শান্তগড়ের ভূত বিদায়
দিলীপকুমার মিস্ত্রী
শান্ত শান্তগড়ে হঠাৎ অশান্তির মেঘ জমেছে। অশান্তির একটিই কারণ- ভূত। সে আবার যে সে ভূত নয়, লংকাখেকো ভূত। এমন ভূত দেখা তো দূরের কথা, এর আগে কেউ কোনদিন লংকাখেকো ভূতের নাম পর্যন্ত শোনেনি। তাই শিশু থেকে বৃদ্ধ, লংকাখেকো ভূতের ভয়ে শান্তগড়ের সবাই একেবারে তটস্থ। এমনকি, রাজার সৈন্যরা পর্যন্ত এই অদ্ভুত ভূতের আতঙ্কে থরকম্পবান। তাই গভীর চিন্তায় পড়েছে শান্তগড়ের রাজা গাবুচন্দ্র পতি।
শান্তগড় সত্যিই এক শান্তির দেশ। রাজা গাবুচন্দ্র পতি ধার্মিক,দয়ালু এবং অত্যন্ত প্রজাবৎসল । এককথায়, তিনি প্রজাদের ভালো রাখতে সদা ব্যস্ত। তার রাজ্যে কোনো জুলুমবাজি নেই। সৈন্য-সামন্তেরদল ঘোড়ায় ছুটে বেড়ালেও রাজা গাবুচন্দ্র পতি কখনও ঘোড়া চড়ে না। তার প্রিয় যান গরুরগাড়ি। যুদ্ধ-সংঘাতে সে মোটেও জড়াতে চায় না। প্রজাদের সে সবসময় পরামর্শ দেয়, “নুন-ভাত খাও, যুদ্ধ ভুলে যাও।“
তবু রাজার সৈন্যবাহিনী আছে। আসলে, সৈন্য না থাকলে যে, রাজার রাজা-রাজা মনে হয় না। তাছাড়া, কিছু প্রজাকে কাজ-বাজও তো দিতে হয়। গাবুচন্দ্র পতি রাজার রাজত্বে কাজ বলতে তো ওই সামান্য ক’জন সৈন্য, আর হাতে-গোনা জনাকয়েক রাজকর্মচারি। ব্যাস ! সারা রাজ্যে মানুষের একটিই কাজ- চাষ। তাও আবার ওই লংকা চাষ। লংকা ছাড়া শান্তগড়ের মাটিতে আর কিছু তেমন চাষ হয়না বললেই চলে। তবে শান্তগড়ের লংকার খ্যাতি আছে বটে। প্রতিদিন পাশাপাশি রাজ্যগুলোতে শান্তগড়ের লংকা চালান হয়ে যায় ভালো দামে। মোটকথা, শান্তগড়ে প্রজারা সবাই সুখেই আছে। রাজা গাবুচন্দ্র পতিও প্রজাদের নিয়ে আনন্দে রয়েছে।
কিন্তু হঠাৎ শান্তগড়ে লংকাখেকো ভূতের আগমনে ঘরে ঘরে অশান্তি ঢুকে পড়েছে। রাজার কাছে রোজদিন অভিযোগ আসছে- চারদিক থেকে। রাজদরবারে অভিযোগের পাহাড় জমে গেছে। কিন্তু কেউ এর থেকে মুক্তির উপায় খুঁজে বের করতে পারছে না। রাজা নিজেও চিন্তায় পড়েছে। চিন্তার প্রধান কারণ, সে সৈন্যদের তেমনভাবে কড়া নির্দেশ দিতে পারছে না। না পারার কারণ, সে নিজেই ভূতকে ভীষণ ভয় পায়। তায় এ’আবার ভূত জগতের নতুন আমদানি লংকাখেকো ভূত। এঁনাদের ক্ষমতা সম্পর্কে কা’রও তেমন কোনো ধারণা বা অভিঙ্গতা একেবারেই নেই। তাছাড়া, রাজামশাই ভালো করে জানে,তার সৈন্যরা যুদ্ধ বিদ্যায় পারদর্শী হলেও, ভূতকে ভয়ানক ভয় পায়। পৃথিবীতে একমাত্র ভূত ছাড়া রাজা গাবুচন্দ্র পতির সৈন্যদের আর কোনো কিছুতে বিন্দুমাত্র ভয়-ডর নেই। অর্থাৎ, ভূতের সঙ্গে যুদ্ধে তারা কোনভাবেই এগুবে না।
রাজ্যের সবচেয়ে বোকা লোকটি হল ঢ্যাবলাকান্তি কলা। তাকে কেউ কোনভাবেই পাত্তা দেয় না। কোন কাজই সে করে না। দিনরাত পথে পথে ঘুরে বেড়ায়। আর এর-ওর কাছে চেয়ে-চিন্তে খায়। সে একদিন সাত-সকালে হঠাৎ রাজদরবারে এসে হাজির হল। রক্ষীকে সে বলল,
”আমি রাজার সঙ্গে দেখা করতে চাই। আমি ভূতের হদিস এবং তাদের পাকড়াও করে আনতে যেতে আগ্রহী। এ’ব্যপারে রাজামশাইয়ের অনুমতি নিতে এসেছি।“
ভূতের কথা বলায়, রক্ষী তাকে এককথায় ছেড়ে দিল। ঢ্যাবলাকান্তি সোজা গিয়ে হাজির হল রাজার মুখোমুখি।
সে রাজামশাইকে বলল, “রাজামশাই, আমি ভূতের প্রকৃত খবর আনতে যেতে চাই। আপনি আমাকে যাবার অনুমতি দিন।“
রাজামশাই তাকে অনেকভাবে বোঝালেও সে নাছোড়বান্দা। অগত্যা রাজামশাই তাকে যাবার অনুমতি দিল। কিন্তু তার সঙ্গে কয়েকজন সৈন্যকেও পাঠাল একরকম জোর করে। ঢ্যাবলাকান্তির পিছু পিছু সবাই বেরিয়ে গেল ভূতের খোঁজখবর আনতে।
সন্ধে নেমেছে সবেমাত্র। সীমান্তের একটি লংকাক্ষেতে ঢ্যাবলাকান্তি একা ঢুকে, লুকিয়ে বসে রইল। সৈন্যদের সে খানিকটা দূরে, আড়ালে থাকতে বলল। তারাও তাদের বর্তমান সেনাপতি ঢ্যাবলাকান্তির নির্দেশ মতো দূরে, আবডালেই রইল।
রাত গভীর হতেই দূর থেকে ভেসে আসতে লাগল নাকিসুরে আওয়াজ, “ নাঁ নাঁ নাঁ নাঁ নাঁ নাঁ নাঁ নাঁ নাঁ। হেঁ হেঁ হেঁ হেঁ হেঁ হেঁ হেঁ হেঁ। আভুঁস্ আভুঁস্। লেঁ লেঁ লেঁ লেঁ । লঁংকা লেঁ।“
এমন অদ্ভুত আওয়াজ শুনে সৈন্যরা সকলে থর-থর করে কাঁপতে শুরু করেছে। ঢ্যাবলাকান্তি সেই দৃশ্য মাঝরাতে অন্ধকারে দেখতে পাচ্ছে না ঠিকই। কিন্তু সে পরিস্থিতিটা অনুভব করতে পারছে। তবু সে সাহস করে চুপচাপ লংকাক্ষেতে বসে মশার কামড় খাচ্ছে। তার একটাই চিন্তা, যে করেই হোক একটা হলেও ভূত পাকড়াও করতেই হবে। ফিরে গিয়ে, রাজামশাইয়ের কাছে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতেই হবে তাকে।
রাত শেষ হয় হয়, এমন সময় লংকাখেকো ভূতের দল এসে ঢুকে পড়ল ক্ষেতের ভিতরে। কালো কুচকুচে তাদের চেহারা। গায়ে ভটকা-বিদঘুঁটে গন্ধ। ঢ্যাবলাকান্তি ক্ষেতের ভিতরে বসে বসে সেই দূর্গন্ধ নাকে নিচ্ছে আর মনে মনে ভাবছে, ‘না এলেই বোধহয় ভালো হোতো।‘
এমন ভাবতে ভাবতেই তার নাগালের মধ্যে চলে এসেছে গোটা কয়েক ভূত। তাদের শরীরের দূর্গন্ধে ঢ্যাবলাকান্তির দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম। কিন্তু সে সব কিছুকে উপেক্ষা করে, এক বিকট চিৎকার করে ঝাঁপিয়ে পড়ল একটি ভূতের উপর। জাপটে ধরেও ফেলল তাকে। ভূতবাবাজী কোনভাবেই ঢ্যাবলাকান্তির কাছ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারল না। তাই দেখে, ভূতেরদল ভয়ে সঙ্গীকে ফেলে দে-ছুট্।
এবার ঢ্যাবলাকান্তির কাছে ধরা পড়ে যাওয়া লংকাখেকো ভূত কাঁদতে শুরু করল। পরিস্কার মানুষের গলায় বলতে লাগল,” আমাকে ছেড়ে দাও। আমি কোনো ভূত নই। আমরা কেউই ভূত নই। আমরা পাশের দেশের গরীব মানুষ। খুব গরীব মানুষ আমরা। আমাদের রাজামশাই ভীষণ দুষ্টু লোক। সে আমাদের দুঃখ-কষ্ট চোখে দেখে না। একটুও বোঝে না। তাই আমরা রোজ তোমাদের লংকা চুরি করতে আসি ভূত সেজে। তোমাদের দেশের সবাই, এমনকি সৈন্যরাও যে ভূতকে ভীষণভাবে ভয় পায় সেটা আমরা জানি। তাই আমরা ভূত সেজে লংকা চুরি করতে আসি। আমাকে ছেড়ে দাও। আমাকে একটু দয়া কর। আচ্ছা তুমিই বলতো, ভূত কখনও লংকা খায় ? ভূত লংকা খায়- এমন কথা কেউ কখনও শুনেছে ?”
এতোক্ষণে সৈন্যরা ঢ্যাবলাকান্তির একেবারেই কাছাকাছি চলে এসেছে। সবাই মিলে ভূতকে ধরে রাজামশাইয়ের কাছে নিয়ে এল। রাজামশাই সমস্ত ঘটনা শুনে, ঢ্যাবলাকান্তিকে জিজ্ঞেস করল, ”একে কী শাস্তি দেয়া যায়, ঢ্যাবলাকান্তি ?”
ঢ্যাবলাকান্তি ফিক্ করে হেসে উঠল। তারপর বিঞ্জের মতো বলল,
“ অত্যন্ত লঘু অপরাধ। রাজামশাই, একে আবার ঠিক অপরাধও বলা চলে না। পেটের দায়ে ভূত সাজা তো! ভূত সেজে মানুষ মারা তো নয়। পশুপাখি নিধন তো নয়। তুচ্ছ লংকা চুরি। লংকাখেকো ভূত সাজার জন্যে এদের সকলের বুদ্ধির তারিফ করতেই হয়। তাই মুক্তিই শ্রেয়। সঙ্গে কিছু উপহার দিতে পারলে, আমাদের রাজ্যের, রাজামশাইয়ের সুনাম আরও ছড়িয়ে পড়বে। আমাদের দেশবাসীরও সম্মান বাড়বে। আসলে, প্রতিবেশীরা ভালো না থাকলে, আমরা ভালো থাকব কীভাবে, বলুন রাজামশাই ?”
ঢ্যাবলাকান্তির কথা শুনে রাজামশাই খুব খুশি হল। লম্বা এক অট্টহাসি হেসে বলল, “বাঃ, কী সুন্দর বিচার ভাবনা ! আমি ঠিক এমনটাই ভেবে রেখেছিলাম। ঢ্যাবলাকান্তি, কে বলে তোমার মাথায় গোবর ? আজ থেকে তুমি আমার পরমবন্ধু। এখন থেকে তুমি আমার রাজবাড়িতেই থাকবে।“
বন্দী ভূতকে মুক্তি দেওয়া হল। সেইসঙ্গে অনেক খাবার, পোশাক আর টাকা পয়সা। শুধু তার একার জন্য নয়, তার প্রতিবেশী সকল গরীব মানুষদের জন্য।
বন্দী চলে গেল তার দেশে। শান্তগড় থেকেও চিরকালের জন্য বিদায় নিলো লংকাখেকো ভূত। শান্তগড়ে আবার ফিরে এল আগের মতো শান্তি। দূর হল লংকাখেকো ভূতের ভয়।
চিঠি
তৃণা মুখার্জী
কেন এত গরিব হলাম ? ভাবে মাঝে মধ্যে বংশী।
কোনো সুখ নেই। সারাদিন পেটের চিন্তা করতে হয় ।নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করে। কেন এই বংশ জন্মালাম ? এর থেকে যদি কোন বিখ্যাত বড় বাড়িতে জন্মাতাম কতই না ভালো হত। ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়ে। সকালে মা ঘুম ভাঙিয়ে একটা চিঠি দেয়। চিঠিটা বংশীকে লেখা ওর দাদুর চিঠি। চিঠিটা পড়া শেষ হলে বংশী বুঝতে পারে তার চোখদুটো জলে ঝাপসা হয়ে আসছে। বাবা, মা, ঠাকুমাকে নিয়ে তার জগত। অনেকবার শুনেছে তারা সম্ভ্রান্ত পরিবারের। তার দাদু ছিল হারমোনিয়াম এর আবিষ্কার কর্তা। একসময় তার তৈরি হারমোনিয়ামের কদর ছিল। কিন্তু এখনকার আধুনিক যুগ কম হারমোনিয়াম বাজায় । বাড়িতে ধুলোপড়া হারমোনিয়ামটাও তো একবারও হাত নিয়ে দেখিনি বংশী। সে নিজেই মিউজিকওয়ালা গান পছন্দ করে ,তাতে গলা নাইবা শোনা গেল। একপলকে নিজেকে ধনী ভাবতে ইচ্ছা হল ,জন্মদিনের সকালে দাদুর রেখে যাওয়া শ্রেষ্ট সম্পত্তির মালিক হল সে। সন্ধ্যায় হারমোনিয়াম বাজিয়ে বাবার গলায় গান আর সকালের চিঠিটা সব চিন্তা আর কষ্টকে দূর করে দিলো নিমেষে।
আপনজন
---- বাপ্পা দাস
ভেসে গেছে স্বপ্ন
অশ্রুর প্লাবনে ।
ঘুমিয়ে পড়েছে খুশি
ভারাক্রান্ত মনে ।
মুছে গেছে রং,
বিবর্ণ জীবন ।
রাগ করে হারিয়ে গেছে
আমার আপনজন ।
উড়ে গেছে সুখ,
ফানুসের মতো ।
দুরে, আরও দুরে
নীল আকাশের গায়ে,
যেথায় দৃষ্টি যায় না আর ।
কেন এমন হলো ?
জীবন তুমি বলো ।
তাকে কি পাবো না আর ?
দিনের আলোয় লাগছে কেন
ঘোর অন্ধকার
অন্ধকার
মিনতি গোস্বামী
অন্ধকার অন্ধকার করছো কেন?
ধরো বিদ্যুতের আলো আসবেনা
মোমবাতি জ্বালাও
না থাকলে হ্যারিকেন
লম্ফ না থাকতেই পারে
প্রদীপ তো জ্বালাতে পারো।
দেশলাই নেই?
হাঁক দাও পাশের বাড়িতে
ছুটে যাও , দেশলাই আনো
আলো জ্বালাও।
আসলে তুমি তো জানোই না
আমফানের পর
সুন্দরবনের মানুষগুলো
কেমন করে অন্ধকারে বসে
আলো জ্বালানোর চেষ্টা করছে।
বাড়ি
- বিনয় ডাঙ্গর
তোমার মনে আছে কিনা জানিনা
আমাদের আলাপের ঠিক কিছুদিন পর,
আমরা একদিন সন্ধেবেলা
খোলা আকাশের নীচে
পাশাপাশি বসে একটা সুন্দর বাড়ি বানিয়েছিলাম।
তোমার উন্মাদনা ছিল সেই বাড়ির ছোট্ট বাগান।
আনমনা হয়ে ছোটাছুটি করবে বলে,
তুলে ফেলেছিলাম সমস্ত চৌকাঠ।
এ ঘর ও ঘর জুড়ে পড়ে ছিল
আমাদের আত্মতুষ্টি,
আমাদের প্রেম।
তোমার প্রতিশ্রুতিতে গাঁথা হল একেকটি ইট,
তোমার হৃদয়ের স্পর্শে প্রতিটি দেয়াল হল প্লাস্টার।
এক মুহূর্তে
পরস্পরের চুম্বনে সুন্দর গোলাপী রঙ
লাগল সমস্ত বাড়ির আনাচে কানাচে।
যতবার জড়িয়ে ধরলে খোলা আকাশের নীচে,
আমাদের ব্যালকনি হাওয়ায় ভরে গেল।
আমাদের অগোছালো উঠে দাঁড়ানোয়
আলো জ্বলে উঠলো বাড়ির উঠোনে।
পরস্পরের চিবুকে দাঁত দিয়ে লেখা হল,
আমাদের সেই নতুন নির্মিত বাড়ির ঠিকানা।
তারপর থেকে শুধু বৃষ্টি হয়েছে পৃথিবী জুড়ে
কালো, অন্ধকার, গভীর অথচ নিরন্তর বৃষ্টি
মুছে গেছে আমাদের বাড়ির ঠিকানা।
মাঝে মাঝে যখন বৃষ্টি ক্লান্ত হয়ে এসেছে,
নিজেই কেঁদে উঠেছি
মধ্যরাত্রির আকাশে।
খোলা আকাশ।
চিবুকে রেখেছি হাত,
দাঁত বের করে খুঁজেছি তোমার চিবুক,
কোথাও ঠিকানা নেই আমাদের সেই বাড়িটার।
চারিদিকে অন্ধকার।
কি লিখেছিলে তুমি?
কি কালি ছিল তোমার দাঁতে?
একটা আস্ত বাড়ির ঠিকানা
কয়েক ফোঁটা বৃষ্টির জলে
এভাবে মুছে গেল
আমার চিবুক থেকেও!
প্রথম আলাপ
----সৌমেন সরকার
মনে পড়ে আমাদের প্রথম আলাপ?
তুমি আর আমি ইছামতীর কূলে দুপুরবেলা
আঙুলে আঙুল ঠেকিয়ে
ভাঙা শীতের ভেজা রোদ মাখছিলাম।
তুমি তখন আঠার,পরনে সেই বাসন্তী শাড়ী
হাল্কা লিপস্টিক পরে হাসছিলে
আমি কিন্তু তোমার হৃদয়ের বন্ধ দুয়ার পড়েছিলাম
তাই বলেছিলাম ভালোবাসি।
তুমি শুধু মুখে হাত রেখে হেসেছিলে
আর আমি বুনেছিলাম রাংধনুর সাতরঙা স্বপ্ন হাজার
আজ তিরিশ বছর পর
আমি আবার এসেছি তোমার দুয়ারে
মনে কি পড়ে বনানী,তোমার শেষ শয্যা ভিজেছিল
আমাদের প্রথম আলাপের মধুর স্মৃতির বৃষ্টিতে!
"সঙ্গীত ও ঈশ্বর"
-----টুম্পা মুখার্জী
রূপসাগরে বৈষ্ণবীর খঞ্জনি
হারিয়ে গেছে,
ওকে কেউ দোতারাটা ধার দাও,
পদাবলী কীর্তন আর সহজিয়া সঙ্গীত
বেজে উঠুক একাঙ্গ সুর হয়ে,
ওর শরীরের ধাপ বেয়ে যৌবনঝর্ণা
নেমে আসুক ঠুংরি দাদরা হয়ে ;
সেই আনন্দে ভ্রমর উছলে পড়া মদিরায়
ডুবে যাক চিরতরে।
আর একতারা ঈশ্বর
সুফি সঙ্গীত হয়ে
অণুরণিত হোক প্রতি হৃৎপিণ্ডে ।
নামমাত্র
শর্মিষ্ঠা সাহা
একই শহর
কিন্তু পৃথক আমি,
আমার অহংকার
ভীষণ দামী।
যে বন্ধ গলি,
শেষ হয় তোর দোরগোড়ায়,
তার মধ্যমান,লয়,
তোলেনা কোনো সুর,
এই অবেলায়।
আমি বেসুরো,
অহংকারের গুঁড়ো
ছড়িয়েছি বালুচরে,
বিস্তৃতি এই শহরে।।
আমার বৃত্তেই আছি আমি
_বাপন দেব লাড়ু_
বিজ্ঞাপনের রস, ভরিয়ে দিয়েছে কামাতুর পেয়ালা ;
এক চুমুকে পৃথিবী পড়ে, পেতে ইচ্ছে করে অজানা উপদ্রব্য ;
পরে উষ্ণ বিনিময়ে যদি বন্যা আসে, ভয় পাই !
ক্ষয়িষ্ণু আয়ুষ্কাল, দিন পেরিয়ে বেড়ে যায় বয়স ;
ঝরে যায় সব প্রতিশ্রুতি ধীরে ধীরে;
আমাকে অন্যদের মতো বিচার কোরোনা আর ;
তোমারতো জানা আছে, ভালোবাসা নস্টালজিক্,
পিছুটানেইতো লুকিয়ে থাকে সব 'হকিকত' ,
তবুও বোঝা পড়ার ক্রেয়নস্টিক্ সাজাও ;
জীবনের পাশে আজ লিখে রেখো আগাম ইতিহাস,
আমার বৃত্তেই আছি আমি।
প্রকৃতি ও মানুষ (অনু গল্প)
প্রকৃতির কথা বলতেই একদিকেই মন যায় সেটা সেটা হল গ্ৰামবাংলার পরিবেশ। গ্ৰামবাংলার প্রকৃতির সাথে মানুষের যে গভীর সম্পর্ক তা প্রমানিত হয় গ্ৰামবাংলায় প্রবেশ করলে। প্রকৃতি ও মানুষের যে নিবিড় সম্পর্ক এ যেন কোথাও মেলবন্ধন সৃষ্টি করে। মানুষের রূপ প্রকৃতির রূপ মিলে তৈরি হয় কোনো মায়া সভ্যতার এক জ্বলন্ত পিন্ডের মতো দ্বীপ্ত বিন্দু। এই ভাবে গ্ৰামবাংলার দ্বীপ্ত সূর্যের সতেজ রাশির সঙ্গে যুগের পর যুগ চিরকাল ধরে ধাবিত হয়ে আসছে। সময়টা ছিল নিস্তেজ সূর্যের অবহেলিত রশ্মির এক নদীর পাড় তার কিছুটা দূর থেকে শুরু হয়েছেন রূপকথার দেশ। কারনটা হল গাছপালার মিলিত সমাহার প্রকৃতি, মানুষ, পশুপাখি,সবে মিলিত হয়ে এক মেলবন্ধন সৃষ্টি করে যার ফলে শৃঙ্খলবদ্ধ ভাবে গড়ে উঠেছে সেখানকার পরিবেশ। নদীর ঠান্ডা বাতাসে মুখরিত করে প্রকৃতির সবুজায়নকে তার ফাঁকে মানুষ উপভোগ করে সেই সৌন্দর্য যা মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে এই অবস্থা দেখে বোঝা যায় গ্ৰামবাংলার সংস্কৃতি, ভ্রাতৃত্ব, সবুজায়নে মোড়া এই মায়ারুপ সৌন্দর্য যুগ যুগ ধরে বহমান। গ্ৰামটা ছিল প্রকৃতির কোলে এক অপরূপ দৃশ্যের সৌন্দর্যের প্রতীক। গ্ৰামটির ভৌগলিক পরিবেশ চারিদিক থেকে গাছপালায় ঢাকা এখানে মজার ব্যাপার হল সবুজের সমাহারে প্রকৃতির সৌন্দর্যে বোঝা যায় না সেটা গ্ৰাম না সবুজ আবৃত কোন আস্তরন। তাহলে বোঝা যায় সেখানকার মানুষ ও প্রকৃতির সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক ভাবে অতি গভীর ও মাধুর্যের সাথে ও মেলবন্ধনে একে অন্যের প্রতীক হিসাবে নিবন্ধ আছে। কিন্তু বর্তমানে ও মানুষ ও প্রকৃতির যে সম্পর্ক তা কোথাও যেন ছিন্ন হচ্ছে।
নাম: আব্দুল রাহাজ
প্রতিবাদ
অর্চনা ভট্টাচার্য্য
বৃষ্টি এলো কালো করে
মেঘের মাদল সঙ্গে করে
গুরু গুরু গুরু বাজে অবিরত
ধরণী হ'ল ধারায় স্নাত ।
চরাচর সব ঢেকে গেল জলে
অবরুদ্ধ আজ রয়েছে সকলে
বুঝি ভয় হয়, হবে সব লয়
জনপ্রাণী আজ দেখি না কোথাও।
দাবদাহে সবে হয়েছে ক্লান্ত
প্রখর তাপে পৃথিবী অশান্ত
তাহারে শীতল করিতে বুঝি
ঝরে ধারা অবিশ্রান্ত ।
বাদল ধারা ঝর ঝর ঝরে
বিরাম নাই যে পথে বাহিরিবে
কাহারও খোঁজ পাই না আজিকে
মোবাইল টাওয়ার বন্ধ ।
শুনিতেছি আজ পড়েছে কোথাও
মহীরুহ সব পথের উপর
বুঝি অভিমানে বাধিয়েছে জট
করিয়াছে পথ ধর্মঘট ।
তারা যে মূক, তারা যে বধির
তবুও আছে তাদের শরীর
আছে প্রাণ আছে অনুভূতি
শোনে না যে কেউ তাদের আকুতি।
প্রকৃতি আজ হয়েছে পাগল
তারই তরে আজ খুলেছে আগল
সকলে মিলেছে এক সাথে আজ
করিতে বন্ধ সভ্যতারাজ ।
ঢপ বাজদের চিনলি না।
দিলীপ রায়।
হাঁদা-
তুই রয়েই গেলি গাধা।
ঢপ বাজদের চিনলি না।
এরা কথার জালে,
ফাঁশায় তোকে।
এতো দিনেও বুঝলি না।
এরা মুখোশ ধারী,
মধুর হাড়ি।
এদের মিষ্টি কথায় ভুলিস না।
তাই বলছি তোকে,
সতর্ক থাক।
এদের ফাঁদে গলিস না।
ওরা ধুর্ত অতি,
শকুন জাতি।
ঠুকরে খাবে মাংস তোর।
ওরা ভদ্রবেশী,
বক ধার্মিক।
আসলে ওরা সিঁধেল চোর।
সারা জীবন শুধুই ঠকলি
ঠকে ঠকে ঠাকুর হলি
তবুওতো শুধলি না।
হয়নি দেরি,
সময় আছে।
কেন ওদের রুখবি না?
চোখ
অনির্বান দাস
আমার চোখে তোমার চোখ পড়ল যখন,
তোমার আমার শুভদৃষ্টি হইল তখন।
চোখেই হয় প্রেম চোখেই হয় চাওয়া,
চোখ দিয়ে দেখে মানুষ চোখেই হয় প্রেমের গান গাওয়া।
চোখ দিয়ে দেখে মানুষ প্রথম পৃথিবীর আলো,
চোখ না থাকলে পৃথিবীর সবকিছু হয়ে যায় কালো।।
দিলীপকুমার মিস্ত্রী
শান্ত শান্তগড়ে হঠাৎ অশান্তির মেঘ জমেছে। অশান্তির একটিই কারণ- ভূত। সে আবার যে সে ভূত নয়, লংকাখেকো ভূত। এমন ভূত দেখা তো দূরের কথা, এর আগে কেউ কোনদিন লংকাখেকো ভূতের নাম পর্যন্ত শোনেনি। তাই শিশু থেকে বৃদ্ধ, লংকাখেকো ভূতের ভয়ে শান্তগড়ের সবাই একেবারে তটস্থ। এমনকি, রাজার সৈন্যরা পর্যন্ত এই অদ্ভুত ভূতের আতঙ্কে থরকম্পবান। তাই গভীর চিন্তায় পড়েছে শান্তগড়ের রাজা গাবুচন্দ্র পতি।
শান্তগড় সত্যিই এক শান্তির দেশ। রাজা গাবুচন্দ্র পতি ধার্মিক,দয়ালু এবং অত্যন্ত প্রজাবৎসল । এককথায়, তিনি প্রজাদের ভালো রাখতে সদা ব্যস্ত। তার রাজ্যে কোনো জুলুমবাজি নেই। সৈন্য-সামন্তেরদল ঘোড়ায় ছুটে বেড়ালেও রাজা গাবুচন্দ্র পতি কখনও ঘোড়া চড়ে না। তার প্রিয় যান গরুরগাড়ি। যুদ্ধ-সংঘাতে সে মোটেও জড়াতে চায় না। প্রজাদের সে সবসময় পরামর্শ দেয়, “নুন-ভাত খাও, যুদ্ধ ভুলে যাও।“
তবু রাজার সৈন্যবাহিনী আছে। আসলে, সৈন্য না থাকলে যে, রাজার রাজা-রাজা মনে হয় না। তাছাড়া, কিছু প্রজাকে কাজ-বাজও তো দিতে হয়। গাবুচন্দ্র পতি রাজার রাজত্বে কাজ বলতে তো ওই সামান্য ক’জন সৈন্য, আর হাতে-গোনা জনাকয়েক রাজকর্মচারি। ব্যাস ! সারা রাজ্যে মানুষের একটিই কাজ- চাষ। তাও আবার ওই লংকা চাষ। লংকা ছাড়া শান্তগড়ের মাটিতে আর কিছু তেমন চাষ হয়না বললেই চলে। তবে শান্তগড়ের লংকার খ্যাতি আছে বটে। প্রতিদিন পাশাপাশি রাজ্যগুলোতে শান্তগড়ের লংকা চালান হয়ে যায় ভালো দামে। মোটকথা, শান্তগড়ে প্রজারা সবাই সুখেই আছে। রাজা গাবুচন্দ্র পতিও প্রজাদের নিয়ে আনন্দে রয়েছে।
কিন্তু হঠাৎ শান্তগড়ে লংকাখেকো ভূতের আগমনে ঘরে ঘরে অশান্তি ঢুকে পড়েছে। রাজার কাছে রোজদিন অভিযোগ আসছে- চারদিক থেকে। রাজদরবারে অভিযোগের পাহাড় জমে গেছে। কিন্তু কেউ এর থেকে মুক্তির উপায় খুঁজে বের করতে পারছে না। রাজা নিজেও চিন্তায় পড়েছে। চিন্তার প্রধান কারণ, সে সৈন্যদের তেমনভাবে কড়া নির্দেশ দিতে পারছে না। না পারার কারণ, সে নিজেই ভূতকে ভীষণ ভয় পায়। তায় এ’আবার ভূত জগতের নতুন আমদানি লংকাখেকো ভূত। এঁনাদের ক্ষমতা সম্পর্কে কা’রও তেমন কোনো ধারণা বা অভিঙ্গতা একেবারেই নেই। তাছাড়া, রাজামশাই ভালো করে জানে,তার সৈন্যরা যুদ্ধ বিদ্যায় পারদর্শী হলেও, ভূতকে ভয়ানক ভয় পায়। পৃথিবীতে একমাত্র ভূত ছাড়া রাজা গাবুচন্দ্র পতির সৈন্যদের আর কোনো কিছুতে বিন্দুমাত্র ভয়-ডর নেই। অর্থাৎ, ভূতের সঙ্গে যুদ্ধে তারা কোনভাবেই এগুবে না।
রাজ্যের সবচেয়ে বোকা লোকটি হল ঢ্যাবলাকান্তি কলা। তাকে কেউ কোনভাবেই পাত্তা দেয় না। কোন কাজই সে করে না। দিনরাত পথে পথে ঘুরে বেড়ায়। আর এর-ওর কাছে চেয়ে-চিন্তে খায়। সে একদিন সাত-সকালে হঠাৎ রাজদরবারে এসে হাজির হল। রক্ষীকে সে বলল,
”আমি রাজার সঙ্গে দেখা করতে চাই। আমি ভূতের হদিস এবং তাদের পাকড়াও করে আনতে যেতে আগ্রহী। এ’ব্যপারে রাজামশাইয়ের অনুমতি নিতে এসেছি।“
ভূতের কথা বলায়, রক্ষী তাকে এককথায় ছেড়ে দিল। ঢ্যাবলাকান্তি সোজা গিয়ে হাজির হল রাজার মুখোমুখি।
সে রাজামশাইকে বলল, “রাজামশাই, আমি ভূতের প্রকৃত খবর আনতে যেতে চাই। আপনি আমাকে যাবার অনুমতি দিন।“
রাজামশাই তাকে অনেকভাবে বোঝালেও সে নাছোড়বান্দা। অগত্যা রাজামশাই তাকে যাবার অনুমতি দিল। কিন্তু তার সঙ্গে কয়েকজন সৈন্যকেও পাঠাল একরকম জোর করে। ঢ্যাবলাকান্তির পিছু পিছু সবাই বেরিয়ে গেল ভূতের খোঁজখবর আনতে।
সন্ধে নেমেছে সবেমাত্র। সীমান্তের একটি লংকাক্ষেতে ঢ্যাবলাকান্তি একা ঢুকে, লুকিয়ে বসে রইল। সৈন্যদের সে খানিকটা দূরে, আড়ালে থাকতে বলল। তারাও তাদের বর্তমান সেনাপতি ঢ্যাবলাকান্তির নির্দেশ মতো দূরে, আবডালেই রইল।
রাত গভীর হতেই দূর থেকে ভেসে আসতে লাগল নাকিসুরে আওয়াজ, “ নাঁ নাঁ নাঁ নাঁ নাঁ নাঁ নাঁ নাঁ নাঁ। হেঁ হেঁ হেঁ হেঁ হেঁ হেঁ হেঁ হেঁ। আভুঁস্ আভুঁস্। লেঁ লেঁ লেঁ লেঁ । লঁংকা লেঁ।“
এমন অদ্ভুত আওয়াজ শুনে সৈন্যরা সকলে থর-থর করে কাঁপতে শুরু করেছে। ঢ্যাবলাকান্তি সেই দৃশ্য মাঝরাতে অন্ধকারে দেখতে পাচ্ছে না ঠিকই। কিন্তু সে পরিস্থিতিটা অনুভব করতে পারছে। তবু সে সাহস করে চুপচাপ লংকাক্ষেতে বসে মশার কামড় খাচ্ছে। তার একটাই চিন্তা, যে করেই হোক একটা হলেও ভূত পাকড়াও করতেই হবে। ফিরে গিয়ে, রাজামশাইয়ের কাছে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতেই হবে তাকে।
রাত শেষ হয় হয়, এমন সময় লংকাখেকো ভূতের দল এসে ঢুকে পড়ল ক্ষেতের ভিতরে। কালো কুচকুচে তাদের চেহারা। গায়ে ভটকা-বিদঘুঁটে গন্ধ। ঢ্যাবলাকান্তি ক্ষেতের ভিতরে বসে বসে সেই দূর্গন্ধ নাকে নিচ্ছে আর মনে মনে ভাবছে, ‘না এলেই বোধহয় ভালো হোতো।‘
এমন ভাবতে ভাবতেই তার নাগালের মধ্যে চলে এসেছে গোটা কয়েক ভূত। তাদের শরীরের দূর্গন্ধে ঢ্যাবলাকান্তির দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম। কিন্তু সে সব কিছুকে উপেক্ষা করে, এক বিকট চিৎকার করে ঝাঁপিয়ে পড়ল একটি ভূতের উপর। জাপটে ধরেও ফেলল তাকে। ভূতবাবাজী কোনভাবেই ঢ্যাবলাকান্তির কাছ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারল না। তাই দেখে, ভূতেরদল ভয়ে সঙ্গীকে ফেলে দে-ছুট্।
এবার ঢ্যাবলাকান্তির কাছে ধরা পড়ে যাওয়া লংকাখেকো ভূত কাঁদতে শুরু করল। পরিস্কার মানুষের গলায় বলতে লাগল,” আমাকে ছেড়ে দাও। আমি কোনো ভূত নই। আমরা কেউই ভূত নই। আমরা পাশের দেশের গরীব মানুষ। খুব গরীব মানুষ আমরা। আমাদের রাজামশাই ভীষণ দুষ্টু লোক। সে আমাদের দুঃখ-কষ্ট চোখে দেখে না। একটুও বোঝে না। তাই আমরা রোজ তোমাদের লংকা চুরি করতে আসি ভূত সেজে। তোমাদের দেশের সবাই, এমনকি সৈন্যরাও যে ভূতকে ভীষণভাবে ভয় পায় সেটা আমরা জানি। তাই আমরা ভূত সেজে লংকা চুরি করতে আসি। আমাকে ছেড়ে দাও। আমাকে একটু দয়া কর। আচ্ছা তুমিই বলতো, ভূত কখনও লংকা খায় ? ভূত লংকা খায়- এমন কথা কেউ কখনও শুনেছে ?”
এতোক্ষণে সৈন্যরা ঢ্যাবলাকান্তির একেবারেই কাছাকাছি চলে এসেছে। সবাই মিলে ভূতকে ধরে রাজামশাইয়ের কাছে নিয়ে এল। রাজামশাই সমস্ত ঘটনা শুনে, ঢ্যাবলাকান্তিকে জিজ্ঞেস করল, ”একে কী শাস্তি দেয়া যায়, ঢ্যাবলাকান্তি ?”
ঢ্যাবলাকান্তি ফিক্ করে হেসে উঠল। তারপর বিঞ্জের মতো বলল,
“ অত্যন্ত লঘু অপরাধ। রাজামশাই, একে আবার ঠিক অপরাধও বলা চলে না। পেটের দায়ে ভূত সাজা তো! ভূত সেজে মানুষ মারা তো নয়। পশুপাখি নিধন তো নয়। তুচ্ছ লংকা চুরি। লংকাখেকো ভূত সাজার জন্যে এদের সকলের বুদ্ধির তারিফ করতেই হয়। তাই মুক্তিই শ্রেয়। সঙ্গে কিছু উপহার দিতে পারলে, আমাদের রাজ্যের, রাজামশাইয়ের সুনাম আরও ছড়িয়ে পড়বে। আমাদের দেশবাসীরও সম্মান বাড়বে। আসলে, প্রতিবেশীরা ভালো না থাকলে, আমরা ভালো থাকব কীভাবে, বলুন রাজামশাই ?”
ঢ্যাবলাকান্তির কথা শুনে রাজামশাই খুব খুশি হল। লম্বা এক অট্টহাসি হেসে বলল, “বাঃ, কী সুন্দর বিচার ভাবনা ! আমি ঠিক এমনটাই ভেবে রেখেছিলাম। ঢ্যাবলাকান্তি, কে বলে তোমার মাথায় গোবর ? আজ থেকে তুমি আমার পরমবন্ধু। এখন থেকে তুমি আমার রাজবাড়িতেই থাকবে।“
বন্দী ভূতকে মুক্তি দেওয়া হল। সেইসঙ্গে অনেক খাবার, পোশাক আর টাকা পয়সা। শুধু তার একার জন্য নয়, তার প্রতিবেশী সকল গরীব মানুষদের জন্য।
বন্দী চলে গেল তার দেশে। শান্তগড় থেকেও চিরকালের জন্য বিদায় নিলো লংকাখেকো ভূত। শান্তগড়ে আবার ফিরে এল আগের মতো শান্তি। দূর হল লংকাখেকো ভূতের ভয়।
চিঠি
তৃণা মুখার্জী
কেন এত গরিব হলাম ? ভাবে মাঝে মধ্যে বংশী।
কোনো সুখ নেই। সারাদিন পেটের চিন্তা করতে হয় ।নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করে। কেন এই বংশ জন্মালাম ? এর থেকে যদি কোন বিখ্যাত বড় বাড়িতে জন্মাতাম কতই না ভালো হত। ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়ে। সকালে মা ঘুম ভাঙিয়ে একটা চিঠি দেয়। চিঠিটা বংশীকে লেখা ওর দাদুর চিঠি। চিঠিটা পড়া শেষ হলে বংশী বুঝতে পারে তার চোখদুটো জলে ঝাপসা হয়ে আসছে। বাবা, মা, ঠাকুমাকে নিয়ে তার জগত। অনেকবার শুনেছে তারা সম্ভ্রান্ত পরিবারের। তার দাদু ছিল হারমোনিয়াম এর আবিষ্কার কর্তা। একসময় তার তৈরি হারমোনিয়ামের কদর ছিল। কিন্তু এখনকার আধুনিক যুগ কম হারমোনিয়াম বাজায় । বাড়িতে ধুলোপড়া হারমোনিয়ামটাও তো একবারও হাত নিয়ে দেখিনি বংশী। সে নিজেই মিউজিকওয়ালা গান পছন্দ করে ,তাতে গলা নাইবা শোনা গেল। একপলকে নিজেকে ধনী ভাবতে ইচ্ছা হল ,জন্মদিনের সকালে দাদুর রেখে যাওয়া শ্রেষ্ট সম্পত্তির মালিক হল সে। সন্ধ্যায় হারমোনিয়াম বাজিয়ে বাবার গলায় গান আর সকালের চিঠিটা সব চিন্তা আর কষ্টকে দূর করে দিলো নিমেষে।
আপনজন
---- বাপ্পা দাস
ভেসে গেছে স্বপ্ন
অশ্রুর প্লাবনে ।
ঘুমিয়ে পড়েছে খুশি
ভারাক্রান্ত মনে ।
মুছে গেছে রং,
বিবর্ণ জীবন ।
রাগ করে হারিয়ে গেছে
আমার আপনজন ।
উড়ে গেছে সুখ,
ফানুসের মতো ।
দুরে, আরও দুরে
নীল আকাশের গায়ে,
যেথায় দৃষ্টি যায় না আর ।
কেন এমন হলো ?
জীবন তুমি বলো ।
তাকে কি পাবো না আর ?
দিনের আলোয় লাগছে কেন
ঘোর অন্ধকার
অন্ধকার
মিনতি গোস্বামী
অন্ধকার অন্ধকার করছো কেন?
ধরো বিদ্যুতের আলো আসবেনা
মোমবাতি জ্বালাও
না থাকলে হ্যারিকেন
লম্ফ না থাকতেই পারে
প্রদীপ তো জ্বালাতে পারো।
দেশলাই নেই?
হাঁক দাও পাশের বাড়িতে
ছুটে যাও , দেশলাই আনো
আলো জ্বালাও।
আসলে তুমি তো জানোই না
আমফানের পর
সুন্দরবনের মানুষগুলো
কেমন করে অন্ধকারে বসে
আলো জ্বালানোর চেষ্টা করছে।
বাড়ি
- বিনয় ডাঙ্গর
তোমার মনে আছে কিনা জানিনা
আমাদের আলাপের ঠিক কিছুদিন পর,
আমরা একদিন সন্ধেবেলা
খোলা আকাশের নীচে
পাশাপাশি বসে একটা সুন্দর বাড়ি বানিয়েছিলাম।
তোমার উন্মাদনা ছিল সেই বাড়ির ছোট্ট বাগান।
আনমনা হয়ে ছোটাছুটি করবে বলে,
তুলে ফেলেছিলাম সমস্ত চৌকাঠ।
এ ঘর ও ঘর জুড়ে পড়ে ছিল
আমাদের আত্মতুষ্টি,
আমাদের প্রেম।
তোমার প্রতিশ্রুতিতে গাঁথা হল একেকটি ইট,
তোমার হৃদয়ের স্পর্শে প্রতিটি দেয়াল হল প্লাস্টার।
এক মুহূর্তে
পরস্পরের চুম্বনে সুন্দর গোলাপী রঙ
লাগল সমস্ত বাড়ির আনাচে কানাচে।
যতবার জড়িয়ে ধরলে খোলা আকাশের নীচে,
আমাদের ব্যালকনি হাওয়ায় ভরে গেল।
আমাদের অগোছালো উঠে দাঁড়ানোয়
আলো জ্বলে উঠলো বাড়ির উঠোনে।
পরস্পরের চিবুকে দাঁত দিয়ে লেখা হল,
আমাদের সেই নতুন নির্মিত বাড়ির ঠিকানা।
তারপর থেকে শুধু বৃষ্টি হয়েছে পৃথিবী জুড়ে
কালো, অন্ধকার, গভীর অথচ নিরন্তর বৃষ্টি
মুছে গেছে আমাদের বাড়ির ঠিকানা।
মাঝে মাঝে যখন বৃষ্টি ক্লান্ত হয়ে এসেছে,
নিজেই কেঁদে উঠেছি
মধ্যরাত্রির আকাশে।
খোলা আকাশ।
চিবুকে রেখেছি হাত,
দাঁত বের করে খুঁজেছি তোমার চিবুক,
কোথাও ঠিকানা নেই আমাদের সেই বাড়িটার।
চারিদিকে অন্ধকার।
কি লিখেছিলে তুমি?
কি কালি ছিল তোমার দাঁতে?
একটা আস্ত বাড়ির ঠিকানা
কয়েক ফোঁটা বৃষ্টির জলে
এভাবে মুছে গেল
আমার চিবুক থেকেও!
প্রথম আলাপ
----সৌমেন সরকার
মনে পড়ে আমাদের প্রথম আলাপ?
তুমি আর আমি ইছামতীর কূলে দুপুরবেলা
আঙুলে আঙুল ঠেকিয়ে
ভাঙা শীতের ভেজা রোদ মাখছিলাম।
তুমি তখন আঠার,পরনে সেই বাসন্তী শাড়ী
হাল্কা লিপস্টিক পরে হাসছিলে
আমি কিন্তু তোমার হৃদয়ের বন্ধ দুয়ার পড়েছিলাম
তাই বলেছিলাম ভালোবাসি।
তুমি শুধু মুখে হাত রেখে হেসেছিলে
আর আমি বুনেছিলাম রাংধনুর সাতরঙা স্বপ্ন হাজার
আজ তিরিশ বছর পর
আমি আবার এসেছি তোমার দুয়ারে
মনে কি পড়ে বনানী,তোমার শেষ শয্যা ভিজেছিল
আমাদের প্রথম আলাপের মধুর স্মৃতির বৃষ্টিতে!
"সঙ্গীত ও ঈশ্বর"
-----টুম্পা মুখার্জী
রূপসাগরে বৈষ্ণবীর খঞ্জনি
হারিয়ে গেছে,
ওকে কেউ দোতারাটা ধার দাও,
পদাবলী কীর্তন আর সহজিয়া সঙ্গীত
বেজে উঠুক একাঙ্গ সুর হয়ে,
ওর শরীরের ধাপ বেয়ে যৌবনঝর্ণা
নেমে আসুক ঠুংরি দাদরা হয়ে ;
সেই আনন্দে ভ্রমর উছলে পড়া মদিরায়
ডুবে যাক চিরতরে।
আর একতারা ঈশ্বর
সুফি সঙ্গীত হয়ে
অণুরণিত হোক প্রতি হৃৎপিণ্ডে ।
নামমাত্র
শর্মিষ্ঠা সাহা
একই শহর
কিন্তু পৃথক আমি,
আমার অহংকার
ভীষণ দামী।
যে বন্ধ গলি,
শেষ হয় তোর দোরগোড়ায়,
তার মধ্যমান,লয়,
তোলেনা কোনো সুর,
এই অবেলায়।
আমি বেসুরো,
অহংকারের গুঁড়ো
ছড়িয়েছি বালুচরে,
বিস্তৃতি এই শহরে।।
আমার বৃত্তেই আছি আমি
_বাপন দেব লাড়ু_
বিজ্ঞাপনের রস, ভরিয়ে দিয়েছে কামাতুর পেয়ালা ;
এক চুমুকে পৃথিবী পড়ে, পেতে ইচ্ছে করে অজানা উপদ্রব্য ;
পরে উষ্ণ বিনিময়ে যদি বন্যা আসে, ভয় পাই !
ক্ষয়িষ্ণু আয়ুষ্কাল, দিন পেরিয়ে বেড়ে যায় বয়স ;
ঝরে যায় সব প্রতিশ্রুতি ধীরে ধীরে;
আমাকে অন্যদের মতো বিচার কোরোনা আর ;
তোমারতো জানা আছে, ভালোবাসা নস্টালজিক্,
পিছুটানেইতো লুকিয়ে থাকে সব 'হকিকত' ,
তবুও বোঝা পড়ার ক্রেয়নস্টিক্ সাজাও ;
জীবনের পাশে আজ লিখে রেখো আগাম ইতিহাস,
আমার বৃত্তেই আছি আমি।
প্রকৃতি ও মানুষ (অনু গল্প)
প্রকৃতির কথা বলতেই একদিকেই মন যায় সেটা সেটা হল গ্ৰামবাংলার পরিবেশ। গ্ৰামবাংলার প্রকৃতির সাথে মানুষের যে গভীর সম্পর্ক তা প্রমানিত হয় গ্ৰামবাংলায় প্রবেশ করলে। প্রকৃতি ও মানুষের যে নিবিড় সম্পর্ক এ যেন কোথাও মেলবন্ধন সৃষ্টি করে। মানুষের রূপ প্রকৃতির রূপ মিলে তৈরি হয় কোনো মায়া সভ্যতার এক জ্বলন্ত পিন্ডের মতো দ্বীপ্ত বিন্দু। এই ভাবে গ্ৰামবাংলার দ্বীপ্ত সূর্যের সতেজ রাশির সঙ্গে যুগের পর যুগ চিরকাল ধরে ধাবিত হয়ে আসছে। সময়টা ছিল নিস্তেজ সূর্যের অবহেলিত রশ্মির এক নদীর পাড় তার কিছুটা দূর থেকে শুরু হয়েছেন রূপকথার দেশ। কারনটা হল গাছপালার মিলিত সমাহার প্রকৃতি, মানুষ, পশুপাখি,সবে মিলিত হয়ে এক মেলবন্ধন সৃষ্টি করে যার ফলে শৃঙ্খলবদ্ধ ভাবে গড়ে উঠেছে সেখানকার পরিবেশ। নদীর ঠান্ডা বাতাসে মুখরিত করে প্রকৃতির সবুজায়নকে তার ফাঁকে মানুষ উপভোগ করে সেই সৌন্দর্য যা মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে এই অবস্থা দেখে বোঝা যায় গ্ৰামবাংলার সংস্কৃতি, ভ্রাতৃত্ব, সবুজায়নে মোড়া এই মায়ারুপ সৌন্দর্য যুগ যুগ ধরে বহমান। গ্ৰামটা ছিল প্রকৃতির কোলে এক অপরূপ দৃশ্যের সৌন্দর্যের প্রতীক। গ্ৰামটির ভৌগলিক পরিবেশ চারিদিক থেকে গাছপালায় ঢাকা এখানে মজার ব্যাপার হল সবুজের সমাহারে প্রকৃতির সৌন্দর্যে বোঝা যায় না সেটা গ্ৰাম না সবুজ আবৃত কোন আস্তরন। তাহলে বোঝা যায় সেখানকার মানুষ ও প্রকৃতির সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক ভাবে অতি গভীর ও মাধুর্যের সাথে ও মেলবন্ধনে একে অন্যের প্রতীক হিসাবে নিবন্ধ আছে। কিন্তু বর্তমানে ও মানুষ ও প্রকৃতির যে সম্পর্ক তা কোথাও যেন ছিন্ন হচ্ছে।
নাম: আব্দুল রাহাজ
প্রতিবাদ
অর্চনা ভট্টাচার্য্য
বৃষ্টি এলো কালো করে
মেঘের মাদল সঙ্গে করে
গুরু গুরু গুরু বাজে অবিরত
ধরণী হ'ল ধারায় স্নাত ।
চরাচর সব ঢেকে গেল জলে
অবরুদ্ধ আজ রয়েছে সকলে
বুঝি ভয় হয়, হবে সব লয়
জনপ্রাণী আজ দেখি না কোথাও।
দাবদাহে সবে হয়েছে ক্লান্ত
প্রখর তাপে পৃথিবী অশান্ত
তাহারে শীতল করিতে বুঝি
ঝরে ধারা অবিশ্রান্ত ।
বাদল ধারা ঝর ঝর ঝরে
বিরাম নাই যে পথে বাহিরিবে
কাহারও খোঁজ পাই না আজিকে
মোবাইল টাওয়ার বন্ধ ।
শুনিতেছি আজ পড়েছে কোথাও
মহীরুহ সব পথের উপর
বুঝি অভিমানে বাধিয়েছে জট
করিয়াছে পথ ধর্মঘট ।
তারা যে মূক, তারা যে বধির
তবুও আছে তাদের শরীর
আছে প্রাণ আছে অনুভূতি
শোনে না যে কেউ তাদের আকুতি।
প্রকৃতি আজ হয়েছে পাগল
তারই তরে আজ খুলেছে আগল
সকলে মিলেছে এক সাথে আজ
করিতে বন্ধ সভ্যতারাজ ।
ঢপ বাজদের চিনলি না।
দিলীপ রায়।
হাঁদা-
তুই রয়েই গেলি গাধা।
ঢপ বাজদের চিনলি না।
এরা কথার জালে,
ফাঁশায় তোকে।
এতো দিনেও বুঝলি না।
এরা মুখোশ ধারী,
মধুর হাড়ি।
এদের মিষ্টি কথায় ভুলিস না।
তাই বলছি তোকে,
সতর্ক থাক।
এদের ফাঁদে গলিস না।
ওরা ধুর্ত অতি,
শকুন জাতি।
ঠুকরে খাবে মাংস তোর।
ওরা ভদ্রবেশী,
বক ধার্মিক।
আসলে ওরা সিঁধেল চোর।
সারা জীবন শুধুই ঠকলি
ঠকে ঠকে ঠাকুর হলি
তবুওতো শুধলি না।
হয়নি দেরি,
সময় আছে।
কেন ওদের রুখবি না?
চোখ
অনির্বান দাস
আমার চোখে তোমার চোখ পড়ল যখন,
তোমার আমার শুভদৃষ্টি হইল তখন।
চোখেই হয় প্রেম চোখেই হয় চাওয়া,
চোখ দিয়ে দেখে মানুষ চোখেই হয় প্রেমের গান গাওয়া।
চোখ দিয়ে দেখে মানুষ প্রথম পৃথিবীর আলো,
চোখ না থাকলে পৃথিবীর সবকিছু হয়ে যায় কালো।।
No comments:
Post a Comment