PravatiPatrika

Sunday, July 5, 2020

রবিবারের পাতা



             সাক্ষাৎকথায় সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
                      প্রশান্ত ভৌমিক

        সুনীলদা কারো সমালোচনা করতেন না

(সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় -রম্য ধারার রচনায় এক পথিকৃত। স্বামী বিবেকানন্দর জীবনীসহ স্বামীজীকে নিয়ে লিখছেন টানা ২০ বছর ধরে। লেখালেখিতে যেমন রম্য রচনা লেখায় সিদ্ধহস্ত, কথাবার্তাতেও তার বহিঃপ্রকাশ। গ্রীষ্মের এক সন্ধ্যায় লেখকের কুঠিঘাটের বাড়িতে লেখকের মুখোমুখি হলাম।)

প্রশান্ত ভৌমিকঃ শুরুতেই আপনার জন্ম ,শিশুকাল, বেড়ে ওঠা -এই তিনটি বিষয়ে জানতে চাইবো ।

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ঃ দেখুন আমার একটাই সৌভাগ্য। আমি যেখানে জন্মেছি সেখানেই আছি। গঙ্গার ধার থেকে একটু এগিয়ে এসে এলাকাটা এখানেই আমার জন্ম, শৈশব, যৌবন থেকে একেবারে শেষ। কাছাকাছি আমাদের একটি পুরনো বাড়ি ছিল। সেই বাড়িতে আমার জন্ম। সেই বাড়ি প্রোমোটারি হয়ে গেল। ফলে বাধ্য হয়ে আমরা এখন যে বাড়িতে আছি , সেখানে চলে এলাম। কিন্তু এই এলাকাটা আমার ছেলে বেলার প্রতিটি মুহূর্তে ছায়া দিয়েছে। এখন এখানে অনেক বাড়ি হয়েছে, অনেক লোক বেড়েছে। আমার ছেলেবেলায় এখানে এরকম ছিলো না। এখানে প্রচুর গাছপালা ছিলো, বাগান ছিলো। সন্ধ্যেবেলা রাস্তায় অনেকক্ষণ দাঁড়ালে হয়তো এরকম একজন-দু'জন লোক দেখা যেত। তেমন গাড়িও ছিলো না। 

প্রশান্ত ভৌমিকঃ আপনার এই বাড়ি আর নদীর মাঝে কি আর কিছু ছিলো ? নাকি পুরোটাই খোলামেলা ?

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ঃ দুই একটা বাড়ি ছিলো। কিন্তু নদীও দেখা যেত। বাড়ির বাইরে একটা পাঁচিল ছিলো। তারপরে একটা রাস্তা। তারপর একটু এগোলেই নদী। কিন্তু এখন তো সেই রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে। তাছাড়া এখানে একসময় জমিদারদের বাড়ি ছিলো। প্রচুর জায়গা ছিলো। সেই জায়গাগুলো কী হল? ইংরেজ সরকার কোম্পানীর আমলে ঠিক করেছিলো গঙ্গ একটা খাল পূর্ববঙ্গ অব্দি টেনে নিয়ে যাবে। ফলে ওরা জমিগুলো অধিগ্রহণ করে খাস করে নিলো। কিন্তু সেই খালটা আর হলো না। ফলে ঐ জমিগুলো বিভিন্ন রাজনৈতিক দল যখন যাকে পারলো দিয়ে দিলো। শর্ত হলো এই ,পাকা বাড়ি করতে পারবে না। দেয়াল পাকা কর। কিন্তু মাথার উপরে টিন বা অ্যাজবেস্টার্স । ফলে গায়ে গায়ে অনেক বাড়ি হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ছাদে দাঁড়ালেই গঙ্গা দেখতে পাচ্ছি,গঙ্গার বাতাস আসছে -এই জায়গাটা সেই কারণেই আমার কাছে খুব প্রিয়। এই জায়গাটা ছেড়ে আমার কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। আর এই যে সামনের মেন রাস্তাটা, এই রাস্তাটা খুব ঐতিহাসিক। এই রাস্তা ধরে খুব বড় বড় মানুষ একদা হাঁটাচলা করেছেন। এই রাস্তা ধরে প্রাইম মিনিস্টার জহরলাল মেহেরু হেঁটেছেন। এই রাস্তা ধরে শরৎ বসু হেঁটেছেন, তাঁরা গেছেন গঙ্গার ধারে। ফলে এই রাস্তাটা খুব ইম্পরট্যান্ট। আবার এই রাস্তা ধরে দক্ষিণেশ্বরের শ্রীরামকৃষ্ণ হেঁটে গেছেন। এইখানে স্বামী বিবেকানন্দ ছুটোছুটি, দৌড়াদৌড়ি ও করেছেন। ফলে এই রাস্তাটা আমার কাছে তীর্থের মতো। এখানে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য ও এসেছেন। এখানেও বড় হওয়া আমার। এখানেই সব দেখা। নকশাল আমলসহ সব দেখা। বেড়ে ওঠা, পড়াশুনো সব এখানেই।

 প্রশান্ত ভৌমিকঃ আপনার প্রথম বই প্রকাশের স্মৃতি বলুন।

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ঃ আমি তো বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম। আমার পড়াশুনোর বিষয় ছিলো কেমিস্ট্রি। তারপরে পড়াশুনোর শেষে সরকারি চাকরি পেলাম। সরকারি চাকরিতে আমার উপর দায়িত্ব পড়লো। আমাদের এই পশ্চিম বঙ্গে ক্ষুদ্র এবং কুটির শিল্পের বিকাশের জন্য যা কিছু করণীয় সেটা করতে হবে। এটাকে বলা হয় ইন্ডাস্ট্রিয়াল জার্নালিজম। বিভিন্ন বই প্রকাশ ইত্যাদি কাজ ছিলো। ধরুন এখন কৃষির জন্য হয় না, বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে কৃষি শেখানো হয়, সেরকমই ব্যাপার। সেরকম শিল্প শেখানো এবং তাদের সাহায্যের জন্য ব্যাংক লোন ইত্যাদি। সেই সময়ে আমি শিল্প সম্পর্কেই তো লিখি। কিন্তু সাহিত্য যাকে বলে সেই কলেজ জীবন থেকেই তো গল্প লিখি। সেসময় দুটো গল্প লিখে 'যুগান্তর' গোষ্ঠীর 'অমৃত' বলে একটি কাগজে পাঠালাম। সেখানে দু'টো গল্পই বেরোয়। তৃতীয় গল্পটা যখন আমি নিয়ে গেলাম, সেখানে ভবানী মুখোপাধ্যায় বলে একজন ছিলেন। তিনি আমায় খুব ভালোবাসতেন। তিনি আমায় বললেন- "সঞ্জীব, গল্পটা খুব ভালো হয়েছে। এটা তুমি 'আনন্দবাজার' গোষ্ঠীর যে 'দেশ' পত্রিকা সেখানে নিয়ে যাও।" তখনকার দিনে 'দেশ' পত্রিকায় লেখা না বেরোলে লেখক মনে করা হতো না। ওখানে নিয়ে গেলাম। ওখানে যিনি ভারপ্রাপ্ত ছিলেন, তিনি বলা চলে আমাকে ক্যাচ করলেন। তিনি বললেন-'' আপনি কী করেন? '' আমি বললাম- আমি এই এই করি। তিনি আমাকে একটা প্রোপ্রোজাল দিলেন। তিনি আমাকে বললেন- "ধারাবাহিক লিখতে পারবেন?"

প্রশান্ত ভৌমিকঃ গল্পটা না পড়েই ?

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ঃ না পড়েই। আমি জিজ্ঞেস করলাম- "কী ধারাবাহিক লিখবো আমি?" বললেন- "আপনি তো সারা পশ্চিম বাংলা ঘুরে ঘুরে দেখছেন। সেটা নিয়েই লিখুন না।" এবং বলে আমায় একটা হেডিং দিলেন- 'জীবিকার সন্ধানে পশ্চিমবঙ্গ'। কিন্তু আমার স্বনামে তো লিখতে পারবো না সরকারি চাকরি বলে। ফলে সঞ্জয় ছদ্মনামে এক বছর লিখলাম সেটা। এটা শুধু তথ্য এবং তত্ত্বের কচকচানি নয়। ওটাতেও সাহিত্য করা যায়। একেকটা জেলাকে ধরে সেই জেলার ইতিহাসকে গল্পের আকারে নিয়ে এসে মানুষের সামনে আমি উপস্থাপন করেছি। ফলে ওটা একটা ইনফরমেটিভ উপন্যাস বলতে পার সারা পশ্চিমবঙ্গের। পরবর্তীতে সেই বইটা বেরোল। এবং সেটাই প্রথম বই। এটা বেরোনোর পর ভীষণ বিক্রি হল। তখন 'আনন্দবাজার' গোষ্ঠীর আমাকে তাঁদের দলে নেয়ার ইচ্ছে হলো। আর আমারও অনেক দিন জার্নালিজম করার ইচ্ছে। ফলে তারা যখন আমাকে প্রপোজাল দিলেন আমি তখন সরকারি চাকরি ছেড়ে আনন্দবাজারেই ঢুকলাম। আমার প্রথম উপন্যাস কিন্তু 'শারদীয় দেশ'- এই বেরোয়। অনেকেই কাছেই ব্যাপারটা ঈর্ষার ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় যে একজন নতুন লেখক, সে একেবারে এসেই 'দেশ' পত্রিকার শারদ সংখ্যায় লিখে ফেললো। তখনকার কালে একটা ব্যাপার ছিলো, যারা বড় বড় লেখক ছিলেন, তাঁরা অদ্ভূত উদার মনের ছিলেন।  তাঁরা স্বতপ্রণোদিত হয়ে চিঠি লিখলেন 'দেশ' পত্রিকায় যে- এই লেখকটিকে মনে হচ্ছে নতুন, উদীয়মান। এরপরে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয় নি।

প্রশান্ত ভৌমিকঃ আপনি দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা করেছেন। সেই সাংবাদিকতা জীবন সম্পর্কে কিছু বলুন।

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ঃ আমি তো একটা অত্যন্ত ভালো সরকারি চাকরি ছেড়ে দুঃসাহসী হয়ে সাংবাদিকতার জগতে প্রবেশ করলাম। তখন আত্মীয়-স্বজনরা আমাকে খুব তিরস্কার করেছিলো। এমনও বলেছিলেন- তুমি শেষকালে খেতে পাবে তো? কিন্তু আমার বাবা, তিনি বড় অদ্ভূত মানুষ ছিলেন। তিনি বলেছিলেন- "দ্যাখো, জব স্যাটিসফেকশান বলে একটা কথা আছে। তোমার যদি মনে হয় এই লাইনে তোমার ভালো লাগবে, তাহলে তুমি মন-প্রাণ উভয়কে লাগিয়ে কাজ কর। তাহলে ও সব সরকারি চাকরিতে কী হতে পারতো, রিটায়ারমেন্টের পর কী বেনিফিট হতো চিন্তা করার দরকার নেই" তিনি আমাকে সাহস দিলেন। যখন আমি ওখানে চাকরিতে ঢুকলাম, ওখানে তখনকার কালে বহু ভালো ভালো বড় মানুষ ছিলেন, যারা সহজেই আমার বন্ধু এবং অভিভাবক হয়ে গেলেন। তাঁরা আমার মন খারাপ দেখে বলতেন- "সঞ্জীব, তুমি আগে যে চাকরি করতে সেখানে অনেক ক্ষমতা-টাকা ছিলো বটে, কিন্তু এখানকার চাকরিরও একটা ভ্যালু আছে।" আর বলতেন- "কিছুদিন পরেই দেখবে ভালো লেগে যাবে।" তারপর হলো কী, আমি নতুন চাকরিতে ঢোকার সাতদিন কী আটদিনের মাথায় আমাকে বলা হলো, তুমি জামা-কাপড়, স্যুটকেস গুছিয়ে ফেলো। তোমাকে লং ট্রিপে যেতে হবে। সেটা কোথায়? আন্দামান। সেখানে আন্দামানের যে চীফ কমিশনার, তিনি একটা আলাদা জাহাজ দিয়ে দেবেন। সেই জাহাজে করে ৫৫৬ টা আইল্যান্ড ঘুরে ঘুরে দেখতে হবে। ফলে সমুদ্রেই থাকতে হবে। তো আমি চলে গেলাম। তখন রাইটার্স বিল্ডিং-এ নয়, আনন্দবাজার দপ্তরও নয়, সমুদ্রটাই আমার বিচরণক্ষেত্র হয়ে উঠলো। এবং সেই সমুদ্র বিচরণ করতে গিয়েই ঝড়ের মুখে পড়লাম, জলস্তম্ভে জাহাজ ডুবে যাচ্ছিলো- তাও হলো। অনেক রকম অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে এলাম। ফিরে এসে আমি লিখলাম- 'ভারতের শেষ ভূখণ্ড'। আন্দামান এবং নিকোবর আইল্যান্ডকে নিয়ে এই লেখাটা লিখে আমার খুব আনন্দ হলো। এবং সবাই আমাকে ভালোও বললো। আমার কোনো লেখাই কিন্তু শুধু গল্প নয়। তাতে ইতিহাস আছে। তারপর সেখানকার সব আইল্যান্ডেই আমি গিয়েছিলাম। তখন তো আর এত বাধা-বিপত্তি ছিলো না। তখন মাত্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে। জাপানিদের অত্যাচার, জাপানিদের বানানো রাস্তাঘাট- এসব দেখলাম। একসময় ফিরে এলাম। ফিরে আসার পর তখনকার প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী, তাঁর সঙ্গে আমাকে ট্যুরে পাঠানো হলো। এবং আমি একদম মেক্সিকো পর্যন্ত চলে গেলাম। মায়া সভ্যতা দেখলাম। এরকমভাবে প্রচুর ঘোরা হয়ে গেলো। কোনো ঘোরাই নিস্ফল ঘোরা নয়। প্রত্যেকটা ঘোরার পরেই একেকটা করে বই হলো বড়। যেমন- দানব দেবতা ইত্যাদি বইগুলো সলিড বই আর কী! ফলে আমার সাংবাদিকতা জীবনের এটাও অনেক বড় প্রাপ্তি।





                 স্বার্থপর
                              দিলীপকুমার  মিস্ত্রী

সার্থক  আজ মুক্তি পাবে। আর পাঁচজন কয়েদি মুক্তিলাভের একমাস আগে থেকে আনন্দে আত্মহারা হয়ে প্রতিটি মুহূর্ত পার করার জন্য ঘন ঘন শ্বাস নিতে থাকে। সেখানে সার্থক ভীষণ বিমর্ষ। তার মন একেবারেই ভালো নেই। তার এই ভালো না থাকার কারণটা সে ছাড়া আর কেউ জানেনা।
                      ফাল্গুনের পঞ্চম দিন, সোমবার। সকাল  আটটা নাগাদ জেলারসাহেব নিজে এসে সার্থকের  সঙ্গে দেখা করে বলে গেলেন,
                  “আর কিছুসময় পর আপনাকে  রিলিজ করে দেয়া হবে। তবে  আপনি দুপুরের খাবার খেয়েই বাইরে  যাবেন। আর যাবার সময় আপনার পাওনাগণ্ডা  ঠিকমতো বুঝে নিয়ে যাবেন।  সময় করতে পারলে, আপনি যাবার আগে আমি আবার আসবো। এসডিপিওসাহেবও আসতে পারেন। আসার সম্ভাবনা  রয়েছে  আরও অনেকের।“
                             একজন সাজাপ্রাপ্ত আসামী  জেল থেকে ছাড়া পাবে,  তার জন্য প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিদের এতো  মাথাব্যথা ! কিন্তু কেন ? কারণ  সার্থক এখন আর কোন সাধারণ কয়েদি নয়।  একজন সফল সাহিত্যিক হিসেবে তার সুখ‍্যাতি এখন দেশজুড়ে। টানা পাঁচবছর ধরে তার বই বাজারে বেস্ট সেলার। তাকে  টপকাতে, এইমুহূর্তে  বাজারে  আর  কোন  প্রতিদ্বন্দ্বী  নেই বললেই চলে।
              সকাল ঠিক সাড়ে এগারোটা। সার্থক অবন্তিপুর সংশোধনাগার থেকে বাইরে এল। গেটের বাইরে পা রাখতেই সে অবাক। বাইরে তার জন্য অপেক্ষা করছে অসংখ্য মানুষ। তাদের মধ্যে একাধিক  ভিভিআইপি, রিপোর্টার, ফটোগ্রাফার, পাবলিশার্স এবং শত শত সাধারণ মানুষ। সবাই তাকে শুভেচ্ছা, অভিনন্দন জানাতে এসেছে। কিন্তু তার আপনজন বলতে কেউ আসেনি। কারণ, এই সংসারে তার আপনজন বলতে কেউ নেই। মাত্র দশবছর বয়স থেকে সে একেবারেই একা।
             সবাই তাকে ঘিরে ধরেছে। ক‍্যামেরার ফ্ল‍্যাসের মুহুর্মুহু ঝলকানি। অটোগ্রাফ শিকারীদের পীড়াপীড়ি। সাংবাদিকদের ছোট ছোট প্রশ্নবাণ। সার্থক অত্যন্ত শান্তভাবে সবকিছু ঠিকঠাক সামলে এগিয়ে চলেছে। সে এখন  ভীষণ উদাস। একজন পাবলিশার্স হঠাৎ তার পথ আটকে কিছু বলতে চাইল। সার্থক তার মুখে তাকিয়ে মৃদু হাসল। তারপর তাকে করজোড়ে  নমস্কার জানিয়ে এগিয়ে চলল। কিন্তু কয়েকপা এগিয়েই সে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। এখন তার সামনে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এক মধ‍্যবয়সী দম্পতি। সঙ্গে দুটি বাচ্চা‌‌ । একটির বয়স বছর ছয়েক হবে। অপরটি  দশটশ।
                                                                 ।। ২ ।।
“আচ্ছা সার্থকদা, তুমি সত্যি করে বলতো, যে অপরাধ তুমি করোনি সেটা কেন নিজের কাঁধে তুলে নিলে ? তুমিতো জানতে, এরজন্য তোমার কঠিন সাজা হবে। তোমার মান-সম্মান ধুলোয় মিশবে। তাহলে, একজন আপরাধীকে বাঁচাতে তুমি কেন নিজের জীবনটাকে এভাবে নষ্ট করলে ?”
“নিখিল, নিজের স্বার্থ ছাড়া এই পৃথিবীতে কেউ কোনদিন কোনো কাজ করে না। আমিও আমার নিজের জন্যই এমন সিদ্ধান্ত সেদিন নিয়েছিলাম। তোর কথা ভেবে মোটেই নয়। ঘটনাচক্রে তুই এরমধ্যে  এসে  গেছিস এই যা।“  হাসতে হাসতে কথাগুলো বলল সার্থক।
“না না সার্থকদা, এটা মোটেও হাসির কথা নয়। আমার প্রাণ বাঁচল। আমার সম্পত্তি বাঁচল। আমার সংসার বাঁচল। কিন্তু এসব বাঁচাতে গিয়ে তোমার যে সব শেষ হয়ে গেল। তোমার এই ঋণ আমি কীভাবে পরিশোধ করব ? তুমি জানো সার্থকদা, এই সাতটা বছর আমি প্রতিটি মুহূর্তে তোমার কথা ভেবেছি। কিন্তু প্রতিবেশীদের ভয়, বাচ্চাদের মুখের দিকে  তাকিয়ে , আমি তোমার সাথে একদিনও দেখা করতে যেতে পারি নি। আমি সত্যি সত্যিই একজন  অপরাধী।“
“ধূর পাগল ! অপরাধী তো আমি। জানিস, এই সামান্য শাস্তির বিনিময়ে আমি কী পেয়েছি ?  তুই এমন কাজ না করলে, আমি কী এই জীবনে এমন বড়ো, বিখ্যাত মানুষ হওয়ার  সুযোগ পেতাম ? তুই আমার কতোবড়ো উপকার করেছিস, তা আমি তোকে বলে বোঝাতে পারব না। সত্যি, তুইই আমার প্রকৃত বন্ধু, আমার সত্যিকারের ভাই। তোর কাছে আমি চিরঋণী হয়ে গেলাম। এবার আমাকে এই ঋণ থেকে মুক্তি পাওয়ার সুযোগ তোকে দিতেই হবে নিখিল!”
“তোমার কথার মাথা-মুণ্ডু আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। খুন করতে গিয়েছিলাম আমি। সাজা খেটে  এলে তুমি। তবু  তুমি বলছ,আমি তোমার উপকার করেছি !”
“দ‍্যাখ নিখিল, প্রতি মুহূর্তে বাবা-মায়ের  মুখটা আমার মনে পড়ে ঠিকই। কিন্তু তোর বাবার মুখটা আমি কোনদিনই ভুলতে পারবনা।  একদিন চরম দুর্দিনে, আমাদের বেঁচে থাকার জন্য  একমাত্র তোর বাবাই  আমাদের পাশে  দাঁড়িয়েছিল। আমার মা, তোর অসুস্থ মায়ের সেবাযত্ন করত । আমার বাবা, তোর বাবার ব‍্যবসায় সাহায্য করত; এটা ঠিক। কিন্তু তার বিনিময়ে, তিনটি  প্রাণীর আজীবন ভরণপোষণের দায়!  তাই কখনো হয় ?  পাশাপাশি,  আমার পড়াশোনার  কতো খরচ। সবইতো  তোর বাবা নির্দিধায়, হাসিমুখে  গ্রহণ  করেছে‌। নিখিল, আমি সেসব  কী  ভুলে গেছি  রে ?”
“কিন্তু তাবলে, তুমি আমার জন্য আসামী  সাজবে ?  মিথ্যে মিথ্যে জেল খাটবে ?”
“মিথ্যে মিথ্যে  কোথায়  রে পাগল ? খুনের চেষ্টার অপরাধে । অ্যাটেম্ টু মার্ডার কেস। মামলা তো মিথ্যে নয়। আর এটাও তুই অন্তত জানিস, আমি কাউকে  কোনদিন খুন করতে যেতে পারিনা। এটা  তো সত্যিই । খুন করলে তো  আমার ফাঁসি বা যাবজ্জীবন জেল হোত। সেটা হলেতো আরও ভাল হোত  রে  নিখিল !”
“বেশী বাজে বকোনাতো নিখিলদা। জেলখানায় ক’বছর থেকে তুমি  না  অনেক পাল্টে গেছ। কই, আগে এতকথা  তুমি  কখন বলতে ? আচ্ছা সার্থকদা, আমার মাথার দিব‍্যি, একটা সত্যি কথা তুমি বলবে ?”
“বল, কি সে কথা ?”
“লোকটাকে আঘাত করলাম আমি। তোমার মাথায় হঠাৎ এটা কীভাবে এবং কেন এল, যেভাবেই  হোক আমাকে  বাঁচাতে  হবে ?”
“সেটা আর একদিন বলব। এখন চলতো, বুবুন তুতুনকে নিয়ে বাজার থেকে ঘুরে আসি। ওদের কিছু বায়না আজই মেটাতে হবে। আমি ওদের কথা দিয়ে ফেলেছি। চল্ চল্।“
                                                                          ।। ৩ ।।
ঊনিশো একাত্তর সাল। পূর্ববঙ্গের ভয়াবহ দাঙ্গায় সর্বশান্ত হয়ে সার্থকের বাবা এদেশে চলে এসেছিল বলতে গেলে, এককাপড়ে। দাঙ্গায় ওদের পরিবারের অন্য সকলের প্রাণ গিয়েছিল রেজাকার বাহিনীর হাতে। এরমধ্যেও, ওর বাবার বাল‍্যবন্ধু হুমায়ূনকাকার সাহায্যে ওরা তিনটি প্রাণী প্রাণটুকু নিয়ে এদেশে আসতে পেরেছিল। আর এদেশে আসা ইস্তক ওদের আশ্রয় এবং আহারের ব‍্যবস্থাটুকু করেছে এই নিখিলের বাবা। অথচ  ওদের, নিখিলের বাবা আগে কোনদিন চোখও দেখেনি। সবচেয়ে বড়োকথা, নিখিলরা এদেশীয়, মানে ঘটি। আর সার্থকরাতো পাড়বাঙাল। তবু পথের সামান্য পরিচয়ে, নিখিলের বাবা সার্থকদের নিজের বাড়িতে ডেকে এনে টানা কয়েকদিন নিজের  বাড়িতে  রেখেছে আপন দাদার মতো করে। পরে অবশ্য ওদের একটা ভাড়া-ঘরে থাকার ব‍্যবস্থা করা হয়েছিল।  সেওতো  হয়ে গেছে কতো বছর। সার্থক তখন মাত্র বছর চারেকের এক শিশু।
               নিখিলের বাবার ছিল আড়তদারি ব‍্যবসা। ব‍্যবসা ভালো ছিল। সার্থকের বাবা সেই আড়তে তাকে সাহায্য করত। নিখিল তখনও জন্মায়নি। ওর মা ছিল চিরকালের রুগী। সার্থকের মা তার সেবা-শুশ্রূষা করত নিজের ছোটবোনের মতো। তার সেবাযত্নের কারণেই সে একদিন পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠল এবং নিখিলের মা হল। তখন সার্থক দশবছরে পা রেখেছে। সার্থক বরাবর  খুব শান্ত ছেলে। লেখাপড়ায় তুখোড়। প্রতিবছর ক্লাসে সে ফার্স্ট। নিখিলের বাবা সার্থককে খুব ভালোবাসতো। নিজের ভাইপোর মতো।
            সার্থক সবে ক্লাস সিক্সে  উঠেছে। হঠাৎ এক পথ দূর্ঘটনায়  ওর বাবা মারা গেল।  এখন কী হবে ওদের দুজনের। নিখিলের বাবা ওর মা আর ওকে ভাড়াবাড়ি থেকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এল‌। ওদের সব দায়-দায়িত্ব  সে নিজের কাঁধে তুলে  নিল। সার্থককে সে জানিয়ে দিল, লেখাপড়া আরও ভালো করে চালিয়ে যেতে হবে। আজ থেকে এটাই ওদের নিজের বাড়ি। নিখিলই ওর নিজের  ছোটভাই।
               নিখিলের মাথাটা  ভয়ানক মোটা। লেখাপড়ায় সে খুব বেশিদূর এগুতে পারলনা। বারকয়েক চেষ্টা করেও সে ম‍্যাট্রিক পাশই করতে পারেনি । শেষমেশ, ওর বাবা ওকে নিজের ব‍্যবসার কাজে লাগিয়ে দিল। একটাকিছু করেতো খেতে হবে।
                কিন্তু সার্থক ইউনিভার্সিটি শেষ করল একচান্সে। কিন্তু ওই  চাকরিতে  তার মন একদম  নেই। তার ইচ্ছে, সে একজন প্রতিষ্ঠিত লেখক হবে। দেশভাগ, নিরীহ মানুষের ওপর পাকসৈন‍্য এবং রেজাকার-বাহিনীর নির্মম পৈশাচিক  অত‍্যাচার, রাজনৈতিক নেতাদের আসল চরিত্র; এসব নিয়ে সে শুধু লিখে যাবে। ওর মা বেঁচে থাকতে  ওকে এবিষয়ে  খুব উৎসাহ দিত। সার্থক মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে চায়।
             কিন্তু চাইলেই  সব তো হয়না। চাইলেইতো আর সব পাওয়াও যায় না। আশ্চর্যজনকভাবে, নিখিলের মা এবং বাবা হঠাতই চিরকালের মতো ওদের ছেড়ে চলে গেল মাত্র আড়াই মাসের ব‍্যবধানে। তার আগেই নিখিলের বিয়ে দিয়ে গেছে তারা। নিখিলের এখন তরতাজা সংসার। স্ত্রী প্রথমবার সন্তানসম্ভবা। অর্থাৎ সংসারের খরচ উর্ধমুখী। অথচ আয়, আগের চেয়ে অনেক অনেক কমে গেছে। কারণ, নিখিল ব‍্যবসাটা আজও ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারে নি। আর একই সংসারে থাকলেও, সার্থক ব‍্যবসার  একটুকুও  খোঁজখবর রাখেনা। এসবে তার মোটেও মন নেই। সে যে লেখকই হতে চায়।
             কয়েকমাস পরের ঘটনা। নিখিলের বসতবাড়িটির ওপর একজন প্রমোটারের নজর পড়েছে। ভালো পজেশান। এক লপ্তে অনেকখানি জায়গা। ফ্ল্যাট করে বিক্রি করতে পারলে, মোটা অংকের লাভ সুনিশ্চিত। অতএব যেভাবেই হোক, জমিটি হাতাতেই  হবে। কিন্তু নানাভাবে নিখিলকে প্রলোভন, লোভনীয় প্রস্তাব দিয়েও তাকে রাজী করাতে পারেনি প্রোমোটার।
             একদিন  দুপুর বেলা। সার্থক বাড়িতে নেই। নিখিল সবে আড়ৎ থেকে ফিরেছে। দুটি বাইক এসে দাঁড়াল তার ঘরের বাইরে। বাইক  থেকে চারজন যুবক নেমে নিখিলের নাম ধরে হাঁকাহাঁকি শুরু করল। সে বাইরে আসতেই যুবকের দল তাকে গালাগালি করতে শুরু করল। নিখিল কিছুই বুঝতে পারছে না। সে তাদের মৃদু বাধাদান করতেই তারা অগ্নিমূর্তি ধারণ করল। তারা নিখিলকে মাটিতে ফেলে মারতে লাগল। নিখিলের চিৎকারে ঘর থেকে ছুটে এল তার স্ত্রী অনু। যুবকের দল অনুকে ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলে দিল। ব‍্যস! আপাত  ভেবলাকান্ত নিখিল রণচণ্ডীমূর্তী ধারণ করে ছুটে গেল ঘরে। সঙ্গে সঙ্গে ফিরেও এল একটি কোদাল হাতে। এসেই সে এক যুবকের ঘাড়ে মারল এক কোপ। এক কোপেই যুবকটি মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। তাই দেখে, বাকি তিন যুবক বাইকে চেপে দে-চম্পট।
                  সার্থক  বাড়ির  কাছাকাছি চলে এসেছিল। গন্ডগোলের আওয়াজ তার কানে যেতেই সে দৌড়াতে দৌড়াতে এসে হাজির হল। দৃশ্যটি একবার দেখেই সে সবটুকু বুঝে ফেলল। আশপাশের লোকজন বেরিয়ে আসছে। সার্থক দেরী না করে, নিখিলের হাত থেকে কোদালটা নিজের  হাতে নিয়ে নিল। তারপর ওদের  ধমক দিয়ে ভেতরে চলে যেতে বলল। যাবার আগে আরও বলল,
            “ নিখিল, আমার মরা-মুখের দিব‍্যি। আমাকে জিঙ্গেস না করে, এবিষয়ে  তুই  একটি  কথাও  কাউকে বলবিনা।  খবরদার ! বলবি, সবকিছুই  আমার  দাদা জানে।“
                                                                            ।। ৪ ।।
“সার্থকদা, একটা কথা বলব ?”
“বল ।“
“তুমি এবার একটা সংসার পাতো।“
“কেন, আমার কী সংসার নেই ? তুই অনু বুবুন তুতুন কী আমার সংসারের কেউ নস? যদি তাই বলিস, আমি আজই অন‍্যত্র চলে যাবো। আর কোনদিন তোর এখানে আসবো না।“
“তুমি শুধু শুধু রাগ করছ। আমি কী তোমাকে সেকথা কখনও বলেছি ? আচ্ছা সার্থকদা, তুমি ছাড়া এই সংসারে আমার আর কে আছে বলতো ? বাবা মা, সবসময় বলতো, নিখিল, সার্থকই তোর বড়দা। ওকে কখনও ভুল বুঝিসনা। আমি কী সেকথা ভুলে গেছি সার্থকদা ?”
“সত্যি রে,তোদের সকলের সাথে আমাদের পূর্বজন্মের কোন সম্পর্ক নিশ্চয়ই ছিল। আর তার সঙ্গে আমাদের ছিল কিছু ঋণ। সেই ঋণ শোধ করতেই আমাদের আবার তোদের কাছে চলে আসা।“
“এসব কথা বোলোনা সার্থকদা। বাবা ওপর থেকে শুনে খুব কষ্ট পাবে‌। আমার ওপরও মিছিমিছি রাগ করবে।“
“ঠিক বলেছিস তুই। কাকা কষ্ট পাবে এমন কথা আমার কখনও বলা উচিৎ নয়।“
“আচ্ছা, তুমি আমাকে সেই কথাটা একটু খুলে বললে না তো !”
“কোন্ কথাটা ?”
“ সেইযে, সেই কথাটা। সেদিন আমাকে বাঁচাতে তুমি কেন সমস্ত দোষ নিজের কাঁধে নিয়ে নিয়েছিলে।”
“দ‍্যাখ ভাই, তুই ভাবছিস, তোকে বাঁচাতে আমি সেদিন এমন করেছিলাম। কিন্তু কথাটা ঠিক এমন নয়। তোর চেয়ে আমি সেদিন আমার স্বার্থটাকেই বেশি করে দেখেছিলাম। সবকথা তোর জেনে কোনো কাজ নেই। চল, তার চেয়ে নতুন ছাদটা কেমন হয়েছে, একবার দেখে আসি।“
“না। আজ তুমি এড়িয়ে যেতে পারবেনা। আজ তোমাকে সেকথা বলতেই হবে। সার্থকদা, তুমি জানোনা, তোমার সেদিনের ঘটনা আমাকে আজও রাতে শান্তিতে ঘুমাতে দেয় না। আজকে তোমাকে বলতেই হবে। আমার মরা মুখের দিব‍্যি। আমার বুবুন তুতুনের-!”
“তুই থাম থাম। কী যা-তা বলছিস ? তোর মাথাটা কী খারাপ হয়ে গেল ?”
“হ‍্যাঁ হ‍্যাঁ, আমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে‌। শুধু তোমার জন্য। তোমার ওই কথা না জানতে পারলে, আমি সত্যিই পাগল হয়ে যাবো।“
“ঠিক আছে। আজ তোকে আমি সত‍্যিটাই বলবো। একটুও মিথ্যে বলবো না। শোন তাহলে।
        “ছেলেবেলা থেকেই আমার একটিমাত্র স্বপ্ন, বড়ো লেখক হবার। দশবছর ধরে কতো লিখেছি। কিন্তু সে লেখা কোন বড়ো পেপার, প্রকাশক তেমন গুরুত্ব দেয়নি। লেখা নিয়ে ওদের দোরে দোরে কতদিন ঘুরেছি। ওরা আমার লেখা একবার পড়েও দেখেনি। আমি একটা বিকল্প রাস্তা খুঁজছিলাম। সেটা তুই এনে দিলি।
      “তোর বাবা আমাদের জন্য অনেক কিছু করেছে। সে ঋণ কোনভাবেই শোধ করা যাবে না,  কোনদিনই। কিন্তু শেষদিন তোর বাবা আমাকে যে দায়িত্ব পালনের দায় চাপিয়ে গেছে, তাকে ছুঁড়ে ফেলতে আমি কখনও পারি ? সেটা ধর্মের কাজ হয় ? কাকা যে আমাকে বারবার বলে গিয়েছে, সার্থক, নিখিল তোর ছোটভাই‌। ওকে বিপদে ফেলে তুই কখনো দূরে চলে যাসনে বাবা ! নিজের মায়ের পেটের ভাই ভেবে ওকে তুই রক্ষা করিস। আমি তোর ভরসায় নিশ্চিতে যাচ্ছি। পরপারে আমাকে কষ্ট দিবিনা, তুই আমাকে কথা দে বাবা !
      “সেদিন সমস্ত দোষ নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে সবদিক রক্ষা করতে পেরেছি। সেটা না করলে, তোর সংসারটা ভেসে যেতো। অনু,বুবুন-তুতুনের কী হোতো সেটা কখনও একবার ভেবে দেখেছিস ? আমার জীবনের মূল্য কী ছিল বলতো ?
        “তবু জেলে গিয়ে,একজন কয়েদি-লেখক হওয়ার সুবাদে আমার লেখা বড় পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার সুযোগ পেল। তারপরেই না আমার লেখার এতো কদর, এতো কাড়াকাড়ি। আসামি-লেখক না সাজলে, আমার লেখা এখনও নিজের খাতায় বন্দী হয়েই থাকতো। কিন্তু, সামান্য সাজা ভোগ করে আজ আমার দেশজোড়া কতো খ‍্যাতি হয়েছে। না চাইতেই কতো টাকা হয়েছে।  এসবই তো তোর জন্য। আমি শুধু সুযোগটা সময়মতো ঠিকঠাক কাজে লাগিয়েছি; এই যা !
      “নিখিল, আমি খুব স্বার্থপর। নিজের স্বার্থের জন্য এমন একটি  করেছি।“
        “তুমি আর ওকথা বোলোনা সার্থকদা। আমার মতো স্বার্থপর মানুষ পৃথিবীতে আর আছে ? নিজের ভালোর জন্য একজন নিরপরাধ, নির্দোষ মানুষকে কঠিন শাস্তি ভোগ করালাম। আমি খুব বাজে লোক। খুব স্বার্থপর লোক।“
         এরমধ্যেই বুবুন তুতুন এসে হাজির। বুবুন চিৎকার করে বলল, “ ঠিক বলেছ তুমি। তুমি খুব স্বার্থপর। আমাকে কাল রাতে পা টিপিয়ে, ঘুড়ি কিনে দিলে ? এক নম্বরের স্বার্থপর বাবা তুমি !”
       “তুতুন দাদার চেয়েও গলা উঁচিয়ে বলল, “তোমরা দুজনেই সমান স্বার্থপর। জ‍্যেঠু, তুমি কাল দুপুরে আমাকে কী বলেছিলে ? কুড়িটা পাকাচুল তুললে, চুড়ি আর পুতুল কিনে দেবে‌। দিয়েছ কিনে ? তুমিও খুব স্বার্থপর। তোমরা দুজনেই সমান  স্বার্থপর।“
      সার্থক নিখিল দুজনেই বুবুন তুতুনকে জড়িয়ে ধরে হাসতে লাগল। ওদের এমন হাসি শুনে, রান্না ফেলে ছুটে এল অনু।







সূর্যোদয়ের অপেক্ষায় আছি
       বি  কা  শ  দা  শ

এখানেই চাঁদ উঠে ডুবে গ্যাছে একদিন
এই উঠোনে তার স্পর্শ লীন হয়ে আছে
রুখা পুরুলিয়ার লাল ধুলায়,  মহুলের বনে
সূর্য গলে নিরুদ্দেশ হয়েছে বহতা নদী
তবু,ফ্যান ভাতের চ্যাপ্টা থালা বুকে সেঁটে
সূর্যোদয়ের অপেক্ষায় আছি।

সোনাঝুরি বনে স্বরলিপির খোলা খাতা বন্ধ হয়েছে একদিন,
কংসাবতীর তপ্ত বালিত স্তব্ধ হয়েছে ছৌ-নাচের মহড়া ,
শকুনের ডানায় আড়াল হয়েছে প্রভাত
রুখা পাটাতনে দাঁড়িয়ে একদিন
বীরসার কণ্ঠস্বর ছুঁয়ে গ্যাছে দিগন্তের সীমানা।
এই মাটিতে ছেলের কবর, আর-
বাবার অশ্রু হাতে নিয়ে সূর্যোদয়ের অপেক্ষায় আছি।

এতগুলো বসন্তের পর ক্ষীন হয়েছে তীক্ষ্ণ উচ্চারণ
রাত আসে,  মৃত চাঁদ বগলে নিয়ে হতাশায়
তবু রুখা বালিতে পদচিহ্ন আঁকে আমার প্রতিজ্ঞা।
ভুখা মায়ের কান্না আর বোনের লাঞ্ছনা দেখে
আজও সূর্যোদয়ের অপেক্ষায় আছি।







বাসর সিরিজের কবিতা-১■
                     
এফ আই আর
মহীতোষ গায়েন

প্রচন্ড যানজটে এসি বাসে একা...
একা এক একলব্য সৃজন;
কবিতা লেখে বলে কি প্রেমিক
পু্রুষ চরাচরে বাজে,অর্বাচীন ?

অদৃশ্য নিয়তি,ফুলচোর হাসে,
গাছ থেকে খসে পড়ে পাতা...
কবিতা,তুমি 'এফ আই আর' করে
তাকে নিয়ে যাবে হৃদয়ের জেলে?

যাবজ্জীবন দণ্ড,অথবা নির্বাসন?
সংশয়ী প্রশ্ন ভাসে বহমান মনে-
সেখানে নাকি সাজানো আছে
ভালোবাসার অমোঘ বাসর।





তর্জা
রাজকুমার ঘোষ

কোচিং শেষে দুই বন্ধুর ভীষণ সেদিন মারামারি
রোজই চলে তর্জালড়াই, আজকে হলো বাড়াবাড়ি,
সচিন নাকি বিরাট বড়
কাজের সময় কে যে দড়,
এসব নিয়েই ঝুট-ঝামেলা, অবশেষে ছাড়াছাড়ি।






                  অনুতাপ
                       অমিত দত্ত

' Blessed are they that mourn: for they shall be comforted.'
               
          St Matthew ch.5 v.3

তিলে তিলে সুতোর টানে, নকশা উঠেছে গড়ে,
রূপকথাকে সাজিয়েছিলে, মনের মতো ক'রে;
পরতে পরতে আদরের ঘ্রাণ, যেন ছায়াপথের মায়া,
সময় আছে স্থির হয়ে,  মা তুমি কালানতরের কায়া।

জড়িয়ে আছে আমাকে এখন,  আমার কবজ কুন্ডল,
ছল চাতুরীর ইয়াগো কত, যত অশুভ মন্ডল,
নগ্ন দেহের লজ্জা ঢাকা, নয় শুধু এর কাজ,
শালিক- মায়ের বুকের ওম, মনে পড়ে বড় আজ।

ক্লান্ত মন, ধ্বস্ত দেহ, এত শীত করছে কেন?
ইতিহাস পথে বহুদিন আমি একা চলেছি যেন,
চোখের নাগালে, মনের আড়ালে,  ওই অমর চিত্রগাথা,
যাচ্ছে ভিজে মা তোমার এই নকশা আঁকা কাঁথা।







No comments:

Post a Comment