PravatiPatrika

Monday, June 15, 2020

কবিতা, গল্প ও ধারাবাহিকউপন্যাস



            ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস

                     সোহান ও তার বন্ধুরা
                             পার্থসারথি
                                পর্ব-৯
কথামতো সবাই ঠিক সময়ে স্কুলে চলে এল। তবে এখনও ক্লাশ রুমে ঢুকে নি। বাইরে বসেই গল্প করছে। সোহান নতুন শার্ট-প্যান্ট পরে এসেছে। প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে কোমড়টা হালকা বাঁকা করে দাঁড়িয়েছে। বেশ লাগছে দেখতে। চিনুদা ওকে মাঝে মাঝে চোখ আঁড় করে দেখছিল। কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে যথাসময়ে ক্লাশে ঢুকল সবাই। সরোজ এখনও পৌঁছায় নি। ওরা কয়েকজন মিলে একসাথে হেঁটে আসে। খাতা দিয়ে সরোজের জন্য জায়গা রাখল।
তিন পিরিয়ড ক্লাশ হয়ে গেছে। চিনুদা খবর নিয়ে এসেছে। চতুর্থ পিরিয়ডের টিচার আজ আসেন নি এবং ক্লাসও হবে না। সুতরাং হাতে অনেক সময়।
'দেরি করে লাভ নেই।চল, বাজারে যাই।'- এই বলে চিনুদা কাহার ও নাউড়াকে কাছে ডাকল। সরোজকে বলতে হয় নি। সে নিজেই এগিয়ে এসেছে। সবাই মিলে বাজারের দিকে রওনা হলো।
বাজার আজ পড়তি ছিল। কারণ পাইকারদের তেমন সরব উপস্থিত ছিল না। তার ওপর বাজারে মুরগীর প্রচুর আমদানি। মুরগীর বাচ্চা কিনতে বেশিক্ষণ সময় লাগে নি। মোট আটটা বাচ্চা কেনা হল। বাচ্চাগুলো বেশ বড়বড়। কিনে সাথে সাথেই চিনুদার বাড়ীতে রেখে আসা হলো। কোনরকম দেরি না করেই আবার স্কুলের দিকে রওনা হল।
সুজন, সোহান ওরা চিনুদার জন্য স্কুলের মেইন গেইটে অপেক্ষা করছে। আসফি ওদের দূর থেকে ফলো করছে। আর মনে মনে ভাবছে ব্যাপারটা কী!
প্রথমে সোহান দেখতে পেয়েই চেঁচিয়ে ওঠল-ঐতো চিনুদারা আসছে।'-এই বলে সুজন ও সোহান এগিয়ে গেল। মুরগীর বাচ্চা কেনা হয়ে গেছে শুনে ওদের যে কী আনন্দ। চিনুদাকে ঘিরে সবাই হাঁটছে। যেন এক মহানায়ককে অভিনন্দন জানিয়ে এগিয়ে নিয়ে আসছে। সবার চোখে-মুখে রাজ্যের আনন্দ। সবাই একসঙ্গে ক্লাশ রুমে ঢুকল।
সোহানটা এমনিতেই একটু ভীতু প্রকৃতির। আর পানিতে তো একেবারে মহাভীতু। প্রথম যেদিন সাঁতারের জন্য পানিতে নামাতে যায় সোহানকে, সেদিন রীতিমত লংকাকান্ড অবস্থা। গরুকে স্নান করাতে গেলে যেমন হয় ঠিক তেমন অবস্থা হয়েছিল। সোহানকে যতই পানির দিকে ঠেলা-ধাক্কা দেয়া হয় ঠিক তার দ্বিগুণ শক্তিতে পেছনে ঠেলে থাকে। সবাই খুব চিন্তিত। সোহানও দুঃশ্চিন্তায় পড়ে গেছে। এখন উপায়? সোহান গালে হাত দিয়ে বসে আছে। তার পাশে অন্য সবাই চুপচাপ। নাউড়া সোহানের কাছাকাছি হয়ে বসে বলল- '' কীরে সোহান, তুই পানিতে নামছিস না কেন?'
'ভীষণ ভয় এসে ভর করে।'-ওর কথাতেই যেন রাজ্যের ভয় জড়িয়ে আছে।
'ভয় পেলে কী চলবে? একটু সাহস করে একবার নেমে পড়। দেখবি ডর-ভয় নিমেষে সব উধাও হয়ে গেছে।'- নাউড়া সোহানকে বুঝাতে চেষ্ঠা করে।
সোহান বেশ কাঁচু-মাঁচু হয়ে বলে- সাহস তো রাখার চেষ্ঠা করি। কিন্তু পানির কাছাকাছি গেল সাহস ধরে রাখতে পারি না। সবকিছু কেমন যেন ওলট-পালট হয়ে যায়।'
সোহান আর নাউড়া কথা বলাতে ব্যস্ত। এরই মধ্যে চিনুদা সব পাকাপোক্ত করে ফেলেছে। চিনুদার কথামতো সবাই মিলে সোহানকে পাঁজাকোলা করে তুলে ধরে পানিতে নেমে এলো। সোহান চোখ বন্ধ করে চিৎকার করতে লাগল। কিন্তু তবুও ওরা সোহানকে ছাড়ে নি। তারপর ধীরে ধীরে হাত পা পানিতে ছুঁড়তে লাগল সোহান। একদিন, দু'দিন, তিনদিন...সাঁতার শেখা চলতে লাগল। পুরো পনের দিন লাগল সাঁতার শেখাতে।
চিনুদা ইদানিং একটা ব্যাপার ঠিকই লক্ষ্য রাখছে। ওর দৃঢ় বিশ্বাস এ ব্যাপারটা অন্য কেউ লক্ষ্য করে নি। চিনুদা সবার কাছে জানতে চাইল, নতুন কোন কিছু কেউ লক্ষ্য করেছে কি-না। কেউ কিছুই বলতে পারে নি। তারপর ব্যাপারটা সবাইকে বুঝিয়ে বলল- '' আসফি, শিবলী, কাজল ওরা ক'দিন ধরে আমাদেরকে ফলো করছে।'
সবাই তো রীতিমত অবাক, প্রায় এক সঙ্গে বলে ওঠল- 'তাই নাকি?'
এখন থেকে খুব সাবধানে চলাফেরা করতে হবে। নয়ত কখন আবার কোন কু বুদ্ধি এঁটে বসে ঠিক নেই।
দেখতে দেখতে পরীক্ষা এসে গেল। সবাই লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত। শুধু মাঝেমধ্যে বিকেল বেলা ওরা দেখা-সাক্ষাৎ করে। তবে বেশির ভাগ সময় লেখাপড়া নিয়েই কথাবার্তা হয়।ফাঁকে ফাঁকে মুরগীর বাচ্চগুলোর যত্ন নেয়। মুরগীর বাচ্চাগুলো বেশ বড়সড় হয়েছে। দু'একদিন পরপর মুরগীর বাচ্চগুলো হাতে নিয়ে ওজন পরীক্ষা করে দেখে। এর মধ্যে একটা মুরগীর বাচ্চা বেজী ধরে নিয়ে গেছে। এখন আছে সাতটা।
আজ শুক্রবার। গতকালই ওদের পরীক্ষা শেষ হয়েছে। সকাল দশটায় সবার পুকুর পাড়ে চলে আসার কথা। পিকনিকের ব্যাপারে বিশদ আলোচনা হবে।
যথাসময়ে সবাই চলে এসেছে। শুধু চিনুদা এখনও এসে পৌঁছায় নি। অবশ্য এখনও মিনিট পাঁচেক সময় বাকি আছে। চিনুদার আবার সময় জ্ঞান বেশ ঠনঠনে। কোনদিন পারতঃপক্ষে দেরী করে না। যদি বিশেষ কোন অসুবিধা হয় সে আলাদা কথা। আজ দেরী হলে হতেও পারে। কারণ পিকনিকের যাবতীয় হিসাব-নিকাষ এবং প্ল্যান করে নিয়ে আসবে।
গাছের ডালে সবাই অলসভাবে বসে আছে। আর কথাবার্তা হচ্ছে বেশ হালকা মেজাজে। যদিও পিকনিকের ব্যাপারে কিন্তু সব এলোমেলো আলোচনা। ওদের এই আড্ডা দেখেদেখে কিছু কাক-পক্ষীও যেন ওদের সঙ্গী হয়ে গেছে। ওদেরকে আসতে দেখলেই কয়েকটা কাক আর এক জোড়া শালিক পাখি সর্বক্ষণ আশেপাশে ঘোরাফেরা করতে থাকে। তার অবশ্য একটা যৌক্তিক কারণও আছে।এটা-ওটা করে ওরা প্রতিদিনই কিছু-না-কিছু খায়। আর তার থেকেই কিছুটা ভাগ কাক-পক্ষীর জন্যও বরাদ্দ থাকে।
গাছটা ঝড়ে হেলে পড়াতেই এর সৌন্দর্য যেন কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। গাছটা হেলে পড়ে যেন জলের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলেছে। ডালগুলো জলের এতটাই কাছাকাছি যেন কানে কানে কথা বলছে।
নাউড়া ডাল বেয়ে বেয়ে জলের খুব কাছে চলে এল। স্পষ্ট দেখতে পেল কয়েকটা মাছ দৌঁড়াদৌড়ি করছে। নাউড়া কিছুক্ষণ মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখল। সকালের শীতল জলে হাত ছোঁয়ালো। তারপর কয়েক কুশ জল ছিটিয়ে দিল চোখে-মুখে।সোহান এতক্ষণ চেয়ে চেয়ে দেখছিল। শেষ পর্যন্ত লোভ সামলাতে না পেরে ডাল বেয়ে জলের কাছাকাছি নেমে এলো।
সবাই চোখ রেখেছিল চিনুদার আসার পথে। কিন্ত সবার চোখকে ফাঁকি দিয়েই চিনুদা চলে এল। হাতে দুটো পুটলা। আজ চিনুদাকে খুব খোশ-মেজাজের মনে হচ্ছে। কারণ বুট, চানাচুর, মুড়ি, পুরি যা'ই আনা হোক ; চিনুদা কখনও আনতে যায় না। অথচ আজ নিজ থেকেই নিয়ে এসেছে। চিনুদা চলে আসতেই নাউড়া ও সোহান স্বস্থানে ফিরে এসে বসল। চিনুদা একটা প্যাকেট খুলল। বাদামের প্যাকেট। সবার হাতে বাদাম পৌঁছে গেল। কয়েকটা বাদাম পাশের দুর্বা ঘাসের উপর ছিটিয়ে দিল। কাক আর শালিক জোড়াও ব্যস্ত হয়ে গেল।
বাদাম খেতে খেতেই কথাবার্তা শুরু হলো। কথা বলার মাঝে চিনুদা হঠাৎ থেমে গেল। স্কুলের ক্লাশ রুমের বারান্দার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। আসফি, কাজল, শিবলী ওরা চিনুদার চোখকে ফাঁকি দিতে পারে নি।সবাইকে ডেকে চিনুদা দেখাল। অবশ্য আসফিকে চিনুদা তেমন একটা পাত্তা দিচ্ছে না। বাদাম চিবোতে চিবোতে আবার আলোচনা শুরু হলো। সবার উদ্দ্যেশে চিনুদা বলল- 'আমরা পিকনিকটা করতে চাই আগামী শুক্রবার।কারও কোন আপত্তি বা সমস্যা আছে কি?'
সবাই খুশীতে সমস্বরে সম্মতি জ্ঞাপন করল। এই মাহেন্দ্রক্ষণটির জন্য যেন অপেক্ষা করছিল। কারও পক্ষ থেকে কোনরকম আপত্তি ওঠে নি।
চিনুদা এবার শুরু করল- 'ঠিক আছে। তাহলে আমরা আগামী শুক্রবার যাচ্ছি। এবার আমাদের কী কী লাগবে তা' জানা দরকার।'-এই বলে কোন উত্তরের অপেক্ষা না করেই আবার শুরু করল- 'আমরা মাইক বাজাতে বাজাতে যাব। এতে আশা করি কারও আপত্তি থাকার কথা নয়।'
কাহার উল্লসিত হয়ে বলল- 'না, না, না, - বেশ মজা হবে!'-সাথে সাথে অন্যরাও কন্ঠ মেলাল।
চিনুদা বেশ খুশী হয়ে বলল- 'ফাইন! তোদের আগ্রহ দেখে খুব ভালো লাগছে। ঠিক আছে, এবার আসল কথায় আসা যাক। কেউ কি নৌকা ম্যানেজ করতে পারবি?'
কারও কাছ থেকে কোন উত্তর নেই।
চিনুদা সবার দিকে একপলক তাকাল। নাউড়ার দিকে তাকাতেই বলল- 'আমি নৌকা ম্যানেজ করতে পারবো না।'
চিনুদা এবার বলল- 'ঠিক আছে। কোন অসুবিধা নেই। আমিই ম্যানেজ করব। নৌকা ভাড়া নিলে আমাদের চলবে না। কারণ নৌকা ভাড়ায় নিলে আমাদের বাজেটে টান পড়বে।নৌকা ভাড়া অনেক। তাছাড়া আবার মাইকও তো ভাড়ায় নিতে হবে। মাখনাপাড়ায় আমার এক বন্ধু আছে। ওকে বলে-কয়ে একটা নৌকা ম্যানেজ করে নেব। হয়ত বড়জোড় দশ-বিশ টাকা লাগতে পারে। সেটা দেখা যাবে।'
শেষ কথাটার উত্তরে বলল- 'দশ-বিশ টাকা কোন ব্যাপার না।'
চিনুদা নিজের কথায় চলে এল- 'আজ বিকেলেই মাইকের কথা আলাপ করে রাখব। এবার আমাদের দরকার লাকড়ি।'
নাউড়া বেশ জোর গলায় এবং বেশ উৎফুল্ল হয়ে বলল- 'লাকড়ির ব্যবস্থা করা আছে। এ নিয়ে কোন চিন্তা করতে হবে না।'
চিনুদা চোখ দুটো ছোট করে বেশ অবাক হয়েই তাকাল। কারণ লাকড়ির ব্যবস্থা হয়ে গেছে অথচ সে নিজে জানে না।তাই আশ্চর্য হচ্ছে। নাউড়া ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বলল- 'একদিন কথায় কথায় ব্যাপারটা সরোজকে বলেছিলাম। ও বলেছিল ওদের বাগান বাড়ীতে অঢেল লাকড়ি। তাই লাকড়ি নিয়ে যাওয়ার কোন দরকার নেই। কিন্তু কথাটা তোদেরকে বলতে একদম ভুলে গিয়েছি। স্যরি, এক্সট্রিমলি স্যরি!'
চিনুদা খুশী হয়েই বলল- 'স্যরি বলছিস কেন? ভালো একটা কাজ এগিয়ে রেখেছিস। তোকে বরং আমাদের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ দেয়া উচিত।'
সবাই চিনুদার কথায় সমস্বরে সম্মতি জানাল। চিনুদা আবার বলতে শুরু করল- 'যাক ভালই হলো। এভাবে জেনে রেখেছিস বলেই একটা চিন্তার বোঝা মাথা থেকে নেমে গেল। সবাইকে এভাবে টুকটাক কাজ এগিয়ে রাখতে হবে। চাল, ডাল, তেল, লবণ, মশলা ইত্যাদি আমরা কিনে নেব এক ফাঁকে। আর আমাদের গাছ থেকে ডাব নিয়ে যাব। ডাব কিনতে হবে না। পরক্ষণেই মনে পড়ে গেল এমন ভঙ্গীতে বলল-'না, ডাব...ডাব...সরোজদের বাগানেই পাওয়া যাবে। শুনেছি ওদের বাগানবাড়ী বিশাল বড়। এমন গাছ নেই যা ওখানে নেই। অতএব আমরা নিশ্চিন্ত থাকতে পারি।'
চিনুদার কথা শুন নাউড়া মুচকি মুচকি হাসছিল। কিন্তু চিনুদার চোখ এড়াতে পারে নি। চিনুদা চোখ কিছুটা কুঁচকে বলল- 'কি-রে নাউড়া, হাসছিস কেন?'
না, এমনি।–নাউড়া প্রসঙ্গটা এড়াতে চাচ্ছে।
এমনি এমনি কেউ হাসে না। একমাত্র পাগলই এমনি এমনি হাসে।
চিনুদা বিশ্বাস কর, এমনি এমনি হেসেছি। কোন কারণে হাসি নি।
কিছুটা রাগ করেই চিনুদা বলল- 'তোর কথা বিশ্বাস করতে পারলাম না। এত তালবাহানা না করে সত্যি কথাটা বলে ফেল। তোরা ভালো করে জানিস, আমি মিথ্যা কথা একদম পছন্দ করি না। আর সত্যিটা যতই অপ্রিয় হোক আমি মাথা পেতে নিই।'
নাউড়া মনে মনে ভাবল, সত্যি কথা না বলে রেহাই নেই। তাছাড়া ব্যাপারটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। হাসতে হাসতে বলল- 'ডাবের ব্যাপারটা শুনে হাসছিলাম। প্রথমে তোদের গাছ থেকে ডাব নিবি বলেছিস। যেই না একটা সুযোগ পেলি অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দিলি।'
আমাদের গাছটা অনেক উঁচু। ঐ গাছ থেকে ডাব পেড়ে আনা অনেক কষ্টসাধ্য কাজ। যদি কোন উপায় না থাকত অবশ্যই আমাদের গাছ থেকে নিতাম। তাছাড়া তোরা ভালো করেই জানিস এটা আমার একটা গুন।'-এই বলে চিনুদা কথাটা হেসে উড়িয়ে দিল।
নাউড়া একটু আশ্বস্ত হল। তারপর আর এব্যাপারটা নিয়ে কোন কথা হয় নি। এবার দ্বিতীয় পুটলাটা খুলে চানাচুর বের করল নাউড়া। সবার হাতে চানাচুর পৌঁছে গেল। কাক-পক্ষীও বাদ যায় নি। খাক-বা-না-খাক কাকপক্ষীও পাবেই।
সবাই উঠতে যাবে এমন সময় সোহান কাঁদু কাঁদু কন্ঠে বলল- 'তোরা সবই তো ঠিক করলি। কিন্তু আমার আব্বু মনে হয় আমাকে পিকনিকে যেতে দেবে না।'
সবাই একেবারে হতভম্ব হয়ে গেল। চিনুদার চোখ জোড়া কুঁচকে গেল। চোখ কুঁচকে যাওয়া মানেই কিছুটা হলেও রেগে গেছে চিনুদা। কিছুক্ষণ নীরব থেকে চিনুদা বলল- 'তার মানে!'
আমার মনে হয় আব্বু আমাকে যেতে দেবে না। কারণ আমাকে কোথাও একা যেতে দিতে আব্বু ভীষণ ভয় পান। তার ওপর নৌকা ভ্রমন।
চিনুদা কতক্ষণ কী যেন ভাবল। তারপর বলল- 'ঠিক আছে ওসব আমি ম্যানেজ করে নেব। তোকে এ নিয়ে আর ভাবতে হবে না।'
সোহান রীতিমত অবাক। মুখ হা হয়ে আছে। কোন কথা যেন মুখ থেকে বের হচ্ছে না।
চিনুদা টিপ্পনি কেটে বলল- 'ওভাবে হা করে আছিস কেন? মুখে মাছি ঢুকবে যে!'
চিনুদার কথা শুনে সবাই একসঙ্গে হেসে ওঠল। কিন্তু সোহান এতক্ষণ নিজের জগতেই ডুবে ছিল। হাসাহাসি থামতেই সোহান বলল- চিনুদা তুই সত্যি বলছিস, আব্বুকে ম্যানেজ করতে পারবি?'
এটা কোন ব্যাপার হল নাকি! তোর আব্বুকে বাসায় পাওয়া যাবে এখন?
'আজ শুক্রবার, আজ শুক্রবার।'-সোহান মনে মনে আওড়াতে আওড়াতে তারপর বলল- হ্যাঁ, মনে হয় পাওয়া যাবে।'
'তাহলে এখনই চল। আগে তোর ব্যাপারটা ঠিক করে নিই। পরে ঝামেলা হলে সামলাতে পারব না।'-চিনুদা বেশ তাড়া দিয়েই বলল।
সবাই দল বেঁধে সোহানদের বাসার উদ্দ্যেশে রওনা হল। যখন ওরা গাছ থেকে নেমে হাঁটা শুরু করেছে ঠিক তখনই আসফি, কাজল আর শিবলী ওরা দূরে সরে গেছে। চিনুদার দৃষ্টিকে ফাঁকি দিতে পারে নি।   চলবে...





        অন্য এক কবি
              বিনয় ভড়

 পিছনে তাকিয়ে দেখি -
 অনেক বছর এগিয়ে এসেছি
  কিন্তু বয়স, একই আছে
  কি আশ্চর্য ! এরকম হয় -

 চোখ তুলে দেখি মূর্ত আকাশের সামনে
 পথরোধ করে দাঁড়িয়ে এক পথিক
ঝাপসা অন্ধকারে মুখটা ভীষণ চেনা

 আস্তে আস্তে মাথাটা নুয়ে এলো
 হাতটা মাটির কাছে নিয়ে যেতেই
 সব আবছা -

 দূরে - বহুদূরে শোনা গেল
 দীপ্ত কণ্ঠে আবৃত্তি
" বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি,
 তাই আমি পৃথিবীর রূপ
 খুঁজিতে যাই না আর -"





     জীবন চুঁইয়ে পড়ে নোনাজল
          পৃথা চট্টোপাধ্যায়

আরো বেশি নিঃসঙ্গ হলে
             হৃৎপিন্ডের শব্দ শোনা যায়
নিঝুম দুপুরকে মাপা যায় লীনতাপে
   বৃত্তের জ্যা ধরে হেঁটে গেলে
           পাওয়া যায় অর্থহীন ব্যাসবাক্য
সমোচ্চারিত  উল্লাসে
     হয়তো পেতেও পারো উৎসব প্রাঙ্গণ

তবুও তো
জীবন চুঁইয়ে পড়ে নোনাজল
পাখিদের শিস্ দেওয়া রাতে
       বিপণ্ণ  বিস্ময় এক খেলা করে...





  নেপো দাদুর কথা
  রাজকুমার ঘোষ

নেপো দাদু ভীষণ খোচো
নস্যি নিতো নাকে ।
ঘুটে বেচে করতো আয়
গন্ধ গায়ে থাকে !

নেপোদাদু কিপ্টে বহুত
পড়তো শুধু লুঙ্গি ।
টাকা নিয়ে করলে ক্যাচাল
বাজাতো বেশ পুঙ্গি !

নেপো দাদু থাকতো একা
ছিলোনা কেউ তার ।
বুড়ো বয়সে করলো বিয়ে
ঠাম্মাটি শানদার ।

নেপোদাদুর মুখে কেবল
বন্ধু পানুর নাম।
সখ-আহ্লাদ আছে যখন
বন্ধুর বাড়ে দাম।





   বেণীমাধব বালক বিদ‍্যালয়
        মহীতোষ গায়েন

মালতীবালা,মালতীবালা, তোমার কাছে যাবো।
মালতীবালা,আমি কি আর তোমায় ফিরে পাবো,
মালতীবালা,তুমি এখন কার সঙ্গে থাকো
আগের মত,তুমি কি আর আমার স্বপ্ন দেখো?

মালতীবালা, মালতীবালা, তোমার রঙ কালো
গোপন প্রেম গোপন ছিল,মনের মধ্যে আলো,
দোকানে দেখে আমার কাছে দিয়েছো সব কত
তখন কি সে বিরহ-জ্বালা বুঝেছি অতশত।

বাগানে হেনা ফুল ফুটেছে মাতাচ্ছে যে বুক
রূপ-নদীতে স্নান করেও পাচ্ছি না তো সুখ,
তখন আমি দ্বাদশ শ্রেণি আনন্দে মৌ-বন
ঠিকানাহীন ভবিষ্যতের বাঁধন হারা মন।

আমি এখন বেণীমাধব স্কুলে পড়াই ভালো
সন্ধ্যেবেলায় পড়ার জন্য কতজনই এলো,
আমি এখন অঙ্ক স‍্যার বিরাট স্কুল বাড়ি
খোঁপায় জুঁই ফুল দেখলে মনকাড়ে সে শাড়ি।

মালতীবালা,মালতীবালা,অনেকদিন পর
সত্যি বলছি আজো সে প্রেম গুমরে কেঁদে মরে,
প্রেমিকাকেই বলেছিলাম তোমার সব কথা
সেজন‍্য‍ইতো মেঠো বিবাদ অন্তরে খুব ব‍্যথা।

তোমার পাশে দেখছি যাকে অনেকদিনের পর
সে কি তোমার প্রিয় পুরুষ, সে কি তোমার বর,
প্রাণ ভরলো মন ভরলো চোখের কোণে জল
ঘরেতে আর মন বসেনা‌ কাটছে না যে পল।

জীবনে আমি প্রতিষ্ঠিত,আছে ফ্ল্যাট গাড়ি
ব‍্যাঙ্কে টাকা গহনা-সোনা স্ত্রী-র সঙ্গে আড়ি,
রোজ রাতেতে  ফিরেই আসা এ জীবন-নদী চরে
হাই-ফ‍্যামিলি কেউ দেখেনা মনের কষ্ট ঝরে।

গভীর রাতে চাঁদের আলো ভেসে আসে সে গান
কোথায় গেলে মালতীবালা, কেটে গেছে সে তান,
ছন্দে ফেরা এ রাতে সব শপথ করে চায়
বিনষ্ট যেন না হয়ে কেউ প্রথম প্রেম পায়।





সুশান্ত'র আত্মহত্যা
                  মৃন্ময় ভট্টাচার্য্য

স্বপ্নের উড়ানে চড়ে
সবারে পিছনে ফেলে
একলা ঘুড়ির মতো
আকাশটা ছুঁয়ে ছিলো ।

আকাশে উড়তো বলে
দেখেছি সকলে মিলে,
ভেবেছি উড়তে পেলে
অপ্রাপ্তি সবই মেলে ।

লাটাইয়ে বাধা সুতো
উড়বে উপরে যতো
বায়ু চাপ বাড়ে ততো
ছিলোনা যে কড়া সুতো !

পারলোনা সইতে টান
ছিঁড়ে গেল সুতো খান
সকলের মুখ ম্লান ,
মাটি হলো অভিযান ।

রাত শেষে দিন আসে
বলেনি কি কেউ তাকে !
তাই ভোকাট্টা মাঝ রাতে
খুঁজে নেয় মৃত মা'কে ।





             দিন আমাদের
                        হামিদুল ইসলাম।

আর কতোদিন
সইবো জীবন
পরিযায়ী পাখি ।

এ জীবন আছে
দুজনে আছি
তবু জলে ভরে আঁখি  ।।

এতোদিন ছিলো সব পাতাবাহার
হলুদ নদী
বাঁচার আশ্বাস ।

অরণ‍্যে দাবানল
পুড়ে যায় বনস্পতি
তবু ফিরে আসে সূর্যের আকাশ  ।।

ভালোবাসা প্রতিদিন
দুহাতের মুঠোয়
উন্মুক্ত সব চিলেকোঠা ।

তোমাকে ছেড়ে
যাবো না দূরে
এক হৃদয়ে আমরা ফুল হয়ে ফোটা   
 ।।

ভালোবাসা ফুল
পৃথিবী সুগন্ধময়
আমরা দুজন ।

জলে নামি
তর্পণ করি
উজ্জ্বল পৃথিবী। পাখিদের কূজন  ।।




ঈশ্বরের  কথা
সৌম্য ঘোষ


পৃথিবী ফেরত চেয়েছেন ঈশ্বর  ;
মনে আছে সেই ছবিটার কথা  ?
বোমা বিধ্বস্ত সিরিয়া , ইরান , লেবানন
বাতাসে বারুদের উগ্র গন্ধ
আকাশ ঢেকেছে কুন্ডুলীকৃত কালো ধোঁয়ায় ।
ক্ষত বিক্ষত ঝলসানো দেহ নিয়ে
শিশু টি বলেছিলো :
"আমি ঈশ্বর কে সব বলে দেবো ।"

হয়তো সে ঈশ্বর কে সব বলে দিয়েছে ।
বলে দিয়েছে ---
আমাদের পৈশাচিক উল্লাস , লোভ আর
নির্যাতনের কথা।

হয়তো সে ঈশ্বর কে সব বলে দিয়েছে :
আকাশের কথা , যে একদিন নীল ছিল ,
পাখীদের কথা , যার সুরে গান ছিল ,
পৃথিবীর কথা
যা সবার আশ্রয় ছিল একদিন  !
তিনি শুনেছেন ,
প্রকৃতির করুণ আর্তনাদ  ,
শুনেছেন সেই পাখীর কান্না  ।

পৃথিবী ফেরত চেয়েছেন ঈশ্বর  ।।





       হেরে যাবেন বিধাতা
       অর্চনা ভট্টাচার্য্য

এই পৃথিবীতে এত মায়া
তাইতো এই গ্রহে জীবের প্রকাশ
অন্য গ্রহগুলো  করে হা-হুতাশ।

এত নদী, গাছ গাছালি
জন্তু জানোয়ার, পাখ পাখালি
সবাই কেমন সুখে আছে
পাতিয়েছে দেখ মিতালি।

মানুষ পড়েছে মায়ার বাঁধনে
স্ত্রী পুত্র সন্তানে-ভাই বোনে
এমন সুন্দর সাজান গ্রহ
কোথায় আছে, আগে দেখেনি কেহ ।

বিধাতার বুঝি হিংসা হোল
মানুষের মনে লোভ পুরে দিলেন
লোভের বশে সে পাপ করল
করতেই লাগল
সোনার পৃথিবী নরক হোল।

মনে মে হাসেন বিধাতা
মানুষ হবে শ্রেষ্ঠতম?
যাবে শ্রষ্টাকে ছাড়িয়ে?
তাইতো সবকিছু দিলেন বিষিয়ে।

তবুও আজও আছে মায়া
আছে মমতা
হয়ত শুভ বুদ্ধির উদয়ে
হেরে যাবেন বিধাতা।




   সময় যখন থমকে দাঁড়ায়
    লক্ষণ কিস্কু

সময় যখন থমকে দাঁড়ায়
                   নীল সাগরের মাঝে
আমরা তখন বিদাই বেলায়
                   চোখের জলে ভেসে
বিরহ হৃদয় বিদীর্ণ ভেলায়
                  মিলবে কে জানে কত বর্ষের শেষে।

আলিঙ্গন চুম্বন ঠোঁটে গলায়
                  সাগরের কিনারে এসে
শরীর শীতল ঢেউয়ের তলায়
                  অনাবিল আনন্দের শেষে
মনভোমরা কাঁদে বিরহ ব্যথায়
                  গোপনে চিন্তন সোনালী কেশে
সময় যখন থমকে দাঁড়ায়
                  নিরাশ বুঝি ছন্দিত আকাশে।





ধারাবাহিক গল্প:-

কলেজে নৃত্যকলা
 - অগ্নিমিত্র ( ডঃ সায়ন ভট্টাচার্য)

পর্ব ১:-

 এই জীবনে অনেক রকম কাজই করেছি বা করতে হয়েছে । এরকমই একটি কাজ হলো কলেজ ফাংশনে নাচা।
  একা নয় অবশ্য, গ্রূপ ডান্স । ..চারজন ছেলে ও চারজন মেয়ে ।
  আমার কোনদিনই নাচের বদভ্যাস ছিল না। ফাংশনের তোড়জোড়েই ব্যস্ত ছিলাম। পোস্টার তৈরী, স্টেজ অ্যারেঞ্জ করা ইত্যাদি ।
  এমন সময়ে আমাদের ব্যাচের মানসী বলে একটি মেয়ে বলল-' লগ্ন সিনেমার একটা গান খুব জনপ্রিয় হয়েছে: মধুবন মে যোগ কানাইয়া ...। ওটা আমারা এবার ফাংশনে কোরিওগ্রাফ করবো।'
 সে ওরা ঠিক তো করলো, কিন্তু নর্তক পায় না। তখন আমরা সিনিয়র ; দরকার চারটি ছেলে ও চারজন মেয়ে যারা নাচতে পারবে।
 মেয়ে তো চারজন জোগাড় হল, কিন্তু ছেলে তিনজনের বেশি কিছুতেই হয় না।
 আমরা পোস্টার তৈরী করছি, এমন সময়ে মানসী তার দুঃখ ব্যক্ত করছিল।
 দীপিকা হঠাৎ বলে -' এই সায়নকে নে না। ভালো নাচে তো ।'
 কে জানে কোথা থেকে এই সব সূচনা পেয়েছে ।
 তবে ওর কথা আবার আমি ফেলতে পারতাম না একদম। মানে এক তরফা অব্যক্ত কিছু ছিল বোধহয় ।
 তাই একটু গাঁইগুঁই করেও আমিই হলাম ওদের চতুর্থ নর্তক!
 এবার মহড়া শুরু হলো। আমি ছাড়া বাকি সবাই জুনিয়র । এবং মোটামুটি ভালোই নাচছে। আমিই আর কিছুতে স্টেপগুলো বাগে আনতে পারি না!
  বাড়িতে বোনকে সব বললাম। ও বলল, -' আরে এরকম ভাবে কর। '
 সেই মত চলে একটু পোক্ত হলাম। পরদিন মানসী খুশী ।
  তবে মহড়ায় হঠাৎ সে বলল-' ডান্ডিয়া স্টাইলে নাচ হবে। সবাই ডান্ডি জোগাড় কর।'
 তখন বিগ শপার বলে একরকম ব্যাগ পাওয়া যেত, তার হ্যান্ডেলে  ডান্ডি থাকতো ।
  সেইগুলোই শেষে নেওয়া হলো ।
 আমরা মহড়া চালিয়ে যাচ্ছি; এমন সময়ে অমিত পোল্লে খবর আনল, বাকি সব গ্রূপেরা নাকি দারুণ দারুণ সব গানে নাচ করছে । সালমান খান, ঋত্বিক রোশন, এদের গান। অমিতও আমাদের গ্রূপেই ছিল।
 পোল্লে বলল-' যত সব মেয়েছেলে মার্কা নাচ। ধুর ।'
 এই কথা শুনে ফেলল মানসী; শুনে সে তো রেগে কাঁই । আমরা পড়লাম মুশকিলে ।...

 ( ক্রমশঃ)




No comments:

Post a Comment