PravatiPatrika

Saturday, June 13, 2020

রবিবারের পাতায়




               হুমায়ূন কবীর ঢালীর সাক্ষাৎকার
                         প্রশান্ত ভৌমিক

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখার প্রতি আমার আলাদা টান রয়েছে

(হুমায়ূন কবীর ঢালী, বাংলাদেশের জনপ্রিয় সাহিত্যিক। মূলত শিশুদের জন্য লিখতে ভালোবাসেন। ১৯৬৪ সালের ৩০ অক্টোবর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশের) নারায়নগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পৈত্রিক বাড়ি চাঁদপুরের সিকিরচরে।

শিক্ষাজীবন থেকেই লেখালেখির হাতেখড়ি। সাংবাদিকতা করেছেন বিভিন্ন পত্রিকায়। লেখালেখিতে পুরোপুরি সময় দেবেন বলে সেই কাজও ছেড়েছেন অনেক দিন। প্রথম বই প্রকাশিত হয় ১৯৯১ সালে। প্রেমের উপন্যাস দিয়ে শুরু হলেও লেখালেখির ধরণ ১৮০ ডিগ্রি পালটে এখন লিখছেন শুধুই শিশুদের জন্য। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৮০। ২৬ শে নভেম্বর,২০১৮ তে কলকাতার বিধাননগরে হুমায়ূন কবীর ঢালীর এক বন্ধুর প্রেসে বসে লেখালেখি সহ নানা বিষয়ে কথা বলেছেন তিনি ।)

প্রশান্ত ভৌমিক;আপনার প্রথম প্রকাশিত লেখা এবং প্রথম প্রকাশিত বই সম্পর্কে বলুন। আমরা জানি যে, আপনি মূলত শিশুদের জন্য লেখালেখি করেন। এর পিছনে বিশেষ কোনো কারণ আছে কি?

হুমায়ূন কবীর ঢালী: সব বাঙ্গালিরই লেখালেখির শুরুটা বোধহয় কবিতা লেখার মাধ্যমে। আমারো তাই। ছাপা হয়েছিলো কলেজ ম্যাগাজিনে। সেটা নিছক আবেগ থেকে লেখা। পড়াশোনা শেষ করে আমি সাংবাদিকতা শুরু করি জাতীয় পত্রিকায়। আজকের কাগজ, ভোরের কাগজ, পরবর্তীতে সাপ্তাহিক সমীক্ষণেও আমি ছিলাম সহকারী সম্পাদক। আমারর প্রথম প্রকাশিত বইটি ছিল একটি প্রেমের উপন্যাস। ‘মন শুধু মন ছুঁয়েছে’ নামের বইটি অসংখ্য মানুষের ভালোবাসা পেয়েছিল। ১৯৯১ সালে প্রকাশিত হয়েছিল বইটি। পরবর্তীতে দেখলাম যে, প্রেমের উপন্যাস কিংবা বড়দের জন্য লেখালেখির জায়গাটা আমার জন্য না। আমার ভালোবাসার জায়গাটা আসলে শিশুসাহিত্য। ছোটবেলা থেকেই শিশুদের প্রতি একটা ভালোবাসা থেকেই শিশুসাহিত্য শুরু করলাম। শিশুদের জন্য আমার প্রথম বই হলো ‘দুষ্টু ছেলের গল্প'। এটা মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে লেখা একটি উপন্যাস। মুক্তিযুদ্ধের পরের প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ধারণা দেয়া এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যেই উপন্যাসটা লেখা। তারপরে অনেক গল্প বেরিয়েছে, উপন্যাস বেরিয়েছে, ফিকশন বেরিয়েছে, নন ফিকশন বেরিয়েছে, সম্পাদিত বই বেরিয়েছে। একেবারে নিছক ভূতের গল্প বেরিয়েছে, রূপকথার গল্প বেরিয়েছে। অনেকে বলে যে ভূতের গল্প- এটা কেমন একটা গল্প! আমি মনে করি না যে ভূতের গল্প লেখা যাবে না। কেন যাবে না? একটা শিশুর হাতে আমি শিশুর উপযোগী সব রকমের বইই তুলে দেব। সে যেটা পড়ে মজা পাবে সেটা পড়ুক। যখন সে বুঝবে যে আমার এটা পড়া উচিত নয়, সে পড়বে না। আর ভূতের গল্প বা রূপকথার গল্প লেখে নাই বাংলা সাহিত্যে এরকম লেখক নাই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে সব লেখকেরই এই বিষয়ে লেখা আছে। এটা নির্ভর করে যে লেখার মানটা কী? লেখাটা আমি কীভাবে শিশুদের কাছে উপস্থাপন করলাম। শিশুদের মেধা- মনন এবং শিশুদের ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী লেখার ভাষা, বাক্য, শব্দ এবং পটভূমি সব ঠিক আছে কিনা এসব লক্ষ্য রাখতে হবে। সেটা ঠিক থাকলে সব ধরণের গল্পই লেখা যাবে- কোনো সমস্যা নেই।

সব মিলিয়ে আমার লেখা মোট ৮০ টি বই প্রকাশিত হয়েছে।

প্রশান্ত ভৌমিক: বিস্তারিত ভাবে বলুন।

হুমায়ূন কবীর ঢালী: আমার লেখা একটা বই গ্রীসের সরকারি স্কুলে পাঠ্য আছে। আমার বই উড়িয়া ভাষায় বেরিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের একাধিক প্রকাশনী থেকে নিয়মিত আমার বই প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশের বাইরে আসামের একটা প্রকাশনীও নিয়মিতভাবে আমার বই প্রকাশ করে থাকে। এবং প্রকাশকেরা নিজেদের টানেই এই বইগুলো প্রকাশ করে থাকেন। আমাকে আজকেই সাহিত্যম এর কর্ণধার নতুন পাণ্ডুলিপি দিতে বলেছেন। ব্যাপার হচ্ছে যে, দু-একজন পাঠক হয়তো আমার বই চায়। নয়তো কেন সে বলবে? আমার মূল জায়গাটা হচ্ছে শিশু সাহিত্য। শিশু- কিশোরদের জন্য লিখতেই আমার ভালো লাগে।

প্রশান্ত ভৌমিক: সাধারণত লেখকদের ইন্টারভিউতে একটা কমন প্রশ্ন করা হয়, দ্বীপান্তরিত হতে হলে আপনি কোন দশটি বই সাথে নিয়ে যাবেন? আপনি কি বলবেন এর উত্তরে?

হুমায়ূন কবীর ঢালী: আসলে এখন পর্যন্ত এই ধরণের ভাবনাই আসেনি যে আমি দ্বীপান্তরিত হব। আমি দ্বীপান্তরিত হতেও চাই না। কারণ, আমি আমার দেশকে ভালোবাসি। আমার বাংলাদেশকে, বাংলাদেশের সবুজকে ভালোবাসি। আমি বিভিন্ন জায়গায়, বিভিন্ন দেশে ঘুরতে যেতে চাই। ভালো লাগাটাকে হজম করতে চাই। কিন্তু দিন শেষে আমি আমার বাংলা মায়ের কোলেই ফিরতে চাইবো। আর যদি একান্তই এরকম কোনো সময় আসে যে আমার দ্বীপান্তর হতেই হবে কোনো কারণে, তাহলে কী করবো ভাবতে হবে। আসলে শুধু যে বই নিয়ে পড়ে থাকবো এমন নয়। দ্বীপান্তরে গিয়ে সেখানকার রস আস্বাদন করবো। ওখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্য, তাৎক্ষণিক বাস্তবতা হজম করবো। শুধু যে বই নিয়ে পড়ে থাকবো তা নয়। বই যদি নিতে হয় ঠিক শেষ মুহূর্তে ভাববো যে দ্বীপান্তরে গিয়ে পড়ার মতো বই কী হতে পারে।

প্রশান্ত ভৌমিক: মুক্তিযুদ্ধকে আপনি কীভাবে দেখেন? আমাদের দেশে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সেভাবে উল্লেখযোগ্য কাজ তেমন একটা হয়নি। আপনার মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বড় পরিসরে কোনো কাজ করার ইচ্ছে আছে কি?

হুমায়ূন কবীর ঢালী: মুক্তিযুদ্ধটা অবশ্যই আমাদের কাছে মানে আমরা যারা লেখালেখি করি তাদের কাছে বিশাল একটা ব্যাপার, বিশাল একটা পটভূমি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ হয়নি কথাটা ঠিক না। কাজ হয়েছে।

প্রশান্ত ভৌমিক: উল্লেখযোগ্য কাজ তেমনভাবে হয়নি সেটাই বলছিলাম।

হুমায়ূন কবীর ঢালী: উল্লেখযোগ্য হয়নি, হবে। ৫০০ বছর পরেও হতে পারে। হবে। হবে না কেন? এবং যেগুলো হয়েছে আমরা সেগুলোই কতটা সংগ্রহ করেছি, কতটা জানছি বা কতটা পড়ছি? যেগুলো হয়েছে সেগুলোরও কিন্তু প্রচার নেই। এগুলো প্রচার হলে যারা নতুন প্রজন্ম, যারা মুক্তিযুদ্ধোত্তর প্রজন্ম- তারা কিছুটা জানতে পারতো। গবেষকরা গবেষণা করবেন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। আমি কিন্তু গবেষক না, আমি লেখক। লেখকের কাজ হচ্ছে কল্পনা বিলাস, কল্পনা করা। সে জায়গা থেকে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমি কাজ করেছি, করবোও।

প্রশান্ত ভৌমিক: মুক্তিযুদ্ধের সময় আপনার বয়স কত ছিল? কোন স্মৃতি?

হুমায়ূন কবীর ঢালী: আমি তখন ছোট, ক্লাস ওয়ানে পড়ি ৭১ সালে। আমার সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে আমি একটা উপন্যাস লিখেছি যার নাম ‘একাত্তরের মিলিটারি ভূত'। রাজাকার, পাক হানাদারদের যে অত্যাচার, যে নিপীড়ন আমি দেখেছি, আমি শুনেছি, আমি পড়েছি তার উপর নির্ভর করে এই উপন্যাস। তোমার আগের প্রশ্নের সূত্র ধরে আমি বলি, আমি মনে করি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আরো বেশি বেশি লেখা উচিত, আরো বেশি বেশি জানা উচিত, আরো বেশি বেশি জানানো উচিত। কারণ সব রাষ্ট্রের, সব স্বাধীন দেশের একটা ইতিহাস থাকে, সৃষ্টির ইতিহাস থাকে। যদি সৃষ্টিকে অস্বীকার করা হয়, তাহলে সবকিছুকেই অস্বীকার করা হয়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে যারা অস্বীকার করে, আমি মনে করি বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে এ দেশে বসবাস করার কোনো অধিকার তাদের নেই। আমি মনে করি তাদেরকে গলা ধাক্কা দিয়ে, ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাংলাদেশ থেক বের করে দেওয়া উচিত। আর স্বীকার করতে হলে অতীত নিয়ে আরো বেশি বেশি কাজ করতে হবে। কারণ অতীতই আমার পরিচয়।

প্রশান্ত ভৌমিক: আচ্ছা আপনি বললেন যে মুক্তিযুদ্ধের সময় আপনি ক্লাস ওয়ানে পড়তেন। এবং আপনি মূলত শিশুসাহিত্য নিয়ে কাজ করেন। তাহলে আপনার পক্ষে তো খুবই সহজ ছিলো একটা শিশুর চোখে মুক্তিযুদ্ধটা কেমন সেটা দেখানো।

হুমায়ূন কবীর ঢালী: আমি বলি, আমার জন্ম নারায়ণগঞ্জে এবং ৭১ সালে আমরা নারায়ণগঞ্জে ছিলাম। ওই সময়ে ক্লাস ওয়ানের একটা বাচ্চার চোখ দিয়ে আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখি। মোটামুটি সেই বিষয়গুলিই আমি তুলে ধরি ‘একাত্তরের মিলিটারি ভূত' বইতে। এই বইটা পড়লে আমি আশা করি সেই সময়ের পরিবেশ- পরিস্থিতি এবং ঐ অঞ্চলের সিচুয়েশান কিছুটা হলেও অনুধাবন করা যাবে। শিশুদের উপর নির্যাতন, মিটিং- মিছিল সবকিছু। তবে এটাই আমার শেষ না। আমার ইচ্ছে আছে সেই সময়টাকে ধরে একটা দীর্ঘ পরিসরের উপন্যাস লেখার যাতে বোঝা যায় ঐ সময়ে শিশুরা কি অবস্থায় ছিল, কেমন ছিল।

প্রশান্ত ভৌমিক: অন্য প্রসঙ্গে আসি। পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সায়েন্স ফিকশনকে আধুনিক রূপকথা হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। আমরা শিশুকালে যে ঠাকুরমার ঝুলি কিংবা আরব্য রজণী পড়েছিলাম তারই পরিবর্তিত রূপ হচ্ছে আজকের সায়েন্স ফিকশন। এখনকার পাঠকও সাদরে গ্রহণ করেছে এই আধুনিক কালের রূপকথাকে। সুনীল বাবু একটা সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন সময়টাই পালটে গেছে। আপনি এ ব্যাপারে কি মনে করেন?

হুমায়ূন কবীর ঢালী: আমি সুনীলদার সাথে সম্পূর্ণ একমত। এটা আমিও মনে করি এবং আমি আমার একটা লেখায় বলেছিও যে বিজ্ঞান কল্পকাহিনী হচ্ছে আধুনিক রূপকথা। আগে যে রাজা বাদশাদের যুগ ছিল সেই সময়ের কল্পকাহিনী নিয়ে তখন রূপকথা হয়েছে। এখন আধুনিক সময়ে আধুনিক কাহিনী নিয়ে রূপকথা হচ্ছে। তখন ঘোড়ায় চড়ে আকাশে উড়ে যেত। এখন ফ্লাইং সসারে চড়ে আকাশে যাচ্ছে। ব্যাপারটা একই। সময় অনুযায়ী শুধু মাধ্যম পরিবর্তিত হচ্ছে।

প্রশান্ত ভৌমিক: আপনি যেহেতু ভূত বা অতিপ্রাকৃত বিষয় নিয়ে লিখতে পছন্দ করেন, তাই আপনাকে একটা প্রশ্ন করবো। আপনি ভূত বিশ্বাস করেন কিনা? যেখানে হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন তিনি ভূত বিশ্বাস করেন না কিন্তু ভূতের ভয় বিশ্বাস করেন। আবার শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বলেছেন, তিনি ভূত বিশ্বাস করেন কিনা সেটা জরুরী নয়, তবে তিনি ভূতের গল্প বিশ্বাস করেন। এ ব্যাপারে আপনার মতামত কি?

হুমায়ূন কবীর ঢালী: ছোটবেলায় ভূত বিশ্বাস করতাম শুনে শুনে। কিন্তু জীবনের এই পর্যায়ে এসেও ভূতের অস্তিত্ব, ভূতের ভয় কিংবা ভূত আছে এরকম কোনো ব্যাপার আমার কাছে ধরা দেয় নি বা আমি জানি না। তার মানে আমি মনে করি ভূত আসলে নেই। তবে আমাদের আশে পাশে অনেক গুলো ভৌতিক ব্যাপার থাকে। যেমন- আঁধার রাতে একা হেঁটে যাচ্ছি রাস্তা দিয়ে। হঠাৎ একটা গাছের ডাল ভেঙ্গে পড়ল। আমি ভাববো এটা হয়তো ভূতের কান্ড। কিন্তু আসলে এই ঘটনার কোনো ব্যাখ্যা কি আছে আমার কাছে? নেই। এটা হচ্ছে মানুষের কল্পনা বিলাস। মানুষের কিছু কল্পনা থাকে ভয়ের, কিছু কল্পনা থাকে মঙ্গল গ্রহে যাওয়ার, কিছু কল্পনা থাকে বাস্তবতার নিরিখে। আসলে মানুষের কল্পনার বিস্তার তো নানা শাখা- প্রশাখায়। কে কোন দিকে তাকে নিয়ে যাবে এটা নির্ভর করে যার যার কল্পনা শক্তির উপর। তাই বললাম, আমি ব্যক্তিগত ভাবে ভূতের অস্তিত্বের প্রমাণ এখনো পাইনি। তবে ভয় আমার আছে। অন্ধকারে হেঁটে যেতে একটা ভয় কাজ করে। আসলে ভয়টা কি ভূতের, না চোরের, না ডাকাতের আমি জানি না। তবে একটা ভয় কাজ করে।

প্রশান্ত ভৌমিক: ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে জানতে চাইছি। আপনার পরিবারে কে কে আছেন?

হুমায়ূন কবীর ঢালী: ব্যক্তিগত জীবন বলতে আমার পরিবারে আমরা পাঁচ জন সদস্য। আমি, আমার স্ত্রী, আমার দুই মেয়ে এবং এক ছেলে। বড় মেয়ে বিবিএ কমপ্লিট করলো। ছোট মেয়ে জগন্নাথ ইউনিভার্সিটিতে এবার চারু ও কারুকলায় ভর্তি হলো। ছেলেটা সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। গ্রামের বাড়িতে মা আছেন, ভাই- বোন আছে। আমি অতি সাধারণ মানুষ এবং সাধারণভাবে জীবন যাপন করতে পছন্দ করি, ভালোবাসি এবং আনন্দ পাই।



                     ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস

                         সোহান ও তার বন্ধুরা
                              পার্থসারথি
                                  পর্ব-৮

কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই মামা নাউড়াকে জড়িয়ে ধরল।নাউড়া আহলাদে মামার গলা জড়িয়ে ধরল। মনটা ভেতরে ভেতরে বেশ খুশী খুশী লাগছে। মামা বেশিদিন থাকবে না। নাউড়া মনে মনে ভাবল আজ চাওয়ার সুযোগ হবে না। আগামীকাল যেভাবেই হোক সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। অবশ্য মামা কখনও না করবেন না।চাইতে একটু লজ্জা লাগবে এই আর কি। মা-বাবা জানলেও কোন অসুবিধা নেই ; শত হলেও মামা।ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বললে মামা খুশী হয়েই দিবেন। কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলার পর নাউড়া নিজের রুমে চলে এলো।স্কুলের সব হোমওয়ার্ক রাত দশটার মধ্যেই শেষ করে ফেলল নাউড়া। মামা আর দাদা এখনও বসে গল্প করছে। নাউড়া চুপচাপ পাশে এসে দাঁড়াতেই দাদা এক ধমক বসাল- 'আবার এসেছিস কেন? যা পড়তে বস গিয়ে।'
আমি সব পড়া শেষ করেই এসেছি।–এই বলে নাউড়া মামার গা ঘেঁষে দাঁড়ায়।
দাদা আবার ধমক বসায়।নাউড়া কোন কথা না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। দাদা উঠতে যাচ্ছিল কিন্তু মামা হাত বাড়িয়ে ঠেকালেন। আর নাউড়াকে টেনে মামা পাশে বসালেন। দাদা চোখ গোল গোল করে বারবার নাউড়ার দিকে তাকাচ্ছে। নাউড়া একবারও দাদার দিকে তাকাতে পারছে না; ভয়েতে কুঁকড়ে আছে। অন্যদিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে আছে। নাউড়া বেশিক্ষণ থাকে নি। কারণ দাদাকে ক্ষ্যাপালে রক্ষা নেই। পরে প্রতিশোধ কড়ায় গণ্ডায় তুলবে।
পরদিন খুব সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠল নাউড়া। সে শুধু সুযোগ খুঁজছে। মামাকে একা পাওয়া যায় কি-না। কিন্তু দাদা যেন কাঁঠালের আঁঠার মতো পেছন পেছন লেগেই আছে। পড়ার টেবিলে নাউড়া বসেছে ঠিকই কিন্তু পড়ায় মন বসাতে পারছে না। মামার কাছে টাকা চাওয়ার মতো কোন সুযোগ পাচ্ছে না। পড়া বুঝার জন্য প্রীতম নাউড়ার কাছে এল। এই সুযোগে নাউড়া প্রীতমকে জিজ্ঞ্যেস করল- 'মামা কী করছে রে প্রীতম?'
তা'তো বলতে পারবো না। তবে সম্ভবত দাদার সাথে ঘরেই আছে।–এই বলে প্রীতম চলে যেতে চাচ্ছিল। নাউড়া ডাক দিয়ে বলে- 'একটু দেখে আয় না ভাই। মামা কী করছে।' 
প্রীতম মাথা নেড়ে চলে যায়। একটু পরই ফিরে এসে জানায়- 'মামা শুয়ে শুয়ে গল্পের বই পড়ছে।'
নাউড়া আসল কথাটা জানতে চায়- 'দাদা কোথায়?'
দাদাকে বাবা কোথায় যেন কাজে পাঠিয়েছে।–এই বলে প্রীতম আর দাঁড়ায় না। আসল খবর পেয়ে গেছে। তাই প্রীতমকে আর আটকায় নি।
'এখনই উত্তম সময়। দাদা আসার আগেই কাজটা সেরে ফেলতে হবে।'-নাউড়া মনে মনে ভাবল। পা টিপে টিপে এসে দরজার আঁড়ালে দাঁড়াল। তারপর দরজার আঁড়াল থেকে ভালো করে দেখে নিল। দাদা নেই। মামা একা একা শুয়ে একটা বই গভীর মনোযোগ সহকারে পড়ছে।
কোন শব্দ না করে নাউড়া পা টিপে টিপে রুমের ভেতর ঢুকল। খুব কাছাকাছি হয়ে দাঁড়ালেও মামা একদমই টের পায় নি। নাউড়া তাকিয়ে দেখল, মামা সত্যজিৎ রায়ের 'গ্যাংটকে গণ্ডগোল' বইটা পড়ছেন। মামা বইয়ের ভেতর ডুবে আছেন। সুতরাং টের না পাওয়ারই কথা। নাউড়া গলা খাঁকাড়ি দিয়ে উপস্থিতি জানান দিল। মামা এবার বইটা রেখে নাউড়ার দিকে তাকালেন।নাউড়া চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। কীভাবে টাকা চাইবে বুঝে ওঠতে পারছে না।মামা জিজ্ঞ্যেস করলেন- 'কিছু বলবে নাকি?'
নাউড়া আসল কথা না বলে বলল-'কী ব্যাপার মামা, এখনও শুয়ে আছো যে?'
'এমনিতেই। উঠে আর করবোটা কী! তাই সুযোগে বইটা পড়ছিলাম। তা তোর কী খবর? কিছু বলবে নাকি?'
নাউড়া মনে মনে ভাবছে, এখনই বলবে নাকি কিছুক্ষণ কা'বার্তা বলে তারপর বলবে। পাছে আবার দাদা হুট করে চলে আসে কি না! কথাটা মনে হতেই নাউড়া মনের অজান্তেই বলে ফেলল- 'মামা, তোমার কাছে একটা জিনিষ চাইবো দেবে?'
মামা স্বাভাবিক ভাবেই বললেন- 'দেরী না করে বলে ফেলো, কী দিতে হবে।'
আগে কথা দাও, দেবে।
আমার সাধ্যের ভেতর হলে অবশ্যই দেবো।
না, আগে তুমি বলো দেবে। তারপর বলবো।
মামা কী যেন খানিক ভাবলেন। তারপর বললেন- 'ঠিক আছে দেবো। নিঃশ্চিন্তে বলতে পারো।'
নাউড়া মামাকে সবকিছু বুঝিয়ে বলল। তারপর আসল কথাটা বলল- 'মামা, এখন শুধু দু'টাকা দরকার। তুমি যদি দিতে...!'
এখনই লাগবে? নাকি পরে দিলে হবে।–মামা বেশ আদুরে কন্ঠে কথাগুলো বললেন।
নাউড়া মনে মনে ভাবল। এখন দাদা নেই। ভালো এবং সুন্দর সময়। পরে নিতে আসা মানে বিপদ থাকতে পারে। দাদা দেখে ফেললে ঝামেলা করবে।কথাটা বাবার কানে চলে যাবে।পরে অনেক বকাঝকা শুনতে হবে। অনেক ভেবে-চিন্তে নাউড়া বলল- 'এখন দিয়ে দিলে খুব ভালো হয়।'
মানিব্যাগ হাতরে মামা একটা ঝকঝকে নতুন পাঁচ টাকার নোট দিলেন। নাউড়া অবাক হয়ে বলল- 'এটা তো পাঁচ টাকা।মামা, আমি দু'টাকা চেয়েছি।'
মামা নাউড়ার দু'গালে হালকা টোকা মেরে বলল- , তা জানি মামুজান।আমি তোমাকে পাঁচ টাকাই দিলাম।'
কখন আবার হুট করে দাদা চলে আসে তার কোন ঠিক নেই। একগাল মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে মামাকে ধন্যবাদ জানিয়ে টাকাটা পকেটে চালান করে দিল। আবারও ধন্যবাদ জানিয়ে নাউড়া নিজের রুমে চলে এল।
আনন্দ কাকে বলে এ মুহূ্র্তে নাউড়াকে দেখলে সত্যি সত্যি বুঝা যাবে। মনের অজান্তেই নাউড়া কয়েকটা লাফ দিল।সে এতক্ষণ খেয়ালই করে নি। ছোট ভাই প্রীতম ওর চেয়ারে বসে আছে। এতক্ষণ দাদাকে বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে দেখছিল। প্রীতমকে দেখে নাউড়ার কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছে। তাই জিজ্ঞাসা করল- 'তুই আমার টেবিলে বসে বসে কী করছিলি?'
তোমার জন্য বসে আছি। বিশ্বাস কর মেজ'দা’ তোমার কোন জিনিষে আমি হাত দিই নি। আসলে এই রুমটার প্রতি প্রীতমের বরাবরই ভীষণ রকমের দুর্বলতা রয়েছে। কারণ নাউড়ার কাছে আছে রাজ্যের যত টুকিটাকি জিনিষ। ছোট ছোট বাক্সের ভেতর তালাবদ্ধ অবস্থায় থাকে। প্রীতম সবসময়ই সুযোগ খোঁজে। নাউড়ার মনে সন্দেহের দানা এখনও দূর হয় নি। চোখে চোখ রেখে আবার জিজ্ঞাসা করে- 'সত্যি বলছিস তো?'
'মা কালীর দিব্যি! তোমার কোন কিছুতেই আমি হাত দিই নি। অংকটা মেলাতে পারছি না। তাই তোমার অপেক্ষায় বসে আছি।'- প্রীতম বেশ গুছিয়ে বলে।
কী অংক, দেখি?-এই বলে নাউড়া কোন কালবিলম্ব না করে প্রীতমের হাত থেকে বই-খাতা-কলম সব টেনে নেয়। প্রীতম অংকটা দেখিয়ে দেয়। অংকটা সমাধান করে বুঝিয়ে দিয়ে প্রীতমকে বিদায় করেই নাউড়া দরজাটা বন্ধ করে দেয়। তারপর ড্রয়ার খুলে পয়সাগুলো আবার বের করল। চাবির গোছা সবসময় কোমড়ের তাগাতেই বাঁধা থাকে। পরপর তিনবার পয়সাগুলো গুণলো। এখন তিন টাকা বেশি আছে। নাউড়ার মনটা আনন্দে ধেই ধেই করে যেন নাচানাচি করছে। টাকা-পয়সা সব গুছিয়ে রেখে লেখাপড়ায় মনোযোগ দিল।
নির্ধারিত দিনে সবাই চিনুদার কাছে বিশ টাকা করে জমা দিল। সরোজের টাকাসহ মোট একশত বিশ টাকা হলো। হিসাব-নিকাষ করে টাকাগুলো পকেটে রেখে চিনুদা বলল- 'আগামীকাল শনিবার। হাট বার। আগামকালই মুরগীর বাচ্চা কিনব।তোদের মধ্যে দু'জন আমার সাথে থাকবি।'
সবাই আলোচনা করে ঠিক করল, চিনুদার সাথে নাউড়া আর কাহার থাকবে। এবার ডালপুরি আনার পালা। চিনুদা তো গাছের ডালে হেলান দিয়ে বেশ আয়েশী ভঙ্গীতে শুয়ে আছে। আজকে সুজন যেতে চাচ্ছে না। শেষে নাউড়া সোহানকে নিয়ে বাজারের দিকে রওনা হলো।
ওপরের মাঠে আসফি সুমন ওরা জাম্বুরা-ফুটবল খেলছিল। নাউড়া আর সোহানকে দেখে আসফি মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে খেলায় মনোযোগ দিল। নাউড়া-সোহানও তাকায় নি। সোজা বাজারের দিকে পা বাড়াল।
বাজার থেকে ফিরে এসে কথাটা বলতেই চিনুদা বলল- 'আর ক'টা দিন সবুর কর। পিকনিকের কথা শুনলেই দেখবি আমাদের সাথে মেশার জন্যে পাগল হয়ে পিছু লাগবে। এখনই তো দেখতে পাচ্ছিস কেমন অসহায়ভাবে তাকিয়ে থাকে।'
কাহার অভিমান ভরা কন্ঠে বলে- 'ওদেরকে কিন্তু আমাদের সাথে নিতে পারবি না।'
চিনুদা হাসতে হাসতে বলে- 'তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে?'
কাহার নিঃসন্দেহ হবার জন্য আবারও বলে- 'তবু আগে থেকেই বলে রাখছি।'
চিনুদা বেশ জোরের সঙ্গেই বলে- 'ওসব নিয়ে তোকে কখনও ভাবতে হবে না। অনেক আগেই ভেবে রেখেছি।'
প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে নাউড়া চিনুদাকে জিজ্ঞ্যেস করল- সোহানকে কোনদিন সাঁতার শেখানো শুরু করবি?'
কতক্ষণ কী যেন মনে মনে হিসেব কষলো চিনুদা। তারপর থুতনিতে কয়েকবার আঙুলের মৃদু টোকা দিয়ে বলল- 'রোববার থেকেই সোহানের সাঁতার শেখার পালা শুরু হবে। সোহান কি বলিস?'
চিনুদার শেষ কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই সোহানের চেহারাটা যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। কিন্তু কোন কথা বলল না সোহান। সোহানের নীরবতায় বুঝা যাচ্ছে যে সে এখনও পানিতে নামতে সাহস পাচ্ছে না। যদিও এ ক'দিনে সোহানের শরীর বেশ হালকা হয়েছে। বাহ্যিকভাবে অবশ্য এখনও তেমন কোন পরিবর্তন আসে নি। সোহানের চলা-ফেরাতে বুঝা যায় যে শরীর কিছুটা হালকাভাবে চলছে। সোহান নিজেও বলেছে ; শরীরটা এখন আগের চেয়ে অনেক হালকা লাগে।
কাহার সোহানের দিকে তাকিয়ে বলল- কী ব্যাপার সোহান, পানিতে নামতে এখনও সাহস পাচ্ছিস না?'
সোহান আমতা আমতা করে বলল- '' না মানে, আর ক'টা দিন পরে শুরু করলে হয় না?'
চিনুদা এতক্ষণে আড়মোড়া ভেঙে সোজা হয়ে বসল। তারপর সান্ত্বনার স্বরে বলল- 'সোহান, এত ভয় পাচ্ছিস কেন? আমি থাকতে কোন চিন্তা করিস না। তোর কোনরকম অসুবিধা হবে না। একদিন পানিতে নামলেই দেখবি সব ভয় কেটে গেছে।'
সুজন এতক্ষণে মুখ খুলল, বলল- 'ও...ভালো কথা, শনিবার তো স্কুল খোলা! তাহলে মুরগীর বাচ্চা কী করে কিনবি?'
চিনুদা সুজনকে কোনরকম পাত্তা না দিয়ে বলল- 'ওসব নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না।'
চিনুদার রুক্ষ কথায় সুজন মন খারাপ করে চুপচাপ বসে আছে। তাকিয়ে আছে পূর্বদিকের খোলা প্রান্তরে।
সান্ত্বনা দেবার প্রয়াসে নাউড়া বলল- 'টিফিন পিরিয়ডে আমরা মুরগী কিনে চলে আসবো। ওসব নিয়ে কোন চিন্তা করিস না। সাত-আটটা মুরগীর বাচ্চা কিনতে আর কতক্ষণ! বড়জোর মিনিট কুড়ি। তাছাড়া ঐ সময়ই বাজার বেশ জমজমাট থাকে।'
'ভালো করে বললেই তো হয়! শুধু শুধু ঝাড়ী-ঝুড়ি দেয়ার কোন মানে হয়?'- এই বলে সুজন চিনুদার দিকে তাকাল।
'না,তোমারে গালে চুমা দিয়া কথা বলব!'-এই বলে চিনুদা বাতাসের গায়ে এক চুমু বসাল।
প্রত্যুত্তরে সুজন এমন অভিব্যক্তি প্রকাশ করল যেন চুমুটা সত্যি সত্যি ওর গালে পড়েছে।
'দেখ, দেখ! আসফি চিৎ হয়ে পড়ে গেছে।'- এই বলে কাহার চেঁচিয়ে ওঠতেই সবার দৃষ্টি মাঠের দিকে চলে গেল। কিন্তু কেউ কোনরকম কথা বলছে না। নীরবতা ভেঙে সোহান বলল- 'চল, এখন উঠা যাক। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। একটু পরেই আজান পড়বে।'
এ কথার জবাবে কেউ কোন কথা বলে নি। তবে সবার মাঝে একটা নীরব নড়াচড়া যেন আড়মোড়া দিয়ে জেগে ওঠেছে।
'নাউড়া টাকাগুলো তোর কাছে রাখ। শনিবার স্কুলে আসার সময় মনে করে নিয়ে আসবি।'-এই বলে চিনুদা টাকাগুলো আবার গুণে নাউড়ার হাতে দিল। টাকাগুলো হাতে নিয়ে নাউড়া আবার গুণল। তারপর পকেটে রেখে দিল। একে একে সবাই গাছ থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে নামল। সোহানও আজ বেশ সুন্দর একটা লাফ দিয় গাছ থেকে নামল। অবশ্য হেলে পড়া গাছের ডালগুলো প্রায় মাটি অথবা পানি ছুঁই ছুঁই। তবুও সোহান এভাবে লাফ দিয়ে আগে কখনও নামতে পারে নি। আর দেরি না করে সবাই বাড়ীর উদ্দ্যেশে পা বাড়াল।
শনিবার খুব সকালেই মামা চলে গেছেন। মা অবশ্য বারবার বারণ করছিল না-যেতে। কারণ শনিবার যাত্রা শুভ নয়। জরুরী কাজ আছে বিধায় মামাকে চলে যেতে হল। যাবার আগে মামা বলে গেলেন- 'পিকনিকটা করেই কিন্তু সম্পূর্ণ বর্ণনা দিয়ে আমাকে চিঠি লিখবে।'
ভাগ্যিস, দাদা কাছে ছিল না। কাছে থাকলে একটা ঝামেলা বাঁধিয়ে তবে ছাড়তো। নাউড়া খুশী হয়ে বলল- 'ঠিক আছে মামা। আমি সুন্দর করে বর্ণনা দিয়ে পিকনিকের কথা লিখব।' 




    স‍্যাটায়ার
    সোমনাথ মুখার্জী

বড্ড কামড়ায় মশা।
না না হাসবেন না, বিরক্ত হবেন না।
লাল পলাশের মত মৃত্যুরং
মিশে আছে হৃদয়ের আপেলর ভগ্নাংশে।
হৃদয় নামক আপেল, বেদানার খোলসের মত
ঘোলাটে দৃষ্টি,
মানুষকে হাসায় খুব।
হাসবেন না, না না হাসবেন না,
বড্ড কামড়ায় মশা।
জীবন এখন নির্জীব সন্ত্রাস,
প্রেমে ঘিরে হিসেবের বাজেট, বাঁচতে চাই উন্নতির কুতুবমিনারে,
বড্ড কামড়ায় মশা।
হাসবেন না অথবা হাসতেও পারেন অথবা বিরক্ত হবেন না।

         

 বিরূপাক্ষ পণ্ডা'র গুচ্ছ কবিতা 
✒✒✒✒✒✒✒✒

        স্বপ্ন

স্বপ্নের ভাঙা পাখি
প্রতিদিন আরো ভাঙে। তবুও জাগি
নিজস্ব নির্জনে রাত্রি হয় ভোর
পানপাতা লাজে হাসে

তারপর শুরু হয় ঝরে পড়া
আহ্লাদীর ললাট জুড়ে
ক্রমশ রক্তপাত। স্রোতে ভেসে যায়
আগুন ও আহ্লাদ

এখনও জানি না কথা ও কবিতা।



             কিন্তু

সবকিছু জানা শোনার পর
আর কি দাঁড়িয়ে থাকা যায়
কমা'র পর কমা'র দীর্ঘ লাইন ধরে ?
এখন বুকভরা নিঃশ্বাস প্রশ্বাসও
আগুন শিখার মতো কাঁপে।

অথচ পাখি ডানা মেলে ওড়ে,  শিস্ দ্যায়
আর আমরা বসে আছি কুঁজোর মতো
এবং ফাঁসির শবের মতো ঝুলিয়ে রেখেছি
কিন্তুর পর কিন্তু ।



       সম্পর্ক

ঘুমন্ত শব্দকে জাগিয়ে
আলোর উৎসবে মাতে স্বপ্ন বর্ণমালা
শুক্লারাতের সোহাগ মাখে
চৈত্রের কৃষ্ণচূড়া মন

এইভাবে সম্পর্কের কষ্টি পাথরে
যাচাই হয় আমাদের প্রতিটি প্রহর


              খরা

আলো থেকে দূরে । সামনে বিপদ
উপরে নীচে হাহাকার
আকাশের শাড়ী চুরি হয়। শস্য  লুকায়
রোদের ফলায় বীজক্ষয়।


        ভারতবর্ষ

আলোর অহংকার ভাঙে
দুঃস্বপ্নের লাঠি
আশার বীজ হত্যা করে
অলস পূর্ণিমা
মৃত্যুর ঘোমটা মাথায়
প্রেমের শরীর
ভাত-রুটির ভারতদেশ
মরুভূমির মাটি ।



         বারোআনা ষোলোআনা
          অনিন্দ্যকেতন গোস্বামী
 
এসো আজ পরিযায়ী শ্রমিকের পায়ে কালো সড়ক অনুবাদ করি
আর রাষ্ট্রের মুখে অনুবাদ করি পদদলিত মানুষের অনুগমন...
যাদের চিরস্থায়ী ঘুম খুবলে খাচ্ছে আগামী ভারতের মজদুরিয়ানা..
যাদের পেটে লাথি
চোখে ঠুলি
কানে মিথ্যা
এবং দাঁতে নমকিন মাজন দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে শরীর ভালো রাখতে হাটা এবং পেট খালি রাখা প্রয়োজন।
তাদের অধোমতি দূরাগমনে স্বপ্ন
গড়ে তুলবে না স্বচ্ছ ভারতে ভূমিজ সোপান।   
একদিন তুমি নিজেই দেখবে
সুদৃশ্য প্যাকেটের মত নিজেই মুড়ে যাচ্ছ নিজের অমৃত বচনে...
এই সব কথারা বিষ কুণ্ডে স্নান করে এসেছে
 সড়কে অনুবাদ হবে বলে-


                              রম্যরচনা

                        বাঙালির আড্ডা 
             - অগ্নিমিত্র ( ডঃ সায়ন ভট্টাচার্য)

  বাঙালি জাতি অত্যন্ত আড্ডাপ্রিয় , বা বলা ভাল আড্ডাপ্রবণ । বন্ধুবান্ধব বা প্রতিবেশীর সাথে রোজ আড্ডা দিতে না পারলে তার জীবনটাই যেন বৃথা হয়ে যায়  । আর বাঙালির আড্ডার কোনদিনই কোনো নির্দিষ্ট বিষয়বস্তু হয় না । রাজনীতি, খেলা, স্বাস্থ্য, পরনিন্দা, পরচর্চা সবই চলে ।..মুখেন মারিতং জগৎ আরকী!
  পুরনো কলকাতার ' রক' বা রোয়াক ছিল সনাতনী বাঙালি আড্ডার পীঠস্থান! তাছাড়া চিলেকোঠার ঘর, চায়ের দোকান বা কারো বাড়ি, আড্ডা সব জায়গাতেই জমতো । পুরুষ ও মহিলা, উভয়েই আড্ডায় যোগ দিতেন পুরোদমে ।
   বাংলা সাহিত্যে দুই আড্ডাবাজ খুব বিখ্যাত, টেনিদা ও ঘনাদা । বাঙালির আড্ডা না হলে আমরা এই দুই অমর চরিত্রকে পেতামই না হয়তো । ..আমার ছোটবেলাতেও এরকম আড্ডাপরায়ণ লোক অনেক দেখেছি । বেশির ভাগই ছিলেন বেকার যুবক বা অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী । চা বা মুড়ির সাথে আড্ডা জমে ক্ষীর হয়ে যেত । একজন আবার কবিতার ছন্দ মিলিয়ে মিলিয়ে আড্ডা দিতেন । মাঝে মাঝে আবার এই আড্ডা থেকেই অনেক কিছু জানতে পারা যেত ।
 এই অতিমারীর মরশুমে ও কিছুটা আধুনিক যুগের ইঁদুর দৌড়ে পড়ে বাঙালির আড্ডা বেশ একটু ধাক্কা খেলেও আবার সম্প্রতিা চাঙ্গা হয়েছে । সকালে আবার পাড়ার চায়ের দোকানগুলো খুলেছে  । তবে এখন কেবলই করোনা নিয়ে আড্ডা, বা করোনাড্ডা! যেন আর কোনো বিষয় নেই ।
  তবে বাঙালির আড্ডা বেঁচে থাক, দীর্ঘজীবী হোক । আখেরে এটা একটা ঐতিহ্য রক্ষার প্রশ্ন!!




                    পারুল (৪)  
                 বদরুদ্দোজা শেখু


'হ্বপন আছো' ? হাঁকে যদি কেউ, মালু ডাকে ' মিঁউ '
কালু যেন গর্জে উঠে--' কিঁউ কিঁউ কিঁউ কিঁউ' ?
যে আসে সে থমকে' দাঁড়ায়, 'ধানী লঙ্কা বটে !'
দিম্মা ডাকে, 'এই কালু , চুপ্ !',কামের মানুষ
বটে' !
লেজ গুটায় সে, মালু ডাকে, ' মিঁয়াঁও মিঁয়াঁও মিঁয়াঁও'
বলে যেন সে,'রোসো বাবু, কর্তা নাই ,খাড়াও' !
পারুল যখন আসে তখন আহ্লাদে আটখানা--
পায়ে পায়ে জড়ায় , পায় বিস্কুট দু'একখানা।
মালু  তো ওর কোলেই চেপে বসে,
কালু তখন দু হাত বাড়ায়, হয়তো-বা আফসোসে !



                     পারুল (৫)

পারুল সোনা ইস্কুলে যায় , টুকাই হ্বপন মাঠে
পেটের জোগাড় করতে তারা সারাটা দিন খাটে
কখনো রোজে কখনো ঠিকায় , কখনো শালবনে
হন্যে হ'য়ে ঘুরে' বেড়ায় শিকার অন্বেষণে ,
কাঠকুটো শালপাতাও কুড়ায় , লকড়ি হবে বটে
তাজা পাতায় থালি বানায়--যা দু'পয়সা জোটে,
এমনি ক'রে চলে তাদের প্রান্তিক সংসার
তাদের পারুল  মানুষটা হোক , চায় না কিছু আর
স্বপ্ন  দ্যাখে ? স্বপ্ন দেখা ওদের যেন মানা,
টুকাই হ্বপন তবুও ছাড়ে কল্পসুখের ডানা---
পারুল হবে নার্স কিংবা  স্কুলের দিদিমণি
তাদেরও তখন কদর হবে,  হবে  মান্যিগণ্যি !




                 লক ডাউন জীবন             
                  হামিদুল ইসলাম

পৃথিবী টা ঘুমোচ্ছে রাস্তার উপর
অনন্ত ঘুম
বন্ধ সব রাস্তা
অসংখ‍্য মানুষ দাঁড়িয়ে আছে অপেক্ষায়
ওরা পেরিয়ে যেতে চায় ওপারের আকাশগঙ্গা    ।।

আজ বোবায় ধরেছে পৃথিবী
নিঃসাড়
শব্দ নেই, চিৎকার নেই, চেঁচামেচি নেই
নির্মেঘ আকাশ। কেবল পাখিদের কূজন
দুচোখের জলে ভেসে যাচ্ছে মানুষের কোলাহল    ।।

পৃথিবীর ঘুম ভাঙছে না আজ
ক্লান্ত পৃথিবী
ঘুমিয়ে নিচ্ছে শেষ বিদায়ের ঘুম
নিষ্ঠুরতার ছোঁয়া তার দুচোখের গভীরে
আজ মৃত‍্যু মানুষের সঙ্গী     ।।

মানুষগুলো ফিরে যাচ্ছে বাড়ি বাড়ি
লক ডাউন জীবন
লক ডাউন পৃথিবী
সূর্য আটকে আছে শ্মশানের পাঁচীলে
বিভৎস ময়াল গ্রাস করছে জীবন


                     লড়াই
             

এখানে বন্ধুরা হাত ধরাধরি করে আসে
প্রতিদিন পাল্টে যায় ক‍্যালেণ্ডার
জীবন বদলে যায়
অপেক্ষার পৃথিবী দাঁড়িয়ে থাকে
মনের সীমানায়    ।।

মন থেকে ঝেড়ে ফেলি
সমস্ত মায়া মমতা
নদীর জলে ভাসিয়ে দিই রাগ অভিমান
ডুব দিই জলে
ডুবুরি হয়ে ঘুরে বেড়াই নদীর তলদেশ   ।।

ফিরে পাই নারী দেহ‍ের নির্যাস
জলে খুঁজি তাকে
ভেসে ওঠে উর্মির নিথর দেহ
ফিরে আসি ঘাটে
আমার ভালোবাসা উর্মি হৃদয়   ।।

যত্ন করে রাখি ভালোবাসা
পাঁজরের গভীরে রাখি শৈশব কৈশোরের সব স্মৃতি
কবিতার ছন্দে মিলিয়ে নিই জীবন
জীবনের নাম সংগ্রাম
সংগ্রাম মানে লড়াই করে বাঁচা   ।।



               নবান্ন
           সৌম্য ঘোষ


তোমরা যারা মাঠে যাচ্ছো আজ
শঙখ ধবনি আর আজানের সুরে
ঘরে এনো নবান্নের সুবাস  !
বীজের ভেতর থেকে উঠে আসা সুর
সোনালী আলোর মুঠোভরা সুখ  !

তোমরা যারা আকাশের নীচে বসেছিলে
জলভরা মেঘের কথা ভেবে  ,
বৃষ্টির  আস্বাদ নাও  , খর রোদ্দুরের  তীর্থ ঘুরে ঘুরে  ।

তোমরা সবাই যারা আজ মাঠে বা আকাশের নীচে
গভীর প্রত্যয়ে
গরম ভাতের ধোঁয়া ওঠা ঘ্রাণে  ।
বেঁচে থাকো সবুজ জীবনে ,
আকাশ  আর  মাটির  সমন্বয়ে  ।।


                        ব্যাক্তিগত গদ্য 

                 নদী কথায় ভেসে যায় ......
                      তীর্থঙ্কর সুমিত

                             ( ৮)

যে পথটা বেঁকে গেছে সে পথটাই মনে হয় সবথেকে সোজা ছিল।বহুদিন আগে যে রাস্তা হারিয়ে গেছে,সে রাস্তার ই আজ বড় প্রয়োজন।কয়েকটা অক্ষর কি কয়েকটা চিহ্ন কখনো ই রাস্তার গল্প শোনায় না। শোনায় না ফেলে আসা নদী বাঁকের গল্প। যে গল্পে দুপুরের রোদ বিকালের ধুলো আর রাতের  ভালোবাসা লুকিয়ে থাকে।তাইতো আমি গঙ্গার কাঁধে মাথা রেখে পদ্মাকে দেখি।আর মেঘনার গল্পে ব্রহ্মপুত্রর রূপ খুঁজি।



                    নতুন বসন্তের গান
                    কবিরুল
       
                
                 বছর শেষের মাদল বাজছে - 
                  আর ক'টা দিন , তারপরেই উঁকি মারবে
                   নতুন ভোর। রবির কমলা , সোনালী আবীরে
                    চনমন করে উঠবে পৌষের নিষ্পাপ শিশির।
                     সবুজের মখমলে বোহেমিয়ান শিহরণ!
                     এর পরে পরেই মাঘের খোলা চিঠি - 
                       খুলে দেবে বসন্তের জানালা।
                      তোমার প্রতীক্ষায় আমি থাকব সারাদিন - 
                       কোপাই নদীর তীরে , অথবা লাল মেঠো পথে।
                        তোমার দু কানে ফুলেল ঝূমকো,
                        সারা শরীরে পলাশ শিমূলের আদর
                         আমার কবিতার ক্যানভাসে আনবে সুনামী।
                           ফিরে যাবে পরিযায়ী পাখিরা ভীষণ অভিমানে
          ফিরবে না তুমি , গোধূলী সন্ধ্যার বক হয়ে ডানা ঝাপটাবে
            তোমার সাদা ডানায় ডানায় আমার বাউল মন
             লিখে দেবে ভালবাসার শ্লোক , নতুন বসন্তের গান ।



              নতুনের সন্ধানে
                                  রীতা চট্টোপাধ্যায়

 প্রবাহমান উষ্ণ পারদ নিমেষে নেমে আসে সভ্যতার গা বেয়ে;
বর্তমান উত্তাপের গতি রোধ করে চলমান সময়,
প্রতিটি জীবনের প্রবাহমাত্রায় সৃষ্টি হয় প্রতিরোধ,
চলমান জীবনপ্রবাহে সুখ খুঁজে ফেরে মূহুর্ত,
জীবন যন্ত্রণায় দগ্ধ হ'য়েও উষ্ণ চিত্তে দিন    কাটে।
শীত অনুভূত হয় না ছন্দবদ্ধ জীবনের।  খাঁজে,
নতুন যাতনার অপেক্ষায় ভাবনার   বহি:প্রকাশ ঘটে,
বাস্তবতার গলাটেপা আর্তনাদে মৃত্যু হয় কঠিন বিশ্বাসের,
সভ্যতার ঝড়ে উলটপালট হয় অস্তিত্বের শুভ্রতা,
সংকীর্ণ পথ বেয়ে নতুনের সন্ধানে মুছে যায় দাপুটে আঁধার।
   
             

No comments:

Post a Comment