ভব নয়। এর চেয়ে বিনা বাক্য ব্যয়ে শাস্তি মেনে নেয়াই ভাল। ৫০০ বার, হাজার বার কান ধরা এখন আর আমার কাছে কোন বিষয় নয়। বরং চড়-থাপ্পড় খেতেই আমার আপত্তি।
কিন্তু অর্ণবের ব্যাপারটা আমি ভেবে পেলাম না। ও কি সত্যিই স্যারকে বলেছে একটায় স্কুল ছুটি হয়? কেন বলবে এই কথা? নাকি স্যারই বানিয়ে বানিয়ে বলছে? কিন্তু একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না। স্যার বদমেজাজী হলেও তো মিথ্যুক নন। তাহলে অর্ণব কেন বলবে এ কথা!
অর্ণব অবশ্য স্যারের কাছে আমার নামে কথা বলার সুযোগ পেলে ছাড়ে না। কিন্তু সেও তো মিথ্যে বলে না! এই তো কিছুদিন আগে ফুটবল বিশ্বকাপ গেল। আমি ব্রাজিলের একটা পতাকা কিনেছিলাম ১৫ টাকা দিয়ে। সেটাও বাবা কিনে দিয়েছিলেন। বাবা আমার আবদারে তেমন বাধা দিতেন না, তাই চাইতেই কিনে দিয়েছিলেন। সেই পতাকাটা অর্ণব আমাদের বাসায় এসে দেখেছে। অর্ণব নিজেও ব্রাজিলের সমর্থক। আর আমাদের আরেক কাজিন সাজু, সেও ব্রাজিলের পাগলা সমর্থক। আমরা সবাই মিলে ব্রাজিলের খেলাও দেখেছি টিভিতে। কিন্তু অর্ণব যে পতাকা কেনার ব্যাপারটি মদন স্যারকে বলে দেবে আমি সেটা ভাবিনি।
মদন স্যারও কিছু বলেননি কয়েকদিন। যেদিন ফাইনাল খেলা ছিল বিশ্বকাপের সেদিন মদন স্যার পড়াতে এলেন বিকেলে। আমি যদিও ব্রাজিলের সমর্থক, কিন্তু খেলা দেখতেই হবে- ব্যাপারটা এমন নয়। ব্রাজিলের খেলা দেখার চেয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলা দেখা আমার কাছে অনেক আনন্দের। ফাইনালের দিন মদন স্যার এসে আমাকে বললেন, কী করছিলিস এতক্ষণ?
সেদিন ছিল শুক্রবার। দুপুর বেলা ভাত খেয়ে আমি শুয়ে শুয়ে ‘কম্পিউটার’ রচনাটি পড়ছিলাম। রচনাটি আমার মুখস্থ। তাও আমি অবসরে কিংবা সুযোগ পেলেই এটা পড়ি। আমার খুব শখ একটি কম্পিউটারের। কিন্তু জানি, বাবা হয়ত আমাকে কম্পিউটার কিনে দেবেন না।। তাই কম্পিউটারের রচনা পড়েই দুধের সাধ ঘোলে মেটাই। স্যারকে রচনা পড়ার ব্যাপারটা বলতেই বললেন, নাকি খেলা দেখছিলিস?
আমি টিভি দেখছিলাম না। কারণ, খেলা আরম্ভ হবে আরো দেড় ঘণ্টা পরে। তাই টিভির সামনে আরো পরে গেলেও চলত।
আমি বললাম, সত্যিই পড়ছিলাম। টিভি দেখছিলাম না।
স্যার বললেন, ঠিক আছে। যে রচনা পড়ছিলিস, সেটা আমাকে লিখে দেখা।
আমি আনন্দিত মনেই লিখতে বসলাম। কারণ, আমি এই রচনাটি দাঁড়ি কমাসহ মুখস্থ লিখতে পারি। স্যারকে আমি প্রায় আধাঘণ্টা লাগিয়ে পুরোটাই লিখে দিলাম। স্যার তাও মনে করলেন আমি দেখে দেখে লিখেছি। এরপর অংক নিয়ে বসলেন। স্যার প্ল্যান করেই এসেছেন আজ আমায় বিশ্বকাপের ফাইনাল দেখতে দেবেন না। খেলা যতক্ষণ চলবে আমাকে পড়াবেন। আমি বুঝতে পেরে স্যারকে জিজ্ঞেস করলাম, অর্ণবকে পড়াবেন না আজ?
স্যার উত্তর দিলেন, আজ বিশ্বকাপের ফাইনাল দেখবে অর্ণব। তাই কাল বেশি করে পড়ে আজকের জন্য ছুটি নিয়েছে। তোকে তো কাল বেশি পড়াতে পারি  নি, তাই আজ বেশি করে পড়িয়ে দেব।
স্যার এরপর পতাকার কথা ওঠালেন। বললেন আমি পড়ালেখা ছাড়া আর সব ব্যাপারেই আগ্রহ দেখাই। তাই আজ খেলে না দেখাটা আমার শাস্তি।
আমি সেদিন সত্যিই অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম। খেলা না দেখতে পারার জন্য নয়, অর্ণবের ব্যবহারে। স্যার নিজেই বলেছিলেন অর্ণবই স্যারকে এই কথা জানিয়েছে। পতাকা কেনার জন্য শাস্তিস্বরূপ সেদিন আমাকে আরো ৬০০ বার কান ধরে বসতে হল।
আমি ধরেই নিয়েছিলাম পৃথিবীতে আমার আসার একমাত্র কারণ মদন স্যারের কাছে কান ধরে ওঠা বসা করা। এছাড়া তো আর কোন কারণ খুঁজে পাই না।
এসব ভাবতে ভাবতেই শুনতে পেলাম স্যার বলছেন, কত বড় বেয়াদব, আমার কথার উত্তর না দিয়ে বেয়াদবি করে! আমি আজকেই তোর বাবার কাছে বলব। দাঁড়া, তোকে দেখাচ্ছি মজা।
আমি এবার সত্যিই খুশি হলাম। কারণ, আজ বাবার কাছে স্যার যদি কমপ্লেন করেন, তাহলে আমিও বাবাকে সত্যিটা বলার সুযোগ পাব।   
স্যার একগাদা অঙ্ক করিয়ে, আরো একগাদা অঙ্ক বাড়িতে করার জন্য দিয়ে চলে গেলেন। আমি সারা বিকেল বসে বসে অংকগুলো করার চেষ্টা করলাম। বিকেলে কিছুক্ষণ তারা বাংলায় ‘নন্টে ফন্টে’ সিরিয়াল দেখলাম। টিভিতে দেখার মধ্যে দেখি এই ‘নন্টে ফন্টে’ সিরিয়াল আর বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলা হলে সেটা। তবে সারাক্ষণই মনের মধ্যে ভয় হচ্ছিল। মদন স্যার বাবাকে কী নালিশ করেন কে জানে! যদি বাবা আজ মার দেন বাসায় ফিরে? এমনিতে বাবা কখনো গায়ে হাত তুলেছেন এমনটা মনে করতে পারি না।

সাতটার দিকে হান্নান স্যার এলেন। হান্নান স্যার আমাকে ইংরেজি পড়ান। আমাকে একদম ছোটবেলা থেকেই পড়াতেন। তাই শাসনের চাইতেও আদরটাই বেশি পেয়েছি স্যারের কাছে। হান্নান স্যার ইংরেজি খুব ভাল পড়ান। পড়ানোর পাশাপাশি কিছুক্ষণ গল্প করলেন। স্যার থাকা অবস্থাতেই বাবা এলেন। ভেতরে গিয়ে কথাবার্তা বলছেন আমি সব শুনতে পাচ্ছি। তারপর টিভিতে খবর দেখতে বসলেন।
স্যার চলে যাওয়ার পর দুটো বিস্কুট খেয়ে আবার পড়তে বসলাম। সারাদিন পড়তে পড়তে একঘেয়েমি বোধ হচ্ছিল। একটু টিভি দেখতে ইচ্ছে করলেও বাবার ভয়ে গেলাম না।
ভাত খেয়ে ঘুমাতে গেলাম, তাও বাবা কিছু বললেন না। স্বাভাবিকভাবেই কথাবার্তা বলতে লাগলেন। তবে কি মদন স্যার বাবাকে কিছু বলেন নি? আমি শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলাম। আগামীকাল স্কুলের কী কী পড়া ভাবার শুরুতেই মনে পড়ল কাল তো শুক্রবার। ছুটির দিন! আমার জীবনে যে ছুটির দিন বলে কিছু আছে, তাই ভুলে যাচ্ছি ধীরে ধীরে!



সাইক্লোন
      অর্পণ উপাধ্যায়

ওই সাইক্লোন আসে, অতি উচ্ছ্বাসে,
বুকে বজ্রধ্বনি।
আঁধার দিবসেও ম্লান আলোকেও
অতি উজ্জ্বল তুমি।।

কথায় তোমার  সাইক্লোন বাণী,
মুখেতে সুরের ঝংকার।
তুমি আমাদের প্রিয় নজরুল,
তুমি দেশের অহংকার।।

তোমার সুরে জুড়ায় প্রাণ,
মন্দ্রিত হয় মন।
তোমার ভাষায় চেতনা জাগে,
বিবেকের অনুরণন।।

তোমার বাণীতে মিলনের গান,
বীণাতে তোমার সুর।
তুমি আমাদের মানব নজরুল,
সাইক্লোন সুমধুর।।

সেই সাইক্লোন আসুক আবার
ধ্বনিত হোক ধরা।
তুমি নজরুল আবার এসো,
ধন্য হই আমরা।।


 প্রশ্ন
      - গণেশ দেবরায়

বাইরে বৃষ্টি পড়ছে
কখনো ইলশে গুঁড়ো কখনো মুসলধারে
 প্রকৃতির কান্না আর থামছে না।

গৃহবন্দী মানুষের জ্বলছে হৃদয়
করোনা আমফান নিসর্গ পঙ্গপাল
আর ভূমিকম্পের প্রচন্ড তান্ডবে।

ভুলটা কোথায় ভুলটা কার ?
 সব থামবে কখন !
কখন শুরু হবে আবার পথচলা?

প্রশ্ন গুলো বাতাসের কানে কানে ভাসছে।




             নতুনের সন্ধানে
                                  রীতা চট্টোপাধ্যায়

 প্রবাহমান উষ্ণ পারদ নিমেষে নেমে আসে সভ্যতার গা বেয়ে;
বর্তমান উত্তাপের গতি রোধ করে চলমান সময়,
প্রতিটি জীবনের প্রবাহমাত্রায় সৃষ্টি হয় প্রতিরোধ,
চলমান জীবনপ্রবাহে সুখ খুঁজে ফেরে মূহুর্ত,
জীবন যন্ত্রণায় দগ্ধ হ'য়েও উষ্ণ চিত্তে দিন    কাটে।
শীত অনুভূত হয় না ছন্দবদ্ধ জীবনের।  খাঁজে,
নতুন যাতনার অপেক্ষায় ভাবনার   বহি:প্রকাশ ঘটে,
বাস্তবতার গলাটেপা আর্তনাদে মৃত্যু হয় কঠিন বিশ্বাসের,
সভ্যতার ঝড়ে উলটপালট হয় অস্তিত্বের শুভ্রতা,
সংকীর্ণ পথ বেয়ে নতুনের সন্ধানে মুছে যায় দাপুটে আঁধার।
 
             
    শিমুল গাছটি
     রিকি ঘোষ

নদীর ওপারে রয়েছে সেই শিমুল গাছটি
বুড়ো হয়েছে তবুও বেশ বলশালী,
নিলামে উঠেছে আজ অদৃশ্য চোখের জলে
রাখবে বড়ো দাম, বিবেকহীন কিছু প্রভাবশালী।

কিনবে কাটবে গড়বে ভিটে বাড়ি
মারবে হাজারও দৃশ্যহিন প্রাণ,
প্রাণের ওপর দাঁড়িয়ে হেন
গাইছে তারা ক্ষমতার গান।

আজ নাহয় তোমরা কাটবে আমায়
কাল যে কাটবে হাজারও গাছ,
বাচঁবো কেমনে বল, কি উপায়ে
তোমাদের বৃক্ষছেদন মন্ত্র হেন ধরেছে পাছ।

তোমরা মানবই উক্তি দাও যে
"গাছ লাগাও, প্রাণ বাঁচাও",
তবে লাগিয়েছো কবে কত গাছ
লোকদেখানো কর্ম করে, পেছন পেছন মিথ্যে রটাও।

কতই না করলাম যুদ্ধ
বেঁচে থাকার হেন প্রাণ ভিক্ষায়,
আমরা বাঁচলেই বাঁচবে তোমরা, ভেবেছো একবার
তাই শপথ নিয়ে যুক্ত হয় সকল স্তরের গাছ রক্ষায়।




      আলগা জীবন
 প্রলয় কুমার বিশ্বাস

জীবন এখন শামুক বাড়ি
উদ্দেশ্যহীন স্বপ্নালু চিন্তারা দলা পাকাচ্ছে ভেতরে
আর বাস্তব নতুন বোবা বউ

অলস ঘুঘুর মতো
পোড়া দুপুরে ভাতঘুম চোখে
বাকিটা বোকাবাক্স আর মুঠোফোন সামলায়

গ্রীষ্মের পড়ন্ত সোহাগী বিকেলে
এখন ফাঁকা মাঠ, নদী তীর
খাটিয়ায় বসে শুধু রোমন্থন লেখচিত্রের এলবাম

হঠাৎ কচ্ছপ গতি সময়ের একঘেয়েমি দূর করা রিংটোন
ওপার থেকে ভেসে আসে সন্দিহান কণ্ঠস্বর
"ভালো আছিস তো?" "ভালো আছে সবাই?"

আজ পৃথিবী দিন গুনছে ভালো থাকার......





      বাড়ি
   বিনয় ডাঙ্গর


তোমার মনে আছে কিনা জানিনা
আমাদের আলাপের ঠিক কিছুদিন পর,
আমরা একদিন সন্ধেবেলা
খোলা আকাশের নীচে
পাশাপাশি বসে একটা সুন্দর বাড়ি বানিয়েছিলাম।

তোমার উন্মাদনা ছিল সেই বাড়ির ছোট্ট বাগান।
আনমনা হয়ে ছোটাছুটি করবে বলে,
তুলে ফেলেছিলাম সমস্ত চৌকাঠ।
এ ঘর ও ঘর জুড়ে পড়ে ছিল
আমাদের আত্মতুষ্টি,
আমাদের প্রেম।

তোমার প্রতিশ্রুতিতে গাঁথা হল একেকটি ইট,
তোমার হৃদয়ের স্পর্শে প্রতিটি দেয়াল হল প্লাস্টার।
এক মুহূর্তে
পরস্পরের চুম্বনে সুন্দর গোলাপী রঙ
লাগল সমস্ত বাড়ির আনাচে কানাচে।
যতবার জড়িয়ে ধরলে খোলা আকাশের নীচে,
আমাদের ব্যালকনি হাওয়ায় ভরে গেল।
আমাদের অগোছালো উঠে দাঁড়ানোয়
আলো জ্বলে উঠলো বাড়ির উঠোনে।
পরস্পরের চিবুকে দাঁত দিয়ে লেখা হল,
আমাদের সেই নতুন নির্মিত বাড়ির ঠিকানা।

তারপর থেকে শুধু বৃষ্টি হয়েছে পৃথিবী জুড়ে
কালো, অন্ধকার, গভীর অথচ নিরন্তর বৃষ্টি

               মুছে গেছে আমাদের বাড়ির ঠিকানা।

মাঝে মাঝে যখন বৃষ্টি ক্লান্ত হয়ে এসেছে,
নিজেই কেঁদে উঠেছি
      মধ্যরাত্রির আকাশে।

খোলা আকাশ।

চিবুকে রেখেছি হাত,
দাঁত বের করে খুঁজেছি তোমার চিবুক,
কোথাও ঠিকানা নেই      আমাদের সেই বাড়িটার।

চারিদিকে অন্ধকার।

কি লিখেছিলে তুমি?
কি কালি ছিল তোমার দাঁতে?
একটা আস্ত বাড়ির ঠিকানা
কয়েক ফোঁটা বৃষ্টির জলে
এভাবে মুছে গেল
  আমার চিবুক থেকেও!



     বেলফুল গাছ
    পিয়ালী গোস্বামী

দেখো অনিমেষ কি সুন্দর গাছটির নতুন পাতা গজিয়েছে। এবার নিশ্চয় গত বারের মতোই ফুল ফুটবে। অনিমেষ বলল দেখ তোমার গাছ কি বলে।আমি কি বলব, আচ্ছা মনে আছে তোমার ঠিক রাত ৮টা বাজলেই গন্ধে ম ম করত সারা ছাত। এবার নিশ্চয় আরো ফুল হবে বলো, কি জানি বলতে বলতে অনিমেষ পিঠে হালকা হাত ছুঁয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল।আমি গাছটিকে যত্নকরে সামান্য জল দিয়ে নীচে নেমে এলাম।কেন জানিনা বাকি ফুলগাছের থেকে বেলফুল গাছটিই আমার সবথেকে প্রিয় ছিল গোলাপপুর বাগানের। একসপ্তাহ অতিবাহিত হল গাছের কোন পরিবর্তন নেই। দুসপ্তাহের মধ্যে গাছটি মারা গেল। খুব মন ভারী হয়ে গেল।টব সমেত গাছটা রেখে দিলাম ছাতের এককোণে। মারা যাওয়া গাছটা উপড়ে ফেলতে মন চাইল না। অনিমেষ বলল ছাড় তো অন্য একটা আনলেই হল। গাছ জন্মালে মারা ও যায় মন খারাপ করো না। আমি ছাতে গাছ পরিচর্যা করতে গেলেই ওই টবটার দিকে তাকাই। আর গন্ধ মাখা ফুলগুলি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। এভাবে দিনগুলি চলে যায়। আস্তে আস্তে বেদনাময় স্মৃতি মুছে গেল। আজ সন্ধ্যায় হঠাৎ লোডশেডিং। অনিমেষকে বললাম ছাতে যাবে। ও বলল আমি একটু পরে যাচ্ছি তুমি যাও। আমি ছাতে গিয়ে দেখলাম সারা ছাত পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় আলোকিত হচ্ছে। কি অপূর্ব দৃশ্য। বেশ কিছুক্ষণ পায়চারি করলাম। মনটাও বেশ প্রফুল্ল আজ। এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ একটা মিষ্টি মনমাতানো গন্ধ ভেসে এলো নাকে। অনুভব করলাম খুব চেনা। হয়তো আশপাশ থেকে আসছে। গন্ধটা আরো ঘনীভূত হচ্ছে। গাঢ় থেকে গাঢ়তর হচ্ছে। ফোনটা হাতেই ছিল। দেখলাম ৮টা ১০মিনিট এবার ফোনের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালিয়ে চারিদিক দেখতে লাগলাম। ছাতের এক কোণে রাখা মরা বেলফুল গাছটার দিকে আলো ফেলতেই সারা শরীর শিহরিত হল। দেখলাম  গাছটা সাদা বেলফুলে ভরে উঠেছে। আর দুলছে নিজের ছন্দে। আমি ভয় পেয়ে সজোড়ে চিৎকার করলাম অনিমেষ....





1 comment:

  1. ধারাবাহিক উপন্যাস এ 'স' টি দিন।টাইপ ভুল হয়েছে

    ReplyDelete