নির্মলেন্দু কুন্ডুর অনুকবিতা
১)
আশ্রয়
জানলা দিয়ে যে ছাতিমটা দেখা যায়
আমি তার ছায়া হতে চেয়েছিলাম ৷
এখন বসন্ত শেষে
আমারই চিতা সাজায় ছাতিমকাঠ ৷
২)
রঞ্জক
রঞ্জক লাগালেই
বদলে যায় চরিত্র,
অথচ আশু মুহূর্তে
জীবন থেকে যায় সাদা-কালো ৷
৩)
সময়
সময় চলে গেলে
থেকে যায় খড়কুটো,
ডুব থেকে বাঁচবার গল্পগুলো
গল্প থেকে যায় ৷
৪)
মশারি
দেওয়াল ভাঙার মন্ত্র পড়েও
দেওয়াল টাঙাই ঘরে
সত্যি শুধু মশারি—
ঘরের মধ্যে আরেকখানা ঘর ৷
৫)
সমীকরণ
একটা সমীকরণ বদলালে
বদলায় অনেক কিছুই,
সমীকরণটা সম্পর্কের—
খাদ্য-খাদকের...
কাঙালের ধন চুরি
জহরলাল দাস
করোনা মহামারীর কারনে দুনিয়া জোড়া লকডাউন। সবকিছুই বন্ধ। কাজকর্ম হারিয়ে শ্রমজীবি মানুষগুলোর আয়-উপার্জন, রুজি রোজগার কিছুই নেই। এই মহাবিপদের দিনে সাধারণ দরিদ্র শ্রমজীবি মানুষের মধ্যে সরকারি বেসরকারি স্তরে চলছে ত্রানবন্টন। মহাসন্কটের এই দিনে যে যেমন পারে দিচ্ছে আবার যে যেভাবে পারে নিচ্ছে।
আমাদের পাড়ার রিক্সাচালক মহিম তার এত দারিদ্র্যতা, অভাবের মধ্যে ও গতকাল পাড়ার একশটি দুঃস্থ পরিবারের মধ্যে চাল,ডাল,তেল, নুন ইত্যাদি বিলিবন্টন করে। পাড়ার মধ্যবিত্ত কৃষক লোভী, হাড়কিপটে রঘু কপালীও গায়ে ছেঁড়া জামা জড়িয়ে ত্রাণসামগ্রী নিতে লাইনে দাঁড়ায়। মহিমের ত্রানবন্টনের ছবি মিডিয়ার কল্যানে সারাদুনিয়ার মানুষ দেখল।
সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো ত্রান নিতে আসা মানুষের লাইনে ছেঁড়া জামা গায়ে রঘুকপালীকেও দেখল।পরদিন সন্ধ্যায় টি.ভি তে রঘু কপালী দেখছে মহিম মূখ্যমন্ত্রীর হাত থেকে তার এই মহান কাজের স্বীকৃতি স্বরুপ পুরস্কার নিচ্ছে। পাশের ঘরে তার ছোট ছেলে সুর করে পড়ছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই কবিতাটি---"এ জগতে হায় সেই বেশি চায় আছে যার ভুরি ভুরি,
রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।"
জীবন কথা
অনির্বান দাস
জীবনে চলার পথে হয় নতুন কিছু শেখা -
তারমধ্যেই হয় জীবনের নতুন গল্প লেখা।
নতুন জীবনে শুরু হয় নতুন পথ চলা,
নতুন জীবনেই হয় নতুন কথা বলা।
নব সৃষ্টির মাধ্যমে হয় নব জীবনের দেখা,
তারমধ্যেই আঁকা হয় মোদের জীবন রেখা।।
হাড় কেপ্পন
ডঃ রমলা মুখার্জী
বিধবা পারুলবালা তাঁর দুটি কন্যার কাছাকাছি বিয়ে দিয়েছেন মোটামুটি ঘর দেখে,কিন্তু ছোট কন্যা কেয়ার বিয়ে ঠিক হল কিন্নাহারে,ছেলে চাকরি করে দিল্লীতে। দুই জামায়ের সহযোগিতা আর নিজের জমানো শেষ পুঁজি দিয়ে কেয়ার বিয়ে দিলেন পারুলবালা।দিন কয়েক কিন্নাহারে থেকে সেখান থেকেই সোজা কেয়া স্বামীর সাথে চলে এল দিল্লী,স্বামীর কোয়ার্টারে। কিন্তু তার জামাইবাবুদের থেকে অনেক বেশি রোজগার করেও
কেয়ার স্বামী সুজয় তার অতি মিতব্যয়িতার কারণে বাইরে বেড়ানো,খাওয়া তো দূরে থাক,একটা কাজের লোক পর্যন্ত রাখে না।পারুলবালা অনেক কষ্টের মধ্যে মেয়েদের মানুষ করেছেন,বিয়ে দিয়েছেন,তাই মাকে কিছুই জানায় না কেয়া।সন্তানসম্ভবা কেয়াকে দুটো ফল এনেও কোনদিন খাও বলেনি সুজয়।ভীষণ মনে কষ্ট পেত কেয়া।ছেলে অরণ্য হল সাধারণ হাসপাতালে।কিন্তু কপাল ভালো কেয়ার,অরণ্য পড়াশোনায় খুবই ভালো।সুজয়ই অরণ্যকে পড়াতো,সুজয় নিজেও পড়াশোনায় বেশ ভালো ছিল।কোন প্রাইভেট ছাড়াই হায়ার সেকেন্ডারী ভালোভাবেই পাশ করলো অরণ্য।কিন্তু সুজয়ের কঞ্জুষতার কারণে ফিজিক্স অনার্স নিয়ে সাধারণ কলেজেই পড়তে হল অরণ্যকে।র্ফাষ্ট ক্লাস পেয়েও অরণ্য এম.এস.সি. না পড়ে আদাজল খেয়ে লাগল সরকারি চাকরির চেষ্টায়।মাকে একটু সুখে রাখার কল্পনায় সে দিন রাত এক করে পড়তে লাগল আর পরীক্ষা দিতে থাকল।
কেয়ার শরীরটাও দিন দিন বেশ খারাপ হয়ে পড়ছে। পেটে মাঝে মধ্যেই একটা ব্যথা হয়,কিন্তু সুজয় দোকানে বলে বড়ি এনে খাইয়ে দেয়।পয়সা খরচের ভয়ে একটা ডাক্তার পর্যন্ত দেখায় না।বছর দুয়েকের অদম্য চেষ্টায় অরণ্য কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে একটা করনিকের চাকরি পেয়ে গেল।প্রথম মাসের মাইনে পেয়েই মাকে নিয়ে গিয়ে ভালো ডাক্তার দেখালো ভুবনেশ্বরে,সেখানেই তার পোস্টিং।ডাক্তার দেখে বললেন যে জরায়ুতে টিউমার হয়েছে।বায়োপসিতে ক্যন্সার ধরা পড়ল কেয়ার।কিন্তু খুব খারাপ স্টেজ তখন; ডাক্তারবাবুরা বলেই দিলেন,"আগে আনলে হয় তো বাঁচানো যেত,কিন্তু এখন আর তা সম্ভব নয়"।মাস চারেক অসহনীয় কষ্ট পেয়ে কেয়া দেহ রাখল। বাবার প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা ও বিতৃষ্ণায় অরণ্য বাবার সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করল,এমন কি কেয়ার মৃত্যুর খবরও সে জানাল না সুজয়কে।মিউচুয়াল ট্রান্সফার নিয়ে চলে গেল মুম্বাই।
আত্মীয়স্বজনের কাছে কেয়ার মৃত্যুর খবর পেয়ে সুজয় ভুবনেশ্বরে ছুটে এল কিন্তু অরন্য সেখানে নেই। পাগল হয়ে সুজয় অরণ্য আর কেয়াকে খুঁজে বেড়াতে লাগলো।আজও সুজয় তাদের খুঁজে চলেছে......
নাম দিয়েছি অস্পষ্টতা
পিয়ালী গোস্বামী
১)
শান্তির খোঁজে,
অস্থিরতা নষ্ট হয়।
ধূলো জমলেও,
দূরত্ব ঘোচার নয়।।
২)
নদীর পাড়ে আগাছার আশ্রয়,
মাটি আঁকড়ে বাঁচে।
যতই প্লাবন আসুক,
ভাঙন না আসে।।
৩)
আবারও ক্ষত বিক্ষত,
শোকের ছায়া।
বাতাসের হাতছানি,
জীবন এক মায়া।।
৪)
জমছে নিকোটিন,
মিশছে বিষ।
অন্ধকার বাষ্প
কালো মেঘকে দিস।।
৫)
অসততার অতল গহ্বরে,
মুখোশ মানুষ চেনা যায়।
আমি পচা গন্ধ,
কর্মফল অভিশপ্ত হায়।।
আকাশ তো একই
তন্ময় চক্রবর্তী
–কী করছ এখন?
–ছাদে বসে আছে একা।আর তুমি?
–আমি!বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া সেই নদীর ধারে বসে আছি।
–বাঃ!দারুণ তো!এই আলো-আঁধারে নদীর ধারে!
–না।এখানে এখনো আঁধার নামেনি।সূর্য চলে গেছে অন্য পারে।নদীর স্রোতে তার রক্তিম আভা লেগে আছে চোখে!নদী খুঁজছে তাকে নাকি নদীকেই খুঁজছে সে–সেটাই বোঝার চেষ্টা করছি!
–তো,পেলে খুঁজে?
–না!পাইনি আজো বুঝে!তাই তো প্রতিদিন এই নদীর খুব কাছে এসে বসি!নদীর স্রোতে আলোর খেলা দেখি!
–খুব ইচ্ছে করছে জানো তোমার কাছে যেতে!খুব খুব ইচ্ছে করছে!
–আমারও!তুমি কী করছ ছাতে?শিশির পরছে না?
–পরছে।সেই শিশিরভেজা গল্পগুলোয় খুঁজছি আকাশে!কয়েক লাইন কবিতা লেখার চেষ্টা করছি!
–কয়েক লাইন কবিতা?
–কেন হয় না?তোমার ওই নদীটির মতো!একটি নদী–কত বাঁক,কত ভাঙন তবু বয়েই চলেছে!কত গভীরতা তার!কত গল্প কত কবিতা বয়ে নিয়ে চলেছে সে!
–হ্যাঁ, ঠিক তোমার মতো!পাতাগুলো উল্টেই যায় একটার পর একটা তবু লেখা শেষ হয় না!
–হ্যাঁ, কিছু কথা বাতাসে ভাসে
কিছু কথা কাছে আসে
কিছু কথা পথের ধূলায়!
কিছু প্রেম আজন্ম নিরুদ্দেশ
কিছু প্রেম আলনায় বেশ
কিছু প্রেম আমার রজনীগন্ধায়!
–কিছু কথা এভাবেই নদীর স্রোতে বয়ে যায় কিছু কথা পরে থাকে পাড়ে!আচ্ছা, নদীর দুই পাড় এক বলেই কি তারা কোনোদিন মিলতে পারে না?কাছে আসতে পারে না?
–কে বলল মিলতে পারে না!নদীই তো মিলিয়ে রেখেছে দুই পাড়কে।নদী মাঝে না থাকলে তখন তো দুই পাড় তখন শুধু মরুভূমি!
–কী সুন্দরভাবে তুমি সবকিছু মিলিয়ে দাও!
–হ্যাঁ, শুধু আকাশটাকে কোনোদিন মেলাতে পারলাম না দিগন্তে!ওই দেখো সারিসারি পাখি উড়ে চলেছে আকাশে!
–আকাশ!জানো,ছাতে বসে পশ্চিম আকাশে তাকিয়ে আছি।জ্বলজ্বল করছে একটি তারা!কী অপূর্ব তার আলো!
–হ্যাঁ, ওটা সন্ধ্যাতারা!আমিও দেখছি তোমারই মতো বহুদিন পরে আজ জ্বলজ্বল করছে!
–তুমিও দেখছ?
–হ্যাঁ, একই আকাশের নীচে বসে আছি তো!আকাশ তো একটাই!বসে আছি নদীর ধারে তোমার কবিতার খাতা হাতে নিয়ে!আর তোমাকেই দেখছি পশ্চিম আকাশে!আকাশ তো একটাই আমাদের!একটাই আকাশ!
জীবন মৃত্যু
হামিদুল ইসলাম
সুখের সংসারে দূরত্ব বেড়েছে আজ
কোথায় সুখ ?
ভয়ে আতঙ্কে কুঁকড়ে যাচ্ছে মানুষগুলো
ব্যথায় ভরেছে বুক ।।
নিজের ঘরে ঘরে আজ ঘরবন্দি জীবন
আকাশে মস্ত আতঙ্কের বোঝা
মৃত্যুকে বুকে নিয়ে প্রতিদিন বেঁচে আছে মানুষগুলো
মৃত্যুর মাঝে কেবল জীবনকে খোঁজা ।।
রূপান্তর
অগ্নিমিত্র ( ডঃ সায়ন ভট্টাচার্য)
দীপিকা আগে কথায় কথায় ইংরেজি বলে ফেলতো । তাকে একটু সাফ বাংলায় কথা বলানোই ছিল একটি চ্যালেঞ্জ!
বাবাকে ' ড্যাড ', মাকে ' মম্' , এসব বলতে বলতে সে পুরো মেমসাহেব হয়ে উঠল । সকালের জলখাবার খায় না, ' ব্রেকফাস্ট ' করে। দুপুরে ' লাঞ্চ' ও রাতে ' ডিনার'।
একদিন হঠাৎ করেই দীপিকার বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। পাত্র অয়ন, নাকি খুব ভালো ছেলে ।..এর পর ছ' মাস পরে আবার বাপের বাড়ি ফিরল দীপিকা! কিন্তু ততক্ষণে সে আমূল পরিবর্তিত!
' বাবা'কে প্রণাম করছে, ' মা'র সাথে হেসে কথা বলছে ।
বলি -' কী করে হলো?'
দীপিকা হেসে বলে -' শর্ত দিয়েছে! আমি তাই....।'
কথা আটকে গেল।।
স্বাভাবিক জীবন
কল্যাণ সেনগুপ্ত
অনেকদিন বাদে নিচে নেমেছি। আহা ! কতদিন বাদে, যেন দীর্ঘ অসুখে আটকে ছিলাম বাড়িতে। ছোট বেলায় মাঝে মাঝে টাইফোয়েড, ডেঙ্গু, pox , হলে অনেকদিন বাদে নিচে নেমে যেমন আনন্দে নেচে উঠতাম তেমনি লাগল। রাস্তা ফুটপাত এখনো তেমনি খালি খালি। দূরে দূরে হাঁটছে ।এই প্রথম মনেহল সবাই নামলে ত রাস্তা, ফুটপাত টা আরো বড় করতে হবে । নাহলে আটবে কেন?
সাত সকালে রোয়াকে বসে নোধো দা।
বললাম - কেমন আছো দাদা?
দিব্যি আছি চিতু। তুই?
মনেহচ্ছে নোধো দার সাথে দেশের অন্য জায়গায় দেখা হলো। বললাম - তোমাকে দেখে খুব ভালো লাগছে।খুব ফ্রেশ লাগছে তোমাকে।রহস্য টা কি?
মুচকি হেসে সামনে একটা বাচ্চা দের বল এসেছিল সেটাতে শট মেরে বললে- বুঝলি এই লকডাউনে প্রচুর মানুষের, এমনকি আমারও খুব অসুবিধা হল কিন্তু জানিস তো আমার একটা বড় উপকার ও হল।যা আমি জীবনে পারতাম না।
বললাম -তোমাকে দেখেই তাই এত ফ্রেশ লাগছে। তোমাকে ত এই সাত সকালে কবে দেখেছি রোয়াকে মনে নেই।
ঠিক ধরেছিস। আমার পিঠে হাত বুলিয়ে বলে -
ওরা খেতেই পাচ্ছেনা দুবেলা আর বাংলা কি বানাবে? মাঝখান থেকে আমি পুরো সাধু পূরুষ হলে গেলাম।
অসুবিধা হোয়নি?
খুব হয়েছে ।খুব কষ্ট হয়ছে।আর হলেই জানিস ত আমি টিভি খুলে মৃত্যুর মিছিল দেখতাম।তাতে কষ্ট টা কমত। অনেকদিন ত তাই আসতে আস্তে কষ্ট টা কমেছে।
আর খাবে?
মা কালীর দিব্যি। আর না ওই পথে। এত সুন্দর জীবন ত অদেখাই রয়ে যেত।
শুনে মনটা ভরে গেল।কেউ ত ভালো হোয়েচে।এই নাহলে এমন করে দাদা কে দেখতে পেতাম?
কিছুদিন চলে গেছে।জীবন অনেক স্বাভাবিক হলে এসেছে।পথে ঘাটে অভুক্ত মানুষের ভিড় বেড়েছে। বলে আর নাবলে চুরি ডাকাতি বেড়েছে।
সন্ধ্যে বেলা অফিস থেকে ফিরে কাগজ পড়ছি। কানে এল গুন গুন করে কে যেন গাইছে রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে " কে আবার বাজায় বাঁশি এ ভাঙ্গা"
বাইরে গিয়ে দেখি সেই পুরনো ছবি। আধো আলোয় নোধোদা টলতে টলতে যাচ্ছে আর গাইছে। কেউ তাকে দেখছে না।চেয়ে রইলাম যতক্ষণ দেখা যায়।
শহরটা স্বাভাবিক হচ্ছে।তাহলে অন্তত যারা বাংলা বানায় তারা ভাত খেয়ে কিছু পড়ে থাকছে বাংলা বানাতে। নোধো দা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেছে।
১)
আশ্রয়
জানলা দিয়ে যে ছাতিমটা দেখা যায়
আমি তার ছায়া হতে চেয়েছিলাম ৷
এখন বসন্ত শেষে
আমারই চিতা সাজায় ছাতিমকাঠ ৷
২)
রঞ্জক
রঞ্জক লাগালেই
বদলে যায় চরিত্র,
অথচ আশু মুহূর্তে
জীবন থেকে যায় সাদা-কালো ৷
৩)
সময়
সময় চলে গেলে
থেকে যায় খড়কুটো,
ডুব থেকে বাঁচবার গল্পগুলো
গল্প থেকে যায় ৷
৪)
মশারি
দেওয়াল ভাঙার মন্ত্র পড়েও
দেওয়াল টাঙাই ঘরে
সত্যি শুধু মশারি—
ঘরের মধ্যে আরেকখানা ঘর ৷
৫)
সমীকরণ
একটা সমীকরণ বদলালে
বদলায় অনেক কিছুই,
সমীকরণটা সম্পর্কের—
খাদ্য-খাদকের...
কাঙালের ধন চুরি
জহরলাল দাস
করোনা মহামারীর কারনে দুনিয়া জোড়া লকডাউন। সবকিছুই বন্ধ। কাজকর্ম হারিয়ে শ্রমজীবি মানুষগুলোর আয়-উপার্জন, রুজি রোজগার কিছুই নেই। এই মহাবিপদের দিনে সাধারণ দরিদ্র শ্রমজীবি মানুষের মধ্যে সরকারি বেসরকারি স্তরে চলছে ত্রানবন্টন। মহাসন্কটের এই দিনে যে যেমন পারে দিচ্ছে আবার যে যেভাবে পারে নিচ্ছে।
আমাদের পাড়ার রিক্সাচালক মহিম তার এত দারিদ্র্যতা, অভাবের মধ্যে ও গতকাল পাড়ার একশটি দুঃস্থ পরিবারের মধ্যে চাল,ডাল,তেল, নুন ইত্যাদি বিলিবন্টন করে। পাড়ার মধ্যবিত্ত কৃষক লোভী, হাড়কিপটে রঘু কপালীও গায়ে ছেঁড়া জামা জড়িয়ে ত্রাণসামগ্রী নিতে লাইনে দাঁড়ায়। মহিমের ত্রানবন্টনের ছবি মিডিয়ার কল্যানে সারাদুনিয়ার মানুষ দেখল।
সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো ত্রান নিতে আসা মানুষের লাইনে ছেঁড়া জামা গায়ে রঘুকপালীকেও দেখল।পরদিন সন্ধ্যায় টি.ভি তে রঘু কপালী দেখছে মহিম মূখ্যমন্ত্রীর হাত থেকে তার এই মহান কাজের স্বীকৃতি স্বরুপ পুরস্কার নিচ্ছে। পাশের ঘরে তার ছোট ছেলে সুর করে পড়ছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই কবিতাটি---"এ জগতে হায় সেই বেশি চায় আছে যার ভুরি ভুরি,
রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।"
জীবন কথা
অনির্বান দাস
জীবনে চলার পথে হয় নতুন কিছু শেখা -
তারমধ্যেই হয় জীবনের নতুন গল্প লেখা।
নতুন জীবনে শুরু হয় নতুন পথ চলা,
নতুন জীবনেই হয় নতুন কথা বলা।
নব সৃষ্টির মাধ্যমে হয় নব জীবনের দেখা,
তারমধ্যেই আঁকা হয় মোদের জীবন রেখা।।
হাড় কেপ্পন
ডঃ রমলা মুখার্জী
বিধবা পারুলবালা তাঁর দুটি কন্যার কাছাকাছি বিয়ে দিয়েছেন মোটামুটি ঘর দেখে,কিন্তু ছোট কন্যা কেয়ার বিয়ে ঠিক হল কিন্নাহারে,ছেলে চাকরি করে দিল্লীতে। দুই জামায়ের সহযোগিতা আর নিজের জমানো শেষ পুঁজি দিয়ে কেয়ার বিয়ে দিলেন পারুলবালা।দিন কয়েক কিন্নাহারে থেকে সেখান থেকেই সোজা কেয়া স্বামীর সাথে চলে এল দিল্লী,স্বামীর কোয়ার্টারে। কিন্তু তার জামাইবাবুদের থেকে অনেক বেশি রোজগার করেও
কেয়ার স্বামী সুজয় তার অতি মিতব্যয়িতার কারণে বাইরে বেড়ানো,খাওয়া তো দূরে থাক,একটা কাজের লোক পর্যন্ত রাখে না।পারুলবালা অনেক কষ্টের মধ্যে মেয়েদের মানুষ করেছেন,বিয়ে দিয়েছেন,তাই মাকে কিছুই জানায় না কেয়া।সন্তানসম্ভবা কেয়াকে দুটো ফল এনেও কোনদিন খাও বলেনি সুজয়।ভীষণ মনে কষ্ট পেত কেয়া।ছেলে অরণ্য হল সাধারণ হাসপাতালে।কিন্তু কপাল ভালো কেয়ার,অরণ্য পড়াশোনায় খুবই ভালো।সুজয়ই অরণ্যকে পড়াতো,সুজয় নিজেও পড়াশোনায় বেশ ভালো ছিল।কোন প্রাইভেট ছাড়াই হায়ার সেকেন্ডারী ভালোভাবেই পাশ করলো অরণ্য।কিন্তু সুজয়ের কঞ্জুষতার কারণে ফিজিক্স অনার্স নিয়ে সাধারণ কলেজেই পড়তে হল অরণ্যকে।র্ফাষ্ট ক্লাস পেয়েও অরণ্য এম.এস.সি. না পড়ে আদাজল খেয়ে লাগল সরকারি চাকরির চেষ্টায়।মাকে একটু সুখে রাখার কল্পনায় সে দিন রাত এক করে পড়তে লাগল আর পরীক্ষা দিতে থাকল।
কেয়ার শরীরটাও দিন দিন বেশ খারাপ হয়ে পড়ছে। পেটে মাঝে মধ্যেই একটা ব্যথা হয়,কিন্তু সুজয় দোকানে বলে বড়ি এনে খাইয়ে দেয়।পয়সা খরচের ভয়ে একটা ডাক্তার পর্যন্ত দেখায় না।বছর দুয়েকের অদম্য চেষ্টায় অরণ্য কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে একটা করনিকের চাকরি পেয়ে গেল।প্রথম মাসের মাইনে পেয়েই মাকে নিয়ে গিয়ে ভালো ডাক্তার দেখালো ভুবনেশ্বরে,সেখানেই তার পোস্টিং।ডাক্তার দেখে বললেন যে জরায়ুতে টিউমার হয়েছে।বায়োপসিতে ক্যন্সার ধরা পড়ল কেয়ার।কিন্তু খুব খারাপ স্টেজ তখন; ডাক্তারবাবুরা বলেই দিলেন,"আগে আনলে হয় তো বাঁচানো যেত,কিন্তু এখন আর তা সম্ভব নয়"।মাস চারেক অসহনীয় কষ্ট পেয়ে কেয়া দেহ রাখল। বাবার প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা ও বিতৃষ্ণায় অরণ্য বাবার সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করল,এমন কি কেয়ার মৃত্যুর খবরও সে জানাল না সুজয়কে।মিউচুয়াল ট্রান্সফার নিয়ে চলে গেল মুম্বাই।
আত্মীয়স্বজনের কাছে কেয়ার মৃত্যুর খবর পেয়ে সুজয় ভুবনেশ্বরে ছুটে এল কিন্তু অরন্য সেখানে নেই। পাগল হয়ে সুজয় অরণ্য আর কেয়াকে খুঁজে বেড়াতে লাগলো।আজও সুজয় তাদের খুঁজে চলেছে......
নাম দিয়েছি অস্পষ্টতা
পিয়ালী গোস্বামী
১)
শান্তির খোঁজে,
অস্থিরতা নষ্ট হয়।
ধূলো জমলেও,
দূরত্ব ঘোচার নয়।।
২)
নদীর পাড়ে আগাছার আশ্রয়,
মাটি আঁকড়ে বাঁচে।
যতই প্লাবন আসুক,
ভাঙন না আসে।।
৩)
আবারও ক্ষত বিক্ষত,
শোকের ছায়া।
বাতাসের হাতছানি,
জীবন এক মায়া।।
৪)
জমছে নিকোটিন,
মিশছে বিষ।
অন্ধকার বাষ্প
কালো মেঘকে দিস।।
৫)
অসততার অতল গহ্বরে,
মুখোশ মানুষ চেনা যায়।
আমি পচা গন্ধ,
কর্মফল অভিশপ্ত হায়।।
আকাশ তো একই
তন্ময় চক্রবর্তী
–কী করছ এখন?
–ছাদে বসে আছে একা।আর তুমি?
–আমি!বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া সেই নদীর ধারে বসে আছি।
–বাঃ!দারুণ তো!এই আলো-আঁধারে নদীর ধারে!
–না।এখানে এখনো আঁধার নামেনি।সূর্য চলে গেছে অন্য পারে।নদীর স্রোতে তার রক্তিম আভা লেগে আছে চোখে!নদী খুঁজছে তাকে নাকি নদীকেই খুঁজছে সে–সেটাই বোঝার চেষ্টা করছি!
–তো,পেলে খুঁজে?
–না!পাইনি আজো বুঝে!তাই তো প্রতিদিন এই নদীর খুব কাছে এসে বসি!নদীর স্রোতে আলোর খেলা দেখি!
–খুব ইচ্ছে করছে জানো তোমার কাছে যেতে!খুব খুব ইচ্ছে করছে!
–আমারও!তুমি কী করছ ছাতে?শিশির পরছে না?
–পরছে।সেই শিশিরভেজা গল্পগুলোয় খুঁজছি আকাশে!কয়েক লাইন কবিতা লেখার চেষ্টা করছি!
–কয়েক লাইন কবিতা?
–কেন হয় না?তোমার ওই নদীটির মতো!একটি নদী–কত বাঁক,কত ভাঙন তবু বয়েই চলেছে!কত গভীরতা তার!কত গল্প কত কবিতা বয়ে নিয়ে চলেছে সে!
–হ্যাঁ, ঠিক তোমার মতো!পাতাগুলো উল্টেই যায় একটার পর একটা তবু লেখা শেষ হয় না!
–হ্যাঁ, কিছু কথা বাতাসে ভাসে
কিছু কথা কাছে আসে
কিছু কথা পথের ধূলায়!
কিছু প্রেম আজন্ম নিরুদ্দেশ
কিছু প্রেম আলনায় বেশ
কিছু প্রেম আমার রজনীগন্ধায়!
–কিছু কথা এভাবেই নদীর স্রোতে বয়ে যায় কিছু কথা পরে থাকে পাড়ে!আচ্ছা, নদীর দুই পাড় এক বলেই কি তারা কোনোদিন মিলতে পারে না?কাছে আসতে পারে না?
–কে বলল মিলতে পারে না!নদীই তো মিলিয়ে রেখেছে দুই পাড়কে।নদী মাঝে না থাকলে তখন তো দুই পাড় তখন শুধু মরুভূমি!
–কী সুন্দরভাবে তুমি সবকিছু মিলিয়ে দাও!
–হ্যাঁ, শুধু আকাশটাকে কোনোদিন মেলাতে পারলাম না দিগন্তে!ওই দেখো সারিসারি পাখি উড়ে চলেছে আকাশে!
–আকাশ!জানো,ছাতে বসে পশ্চিম আকাশে তাকিয়ে আছি।জ্বলজ্বল করছে একটি তারা!কী অপূর্ব তার আলো!
–হ্যাঁ, ওটা সন্ধ্যাতারা!আমিও দেখছি তোমারই মতো বহুদিন পরে আজ জ্বলজ্বল করছে!
–তুমিও দেখছ?
–হ্যাঁ, একই আকাশের নীচে বসে আছি তো!আকাশ তো একটাই!বসে আছি নদীর ধারে তোমার কবিতার খাতা হাতে নিয়ে!আর তোমাকেই দেখছি পশ্চিম আকাশে!আকাশ তো একটাই আমাদের!একটাই আকাশ!
জীবন মৃত্যু
হামিদুল ইসলাম
সুখের সংসারে দূরত্ব বেড়েছে আজ
কোথায় সুখ ?
ভয়ে আতঙ্কে কুঁকড়ে যাচ্ছে মানুষগুলো
ব্যথায় ভরেছে বুক ।।
নিজের ঘরে ঘরে আজ ঘরবন্দি জীবন
আকাশে মস্ত আতঙ্কের বোঝা
মৃত্যুকে বুকে নিয়ে প্রতিদিন বেঁচে আছে মানুষগুলো
মৃত্যুর মাঝে কেবল জীবনকে খোঁজা ।।
রূপান্তর
অগ্নিমিত্র ( ডঃ সায়ন ভট্টাচার্য)
দীপিকা আগে কথায় কথায় ইংরেজি বলে ফেলতো । তাকে একটু সাফ বাংলায় কথা বলানোই ছিল একটি চ্যালেঞ্জ!
বাবাকে ' ড্যাড ', মাকে ' মম্' , এসব বলতে বলতে সে পুরো মেমসাহেব হয়ে উঠল । সকালের জলখাবার খায় না, ' ব্রেকফাস্ট ' করে। দুপুরে ' লাঞ্চ' ও রাতে ' ডিনার'।
একদিন হঠাৎ করেই দীপিকার বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। পাত্র অয়ন, নাকি খুব ভালো ছেলে ।..এর পর ছ' মাস পরে আবার বাপের বাড়ি ফিরল দীপিকা! কিন্তু ততক্ষণে সে আমূল পরিবর্তিত!
' বাবা'কে প্রণাম করছে, ' মা'র সাথে হেসে কথা বলছে ।
বলি -' কী করে হলো?'
দীপিকা হেসে বলে -' শর্ত দিয়েছে! আমি তাই....।'
কথা আটকে গেল।।
স্বাভাবিক জীবন
কল্যাণ সেনগুপ্ত
অনেকদিন বাদে নিচে নেমেছি। আহা ! কতদিন বাদে, যেন দীর্ঘ অসুখে আটকে ছিলাম বাড়িতে। ছোট বেলায় মাঝে মাঝে টাইফোয়েড, ডেঙ্গু, pox , হলে অনেকদিন বাদে নিচে নেমে যেমন আনন্দে নেচে উঠতাম তেমনি লাগল। রাস্তা ফুটপাত এখনো তেমনি খালি খালি। দূরে দূরে হাঁটছে ।এই প্রথম মনেহল সবাই নামলে ত রাস্তা, ফুটপাত টা আরো বড় করতে হবে । নাহলে আটবে কেন?
সাত সকালে রোয়াকে বসে নোধো দা।
বললাম - কেমন আছো দাদা?
দিব্যি আছি চিতু। তুই?
মনেহচ্ছে নোধো দার সাথে দেশের অন্য জায়গায় দেখা হলো। বললাম - তোমাকে দেখে খুব ভালো লাগছে।খুব ফ্রেশ লাগছে তোমাকে।রহস্য টা কি?
মুচকি হেসে সামনে একটা বাচ্চা দের বল এসেছিল সেটাতে শট মেরে বললে- বুঝলি এই লকডাউনে প্রচুর মানুষের, এমনকি আমারও খুব অসুবিধা হল কিন্তু জানিস তো আমার একটা বড় উপকার ও হল।যা আমি জীবনে পারতাম না।
বললাম -তোমাকে দেখেই তাই এত ফ্রেশ লাগছে। তোমাকে ত এই সাত সকালে কবে দেখেছি রোয়াকে মনে নেই।
ঠিক ধরেছিস। আমার পিঠে হাত বুলিয়ে বলে -
ওরা খেতেই পাচ্ছেনা দুবেলা আর বাংলা কি বানাবে? মাঝখান থেকে আমি পুরো সাধু পূরুষ হলে গেলাম।
অসুবিধা হোয়নি?
খুব হয়েছে ।খুব কষ্ট হয়ছে।আর হলেই জানিস ত আমি টিভি খুলে মৃত্যুর মিছিল দেখতাম।তাতে কষ্ট টা কমত। অনেকদিন ত তাই আসতে আস্তে কষ্ট টা কমেছে।
আর খাবে?
মা কালীর দিব্যি। আর না ওই পথে। এত সুন্দর জীবন ত অদেখাই রয়ে যেত।
শুনে মনটা ভরে গেল।কেউ ত ভালো হোয়েচে।এই নাহলে এমন করে দাদা কে দেখতে পেতাম?
কিছুদিন চলে গেছে।জীবন অনেক স্বাভাবিক হলে এসেছে।পথে ঘাটে অভুক্ত মানুষের ভিড় বেড়েছে। বলে আর নাবলে চুরি ডাকাতি বেড়েছে।
সন্ধ্যে বেলা অফিস থেকে ফিরে কাগজ পড়ছি। কানে এল গুন গুন করে কে যেন গাইছে রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে " কে আবার বাজায় বাঁশি এ ভাঙ্গা"
বাইরে গিয়ে দেখি সেই পুরনো ছবি। আধো আলোয় নোধোদা টলতে টলতে যাচ্ছে আর গাইছে। কেউ তাকে দেখছে না।চেয়ে রইলাম যতক্ষণ দেখা যায়।
শহরটা স্বাভাবিক হচ্ছে।তাহলে অন্তত যারা বাংলা বানায় তারা ভাত খেয়ে কিছু পড়ে থাকছে বাংলা বানাতে। নোধো দা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেছে।
No comments:
Post a Comment