PravatiPatrika

Sunday, June 28, 2020

সোমবারের পাতা


     
বন্দি ঘরে মনকেমনের ছড়া
জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়

বন্দি ঘরে ক-মাস ধরে ভাল্লাগে না
মস্ত তালা দেখেই কি কেউ ভিখ মাগে না !
দারুণ ভয়ে চুপ দেখি সব কি যে হবে
কোন বাতাসে বিপদ আসে হু হু রবে!
বন্ধু যত আমার মতই কীভাবে যায়
বন্ধ দুয়ার খেলতে যাবে নেই যে উপায়!
রকের কুকুর দেখে করুণ মুখটা তুলি
ব্যালকনিতে হাত বাড়িয়ে খাবার ফেলি।
কাক ও শালিখ ডাকছে বেজায় ঝগড়া ভুলে
মায়ের দেওয়া ভাত ও মুড়ি নিচ্ছে তুলে।
আমার খাওয়ার সময় ওরা খুব যে ডাকে
মন ভালো নয় মন চলে যায় গ্রিলের ফাঁকে।
ভবঘুরে কাকুটা আর পায় না খেতে
বাবার প্যান্টে বসেছে সে গামছা পেতে।
বাবা ওকে ডেকে নিয়ে দুই বেলাতে
থালায় করে খাবারটা দেয় জলের সাথে।
তখন হাসির ঝিলিক লাগে কাকুর মুখে
তাই দেখে খুব আনন্দ পাই আমার বুকে।
কবে আবার খুলবে দুয়ার ভয়কে গিলে
স্কুলে যাবো খেলতে পাবো সবাই মিলে!



 
                 কি মজা
             রঞ্জন চৌধুরী

                    হ্যাঁ
চাঁদ উঠেছে       পলাশ বনে
                   উ-ফ!
    হায়না চলে হন হনিয়ে।
ফুল হাসছে     পাখি হাসছে
                  হু-ম!
  হাতি নাচছে ঠ্যাং দুলিয়ে।
তালে মাতাল     বেতাল যত
                  বা-হ্!
বাদুড় বাজায় খোল ঢোল।
মেও পুষির        বিয়ে হবে
                 তা-ই!
     ছাতিম তলে সবাই চল।
চলছে সবাই     ভূতের নায়ে
                 কি-ই!
    উঠছে যত খুশির রোল।
বাঁদর তখন      আদর করে
    বলছে বাঘা ঘুমিয় পর।
                  ই-স্!




দাবা
অনিন্দ্যকেতন গোস্বামী

প্রশ্নগুলো হারিয়ে গেলো
কোথায় গেলো কেউ জানে না।
তার যে কিছু উত্তর ছিলো
উত্তরগুলো ঢেউ টানে না...
দাঁড়গুলো সব তুলোটকাঠের
উত্তর দেবে সাধ্যটা কি?
প্রশ্নগুলোই রাজা হলে
উত্তর দিতে বাধ্য নাকি?
বড়ে ঘোড়া নৌকো রাজা
হাতের গুলি শক্তিনগর
দাবার খাঁজে ফুল রেখেছি
নিবেদনে ভক্তি টগর...





           " ব‍্যবধান "
                 হামিদুল ইসলাম
                   

বুকের ভেতর বুক
পড়ে থাকে সময়
যেনো মস্ত অজগর সাপ
ছোবলে গর্জায়   ।।

রাতের উল্কারা খসে পড়ে
রক্তাক্ত মাটি
পৃথিবীর পাঠশালা বন্ধ আজ
তবু জীবন দুর্জয় খাঁটি   ।।

বন্ধু আমার আসে না আর
বাড়িতে কোনোদিন
ঘরের দরজায় মস্ত তালা
অপেক্ষার রাত সঙ্গীহীন  ।।

দূরে দূরে খুঁজি জীবনের স্বাদ
জীবন এখন অন‍্যরকম
বাক্সবন্দি জীবন হাপিত‍্যেশ করে
মনের বাইরে যেতে অক্ষম   ।।

তবু পেয়ে যাই জুটি
নিঃশব্দ প্রেম
দুজনে পাশাপাশি ব‍্যবধান হাজারো বিছানা
কেবল স্মৃতিগুলো বুকে আঁটা ফ্রেম   ।।






                          সাহিত্য
              ------সৌমেন সরকার

সাহিত্য কথার সঠিক অর্থ প্রকৃতপক্ষেই আমরা কেউই জানিনা।বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় সাহিত্যের সংজ্ঞাতে বলেছেন,"সাহিত্য শুধু রসবিলাস নয়,জীবন সমস্যার সমাধানের গূঢ় ইঙ্গিত থাকবে যে সাহিত্যের মধ্যে তারই মধ্যে আমরা পাবো কলালক্ষ্মীর কল্যানতম মূর্তিটির সন্ধান।"শুধু তাই নয়,সাহিত্য হবে "The easiest way to express".সাহিত্য মানে আমি কতটা জানি,কতটা পারি বা কতটা ট্যালেন্টেড্ তা দেখানো নয়।যেটা আমি জানাতে চাইছি সেটা কত সহজে,কত সাবলীলভাবে বা কত চিত্রপূর্ণরূপে উপস্থাপন করতে পারি তাই।সাহিত্য শুধুমাত্র নীরস বা সরস না;কিম্বা গল্প,কবিতা,নাটক ইত্যাদির সম্ভার হবেনা।সাহিত্য হবে বাস্তব ও তৎকালীন পরিস্থিতির রত্নস্বরূপ;সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, পারিপার্শ্বিক ইত্যাদির জীবন্ত দলিল।রচয়িতার সুক্ষ বিচারশক্তি,দার্শনিকতা,উপস্থাপন ক্ষমতা প্রভৃতি প্রতিটি বিষয় প্রতিটি পদক্ষেপে সুন্দরভাবে উপস্থাপিত থাকবে।সাহিত্যের বিভিন্ন শাখার নিয়মাবলী মানতে হবে সাহিত্যিককে পুঙ্খানুপঙ্খভাবে।মানে,উপন্যাসের নিয়মের সাথে কবিতার নিয়ম মিলবেনা বা গল্পের বিভাগ হলেও ছোটগল্প ও অনুগল্পের মধ্যে সুক্ষ পার্থক্য থাকবেই।আবার জীবনী অন্য ব্যক্তির জীবনকাহিনী হলেও আত্মজীবনী লেখকের নিজেরই জীবনকথা হবে।ভ্রমন কাহিনী হবে সম্পূর্ণ সহজ ও সাবলীল।গোয়েন্দাকাহিনী হবে রহস্য আর অ্যাডভেঞ্চারে পরিপূর্ণ।
         লেখকদেরও বিভিন্ন বিভাগের জন্য বিভিন্ন নামে অবিহিত করতে হবে।কবিতার ক্ষেত্রে কবি,গল্পের জন্য গল্পকার,উপন্যাস হলে ঔপন্যাসিক,জীবনী হলে জীবনীকার,ভ্রমনকাহিনী হলে ভ্রমনকারী,গোয়েন্দাকাহিনী হলে লেখক বা কাব্য হলে কাব্যিক।তবে যদি গল্পের ক্ষেত্রে গল্পকার নিজে ঘটনা বর্ণনা করে তবে হবে কথক ইত্যাদি।পরিশেষে বলা যায় রচনা যতটা বাস্তবধর্মী হবে,যতটা মানুষের হৃদয়ের মণিকেঠায় হিরকের ন্যায় প্রজ্জ্বলিত হতে পারবে ততটাই তার উদ্দেশ্য সার্থকতায় পর্যবসিত হবে।





                   দুর্ভিক্ষ দুয়ারে দাঁড়িয়ে
                     ডঃ রমলা মুখার্জী

ইতিহাসের পাতা ওল্টালে দেখতে পাব ভারতবর্ষে প্রধাণত দুটি দুর্ভিক্ষ বড় আকারে দেখা দিয়েছিল। ১৩৫০ বঙ্গাব্দে পঞ্চাশের মন্বন্তরে ভারতবর্ষে প্রায় ত্রিশ লক্ষ মানুষ অনাহারে মারা গিয়েছিল। এই দুর্ভিক্ষের কারণ ছিল তৎকালীন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর অমানবিক নীতি, তবে বর্নবৈষম্যও কিছুটা দায়ী ছিল। তবে সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ছিল ১১৭৬ বঙ্গাব্দের ছিয়াত্তরের মন্বন্তর। ইষ্ট ইন্ডিয়া কম্পানির খাদ্যশস্যের বাজার থেকে মুনাফা লুট এবং অতিরিক্ত রাজস্ব আদায়ের জন্যই দেখা দিয়েছিল এই চরম দুর্ভিক্ষ যার ফলে প্রায় এক কোটি লোক মারা গিয়েছিল।
     দুভাগ্যবশত আগের দুর্ভিক্ষগুলি প্রধাণত ছিল মনুষ্যঘটিত। কিন্তু ২০২৯ এ সারা পৃথিবীর মাটিতে নেমে এল বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত এক আতঙ্ক অনুকণা। প্রকৃতিসৃষ্ট নভেল করোনা ভাইরাস দ্বারা ভয়াল প্রাণঘাতী অসুখের কারণে সারা পৃথিবী জুড়ে মড়ক লেগে গেল।১৮৯৭ সালের মহামারী রোগ আইন ও করোনা ভাইরাস সংক্রান্ত  বিধিনিষেধ অনুসারে ২৪শে মার্চ থেকে ভারত সরকার লকডাউনের নির্দেশ জারি করতে বাধ্য হয়েছিল। স্তব্ধ হল সোনার দেশ। সত্যি, এমন বিপর্যয়ের কথা কি মানুষ কখনও কল্পনা করতে পেরেছিল! পৃথিবীর উন্নততম প্রজাতি যখন প্রকৃতি জয় করার উল্লাসে দাপাচ্ছে ঠিক তখনই এই মারাত্মক করোনা কীটের আক্রমণে সারা পৃথিবী জুড়ে কোটি কোটি মানুষ একদম ধরাশায়ী, লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু মিছিল।
     সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করাই ছিল এই লকডাউনের একমাত্র উদ্দেশ্য কারণ এক মানুষ থেকে আর মানুষে খুব দ্রুত সংক্রমিত হয় এই কভিড নাইটিন। আচমকা এই লকডাউন ঘোষণার ফলে যারা বাড়ির থেকে দূরে ছিলেন তাদের দুর্গতির আর সীমা পরিসীমা রইল না। তারা সবাই আটকে পড়ে রইলেন, হোটেল নেই, খাবার নেই, এমনকি জল পাওয়াও মুস্কিল হয়ে পড়ল। প্রচুর অর্থের বিনিময়ে যাদের সঙ্গতি আছে কিছু যোগাড় করতে পারলেও গরীব মানুষদের অবস্হা নিদারুণ হয়ে পড়ল। পরিযায়ী শ্রমিকরা মাইলের পর মাইল হেঁটে ঘরে ফিরতে লাগল। অনাহারে, পথশ্রমে ক্লান্ত শ্রমিকদের কি চরম ভোগান্তি যে হল তা বর্ণনা করা ভাষার অতীত। ক্লান্ত শ্রমিক পথে, রেললাইনে, যেখানে সেখানে ঘুমিয়ে পড়ে, আবার ওঠে, আবার পথ চলে। কিন্তু পথে অনাহারে, অসুখে, পথশ্রমে, দুর্ঘটনার কবলে পড়ে অনেক শ্রমিকের প্রাণ পথেই শেষ হয়ে গেল, ঘরে আর ফেরা হল না।
         যান চলাচল, দোকান বাজার হঠাৎ বন্ধ হওয়ার কারণে একদিকে যেমন দেশবাসী চরম দুর্গতির সম্মুখীন হল, অপরদিকে প্রচুর মানুষ কাজের অভাবে অনাহারে ভুগতে লাগল। দেশে নেমে এল হাহাকার, অন্নহীনতা। সরকারও চরম অর্থসঙ্কটে পড়ল, তাই সরকার আস্তে আস্তে পয়েলা জুন থেকে লকডাউন তোলার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হল। কিন্তু তার ফলে সংক্রমণ দিন দিন লাফিয়ে লাফিয়ে যে হারে বাড়ছে, জানি না এর শেষ কোথায় ! অতিমারীর ভয়ংকর ছোঁবলে সোনার ভারত ছারখার হয়ে যাচ্ছে; দুর্ভিক্ষ লেগে গেছে ঘরে ঘরে। এ যেন শাঁখের করাত, ঘরে থাকলে না খেয়ে মরতে হবে, বাইরে বেরুলে করোনা সংক্রমিত হবে।
      লকডাউনের মধ্যেই আবার  শস্য-শ্যামলা সোনার পশ্চিমবঙ্গ তছনছ হয়ে গেল আম্ফান ঘূর্ণিঝড়ের প্রচন্ড দাপাদাপিতে। কত শত গাছ যে আছড়ে পড়ল তার ইয়ত্তা নেই। গৃহহারার হাহাকার প্রবল বৃষ্টির শব্দের সাথে মিশে বাংলার আকাশ বাতাস ভরিয়ে তুলল। বেশ কয়েকটি জেলার চাষের জমি ভেসে গেল।শস্য, ফসলের অভবে বাংলায় যে দুর্ভিক্ষ দুয়ারে কড়া নাড়ছে তা তো বোঝাই যাচ্ছে। সমুদ্রের পাড় ভেঙে নোনা জলে ডুবে গেল সুন্দরবনের গ্রামকে গ্রাম। বিশ্বউষ্ণায়ণের ফলে  বঙ্গোপসাগরের তাপমাত্রা বাড়ছে, তাই জলচ্ছাস বাড়ছে। বিগত এক দশকে তাই ঝড়-ঝঞ্ঝার ঝঞ্ঝাটও বেড়ে গেছে। আবহাওয়াবিদদের মতে ঝড়ের প্রকোপ আরও বাড়তে পারে। সুন্দরবন আমাদের রক্ষাকবচ, তাই সুন্দরবন ধ্বংস হলে কোলকাতা মহনগরীও তছনছ হয়ে যেতে পারে।
       মনুষ্য প্রজাতির অতি আধুনিকতা, ভোগ-বিলাসিতা, বেহিসেবী পদক্ষেপ কি তাহলে হোমো সেপিয়েন্সের কাছেই বুমেরাং হয়ে ফিরে আসছে। প্রকৃতি কি তার তুলাদন্ডে  ভারসাম্যের হিসেব কষতে বসেছে, নিক্তির ওজনে বুঝে নিচ্ছে তার অম্লজানের অনুপাত, আরও সব পরিবেশের ঘাটতি। পাখির কাকলি শুনতে শুনতে বন্যপ্রাণীর বিচরণ ক্ষেত্রকে প্রশস্ত করার কাজে পরমা প্রকৃতি বড় ব্যস্ত তাই মানুষের কোন প্রার্থনাই তাঁর কানে পৌঁছাচ্ছে না। কবে যে করোনার বিভীষিকা শেষ হবে তার  উত্তর জানা নেই। তবে নিজের প্রয়োজনে করোনা সব মানুষকে ধ্বংস করবে না কারণ এই ভাইরাস যেহেতু মানুষের দেহে ঢুকে জীবন লাভ করে তাই মানুষ না থাকলে করোনারও অস্তিত্ব থাকবে না। তবে মানুষের উন্নত মস্তিষ্ক থেকে নিশ্চয়ই করোনার প্রতিষেধক আবিষ্কার হবে, এই আশায় আমরা সবাই। সেইদিনটা যেন  খুব তাড়াতাড়ি আসে এটাই আজ সারা পৃথিবীর প্রার্থনা। প্রতীক্ষার শেষ কর প্রকৃতি মা, তোমাকে লাঞ্ছিত আর করবে না মানুষ। পৃথিবীকে বিশুদ্ধ আর সুন্দর রাখবো এই অঙ্গীকারে দৃঢ়বদ্ধ আমরা সবাই।

পরমা-প্রকৃতি, ক্ষমো অপরাধ যত,
নতুন ভোরে ধুইয়ে দেবো ক্ষত।
দুষণ-দৈন্য করে যাব সব দূর....
সাম্য-মৈত্রী-ঐক্যে তুলবো সুর।
অতিমারী শেষে ধনী-দরিদ্র মিশে
হাতে হাত রেখে বাঁচবো ভালোবেসে।




                   যদি জানতেম
              শ‍্যামাপ্রসাদ সরকার


শীতের মাঝামাঝি মা চলে গেলেন। বছর আঠষট্টির মোটামুটি সুস্হ শরীর, একটু সুগার, গায়ে হাতে ব্যথা এ ছাড়া উপসর্গ ছিলনা। রাত্রিবেলা উঠে বাথরুম যাবার সময় হঠাৎ পড়ে যান। হঠাৎ স্ট্রোক আর তারপর কোমা। জ্ঞান ফেরেনি আর।

মা'য়ের টবজোড়া গাঁদা আর জারবেরা। তাদের সবকটা ফুলে ভরে উঠতে উঠতেই মা আর নেই।

বাড়ীতে যে কদিন লোকজন আসাযাওয়া করেছে ধূপের গন্ধ আর ফলপাকুড়ের ঝুড়ির মনখারাপ করা গন্ধে বাড়ি ছেয়ে ছিল। সবটাতেই একজনের অনুপস্থিতি প্রবল, অথচ মানুষটা ছিলেন মিতবাক। মানুষের থাকার সময়ের চেয়ে না থাকার সময়ে বড় বেশী চর্চিত হয়। জীবনের এ এক নিদারুণ রসিকতা।

শ্রাদ্ধশান্তির অনুষ্ঠান  মিটতে মিটতে বেশ দেরী হয়ে গেল।  কালকে দাদা ফিরে যাবে পুনায়,আর আমি ফিরে যাব জব্বলপুর আমার কর্মক্ষেত্রে। দু' ভাই এর বউরা অবশিষ্ট আত্মীয়স্বজনের সাথে নীচের ঘরে টুকিটাকি ব্যস্ত। আমরা দু' ভাই ধীরে ধীরে ছাদে  উঠলাম এলাম চুপচাপ। মাথার  ওপর আকাশের শামিয়ানা। দাদা ই বরাবর মায়ের নেওটা তাই ওর মনটা এখনো অস্হির। নীরবতা ভেঙে আমি বললাম - 'আচ্ছা মা এর সাথে আবার দেখা হলে কোন কোন কাজ  করতে বারণ করবি?' দাদা স্মিত হেসে বলল, ' মা বড় বেশী সঞ্চয়ী ছিল অপ্রয়োজনেই। এখনো মা র আলমারিতে কমপক্ষে এখনো দশটা নতুন শাড়ি পরে আছে ! জীবনকে উপভোগ করতে মা ভুলে গেছিল ! দেখা হলে আয়ুষ্কাল খরচ করতে বলব ! অতি সঞ্চয়ের পরিণাম যে আসলে শূন্য সেটাই বোঝাব।'

একটা সিগারেট ধরিয়ে আমি বললাম
'তোর মনে আছে ! মা হারমোনিয়ামটা বেচে দিয়েছিল? দাদুর দেওয়া ডোয়ার্কিন হারমোনিয়াম ছিল ওটা ! তার আগের রাতে বাবার সাথে কি সব নিয়ে অনেক্ষণ ঝগড়া হয়েছিল ! কে এক রমেনদা'র  নাম ঝগড়ার মধ‍্যে বারবার  ফিরে ফিরে আসছিল। '
দাদা বলল 'রমেনদা' মা'র গানের মাস্টার ছিল বিয়ের আগে। এবাড়িতেও কয়েকবার এসেছে, বেশি কিছু করত না ওই  ছুটকোছাটকা গানের টিউশনি ছাড়া।'

মা খুব অপমানিত হয়েছিল সেই ঘটনায়। পরদিন কাবারিওলা ডেকে হারমোনিয়াম বেচে দেয়। আর তারপর থেকে ঘুণাক্ষরেও কোনওদিন বাড়িতে এক লাইনও গান গায়নি মা আর। ওই হারমোনিয়ামটায় মায়ের কৈশোরবেলাটা ধরা ছিল। আজ হলে ওটা বিক্রি করতে বারণ করতাম।

' আচ্ছা! মায়ের কি সত্যি রমেনদা'র প্রতি কোনও অপাপবিদ্ধ দূর্বলতা ছিল? না কি সে সব নয় স্রেফ গানের মধ্যেই বদ্ধজীবনের মুক্তি খুঁজেছিল কখনো? '

এরপর আরও কিছুক্ষণ স্তব্ধতা ঘুরপাক খায়  সিগারেটের ধোঁয়ার সাথে মিশে।

দাদার হাতটা পিঠের ওপর এল আলতো করে। বলল 'ওসব কথা আজ থাক! বেশ ঠান্ডা লাগছে এখন ছাতে!  গায়ে চাদর আর মাথায় টুপি দেওয়ার কথা মনে করিয়ে দেওয়ার এখন আর কেউ নেই ! নীচে যাই চল !'

সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে মাথার ওপরের জমাটবাঁধা তারাভরা আকাশের বুক থেকে হাল্কা একঝলক হিমেল বাতাস আমাদের দু'ভায়ের গা ছুঁয়ে চলে গেল।







                        বোকামি
                  মিনতি গোস্বামী

দিন দিন পলি অবসাদগ্ৰস্ত হয়ে যাচ্ছে।তার গানের মাষ্টারমশাই বহু পুরোনো।ছোট্ট বয়স থেকে সে গান শেখে।কিন্তু বছরখানেক একটি নতুন মেয়ে এসেছে,তাকেই সব প্রোগ্ৰামে সুযোগ দেয় মাষ্টারমশাই।
পলি যে তার থেকে গানে ভালো সারা শহর জানে।
কিন্তু পুলিং এর যুগ, তাই পলি কোথাও সুযোগ পাচ্ছেনা।এছাড়া এস, এস,সি বন্ধ বলে মাষ্টার্স করার পর চাকরির সুযোগ ও হচ্ছেনা।
ইতিমধ্যে লকডাউন শুরু, পৃথিবী জুড়ে থমথমে অবস্থা।এক ধাক্কায় পৃথিবী স্তব্ধ, সবাই ঘরবন্দী।
দু'চারজন বান্ধবী ছিল, তাদের সঙ্গে দেখা করার ও সুযোগ নেই।
যেহেতু পলি তার বাবা মায়ের বেশি বয়সের সন্তান, তাই তাদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ও গড়ে ওঠেনি।
তাদের আত্মীয়-স্বজন ও তেমন নেই।তার থেকে ও তার জীবনের বড় সমস্যা এখন অতনুর সঙ্গে সম্পর্কটা। অতনুও বেকার, তাই বিয়ে করতে পারছেনা।অতনু অবশ্য বড় ব‍্যবসাদারের ছেলে, চাকরি না পেলেও অসুবিধা নেই জানিয়েছে।
সেই অতনুও লকডাউনের প্রথম দিকে কথা বললেও দিন পনেরো কোন যোগাযোগ রাখছেনা।
পলির বাড়িতে প্রেম না জানলেও বন্ধু বলে অতনুকে জানে।
পলি যেন দিশেহারা।ভাগ‍্যের বিড়ম্বনায় প্রতিটি পদক্ষেপে তার মত মেয়ের পিছুহটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেনা।তার এখন মনের কথা বলার মত কেউ নাই।বান্ধবীরা ফোন করলে নিজের কথাই বলে, তাই সে আর কথা বলেনা।অবসাদগ্ৰস্ত পলি ক'দিন মনের সঙ্গে যুদ্ধ করে অবশেষে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।
দুপুর বেলায় ফ‍্যানের সঙ্গে শাড়িটা লাগিয়ে জানালা
দিয়ে শহরটা শেষবারের মত দেখে নেয়।এমন সময়ে দরজায় ধাক্কা।মা বললো,"অতনু এসেছে,
দরজা খোল।" সে মূহুর্তেই দরজা খোলে।
অতনু হতবাক।
অতনু বলে,"লকডাউনে ব‍্যবসা মন্দা, তাই চিন্তায় বোধহয় বাবার স্ট্রোক হয়েছিল।খুব দুশ্চিন্তায় ছিলাম।এখন বাবা ভালো হয়ে বাড়ি এসেছে।
বিশ্বাস করো, একদম যোগাযোগ করতে পারিনি।
কিন্তু এই সেবা ভুলটা তুমি করে ফেললে কি হতো?"
পলি হাঁউমাঁউ করে কেঁদে বলে,"সত্যি বোকামি হতো।"





    আমি আত্মহত্যা করব
                                     --গৌতম দাস।

বর্বরতার মায়াজালে বিষাক্ত মন্ত্র ঢুকল
মনের গহিনে।
নিজেকে একা মনে হয় প্রিয়া তোমার বিহনে।
তব সুধাময় আলতো স্পর্শের স্মৃতি আজ জীবন্ত।
শোকের জলে ডুবুরি সেজে তোমায় খোঁজা একান্তই ভ্রান্ত।
বয়ঃসন্ধিতে নেশার জলে নিজেকে হারিয়েছি।
ভরা যৌবনে পরিপূর্ণ শোকে রেল লাইনে মাথা রেখেছি।
এই ধাপেও ব্যর্থ  হলাম শুভাকাঙ্ক্ষীর চোখে।
সমাজ বলে কুলাঙ্গার, কাপুরুষ ,নিষ্কর্মারা নিজেকে নিজে হারায়।
ছোট বাচ্চারাও শুনে মুখ ফিরিয়ে নেয় ,কেঁদে বুক বাসায়।

মানসিক অবসাদের তরে আত্মহত্যা করতে চাই।
যদিও এটা বড় মহাপাপ এর নেই কোন মাফ।
মা বলে সব সমস্যার সমাধান মৃত্যুতে নয়।
অন্যায়,শোক,হতাশাকে কেন কর ভয়?
সমস্যাকে আঁকড়ে ধরে এগিয়ে যেতে হয়।
চন্দ্র,সূর্য ,পৃথিবী থমকে দাঁড়ায় এই শোকেতে।
কী সুখ পাবে তুমি আত্মহত্যা করাতে?
কেন বার বার বল আমি আত্মহত্যা করব?
             
                                 


পথ
--চিরঞ্জিৎ বৈরাগী

খাতাগুলো ছিঁড়লেও
অগোচরে থেকে যাবে একশোভাগ হিসেব

তোমার থেকেই অন্যতুমি
মনে রেখো
 সুন্দর সকালের উল্টোপিঠে দুঃখ-রাত

তর্জনী যতো উঠবে
বৃদ্ধাঙ্গুলি তত কাছে

ব্যক্তি এক। পথ অগাধ
বেছে নেওয়া তোমার কর্তব্য





সঞ্চয়ী!
সমীরণ বেরা।

এখন সব কিছুই থেমে গেছে
শুধু কয়েকটি ব্যতিরেক
আহ্নিকগতি কিম্বা শ্বাস প্রশ্বাসের মত ।
কবিতাও কি থেমে গেল?
কবিতা তো থামতে জানে না
থমকে গেছে ; বিস্ময়ে নয়, সঙ্কটে নয়
আতঙ্কে নয়; অকস্মাত্ বিপন্নতায়
কলম ধরতে গেলেও তো হৃদয় লাগে!

হৃদয়ে লেগেছে অন্ধকারের দাপট
এক লহমায় সব গুলিয়ে যাচ্ছে
এত মানুষ না খেয়ে ঘুমাতে যেত!
মানুষও পরিযায়ী হয়?
তিলোত্তমা তবে তুমি কেন জলসাঘর সাজিয়ে রাখতে?
নেশার মত চোখে এখন বিষম ঘোর
না জানি মেঘের বুকে কেমন বজ্রপাত !
আমি শুধু দেখছি শুনছি নির্বাক শ্রোতার মত,
সঞ্চিত গচ্ছিত রাখছি গোপন ইস্তেহারের ইতিকথা।
ওদের ঘাম ওদের শ্রমেই বেড়ে উঠছে
চোরা গোপ্তা রাস্তা হেঁটে খুনী প্রত্যয়
তুমি কি দেখেছো তাকে?

বহু শতাব্দীর পর শতাব্দী সে ফিরে ফিরে আসে
গেরিলা যুদ্ধ উলগুলান অন্য রক্তের স্বাদ
গলির মুখে মেধাবী ছাত্র ছুরি উঁচিয়ে
লাশের পাহাড় পুঁজিপতির অনিশ্চল হাতের মত
আমি তাই শুধু গোপনে সঞ্চয় রাখছি দৃশ্যপট
আমার ক্যানভাসে একদিন তুলির আঁচড় পড়বেই।
তোমরা এখন শুধু টিকে থাকো; টিকে থাকাই আসল লড়াই,
আমি সঞ্চয় করে রাখছি বিষ মন্ত্র
একদিন ঠিক ঢেলে দেব।
আমার সারা শরীরে চেতনায় এখন বিষ
সঞ্চিত বিষে সঞ্চারিত আমার আলো বাতাস
আমি সঞ্চয়ী! একদিন ঠিক সব সঞ্চয়
 বিলিয়ে দেব সর্বহারার মত
তাই আমার ভয় কী!






                     . মিলন
                 রাজকুমার ঘোষ

গত একবছরে অনেককিছু পাল্টে গেছে। জ্যাঠতুতো দাদা বিট্টুর সাথে সেন্টুর সম্পর্ক ভীষণ ভালো। একসাথে দুজনের বেড়ে ওঠা, খেলাধুলা, স্কুলে যাওয়া সব কিছু। যাকে বলে হরিহর আত্মা। বিট্টু সেন্টুর থেকে মাত্র একবছরের বড়। দুজনে একই ক্লাসে পড়ে। তাও সেন্টু বিট্টুকে দাদা বলে ডাকে। গতবছর শীতের সময় একসাথে পৌষমেলা গিয়ে দারুণ আনন্দ করেছিলো। তারপর বাড়িতে এসে পিঠে পাব্বনে দুজনে কম্পিটিশন করে পিঠে খাওয়া, আজ সবই যেন ফিকে হয়ে গেছে ওর বা বিট্টুর কাছে। কারণ হল ওদের বাবা-জ্যাঠার লাঠি-ঝ্যাটা সম্পর্ক। সম্পত্তির ভাগ বাটোয়াড়া নিয়ে দুই ভাইয়ের মধ্যে তুমুল অশান্তি। এই একবছরে একটা অদৃশ্য দেওয়াল তৈরি হয়েছে যেন দুই পরিবারের মধ্যে। পাশাপাশি ঘর অথচ খবর নিতে পারে না বা যেতে পারেনা একে অপরের ঘরে।  সেন্টু খুব চিন্তিত বিট্টুর সাথে কিভাবে এই বিশেষ দিনগুলোতে আনন্দ করবে। ওরা এখন বাড়ির বাইরে দেখা করে, কথা বলে। কিন্তু বাড়িতে এলেই যেন কেউ কাউকে চেনে না এমনই বিধিনিষেধ আরোপ হয়েছে ওদের বাড়ির তরফ থেকে। তার ওপর বিট্টুরও গত কদিন ধরে দেখা নেই। ও বন্ধু মারফত খবর নিয়েছে বিট্টুর নাকি ভীষণ জ্বর। এবারের শীতেও যথারীতি পৌষের মেলা চলে এসেছে। পিঠে পাব্বন খুবই কাছে। বলতে গেলে আর দুদিন পরেই এই কাঙ্খিত দিনগুলো ওদের সামনে চলে আসবে। সব বন্ধুরা গিয়ে মজা করবে, কিন্তু সেন্টু ওর দাদা বিট্টুকে ছাড়া কিভাবে কাটাবে? ও আর ভাবতে পারে না। ভীষন অসহায় বোধ করে। বিট্টুকেও সে বলতে পারে না তার মনের কথা। না... সেন্টুর আর ভাবার সময় নেই, পৌষ মেলার দিন ও চলে এল বিট্টুদাদার বাড়ি... “বিট্টু দাদা, কোথায় তুই ? আজ আমরা একসাথে পৌষমেলায় যাবো, তারপর একসাথে পিঠে খাবো তো নাকি”। ওর হঠাৎ আগমনে ওর জ্যেঠু ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেলো। ওর সাহস দেখে জ্যেঠু বড় বড় চোখ করে ওর কাছে এল, তারপর চিৎকার করে ডাকলো ওর বাবাকে, ‘এই কমল, সাহস দেখ তোর ব্যাটার... আজ পিঠে পার্বনে সেন্টু এসে কি কান্ড করছে দেখে যা... ওর বুকের পাটা দেখেছিস...” সেন্টুর বাবা কমল এবং তার স্ত্রী ছুটে চলে এল। হাতে একটা লাঠি নিয়ে কমল সেন্টুকে মারতে উদ্যত হবে কি! জ্যেঠু চিৎকার করে বলল, ‘এই কমল একদম মারবি না’ তারপর সেন্টুকে বুকে জড়িয়ে ধরে, “চরম শিক্ষে দিয়েছিস ব্যাটা”, এবার তার ভাইকে হেড়েগলায় বললো, “কমল, দেখ তোর ব্যাটা আমাদের মেলানোর জন্য এইরকম দুঃসাহসিক কাজ করেছে, তোর মত নয় একদম। তুই তোর দাদার কাছে আসতে পারিসনি? কি হবে এই বিষয় সম্পত্তি... এদের থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়া দরকার। আমার চোখ খুলে দিয়েছে”। অন্যদিকে বিট্টুও চলে এসেছে সেন্টুর কাছে এবং ওকে দেখেই জড়িয়ে ধরলো। সেন্টু বললো,’চল দাদা, আমরা যাই পৌষমেলায়, কিন্তু তোর শরীর খারাপ... কি করে যাবি রে?” বিট্টূ জানালো, “তোকে দেখে আমার শরীর ঠিক হয়ে গেছে। আজ আমরা খুব আনন্দ করবো, তারপর রাত্রে এসে আমাদের পিঠে খাওয়া নিয়ে কম্পিটিশন... ঠিক আছে”।  দুই ভাইয়ের এই মিলনে বাড়ির বড়োদের চোখের জলে ভিজিয়ে দিলো দুই পরিবারের তিক্ততার সম্পর্ক।






একার কল্পনা
প্রিয়া ঘোষ

 প্রিয় ,তেপান্তর হারাবে ?
নতুন করে পথ গুলো আমায় দেখাবে
চোখে চোখে হৃদয়ের মেল বন্ধন ঘটাবে ।
যদি কখন বড্ড বিরক্ত করি
একটিবার বুকে নিয়ে নিমেষে শান্ত করবে?
আচ্ছা খুব দামী উপহার না হোক
অফিস ফেরা ক্লান্ত মানুষটিকে দুচোখ ভরে দেখার অধিকার দেবে ?
আমার এই এলোমেলো জীবন তোমার পদবীর ছোঁয়ায় সাঁজাবে?
কথা দেবে খুব গোপনে?
এভাবে চলতে চলতে শরীর যখন ছাড়বে আমার সাথ -
তোমার বাড়ির কাছে এক নদীর ধারে ছেড়ে আসবে সেই আগুনের কাছে ।
শেষ দেখায় ছাই  যেন তোমায় আমার অস্তিত্ব জানান দেবে ।
তুমি হয়তো আসবে বাড়ি ফিরে-
কিন্তু আমি যেন পিছু ছাড়বো না ।
হাওয়ার সাথে ভেসে এসে কানে কানে বলব -  প্রিয় তোমায় যে বড্ড ভালোবাসি





না পাওয়ার গল্প
জয় জ্যোতির্ময়


পাহাড়ের বুকে পাথরের কান্না ঝর্ণা,
ভুলে গেছে তার আদি কথা।

ঝর্ণার সাথে নদীর ইদানীং গলায় গলায় ভাব
ঝর্ণা একদিন মুখ ফুটে নদীকে বললে,
আমি তোমাকে ভালোবাসি নদী,
যতটা ভালোবাসলে ভুলে থাকা দায়;
আমি তোমাতে মিশে বহমান থাকতে চাই।

নদী কলকল শব্দ থামিয়ে বললে,
আমি নদী তুমি ঝর্ণা;
তাই বলে কি তোমাকে ভালোবাসা যায়?
তোমার গণ্ডি সীমাবদ্ধ; আমি প্রবাহমান-
তুমি বরং পাহাড়কে ভালোবাসো
তোমার জন্মে পাহাড়ের অবদান।

কথাগুলো শুনে ঝর্ণা কান্না করলেও
টের পায়নি নদী।

আষাঢ়ের বর্ষায় জলে থৈ থৈ করছে নদী
ভরা যৌবনে আনন্দে-উৎফুল্লে দিশেহারা নদী।
দক্ষিণাবাতাসে হাসিমুখে
সাগরের কাছে গিয়ে নদী বললে,
তোমার বুকেই তো আমার চিরসুখ-
আমার জন্যই যেন সৃষ্টি হয়েছে তোমার বুক।

কথাগুলো শুনে সাগর বললে,
তোমার মতো কত নদী আমাতে মিশেছে।
আষাঢ়-শ্রাবণে প্রেম নিবেদন করে
তাই বলে কি নদীকে ভালোবাসা সাগরের চলে?

নদীর কান্না হারিয়ে যায় সাগরের ঢেউয়ে।

মনখারাপেও হাসিমুখে ঝর্ণার কাছে গিয়ে বলে,
আমাকে ক্ষমা করো; কষ্ট দিয়েছিলাম সেদিনে,
সত্যিকারের ভালোবাসা ক'জনে বা চিনে!

     




জীবনের স্বপ্ন
তাপস কুমার বেরা

আপদ মস্তক
বিষাক্ত ছোবল
সাথে নিয়ে
অহরহ
নিত্য দিনের
হাসি কান্নার
জীবনালেখ্য
চলে পাঠ |

রিক্ত হাতে
জীবনের মাঝে
দন্ডায়মান |
অতীতে
বুনে চলা
ভাবী সময়ের
সোনালী
স্বপ্নগুলো
রাতের অন্ধকার
ছিঁড়ে
জাগ্রত
দিনের আলোয়
খান খান |

তবু
জীবনের
অবশিষ্ট
দিনগুলো
অলঙ্ঘনীয়
প্রাচীর তুলে
সুরক্ষিত
করার
স্বপ্ন দেখা
শুরু হোক |





উড়ান্ত ফাল্গুনি
   এম ডি আবুহোসেন সেখ

হাওয়াই হাওয়াই দ‍্যায় দলিয়ে মনুষ্যত্বের শরীরটাকে।
শান্ত স্নিগ্ধ বাতাস বইছে আমাদের পাড়াগাঁয়।
ঝরিয়া পুষ্পতি হচ্ছে নতুন গাছের পাতা।
সেই সুন্দরজীনি দেখিয়া মুগ্ধ মানুষেরা।

উড়ান্ত করিয়া দ‍্যায় মানুষের মন।
যেন পুরান কলঙ্গ শেষ করে,
নতুন আলম্ভের অনুভূতি জাগায়।

ফাল্গুনি মাস মনুষ্যত্বের কাছে অবিনশ্বর হয়ে যায়।
মানুষের মাঝে হয়ে উঠুক গাছেরী মতো।
   
 
             


           আদিবাসী জীবন যাত্রা
              আব্দুল রাহাজ

ওরা কোথাও যেন আজ অবহেলিত ক্ষুধার্ত, অসহায় প্রান্তিক প্রকৃতির সভ্য সমাজের সঙ্গে নতুন বিশ্বের মধ্যে এখনো তৈরি করতে পারেনি। পারবেই বা কি করে আধপেটা খাওয়া প্রতিনিয়ত ও জীবিকা উপার্জনের জন্য কঠিন সংগ্রাম করে বেশি আছে আদিবাসী মানুষেরা। কত কষ্ট করে এই সমাজ তথা প্রকৃতি তথা বাংলা মা তথা সুন্দর পৃথিবীর কোলে বসবাস করছে ওরা। সেই আদিবাসী মানুষেরা ছোট্ট ছেলে মেয়েদের নিয়ে তাদের পরিবার নিয়ে বসবাস করে খাবার জোটে আধপেটা অত্যন্ত কষ্টে জীবিকা উপার্জন করে সংসার চালান এইসব আদিবাসী মানুষগুলো। কিন্তু তারা প্রান্তিক হলেও সরল সাদাসিধে একে অপরের সাহায্যে রক্ষক বিপদের দিনে বন্ধু। সমাজের চোখে তারা যেন কোথাকার কি কেউ দাম ই দেয়না সাহায্যে তো দূরের কথা। এই আদিবাসী মানুষগুলোর প্রতিভা থাকলেও তাদের কেউ পাত্তা দেয় না। একবার স্বচক্ষে আরিফ ও শাহাদাত দেখেছিল আদিবাসী মানুষের জীবনযাত্রা বাঁচার রসদ কিভাবে বাঁচা যায় প্রতিনিয়ত কঠিন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আর ছোট্ট ছেলে মেয়েরা খেতে না পেয়ে ও পুষ্টির অভাবে দিনের-পর-দিন শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়ে উঠেছে ওরা। শরিফদের ও শাহাদাতের গ্রাম থেকে তিন কিলো মিটার দূরে বেশ কয়েকটা গ্রাম সবকটি আদিবাসী ও অধুষ্যিত প্রান্তিক মানুষের বসবাস। সেখানেই বিভিন্ন আদিবাসী পুরো জাতির বসবাস মুন্ডা সাঁওতাল ওরাংওটাং প্রভৃতি। তাদের জীবিকা উৎস ছিল পাশে ইটভাটা বিদ্যাধরী নদীর মাছ ধরা আবার কারন ইঁদুর মৌমাছি চাক থেকে মধু সংগ্রহ করা এসব কাজ করে প্রান্তিক আদিবাসীদের জীবনযাত্রা চলত। কোনরকম সংসার চালাতে ওরা বাড়ির বাচ্চারা বাদেই সকল সদস্য শীত-গ্রীস্ম ও বর্ষা এক করে কাজ করে অন্ন তুলে দিতেন তাদের মুখে সেটা আবার দিন আনা দিন খায় ঠিকমতো ভাতের স্বাদ নিতে পারে না এইসব মানুষগুলো। ঠিকমতো পোশাক-আশাক পর্যাপ্ত পানীয় জল মিললেও কোথাও অপুষ্টির শিকার হতো ওরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হতো। এখন অবশ্য প্রাথমিক শিক্ষা পায় ওরা আবার খুব কষ্ট সহ্য করে তাদের এই শিক্ষাটা গ্রহণ করতে হয়। মানুষ গুলোর দিকে তাকালে সত্যিই যেন মনটা কেঁদে ওঠে। ছোট্ট ছেলে মেয়েরা সারা দিন খেলা করে কাটাতো তাদের অবস্থা দেখলে সত্যিই যেন মায়া লাগে।গায়ে আছে ধুলো কাদামাখা শুধু পরনে একটা প্যান্ট জামা থাকলেও অপরিচ্ছন্ন এভাবে দিনের পর দিন ওরা খেলা করে বেড়ায় বাবা মা ছোটে দুবেলা দু'মুঠো তাদের মুখে তুলে দেওয়ার জন্য কঠোর পরিশ্রম করে। এরকম অবস্থায় যখন কোন অনুষ্ঠান কিংবা মেলা বসলে চাতক পাখির মতো তাকিয়ে থাকে সভ্য মানুষের দিকে কখন তারা তাদের সাহায্য করবে এরপর যদি তা কখনো পায় তাদের আনন্দের আর সীমা থাকে না। এইভাবে ওরা বহুকষ্টে ক্ষুধায় যন্ত্রণায় ভোগ করে বড় হয়ে ওঠে তারপরই ওই ছোট বয়সে কাজে যোগ দেওয়া একটু ভালো করে পেট ভরে খাবার খাওয়ার জন্যকিন্তু সে আশায় কোথাও যেন ঘাটতি থেকে চাই বহুকাল ধরেই। ওরা উৎসব আসলে তাঁদের
 সাধ্যমতো করে মাতে নিজেদের মতো করে পালন করে। আহা কি কষ্ট কি কঠিন পরিশ্রম মনে হয় বিধাতা যেন জন্মের পর থেকে এরকম ভাবেই তাদের পাঠিয়েছে। একবার এক বিকাল বেলায় শাহাদাত শরীফ ঘুরতে ঘুরতে আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় ঢুকলো সাদা দল আজকে আমরা এদের সঙ্গে কথাবার্তা বা আলাপ করি তখন পেছন থেকে বেশ কয়েক ছোট্ট ছেলে মেয়ে হাত ধরে ডেকে বলল দাদা দাদা একটা টাকা দেবে বিস্কুট কিনে খাবো এরকম অবস্থায় শাহাদাত শরীফের মনে মায়া হল তোমরা বিস্কুট খাবে এই বলে তাদের হাতে বিস্কুট কিনে দিলো তখন ছেলে মেয়েদের মুখে সে কি চওড়া হাসি এই হাসি দেখে শাহাদাত শরীফের যেন একটু আনন্দ বোধ হল। তাড়াতাড়ি হাসির মধ্যেই লুকিয়ে আছে কষ্ট ক্ষুধার যন্ত্রণা এবার শরীফ একটা গ্রামে ভিতরে ঢুকলো কি করুন অবস্থা শাহাদাত আর শরীফকে দেখে সবাই কাছে চলে এলো তারা মনে করলো হয়তো আমাদের সাহায্য করবে তখন শরীফ ও শাহাদাত বললো তোমাদের সাথে একটু কথা বলবো তখন সন্ধ্যা হতে বেশ দেরি আস্তে আস্তে ওরা ভিড়ের জটলা কাটতে দেখলো তারপর কয়েক জন ছেলেমেয়ের কাছ থেকে শুনলো করূন অবস্থার কথা। শরীফের চোখ দিয়ে জল টপ টপ করে পড়তে লাগলো তাদের কথা শুনে শাহাদাত বিষন্ন মনে বসে রইলো হঠাৎ একজন বুড়িমা  বললো বাবারা তোমরা বাড়ি যাবেনা কালো অন্ধকার যে নেমে এসেছে হ্যাঁ হ্যাঁ যাবো বাড়ির পথে হাঁটতে হাঁটতে ওরা দুজন ভাবলো কী করূন অবস্থার মধ্য দিয়ে কাটছে ওদের জীবন দেখলেও যেন কোথাও মায়া লাগে এই বলে দুজন যে যার বাড়ি চলে গেল। পরের দিন আবার বিকাল বেলায় সেই অধুষ্যিত অঞ্চল বরাবর একটি নদী ছিল বিদ্যাধরী তার বাঁধের উপর বসে গল্প করছে শাহাদাত শরীফ তারপর দেখল পাশে একটা ছোট্ট বোন থেকে একদল মহিলা কাঠ কেটে মাথায় করে নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে সারিবদ্ধ পাড় ধরে হেঁটে যাচ্ছে তখন শাহাদাত বলল দেখ দেখ দৃশ্যটা পেটের জ্বালায় দুবেলা দুমুঠো ভাতের আশায় গভীর বন থেকে কাঠ সংগ্রহ করে বাড়ি ফিরছে সত্যিই তাদের জীবনযাত্রা কি অদ্ভুত ভাবেই গড়ে উঠেছে। তারপর তারা হাঁটতে হাঁটতে দেখল একটা পরিবার অর্থাৎ একটা বাড়ির সমস্ত সদস্যরা ইটভাটায় কাজ করছে সবশেষে মালিকের দেওয়া টাকা নিয়ে হাসিমুখে বাড়ি ফিরে খাবারের জোগার করে আশায় বুক বাঁধে তারা আজ ভাত খাবে পেট ভরে এই দেখে শাহাদাত বলল আজকে  ওদের কী আনন্দের দিন এরকম যদি প্রত্যেকদিন ভালো করে কাটতো তাহলে এই সমাজের চোখে তারা উজ্জ্বল প্রতীক হয়ে থাকতেন কিন্তু তা না চিরদিনের পথ ধরে এখনো অসহায়তাকে আঁকড়ে ধরে দুবেলা দুমুঠো ভাত খাওয়া কে আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছে সবার মাঝে। সত্যিই এই মানুষগুলোর জীবনযাত্রা অদ্ভুত ভাবাই। সূর্যের নীল দিগন্ত রাশির সাথে ওদের জীবনযাত্রা ও পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিলেও কোথাও যেন ঘাটতি থেকে যায় ঘাটতি থেকে যায়।






ঘন্টা
শুভার্থী সাহা

সারাদিন ঝুলে থাকে দুলে যায় ঘন্টা
মন্দিরে গির্জায় বাজে এই ঘন্টা ।
এছাড়াও কত কাজ আছে তার দিন রাত
স্টেশনে ট্রেন এলেই, তার আবার পরে ডাক।
কত ট্রেন আসে যায়, বাজ সে ঠং ঠং
ফায়ার ব্রিগেডেও, বাজো তুমি টং টং ।
মালগাড়ি - টয়ট্রেন নয় শুধু সীমা তার
কুলফির গাড়িতেও , দেখা যায় তাকে আর ;
দেওয়ালের ঘড়ি টায় অ্যালার্ম এর সঙ্গে
প্রত্যেক ঘন্টায় বাজে সে নিয়মে ।
স্কুল কলেজ ও পরীক্ষা কেন্দ্রে -
তুমি ছাড়া ঘন্টা জীবন অচল যে ,
এছাড়াও ঘন্টা পুরুতের আঙুলে
কাঁচ কলা উঁচিয়ে ঘন্টা বাজায় সে ,
সারাক্ষণ বেজে যায় বাড়িতে ও অফিসে
কাওকে ডাকতে গেলে দেওয়ালে ও টেবিলে।
কখনো বা হাতুড়ির বারি খায় সমানে
আজীবন বেজে যায় সে আপন খেয়ালে।
কিন্তু আঘাত ছাড়া ঘন্টা না বাজে ভাই
শত আঘাত সয়ে নিজে, সচেতন করে যায়।






অনুকবিতা:      বৃষ্টি যেন ঝড়ে
                    বাপ্পা দাস

চলো যাই পঙ্খিরাজে চড়ে ,
রঙ বেরঙের ডানা মেলে পাখি যেথায় উড়ে ।
মেঘগুলোকে আসবো বলে,বৃষ্টি যেন ঝড়ে ।
শখ হয়েছে ভিজবো আমি তোমার দুহাত ধরে ।







জেনারেশন গ্যাপ্
বাপন দেব লাড়ু

'জিগ্ জ্যাগ্' পথে
সময়ের হাইজাম্প্
মিটার ফিঁতেতে মাপা যায় না
জেনারেশন গ্যাপ।
নতুন কত মুখ কতই খোলামেলা ;
তবুও গোপন,
তবুও নিষিদ্ধ
হাইব্রিডের আয়নায়
আজ বিশ্বায়নের মুখ।






                কাশী ভ্রমণ-
               নির্মাল্য পান্ডে

১১) কি! তীর্থ ভ্রমণে অনেক তো ঘুরলে, এবার তব এচল যাই কাশী ধামে, রথদেখা ও ক লা বেচা দুইই হবে! কাশী বা বারাণসী যাওয়া খুব সহজ। উত্তর প্রদেশের প্রায় মধ্যভাগে অবস্থিত এবং রেল, সড়ক ও ফ্লাইটের ব্যবস্থা আছে। এটা তো বর্তমান প্রধান মন্ত্রীর ভোট কেন্দ্র, কাজেই এই ঐতিহাসিক স্থান নে দেখলে তো জীবনি বৃথা। বাঙ্গালীরা তো কাশী দর্শন করেন নি-তা শোনা যায় না। ক ল কাতা থেকে মাত্র ১২ ঘণ্টার জার্নি রেলে। চল যাই কাশী-
কাশীধামে বিশ্বেশ্বর- এবার আমরা চলে এসেছি উত্তর প্রদেশের কাশী বা বারাণসীতে, যেখানে আছেন দ্বাদশ জ্যোতিঃরলিঙ্গের অন্যতম শিবস্থান। এখানে শুধু বাবা বিশ্বনাথ আছেন তা নয়, আছেন মা অন্নপূর্ণাসহ বহু দেবদেবী। এটি বহু চর্চিত দেবস্থান, অবশ্য হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে, কারণ এই হিন্দুদের আদিকাল থেকে এই স্থানটি পীঠস্থান হিসেবে চিহ্নিত ছিল, তাই বারংবার মুসলমানদের দ্বারা আক্রন্ত ও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। আমরা এই পরিক্রমায় কাশীর অন্যতম তীর্থ  ভগবান শিববাবাকে বিশ্বেশ্বররূপে যেমন দেখব, তেমনি এই দ্বাদশ জ্যোতিঃরলিঙ্গের অবস্থান, পৌরাণিক কাহিনী ও ইতিহাসের দিকে নজর দেব। তবে খুব অল্প কথায়—
অবস্থান—ভারতের উত্তরপ্রদেশের বারাণসীতে বা কাশীতে গঙ্গার তীরে অবস্থিত। সব দিক থেকে রেল ও সড়ক পথের যোগাযোগ আছে। কলকাতা থেকে ১২ ঘণ্টা মত সময় লাগে ট্রেনে এবং অন্যন্য স্থানের সঙ্গেও অনুরূপ যোগাযোগ আছে। প্রচুর ধর্মশালা, হোটেল, ভারতসেবাশ্রমে থাকারও ব্যবস্থা আছে। বর্তমানে কাশী বা বেণারস জনবহুল, ব্যবসাকেন্দ্রিক, ধর্মীয়, সংস্ক্রিতি, শিক্ষা ও রাজনৈতিক সচেতন স্থান হিসেবে চিহ্নিত। এখনে প্রাচীনকাল থেকে রাজামহারাজার ধর্মের খিদে মেটাতে এসেছেন, পবিত্র গঙ্গার ঘাটে স্নান করেছেন, ঘাট বাঁধিয়েছেন, মন্দির নির্মাণ ও সংস্কার করেছেন-তাই, তো আজ কাশীতে ১০০টির বেশী বাঁধন ঘাট ও তাঁদের নামে ঘাট যেমন, হরিশ্চন্দ্র ঘাট, মণিকর্ণিকা ঘাট, রাজেন্দ্র, অহল্যাবাই, প্রয়াগ, দশাশ্বমেধ ঘাট—প্রভৃতি।
 মন্দির ও বিগ্রহ প্রসঙ্গে—বিভিন্ন পুঁথি ঘেঁটে সঠিক কখন ও কেন ভগবান শিববাবা জ্যোতিঃরলিঙ্গ রূপে এই স্থানে আবির্ভূত হয়েছিলেন, তার হদিশ আমি পাই নি তবে, এই স্থানের কথা- ‘স্কন্ধপুরাণে-কাশীধামের নাম’- উল্লেখ আছে। একাদশ শতাব্দীতে রাজা হরিশ্চন্দ্র বিশ্বেশ্বরের মন্দিরের পুননির্মাণ করেছিলেন এবং ১১৯৪ সালে মহম্মদ ঘোরি মন্দির ধ্বংস করে লুটপাঠ চালায়। পুনরায় মন্দির সংস্কারের পর মহম্মদ কুতুবউদ্দিন আইবক ও ১৩৫১ সালে ফিরোজ শাহ তুঘলক আবার ধ্বংস করেন। ১৫৮৫ সালে সম্রাট আকবরের রাজদরবারের রাজস্ব মন্ত্রী ‘টোডরমল’ পুনরায় ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দিরের সংস্কার ও পুনঃ নির্মাণ করেন.। ১৬৬৯ সালে সম্রাট ঔরাঙ্গজেব আবার এই মন্দির ধ্বংস করে জ্ঞানবাপি মসজিদ নির্মাণ করেন, যা আজও বিদ্যমান। এই মন্দিরের একপাশে উক্ত মসজিদ বিদ্যমান। ১৭৮০ সালে ইন্দোরের রাণী অহল্যাবাই মসজিদের পাশে আবার অনুরূপ মন্দির নির্মাণ করে পুজোর ব্যবস্থা করেন। আবার, ১৮৩৫ সালে পাঞ্জাব কেশরী মহারাজা রণজিৎ সিংহ মন্দিরের চূড়া ১০০০ কেজি সোনা দিয়ে মুড়ে দেন।তাই, এই জ্যোতিঃরলিঙ্গের    বিগ্রহের উচ্চতা ৬০ সেন্টিমিটার ও পরিধি ৯০ সেন্টিমিটার যা, একটি রূপোর পাত্রে রাখা আছে, এটা সব তীর্থ যাত্রিরা দেখে থাকবেন। মন্দিরের মধ্যে জ্ঞানব্যাপী নামে একটি কুয়ো আছে, কথিত, যখন মুসলমান আগ্রাসনে মন্দির ও বিগ্রহ ধ্বংসর মুখে, তখন প্রধান পুরোহিত আসল বিগ্রহ নিয়ে ঐ ক্যুয়োতে ঝাঁপ দেন। তাই এটাও পবিত্র ও দর্শনীয়।
 গুরুত্বঃ—এই প্রাচীন বিগ্রহ ও মন্দিরের গুরুত্ব অপরিসীম। পুরান, বেদ বেদান্ত, ইতিহাস খ্যাত এই স্থানে কে না এসেছেন, থেকেছেন ও এখনও থাকছেন। আদিশঙ্করাচার্জ, রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, ত্রৈলঙ্গস্বামী, তুকিরাম, স্বমীবিবেকান ন্দ, প্রমুখ আরও অনেক অনেক আধ্যাত্মিক জগতের দিকপালের পদধূলি ধন্য এই বারাণসী বা কাশী। তাই তো বিদেশীদের বার বার টেনে এনেছে লুণ্ঠন ও ধ্বংস করে কৃতিত্ব স্থাপন করতে! তাছাড়া, এখানে আছে শক্তিপীঠ। সতীমায়ের দেহত্যাগের পর যখন মহাদেব উন্মত্তের মত শবদেহ নিয়ে নৃত্য আরম্ভ করেন, তখন পৃথিবীকে রক্ষা করার জন্য শ্রীবিস্নু সুদর্শনচক্র দিয়ে ঐ শবদেহ বিচ্ছিন করতে থাকলে মায়ের দেহাংশ বিভিন্ন স্থানে পড়ে ও সেই সব স্থানে সতীপীঠ তৈরী হয়। কাশীতে মায়ের চোখের মণি পড়ে ও মণিকর্ণিকা ঘাটের সৃষ্টি হয়। কথিত, এই ঘাটে শবদাহ করলে ‘আত্মার মুক্তি’ লাভ ঘটে। এখানেই আছে বিখ্যাত অন্নপূর্ণা দেবী ও অন্নকূট সেবার স্থান। কাশীতে কেউ অভুক্ত থাকেন না- সেটা মা অন্নপূর্ণা মায়ের দৌলতে।  গোটা কাশী মন্দিরময়- পুণ্য দেবস্থান, এর গুরুত্ব অপরিসীম।
 এই বিষয়ে আর বেশী বলব না। সকলেই প্রায় কাশী দর্শন করেছেন, নিয়েছেন বাবা বিশ্বেশ্বরের ও মায়ের আশীর্বাদ। বাঙ্গালী বিধবারা পূর্বে বলতেন,-‘ বাবা, আমায় কাশী পাঠীয়ে দে, সেখানেই বাবা বিশ্বনাথের আশ্রয়ে থাকব—‘। কাশীর ঘাট ও মন্দির নিয়ে ‘ছায়াছবি, বিশেষত সত্যজিত রায়ের ছবি- ফেলুদা’ নির্মিত হয়েছে, কাজেই এর কদর ও আদর কতটা বুঝে নাও তোমরা- চল এবার যাই শেষ ধাম- কেদার--।

   আচ্ছা! এই সব গল্প যে বলছেন, এর সত্যতার কি প্রমাণ আছে? বলচ্ছেন, আত্মা অবিনশ্বর, তবে তার মুক্তির জন্য এত আকুতি কেন? তার জন্ম তো অনিবার্য!
-হ্যাঁ, ঠিক বলেছ, এর কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই, নেই কোন সঠিক প্রমাণ, সবই প্রাচীনের শ্রুতি থেকে স্মৃতি, তার থেকে প্রাপ্ত লিপি থেকেই এর উদ্ভব। কথাতে আছে না! ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর’--।






পাহাড় ও সোনার নদী
 - অগ্নিমিত্র

  পাহাড়, জঙ্গল, আপন মনে বয়ে চলা নদী, এই নিয়েই হলো ঘাটশিলা । বছর কুড়ি আগে গিয়েছিলাম সপরিবারে ।..
  প্রকৃতি একে সাজিয়েছে আপন খেয়ালে! ফুলডুংরি পাহাড়ে অমর সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি দেখা হলো। দেখলাম ক্ষীণতোয়া সুবর্ণরেখা নদী; আজও নাকি এর জল ও  মাটিতে সোনা পাওয়া যায়! সেই আশাতেই হয়তো মহিলা ও শিশুরা বড় ছাঁকনি নিয়ে সমানে জল ছেঁকে চলেছে !
 ঘাটশিলা দেখে ভাবি, কাছেই তো বাঙালি অধ্যুষিত জামশেদপুর; যাবো না নাকি ?
  রাস্তায় পড়বে বিরাটকায় ডিমনা লেক ও ড্যাম। খুব ভালো লাগবে ।
  জামশেদপুর সাজানো গোছানো ব্যস্ত আধুনিক শহর। ঘাটশিলা থেকে ঘন্টা দেড়েক লাগলো বাসে। জুবিলি পার্কে গিয়ে বেশ লাগলো ।...সুন্দর পার্ক, মাঝে মাঝে বাগান। অনুপম লাগলো। সন্ধ্যায় বাইরে থেকেই দেখলাম বিখ্যাত কিনান স্টেডিয়াম । উঁকি দিয়ে দেখা হলো মখমলি ঘাসে মোড়া স্টেডিয়াম । ক্রিকেট ম্যাচ হয় এখানে।
 আবার ফেরা ঘাটশিলা! পাহাড়টা যেন সবুজে মাখোমাখো । ..দুদিন জিরিয়ে বুঝলাম, বিভূতিভূষণ কেন প্রকৃতিপ্রেমিক হয়েছিলেন!
 বেশি প্রেম নাকি ভালো নয়। তাই আবার কলকাতার পথ ধরা।
 এতই মন টেনেছিল ঘাটশিলা ও সুবর্ণরেখা, যে আরেকবার যাবো ভাবছি ।।





 পারুল ( ৭ )
বদরুদ্দোজা শেখু


পারুল মাঝি ভর্তি  হলো ঝাড়গ্রাম শহরে
এগারো ক্লাশে ,লোকজন আসে তারে দেখার তরে ,
সেখানে আলাপ  সহপাঠী যোহান টুডুর লগে
যোহান  আছে সাঁতাল বটে খ্রীস্টান বরগে,
 আলাপ থেকে অন্তরঙ্গ  ভালো লাগার মন
ধীরে ধীরে তৈরী হলো স্বপ্ন এক ভুবন ,
জানলো সে বঞ্চনার কথা জঙ্গলমহল জুড়ে
জানলো আমলাশোলের কথা না-খেতে পেয়ে মরে
জীর্ণ শীর্ণ অভুক্ত মানুষ বছর বছর মাস
সাহায্য নাই চিকিৎসা নাই, আছে দলদাস,
করুণ কাহিনীতে তারা দুঃখী প্রতিবাদী---
গোপন ডেরায় নাম  লেখালো, হলো কি মাওবাদী ?


তখন থেকে চলাফেরায় শুরু হলো ধোঁয়াসা----
কখন্ কোথায় যায় বলে না, কেবল ক্রূর হাসা;
আর ভালবাসায় মগ্ন থাকে  দুজন আদিবাসী
ছাত্রছাত্রী,  রাতবিরাত্রি সহচর পাশাপাশি
দলের কাজে , গোপন সভায়, অস্ত্র প্রশিক্ষণে,
ভাঁটা পড়লো লেখা পড়ায়  অন্য আকর্ষণে,


মাওবাদী স্কোয়াড ছেড়ে বিহা করবে দু'জন
শুরু করবে অন্য জীবন , মনে মনে এক স্বপন
দেখছে তারা, গোপন ডেরার জীবন বড়ো কঠিন--
এমন ক'রে দুঃখ-মোচন হবে না কোনোদিন  ;
তাই দুজনে  সমাজসেবার কাজ করবে ব'লে
ক্রমশঃ তারা ছেদ ঘটালো মাওবাদীদের দলে ।




                    পারুল ( ৮ )

আজ পারুলের গায়ে  হলুদ , কাল পারুলের বিহা
পারুল যাবে শ্বশুরবাড়ি গোর্গাবুরু ডিহা
বেলপাহাড়ি বেলপাহাড়ি বেলপাহাড়ি হাসো,
আমলাশোলের ক'জন ম'লো ? ক'জন ভালো আছো ?
বর সেজেছে যোহান টুডু --- তাগড়া মরদ বটে
তার  মতো কি বর আছে এই জঙ্গলী তল্লোট ?
পারুল যাবে বরের বাড়ি, সঙ্গে মালু কালু
জোয়ান বিটির কপাল  বটে মারাং বুরু দয়ালু,
চিকন কালো মেইয়া মরদ  মেঝেন মাঝি সাঁঝে
রঙবেরঙে নাচছে সবাই কূলপ্রথার সাজে---
লাল পাগড়ি পালক -গোঁজা, গামছা-বাঁধা কটি
গাছ-কোমরে রঙীন শাড়ি, ফুল-খোঁপাতে নটী ;
বহু বিটি নাচছে বেতাল মরদগুলার সাথে
পারুল মাঝি যোহান টুডুর আজকে বিহা রাতে।
হাসছে বুঝি বেলপাহাড়ি ,হাসছে মারাং বুরু
টাঁড়মহলের গাছগাছালি কাঁপছে দুরু দুরু !

 
মধ্যি রাতে গুড়ুম গুড়ুম , ধোঁয়ায় আঁধার দিশা
চারিদিকেই বারুদ পোড়ার গন্ধে ভয়াল নিশা,
মাওবাদীদের হামলা বুঝি ? সূত্র খুঁজি কোথা ?
যোহান পারুল নাম লিখিয়ে ভাঙলো দলের
প্রথা ?


লাশ পড়েছে লাশ পড়েছে , সঙ্গে মালু কালু
ওরাও দোষী ? মাওবাদীরা ভয়ঙ্কর ভয়ালু ?
চালু চুক্তি ভেঙেছে ওরা পারুল যোহান টুডু
তাই কি বাঁচার নাই অধিকার ? যাবেই যাবে মুণ্ডু?
পোড়া মাংসের কটু গন্ধ যাচ্ছে ভেসে দূরে
অপারেশন বিহা-বাড়িকে শোকে দিয়েছে মুড়ে !


আজ পারুলের  বিহ্যার হাসি, আজ পারুলের গঙ্গা,
সঙ্গে যোহান মালু কালু । সঙ্গে কি  তিরঙ্গা ?
এই অবেলায় রঙ ছাড়্ নাই, রাজনীতি তো জমবে
এবার আরো,বলতে পারো দুঃখ কবে কমবে ?

মারাং বুরু,  আজ তো কাঁদো, কাঁদছে বেলপাহাড়ি  !
জঙ্গলমহল আকাশ বাতাস  অন্তরীক্ষ ভারী !
অন্তরীক্ষ ভারী  এবং অন্তরীক্ষ গুমসাম !
কাম দিলো কি মারাং বুরু আল্লা যীশু জয় শ্রীরাম?







No comments:

Post a Comment