সাক্ষাৎকথায় স্মরণজিৎ চক্রবর্তী
প্রশান্ত ভৌমিক
আমার জন্য যেন কেউ দু:খ না পায়
স্মরণজিৎ চক্রবর্তী- পশ্চিম বাংলার জনপ্রিয় সাহিত্যিক। এক কথায় বলতে গেলে উনিশ-কুড়ির তরুণদের কাছে অসম্ভব জনপ্রিয়। উপন্যাস, কবিতা, ছোট গল্প থেকে শুরু করে সিনেমার স্ক্রিপ্ট- সবই লিখেছেন, লিখছেন। পাশাপাশি নিয়মিত সময় দিচ্ছেন পৈত্রিক ব্যবসায়। সদাহাস্য মিষ্টিভাষী সাহিত্যিক লিখে যেতে চান জীবনের নানান দিক নিয়ে। এক ফাল্গুনের বিকেলে (২১-০২-২০১৯) স্মরণজিৎ চক্রবর্তীর সঙ্গে কথা হলো লেখকের পৈত্রিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বসে। অন দ্যা রেকর্ড যত কথা বলেছেন তার চেয়ে দ্বিগুণ সময় আড্ডা দিয়েছেন অফ দ্যা রেকর্ড। জীবনকে খুব সুন্দরভাবে দেখার একটা চোখ আছে লেখকের। কিছুটা খোঁজ কি পাওয়া গেল এই সাক্ষাৎকারে?
প্রশান্ত ভৌমিক: এবার আপনার লেখালেখি নিয়ে আসি। কখন বুঝলেন যে, আপনাকে লিখতেই হবে? লেখালেখির শুরুটা সম্পর্কে জানতে চাই।
স্মরণজিৎ চক্রবর্তী: এরকম কোনওদিন আমার মনে হয় নি যে, না লিখলে আমার চলবে না। আমার সবসময় মনে হয়েছে যে, না লিখলেও তো কোন ক্ষতি বৃদ্ধি হচ্ছে না। তার কারণ, বাংলা ভাষা কিংবা বাংলা সাহিত্য এত সমৃদ্ধ যে আমি স্মরণজিৎ লিখলাম নাকি না লিখলাম, তাতে বাংলা ভাষার বা সাহিত্যের কিছু এসে যাবে না। সেটা আমি বিশ্বাস থেকেই বলছি। তাহলে লিখি কেন? লিখতে ইচ্ছে করে তাই লিখি। যেদিন ইচ্ছে করবে না সেদিন আর লিখবো না। লেখা থামাতে আমার এক সেকেন্ডও সময় লাগবে না। যেমন ধরুন, আমি লিখছি। আমার যারা পরে লেখা শুরু করেছে, তাঁদের পঞ্চাশটা ছোট গল্পের সংকলন বের হয়েছে। আমার এখনো বের হয় নি। তার কারণ? আমি খুব কম ছোট গল্প লিখেছি। তার কারণ? ঐ যে, ইচ্ছে হয় না। লিখি না। লিখতেই হবে, এরকম কোনো প্রেশার নিজেকে নিজে কখনো দেইনি। কিছু নেই ওরকম। আমার ছোটগল্পের চেয়ে উপন্যাস লিখতে অনেক বেশি ভালো লাগে। আমি মূলত উপন্যাস লিখতে পছন্দ করি। ছোটগল্প যদি পঞ্চাশটা কোনোদিন না হয়, না হবে। আমার ওপর তো কোনো দায় নেই পৃথিবীতে।
প্রশান্ত ভৌমিক: লেখালেখির শুরুটা নিয়ে বলুন।
স্মরণজিৎ চক্রবর্তী: লেখালেখির শুরুটা ছিলো ক্লাস থ্রিতে। আমি আর আমার দিদি মিলে যৌথ উদ্যোগে একটা থ্রিলার লিখেছিলাম। থ্রিলার উপন্যাস লিখেছিলাম। তখনকার উপন্যাস মানে কুড়ি পাতার একটা লেখা। সেটাইতো অনেক বড় ক্লাস থ্রি-এর পক্ষে, তাই না? সেটা তো একবারই হয়। তারপর হল ক্লাস সিক্সে, তখন আমি কলকাতায় থাকি। যেহেতু আমি আচমকা বাটানগর ছেড়ে কলকাতা চলে আসি, সেহেতু আমার বন্ধু-বান্ধব আর রইলো না। ক্লাস সিক্সের গরমের ছুটির একদিনের কথা বলছি। পড়াশোনা হয়ে গেছে। আটটা মতো বাজে সন্ধ্যেবেলা। আমার বাবার কাছে গিয়ে বললাম, আমাকে একটা ডায়েরি দাও। যেহেতু অনেক ডায়েরি পাই আমরা, বাবা সেখান থেকে একটি ডায়েরি নিয়ে আমাকে দিয়ে দিলেন। বললেন- নে, এটা তোর। আমি খুশিতে আত্মহারা। এরকম বড় মোটা একটা ডায়েরি আমার! তখন আমি ঐ ডায়েরিতে চার লাইন, চার লাইন করে কবিতা লিখতাম। পদ্য, ছড়ার মতো। ক্লাস সিক্স থেকে নাইন অব্দি এটা চললো। নাইনে আমার এক বন্ধু ছিলো। সে আমাকে ‘আমগাছ’ বলে একটা কবিতা এনে পড়ালো। তার ডায়েরিতে লেখা। আমি দেখলাম, দারুণ লিখেছে তো! আমার বেস্ট ফ্রেন্ড সে। আমি ভাবলাম, সে এত ভালো কবিতা লিখে ফেলেছে! আমি তো ছড়ার মতো কী সব লিখছি। আমার কোথায় যেন লাগলো। এই যে আমি ধাক্কা খেলাম, আমি বুঝলাম- আমাকে অর্থবোধক কিছু লিখতে হবে। আমার মনে আছে, আমাকে যে ডায়েরিটা বাবা দিয়েছিলেন, সেটা অর্ধেক শেষ হয়েছিলো। আমি দু’টো পাতা ছাড়লাম ডায়েরির। তারপর মিনিংফুল লেখার দিকে ঝুঁকলাম ক্লাস নাইনের ঐ সন্ধ্যেবেলা। আমার বন্ধু যদি ওটা না দেখাতো আমাকে, তাহলে আমি কিন্তু এভাবে ভাবতাম না। এবার একটা গল্প আছে। ক্লাস ইলেভেনে পড়ি তখন। আমার সেজ কাকার বাড়িতে অনেকে মিলে বসে ক্যারাম খেলছি। আমি সেখানে বইয়ের স্তূপ থেকে একটা পুরনো শুকতারা খুঁজে বের করলাম। পুরনো একটা শুকতারা। পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে দেখি সেই ‘আমগাছ’ কবিতাটা। অন্য একজনের লেখা। আমার বন্ধুর লেখাই নয়। ও টুকেছিলো। ও টুকে রেখেছে আর আমাকে দেখিয়ে বলেছে, দ্যাখ আমি লিখেছি। আমিও বিশ্বাস করেছিলাম। কিন্তু এই যে মিথ্যেটা বলেছিলো আমাকে, তাতে কিন্তু আমারই উপকার হয়েছিলো। তারপর থেকে আমি বুঝেছি একটা জিনিস, জীবনের কোনো কিছু আজকে শেষ হয়ে গেল মানে আজকে শেষ হয়ে যাওয়া নয়। এর প্রভাব বা এর রেজাল্টটা আমি অনেক দিন পরেও পেতে পারি। কেউ আমাকে ছেড়ে গেলো আজকে বা কেউ আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করলো এর মানে কিন্তু এখানেই শেষ হয়ে গেলো না। আপাতত এই চ্যাপ্টারটা শেষ হলো হয়তো। কিন্তু গল্পটা এখানে শেষ নয় মোটেই। কে বলতে পারবে, দশ বছর পরে এই চ্যাপ্টারটা নতুন করে শুরু হবে না!
এভাবেই আমার লেখার শুরু। কিন্তু তখন আমি শুধু কবিতা লিখি। আমাদের বাটানগরে আমার দাদাদের একটা লিটল ম্যাগাজিন ছিলো, সেখানে লিখলাম। তারপর ওরা আমাকে নিয়েও নিলো। বললো- “তুই তো কলকাতায় থাকিস। কলকাতার কবি-সাহিত্যিকদের কাছ থেকে লেখা যোগাড় কর।” করতাম। এভাবেই চলতে লাগলো।
আমার মা মারা গেলেন ২০০২ সালে। আমি তখন বুঝলাম, আমার আর কবিতা ভালো লাগছে না। নিজের কবিতা যদি নিজের কাছে একঘেয়ে লাগে, তার চেয়ে খারাপ তো আর কিছু হয় না। সেই সময় আমার দাদা, সব্যসাচী দা আমাকে বললেন, তুই উপন্যাস লেখ। কেননা আস্তে আস্তে সমস্ত নামকরা উপন্যাসিকদের বয়স হয়ে যাচ্ছে। নতুন কেউ উঠছেই না, কেউ উপন্যাস লিখছেই না। কারণ সেটা পরিশ্রমসাধ্য ব্যাপার। তারচেয়ে কবিতা লিখে ফেসবুকে পোস্ট করলে তাড়াতাড়ি জনপ্রিয় হওয়া যায়। তাই না? কেউ অতক্ষণ ধরে বসে, পরিশ্রম করে লিখছে না।
আমি তখন একটা ছোটগল্প লিখলাম। জমা দিলাম। সেটা ছাপা হলো ‘উনিশ কুড়ি’ নামে একটা পত্রিকা বের হলো, তার প্রথম সংখ্যায়। আরেকটা লিখলাম। এভাবে লিখতে লিখতেই আমাকে জিজ্ঞেস করলো- তুমি উপন্যাস লিখবে? আমি বললাম- লিখবো। লিখলাম। তারপরে বলা হলো- তুমি আরেকটা দীর্ঘ উপন্যাস লিখবে? ধারাবাহিক লিখবে? আমি বললাম- হ্যাঁ, লিখবো। বললো- লেখা সিলেক্টেড হলে ছাপা হবে। আমি বললাম- ঠিক আছে। লেখা সিলেক্টেড হলে ছাপা হবে। না হলে হবে না। এই ভাবে আমার উপন্যাস লেখা শুরু হলো।
একটা কথা আমার স্বীকার করতে লজ্জা নেই, আমার জীবনে একটা সময় পর্যন্ত আমি কোনো কিছু শেষ করতে পারি নি। আমি ৩০ বছর বয়েসে প্রথম যখন উপন্যাস লিখতে শুরু করলাম আমি দেখলাম যে এটা আমাকে শেষ করতেই হবে। আমি এর আগে কোনো জিনিস পুরোপুরি শেষ করতে পারিনি। তাই উপন্যাসটা শেষ করতেই হবে আমাকে। সেই জেদ ধরে আমি বড় উপন্যাস শেষ করেছি। তারপর ছাপা হয়েছে। এভাবেই লেখা শুরু।
প্রশান্ত ভৌমিক: সেটা কোন লেখা ছিলো?
স্মরণজিৎ চক্রবর্তী: ‘পাল্টা হাওয়া’ বলে একটা উপন্যাস।
প্রশান্ত ভৌমিক: প্রথম বই আকারে প্রকাশিত কি ‘পাল্টা হাওয়া’?
স্মরণজিৎ চক্রবর্তী: না। ‘পাতা ঝরার মরশুমে’ প্রথম লেখা উপন্যাস। সেটাই বই হিসেবে প্রখম প্রকাশিত হয়।
প্রশান্ত ভৌমিক: আপনার লেখা নিয়ে আপনার মতামত কী? মানে লিখে কি আপনি তৃপ্ত? অর্থ্যাৎ যা বলতে চান তা কি বলতে পেরেছেন?
স্মরণজিৎ চক্রবর্তী: আসলে যা বলতে চাইছি সঠিকভাবে তা তো বলা সম্ভব হচ্ছে না। লেখার পর মনে হলো, এই যা! কোথায় জানি কী একটা খামতি থেকে গেলো! ফলে ওরকমভাবে খুশি নই। তৃপ্তও নই। চেষ্টা করি যাতে লিখতে পারি। যাতে একটা পজিটিভ ফিলিং থাকে। যাতে জীবনের প্রতি একটা ভালোলাগা, ভালোবাসা থাকে। আমি যেমন লেখা পড়ে বড় হয়ে উঠেছি বা আমার যেমন হাসিখুশি মন তৈরি হয়েছে, সেটা যেন থাকে মানুষের। আসল কথা কী? মন ভালো না থাকলে কোনো কিছু ভালো থাকে না। কাউকে সোনার থালায় খেতে দিলেও সেটাকে ছাই বলে মনে হয়। মনটাই তো সব। সেই মনটাকে ঠিক রাখা, সেটাই আমার মনে হয় আসল। খুব সচেতনভাবে সাহিত্য করা- সেটা আমার হয় না। আমার মাথায় যে গল্প আসে, সেটা আমি লিখি। চেষ্টা করছি- এইটুকুই আমি বলতে পারি।
ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস
"সোহান ও তার বন্ধুরা“
পার্থসারথি
পর্ব-১১
সকাল সকাল রওনা হল। রওনা হবার আগে অর্ডার দেয়া নাস্তাটা নিয়ে এসেছে। কারণ কেউ সকালে কিছুই খেয়ে আসে নি। রাহেলা গ্রামটিতে পৌঁছাতে এক ঘন্টা থেকে দেড় ঘন্টা লাগবে। যদি ইঞ্জিন চালিত নৌকা হতো তাহলে বিশ মিনিট থেকে পঁচিশ মিনিট সময় লাগত। ওরা ইচ্ছে করেই বৈঠা-দাঁড় চালিত নৌকা নিয়েছে। অবশ্য ইঞ্জিন চালিত নৌকার ভাড়াও অনেক। তাছাড়া আনন্দও তেমন জমে না। সকাল আটটা নাগাদ নৌকা ঘাট থেকে ছেড়েছে। নৌকায় সাদা পাল উড়ছে। মাইক বাজানোর প্রস্তুতি চলছে। তবে টেপ রেকর্ডারটায় গান বাজছে। কেউ বসেছে নৌকার ছৈ-এর ভেতর কেউবা উপর, কেউবা কার্ণিশে আবার কেউবা নৌকার একেবারে সামনের গলুইয়ে। সবাই যেন প্রকৃতির রূপ মন্থনে নিমগ্ন। চিনুদা অবশ্য আগেই সবাইকে বলে দিয়েছে যেন লাফালাফি কেউ না করে। কথাটা অবশ্য আসফিদের উদ্দ্যেশ্য করে বলা। এখন অবশ্য চিনুদা যা বলে আসফিরা তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে।
কিছুদূর এগোতেই রেকর্ডার বন্ধ করে বাকী সবাই ছৈ-এর ভেতর থেকে বেরিয়ে এল।চিনুদা আর সোহান ছৈ-এর উপরে গিয়ে বসল। পালে দারুণ হাওয়া লেগেছে। নৌকা ভাল গতিতেই চলছে। নৌকার মাঝি অবশ্য একজন। তবে দুটো অতিরিক্ত বৈঠা আনা হয়েছে। পালে বাতাস লাগাতে বৈঠা ধরতে হচ্ছে না।
সোহান মুগ্ধ দৃষ্টিতে চারদিকে চোখ বুলাচ্ছে। বর্ষাকালের পানিতে গ্রামগুলো কিছু দূর দূর ভাগ হয়ে আছে। যেন একেকটি গ্রাম একেকটা দ্বীপ। চিনুদা পরপর গ্রামগুলোর নাম বলে দিচ্ছে সোহানকে। বরুহা গ্রামটির কাছাকাছি আসতেই ওরা নাস্তার প্যাকেট খুলল। মাঝিকেও একটা নাস্তার প্যাকেট দিল। বরুহা গ্রাম পেরিয়ে একটু এগোতেই সবাই হৈ-হুল্লোড় করে ওঠল ; ঐই যে রাহেলা গ্রামটি দেখা যাচ্ছে। সবার মনের মাঝে আরও হাসি ও আনন্দের রঙ ছড়িয়ে দিল বিরাট জলরাশির বুক জুড়ে ফুটে আছে লক্ষ্য-হাজার জাতীয় ফুল শাপলা। সোহান জীবনের প্রথম এমন রূপলাবণ্যের ছোঁয়া পেল। সত্যিই সে বিমোহিত। একটা অজানা আনন্দের জোয়ার যেন শিরা-উপশিরায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। প্রাকৃতিক রূপ যেন সবাইকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে আর বলছে তোমরা এখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে যাও। সত্যি সত্যি সবাই বিমোহিত হয়ে আছে। তারপর সম্বিৎ ফিরে আসতেই সবাই সমস্বরে বলতে লাগল- মাঝি আংকেল এখানে নৌকা থামান। মাঝি যুৎসই করে নৌকাটা থামাল।
চারদিকে শাপলা ফুলের রাজ্য। মাঝখানে ওরা সবাই আনন্দে আত্মহারা। সোহানের তো হতবিহ্বল অবস্থা। এখনও মুগ্ধতার ঘোর কাটে নি। পলকহীন দৃষ্টিতে এখনও তাকিয়ে আছে। প্রকৃতি যে এত সুন্দর সাজে জলরাশিকে সাজাতে পারে এর আগে আর কখনও সোহান দেখে নি। শাপলা ফুলের গায়ে হাত বুলাচ্ছে সোহান। সোহান এর আগে ফুটন্ত শাপলা ফুল দেখে নি তা কিন্তু নয়। দেখেছে, দূর থেকে। কিন্তু কোনদিন ছুঁয়ে দেখে নি। তবে আজকের মতো এত মনোরম দৃশ্য এর আগে কেউ কখনও দেখে নি বা এত মুগ্ধতা অনুভব করে নি। সবার মুগ্ধতায় ছেদ ঘটিয়ে মাঝি বলল- 'কিছু শাপলা তুইল্যা লইন। ইছা ( চিংড়ি ) মাছ দিয়া রানলে ( রান্না করলে ) বালা লাগবো। আফনেরার পিকনিকটা আরও জমবো।'
মাঝির কথার সাথে সাথেই চিনুদা ভেবে নিল, মন্দ হয় না। তারপর সবার উদ্দ্যেশে বলল-'যে যে পারিস শাপলা তুলে নে।'-এই বলে চিনুদাও শাপলা তুলতে লাগল।
কাহার প্রশ্ন করে- 'শাপলা না-হয় তুললাম। কিন্তু চিংড়ি মাছ কোথায় পাবো?'
ওসবের চিন্তা পরে হবে। আগে শাপলা নিয়ে নিই। তারপর অনেকগুলো শাপলা তুলে নিল।
সাড়ে-দশটা নাগাদ ওরা রাহেলা গ্রামে পৌঁছাল। গ্রামটা দেখতে বেশ সুন্দর।স্বপ্নের মতো সাজানো এবং পরিপাটি। গ্রামটি দেখে সোহান বিমুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে।
সরোজ ওদের জন্যেই ঘাটে অপেক্ষা করছিল। ঘাটে নৌকা ভিড়তেই উঠে এল সরোজ। তারপর মাঝিকে পথ দেখিয়ে একটু ঘুরিয়ে এগিয়ে চলল। মিনিট পনের নৌকা চালানোর পর একটু ঝোপঝাড় মতো জায়গায় এসে পৌঁছাল। অজানা রহস্যে সবার শরীর-মন ছমছম করছে। কিছুদূর এগিয়েই একটা ঝোপের পাশে নৌকা থামল। প্রথমে সরোজ নামল। তারপর সাথে সাথে চিনুদা নামল।এক এক করে তারপর সবাই নেমে এল। সোহান ভীত চোখে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। সরু পথটা ঝোপের মাঝখান দিয়ে এগিয়ে গেছে। দু'জন পাশাপাশি হাঁটা যায় না। দু'জন পাশাপাশি হাঁটতে গেলেই ঝোপের কাঁটা গায়ে লাগে। তাই লম্বা লাইন ধরে একজনের পেছনে অন্যজন হাঁটছে। যদিও কিছুটা ভয় ভয় লাগছে তবুও বেশ রোমাঞ্চকর লাগছে। সোহানের সামনে দিয়েই একটা বেজী সুরুৎ করে রাস্তা পার হয়ে ঝোঁপের ভেতর চলে গেল। সোহান রীতিমত চেঁচিয়ে ওঠল-'ওরে বাবারে...ওটা কী গেল!'
সোহানের পেছনে নাউড়া।বেজীটাকে নাউড়া এক পলক দেখতে পেয়েছিল। তাই নাউড়া বলল- 'ওটা বেজী। ভয় পাবার কিছু নয়।'
সোহান ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে দাঁড়িয়ছিল। নাউড়া সোহানের পিঠে আলতো ধাক্কা দিয়ে বলল- 'ভয় নেই। এগিয়ে চল। ওরাতো অনেকদূর এগিয়ে গেল!'
সোহান ভীত পায়ে এগিয়ে চলল। আশেপাশে মাথা উঁচু করে নাম জানা-অজানা বড় বড় গাছ যেন আকাশ ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনেকগুলো গাছ থেকে পাঁকানো মোটা মোটা লতা ঝুলে ঝুলে জঙ্গলের ভেতর মুখ লুকিয়েছে।যেন জঙ্গলকে কানে কানে কিছু বলছে। পাখিরা কিচির-মিচির করে গাছে গাছে উড়াউড়ি করছে। বনালী গন্ধ মনটাকে কেমন যেন মাতোয়ারা ও বিমোহিত করে দিচ্ছে। সোহানের মনে হচ্ছে স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে অজানা কোথাও যেন চলে যাচ্ছে। প্রায় মিনিট পাঁচেক হাঁটার পর সবাই একটা ফাঁকা মাঠের মত জায়গায় এসে জড়ো হল। এখানে এসে দাঁড়িয়ে সরোজ বলল- 'বাগানবাড়ির এ জায়গাটাই বেশ ফাঁকা। এখান রান্না-বান্নার কাজের সুবিধা হবে। আশা করি পিকনিকটাও জমজমাট হবে এখানে। কী বলিস চিনুদা?'
শান্তির নিঃশ্বাস ফেলে চিনুদা ঘাসের ওপর বিছিয়ে বসল। দেখাদেখি সবাই ঘাসের উপর আরাম করে লেপটে বসল।
জঙ্গলাকীর্ণ এই বাগানবাড়িটি সত্যিই চমৎকার। আমবাগানে বেশ উঁচু উঁচু কয়েকটা আমগাছ। এখনও কিছু কিছু আম গাছে ঝুলে আছে আম। বেশ কিছু কাঁঠাল গাছ। ঠাসা বড় বড় অসংখ্য কাঁঠাল গাছে গাছে ঝুলে আছে। গাছগুলো দেখেই বুঝা যাচ্ছে অনেক পুরনো গাছ এগুলো। লিচু গাছ দুটো ছাতার মতো মেলে আছে। গাছগুলো বেশ বড় কিন্তু কোন ফল নেই। বাতাবি লেবুর ঝোঁপটা বেশ বড়সড়। থোকা থোকা লেবু ঝুলে আছে। জাম পেকে টসটসে হয়ে আছে। জাম গাছে পাখিদের জমজমাট কোলাহল। পাখিরা ডালে ডালে খুবই ব্যস্ত যেন প্রাণেরা এখানে সদা হাস্যোজ্জ্বল।পাখির মনের যত সুখ বন-মাঝারে বিলিয়ে দিচ্ছে। সবাই জাম গাছের দিকে তন্ময় হয়ে তাকিয়ে আছে। আরও কত নাম জানা-অজানা গাছগাছালি এই বাগান বাড়িতে। সোহান সরোজকে কৌতূহল বশতঃ বলল- 'সরোজ তোদের বাগান বাড়ির অনেক গাছই আমি চিনি না।'
সরোজ দেখিয়ে দেখিয়ে এক এক করে বলল- 'ঐ যে ওটা চালতা গাছ, আর ওটার পেছনেরটা জলপাই গাছ। ভূতুরে অন্ধকার মতো গাছটা দেখছিস, ওটা গাব গাছ। গোল গোল হলুদাভ সবুজ পাতাওয়ালা গাছটা দেখছিস ওটা ডেওয়া গাছ।'
সোহান বলল- 'ডেওয়া চিনি না।'
উত্তরে সরোজ বলল- 'ঠিক আছে তোকে খা'ইয়েই চেনাবো। আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু ওগুলো তো চিনিসই।'
মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।
সরোজ এক এক করে আরও অনেক রকম গাছ সোহানকে পরিচিত করে দিল।
কাছেই টুনটুনি পাখিটা টুন-টুন-টুন করে ডাকছে আর ডালে ডালে লাফাচ্ছে। একটা একটা পোকামাকড় পাতার আড়াল থেকে খুঁজে খুঁজে ধরছে আর খাচ্ছে। অদূরেই এক গাছের ডালে বসে দোয়েল পাখি মধুর সুরে ডাকছে। ঘুঘু পাখির ডাক ভেসে আসছে। বেশ কিছুক্ষণ একটা ঘোর তন্ময়তার মধ্যে কেটে গেল।
চিনুদা নাউড়াকে ডেকে বলল- 'নাউড়া ওই ঝোপটা থেকে একটা লেবু এনে দিবি?'
নাউড়া সোহানকে নিয়ে গিয়ে কতগুলো লেবু নিয়ে এল। সোহানের চোখ জোড়া খুশিতে ঝলমল করছে। প্যান্টে ঘষে মুছেই চিনুদা দাঁতে লেবু ছিঁড়ে চাকুস-চুকুস শব্দে লেবু খেতে শুরু করল। দেখাদেখি অন্যরাও।
লেবু চুষতে চুষতেই চিনুদা সরোজকে জিজ্ঞাসা করল- 'কি-রে সরোজ, তোদের বাড়ীতে কি ঠেলা জাল আছে?'
সরোজ কিছুটা অবাক হয়ে বলে- ' তা' আছে, কিন্তু কেন?'
কাজ আছে।-এই বলে চিনুদা সবার উদ্দ্যেশে বলল- 'চল, আগে সব জিনিসপত্র নৌকা থেকে নামিয়ে নিয়ে আসি।' চলবে...
নদী কথায় ভেসে যায় ......
তীর্থঙ্কর সুমিত
(১০)
যে নদীটা রোজ দেখি বয়ে যেতে তাকে নিয়ে ই মানুষের যত প্রশ্ন।সকাল থেকে রাত যত ভাবনা,অনুশোচনা,ক্রমশ ভালো লাগার তাগিদ আবার নানা প্রশ্ন।এভাবেই দিন চলে যায়।কেউ এর গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করে না।কোনো কারণ ছাড়াই অকারণে নানা কথা।যুক্তিগুলো কে পাশাপাশি সাজিয়ে নতুন হয়ে ওঠা।এভাবে কি কিছু ফিরে আসে?
মাটি
সোমনাথ বেনিয়া
সুবোধ পাল মারা যাওয়ার পর পাড়ার পুজো কমিটির লোকজন চিন্তায় পড়ে গেল। কাকে দিয়ে এবছর মায়ের মূর্তি গড়াবে। এতদিন সুবোধই মূর্তি গড়ে আসছিল। মূর্তি গড়ায় তার আন্তরিকতা অনেকেই দেখেছে পাড়ার মণ্ডপে। এখন উপায়! মিটিঙে কেউ বললো কুমোরটুলি থেকে সরাসরি কিনে আনতে আবার কেউ বললো অন্য শিল্পীকে এখানে ভাড়া করে আনতে। হঠাৎ কমিটির সেক্রেটারি বলে - সুবোধের ভাই অনিল তো প্রতিবার তার কাজে সাহায্য করতো। এতদিনে তার হাতও নিশ্চয়ই পেকেছে। সেও এই কাজ করতে পারে। কমিটির লোকজন সহমত পোষণ করলো। সেই ভাবে অনিলকে প্রস্তাব দেওয়া হলো। অনিল বললো সে কি আর দাদার মতো অত ভালো মায়ের মূর্তি তৈরি করতে পারবে! সবাই তাকে উৎসাহ জোগালো যে সে এই কাজ বেশ ভালো মতোই করতে পারবে। অগত্যা অনিল রাজি হলো।
সে ঠিক করলো তার বিধবা বউদির মুখের আদলে মূর্তি তৈরি করবে যেন সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণা। এখন মূর্তি তৈরি করতে গেলে পতিতা পল্লির মাটি দরকার। না হলে কাজ শুরু করা যাবে না। অনিলকে চিন্তিত দেখে তার বউদি জিজ্ঞাসা করলো - কী হয়েছে? অনিল মাটির কথা তুলে ধরলো। শুনে অনিলের বউদি বলে - আমাদের ঘরের মাটি নিলে হবে না!
অবৈধ সম্পর্কের কথা মনে পড়তেই অনিল মূর্তির মুখের গড়নটা আর কিছুতেই দাঁড় করাতে পারছে না ...
কুমারেশ তেওয়ারী র কবিতাগুচ্ছ
কালপুরুষের থুতু
শুশ্রূষার ট্রায়ালরুম
সৈকত ঘোষ
প্রত্যেক সম্পর্কেই অমাবস্যা পূর্ণিমা থাকে
যেভাবে রাতের পর রাত
ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় রোদ বৃষ্টি ঝড়
আমরা দেখার মধ্যে চোখ
আঙুলের মধ্যে স্পর্শ খুঁজে বেড়াই
বাকি যা কিছু রহস্য কল্পতরু
কেউ ফিরে আসে
কেউ অন্ধ হয়ে যায়
সম্পর্ক সেই অন্ধ চশমা
দেখতে শুরু করলেই কালো হয়ে আসে চারিদিক
ডুব
No comments:
Post a Comment